সাদাকালোর রংগুলো

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ০১/০৭/২০১৩ - ১০:০৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

তখন এক রকম দিন ছিল, যখন কিছু কিছু সকাল শুরু হত দোতালার বারান্দা বরাবর রাস্তার ওপারে পুকুর পাড় বলে তো তেমন কিছু ছিলনা কিন্তু একটা খেঁজুর গাছের কান্ড ছিল যার উপর বসে মেরীর বাবা যিনি আমাদের বয়েসী সবার ড্রাইভার আংকেল গড় গড় করে কুলি করতে করতে পানিতে নেমে যেতেন, তার শব্দে। বারান্দায় ছুটে যেতাম কারণ একটা সোনালু গাছ হলুদ ফুলে ঢেকে রাখত পুকুর পাড়টা আর চোখ ডলতে ডলতে দেখতাম সোনালী সে গাছটার হলুদ বৃষ্টি। পাশে একটা বাবলা গাছও ছিল যদিও এখন আর বাবলা গাছ দেখিনা কোথাও কিন্তু তখন আমাদের ছাদের প্যারাপেট ভরা থাকত বাবলা ফুলে।

একটা বার্লি গাছ ছিল আমার ছাদের টবে যেটা আমি ঘোড়ার কাছ থেকে পেয়েছিলাম যদিও তার আসল নাম সাইফুল ভাই, তার একটা চিঠি মুন্নি আপুকে পৌছে দিয়ে। উত্তরে মুন্নি আপু ঘোড়াকে কোন চিঠি দেয়নি কেন তা আর জানা হয়নি তবে বার্লি গাছটা মরে গিয়েছিল সপ্তাহ খানেকের মধ্যে আর সাইফুল ভাইও বাদ দিয়েছিল আমাদের গলির রাস্তা। সম্ভবত তখনই আমার পরিচয় হয় কিশোর মুসা আর রবিনের সাথে আর সিড়িঁঘরটা হয়েছিল পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ড। প্রথম যে বইটা আমি পড়েছিলাম সেটা 'খ্যাপা শয়তান' তবে সেটা কার কাছ থেকে পেয়েছিলাম মনে নেই কিন্তু এডিক্টেড হয়ে পড়েছিলাম তাই সময়মত গল্পের বই না পেলে গা চুলকাত। তিনতলা হলুদ রঙের বাসাটার ছাদ তখন আমার সারা পৃথিবী তাই ছাদের প্রত্যেকটা কোনা, পাইপের নীচে বেড়ে ওঠা চারাগাছ, পানির ট্যাংকের গায়ে জমে থাকা শ্যাওলা, কার্নিশে পরিবার পরিজনসহ বটের সংসার, চিলেকোঠার ছাদের নীচে ভীমরূলের চাক, ডাই পিপড়ার হাইওয়ে, টিভির এন্টেনায় বসানো এক্সট্রা বাটি, নীচতলার নন্দিনীর খেলার হাড়িপাতিল- সব আমার দখলে থাকত। নন্দিনীর মায়ের একটা তানপুরা ছিল, সময় করে সকাল বিকাল কাকীমা গান গাইতেন আর আমি অবাক হয়ে তাঁর চোখবুজে তানপুরা বাজানটা দেখতাম। ঝামেলা বাঁধত সন্ধেবেলায় কেননা পড়তে বসতে হতে নিয়ম করে, পড়ি বা নাপড়ি। দোতালার বারান্দা যেখানে একটা ছোট্ট টেবিল পাতা থাকত নানারকম কাজের, তবে সন্ধে থেকে সেটা আমাদের পড়ার টেবিল হত আর মা মেঝেতে বসে হারিকেনের কাঁচ পরিস্কার করত কারণ কিছুক্ষন পরই নিশ্চিত লোডশেডিং। কারেন্ট চলে গেলে সাথেসাথে আমার পড়া উধাও নীচের গন্ধরাজ আর হাসনাহেনার গন্ধে। ফুলের গন্ধেই ঘুম তার মধ্যেই খাওয়া আর বিছানা।

সকালবেলা আবারও সেই ড্রাইভার আংকেলের কুলির শব্দ, সোনালু গাছ......কিছুক্ষনের মধ্যেই বাসার নীচে প্লাস্টিকের সাদা জুতা আর সাদা শার্ট-নেভী-ব্লু প্যান্ট পরা কেউ একজন ডাকত স্কুলে যাবার জন্য। কাকীমার তানপুরাটার শব্দ আর বাবলাফুলের মিষ্টি কষগন্ধ মিলিয়ে যাবার সাথে সাথেই স্কুলের গেটটা দেখতে পেতাম যেখানে আমার এইম ইন লাইফ 'হাওয়াই মিঠাইওলা' কাচেঁর বাক্সভর্তি হাওয়াই মিঠাই নিয়ে গেটের পাশে বসে মিটমিট করে হাসত।

আমি এখনও সেই হাওয়াই মিঠাই'ওলার নখের যোগ্যও হতে পারিনি। একবক্স হাওয়াই মিঠাই নিয়ে হাসিখুশী থাকার মন্ত্রটা না শিখেই প্রতিদিন ক্লাসে ঢুকে যাওয়ার আক্ষেপ কোনকালেই আমার যাবেনা হয়ত।

(ফিদাইন)


মন্তব্য

পদব্রজী এর ছবি

মন ছুয়েঁ গেলো-----------

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

ছেলেবেলার গল্পগুলো প্রায় কাছাকাছি রকমের। একজন লিখলেই মনে হয় আরে এটা তো আমারও কথা।
ভালো লিখেছেন।

***শুভ জন্মদিন সচলায়তন***

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাল লাগল।
শুভ জন্মদিন সচলায়তন!
- একলহমা

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।