জীবের বিলুপ্তি ২ঃ গ্যাষ্ট্রিক ব্রুডিং ব্যাঙ এর ফিরে আসা! বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রাণী কি ফিরিয়ে আনা যাবে?

সজীব ওসমান এর ছবি
লিখেছেন সজীব ওসমান (তারিখ: শনি, ০৬/০৭/২০১৩ - ৮:১৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১৯৭২ সাল, অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডের পর্বতমালায় একধরনের ব্