স্পেনের এক বন্য ছাগল প্রজাতি- নাম বুকার্ডো বা Pyrenean ibex। গড়ে প্রায় ১০০ কেজি ওজনের বিশালাকৃতির এই প্রাণী হাজার হাজার বছর ধরে বসবাস করেছে পাইরেনিয়ান পর্বতে। স্পেন এবং ফ্রান্স কে ভাগ করা এই পর্বতের খাঁজে খাঁজে, চড়াই উৎরাইয়ে ঘাস-পাতা খেয়ে প্রচন্ড ঠান্ডাতেও বেঁচে থাকতো এই প্রাণী। 'থাকতো' বলছি কারন তারা আর একজনও বেঁচে নেই, খুব সম্প্রতিই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ঠান্ডা তাদের কাবু করতে না পারলেও বন্দুক মুছে দিয়েছে বিলুপ্ত না হওয়া পর্যন্ত শেষ প্রাণীটিকেও।
মানুষের নৃশংসতার শিকার এই প্রাণীগুলির উপর ১৯৮৯ সালে বিজ্ঞানীরা সার্ভে করে বের করেছিলেন যে এইসব পর্বতে আর মাত্র একডজন ছাগল বেঁচে আছে। ঠিক তার দশবছর পর মাত্র একটা বেঁচে ছিল। প্রাণীটির নাম বিজ্ঞানীরা দিয়েছিলেন- সেলিয়া। প্রাণীটির গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য একদিন ফাঁদে ফেলে ধরে নিলেন তারা এবং গলায় একটা রেডিওট্রান্সমিটার দিয়ে আবার পাহাড়ে ছেড়ে দিলেন। সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল, সিলিয়ার কাছ থেকে সিগনাল আসছিল তার নড়াচড়া, অবস্থান পরিবর্তনের। কিন্তু ৯ মাস পরে হঠাৎ একদিন দেখা গেল রেডিও সিগনালটি একজায়গায় স্থীর হয়ে আছে, নড়াচড়া করছে না। সিগনাল ধরে ধরে খুঁজতে খুঁজতে বিজ্ঞানীরা শেষপর্যন্ত পেলেন সেলিয়াকে। ধ্বসে যাওয়া একটা বিশাল গাছ এর নিচে চাপা পড়ে আছে সেলিয়া, মৃত। সেলিয়ার মরণের সাথে সাথে এই বুকার্ড প্রজাতির জীবটির বিলুপ্তি ঘটল পৃথিবী থেকে।
কিন্তু সেলিয়ার কোষগুলি বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল যারাগোযা এবং মাদ্রিদ এর দুইটি গবেষণাগারের কোষ সংরক্ষণের স্থানে। আইবেক্স কে ফিরিয়ে আনতে বিজ্ঞানীরা এক অভিনব প্রজেক্টের সূচনা করলেন। কোষগুলি থেকে ডিএনএ নিয়ে সেটা একধরনের ছাগলের ডিম্বকোষে প্রতিস্থাপন করে ছাগলগুলির গর্ভে স্থাপন করলেন। এই ছাগলগুলিকে সেজন্য বলা হয় surrogate mother (নিচের ছবিটি দেখুন)। ৫৭টি মা এর মধ্যে মাত্র ৭টি গর্ভধারণ করলো। আর এই ৭টির মধ্যে ৬টির আগেই গর্ভপাত হয়ে গেল। কিন্তু একটা মা (মা টা ছিল আইবেক্স এবং ছাগলের হাইব্রিড) গর্ভে শিশু আইবেক্স কে ধরে রাখল শেষ পর্যন্ত। প্রায় ২ কেজি ওজনের একটা আইবেক্স শিশু জন্ম দিল।
কিন্তু জন্মাবার সঙ্গে সঙ্গেই বিজ্ঞানীরা দেখতে পেলেন যে শিশুটি শ্বাস নিতে পারছেনা আর তার জিহ্বা বাইরে বেরিয়ে আছে। শ্বাস নিতে সাহায্যের অনেক চেষ্টার পরও মাত্র ১০ মিনিট পরেই মারা গেল সদ্য বিলুপ্তি থেকে ফিরে আসা আইবেক্স। পরে পরীক্ষা করে দেখা গেল যে শিশু আইবেক্সের ফুসফুসের একটা অংশ বেড়ে বিশাল আকার ধারণ করেছিল। এই অংশটা অনেকটা যকৃতের মত থলথলে মাংসপিন্ড হয়ে গিয়েছিল। বিজ্ঞানীদের আসলে কিছুই করার ছিলনা। এখন প্রশ্ন হল, ক্লোন করতে চেষ্টা করার সিদ্ধান্তটা কি তবে ভুল ছিল?
এবার বাংলাদেশের এক বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির দিকে নজর দেই। নাম সরুঠুঁটি শকুন বা Slender billed vulture। এর বিলুপ্তির কাছাকাছি পৌঁছানোর কারন অদ্ভুত। ডাইক্লোফেনাক নামক গরুকে খাওয়ানোর একটা ওষুধের কারণে প্রায় বিলুপ্তির পথে এই শকুন। গরুকে ওষুধটি খাওয়ানো হয় ব্যাথানাশক হিসেবে। কিন্তু শকুন যখন মরা গরুর হাড় থেকে মাংস খাওয়ার চেষ্টা করে তখন এই ওষুধও খায়। ডাইক্লোফেনাক শকুনের কিডনি নষ্ট করে দেয়।
আইবেক্স পৃথিবীর হারিয়ে যাওয়া প্রাণীদের তালিকায় শুধু একটি নাম। dodo, great auk, thylacine, Chinese river dolphin, passenger pigeon, imperial woodpecker- সবই বিলুপ্ত, এবং সবগুলিরই বিলুপ্তির কারণ মানুষ। পৃথিবীর আরও বহু প্রাণী বিলুপ্তির পথে- বিভিন্ন প্রজাতির পশু, পাখি, মাছ। লোনসাম জর্জ নামের কচ্ছপটির কথা তো জানেনই। নিজের উপ-প্রজাতির একমাত্র প্রাণী হিসেবে বেঁচে ছিল পৃথিবীতে। গত বছর জুন মাসে নিজের মৃত্যুবরণের সঙ্গে সঙ্গে তার উপ-প্রজাতিরও বিলুপ্তি ঘটায় জর্জ।
সূত্রঃ http://ngm.nationalgeographic.com/2013/04/125-species-revival/zimmer-text
খান ওসমান
মন্তব্য
তবে শুধু সরুঠুঁটি শকুন না- বরং অন্যান্য শকুন, যেমন, রাজ শকুন বা বাংলা শকুনও একইধরনের কারনে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
খান ওসমান
গুরুত্বপূর্ণ লেখা।
পিরেনিজ আইবেক্স ফিরিয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা সফল হবে আশা করি, সেই সাথে আমাদের রক্ষা করতে হবে যা আমাদের সাথে আছে।
উপমহাদেশের ৯৯% শকুন বিলুপ্ত হয়ে গেছে, দেখি আমরা কতটা করতে পারি তাদের টিকিয়ে রাখতে।
facebook
ডাইক্লোফেনাক এর বদলে মেলোক্সিক্যাম ব্যবহার করলে শকুনের ক্ষতি না হওয়ার কথা।
চমৎকার লেখা। এর সাথে সাথে যদি এই প্রাণীটা বিলুপ্ত হয়ে গেলে পরিবেশের ক্ষতিগুলো কিভাবে হয় সেটা একটু ডিটেইলে দিলে আরো ভাল লাগতো।
পৃথিবীতে বহু প্রাণীই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এদের বাঁচিয়ে রেখেই বা লাভ কী? মানুষের লোভে তাদের মৃত্যু তো অবধারিতই।
গাছপালা, পাহাড়, নদী, অন্যান্য প্রাণীকে মেরে ফেলেও মানুষ কিভাবে পৃথিবীতে টিকে থাকতে পারে তা ঠিক একদিন না একদিন কেউ আবিষ্কার করে ফেলবে। তারপর সব ধ্বংশ করে ফেলবে। পৃথিবীটা শুধু মানুষের।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
সেটা করতে পারা খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার হবে!
খুব-ই দামী লেখা ।
তারেক অণু তার একটি লেখায় আমার মন্তব্যের প্রতিমন্তব্যে লিখেছিল যে সচেতন এবং সক্রিয় ধরণের মানুষের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত কম। তারেক-এর কথা মর্মান্তিক ভাবে সঠিক। তাই অনেক প্রাণী-ই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তবে কিছু প্রাণী হয়তো বেঁচে যাবে আর, কিছুকে বিজ্ঞানীরা ফিরিয়ে আনবেন বিলুপ্তির পর - যদি না ইতিমধ্যে আমরা সেই মানুষগুলো আর তাদের শুভ উদ্যোগগুলোকেই শেষ করে দিতে পারি অজস্র ছল-ছুতায়।
আপনার পরের লেখার অপেক্ষায় থাকলাম।
- একলহমা
দারুণ লেখা! ছবি গুলোও ভালো লেগেছে!
জীবের দেহকোষে নিউক্লিয়াস-ডিএনএ ছাড়াও আরো অনেক জিনিসপত্র থাকে। মাইটোকন্ড্রিয়ার নিজস্ব একগোছা ডিএনএ থাকে, যেটা তার শক্তি উৎপাদনের রেসিপি ঠিক করে দেয়। ছাগলের ডিম্বাণুতে আইবেক্সের নিউক্লিয়াস প্রতিস্থাপনের সময় ওই সবকিছুই বাদ পড়ে যায়। অতএব জন্ম নেওয়া প্রাণীটা ১০০% আইবেক্সের মত না হওয়াই স্বাভাবিক। তাই কাছাকাছি কোনো প্রাণীকেই সারোগেট মাদার হিসেবে নেওয়া হয় যাতে তার মাইটোকন্ড্রিয়া ইত্যাদির তফাত যতটা সম্ভব কম রাখা যায়। তাও অধিকাংশ সময় ব্যর্থতাই আসে।
সেই।
বিলুপ্ত প্রাণী ফিরিয়ে আনার মতো অবস্থায় এখনো পৌঁছাইনি আমরা। ফিরিয়ে আনা গেলেও প্রাকৃতিক অন্যান্য পরিবর্তনের কারণে অধিকাংশের জায়গা হবে চিড়িয়াখানাতেই। যেমন, ট্যাযমেনিয়ান টাইগারকে নিয়ে এখন কোথায় ফেলবেন? ওদের উপযুক্ত পরিবেশ কি আর আছে?
লেখাটা ভালো লেগেছে।
হুম। ডলি'র ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা এমন ছিল। মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ'র জন্য সম্ভবত ফুসফুসের সমস্যাটা হয়নি। কিন্তু অবশ্যই এই ডিএনএ'র পার্থক্য বিবেচনা করা বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
অমিত আহমেদ, পরের একটা পর্বে এদেরকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারটা কতটা যৌক্তিক সেটা নিয়ে আলোচনা করবো।
খুবই আগ্রহ উদ্দীপক লেখা। এই লেখার সাথে সম্পূরক একটি টেডটক এমবেড করলাম। এই বিষয়ে আগ্রহী অনেকর ভালো লাগতে পারে।
- ছাইপাঁশ
ধন্যবাদ। এই টেডটক সিরিজের আলোচনাকে ভিত্তি করে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পত্রিকাও একটা সিরিজ তৈরি করেছিল। খুব ইন্টারেস্টিং। বিলুপ্ত প্রাণীকে ফিরিয়ে আনা উচিত হবে কিনা সেটাই বোধহয় মূল আলোচ্য হওয়া উচিত। যেমন, আমরা যদি একটি ম্যামথ কে ফিরিয়ে আনতে পারি তবে কি তার জন্য উপযোগী বাসস্থান দিতে পারব?
গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়
নতুন মন্তব্য করুন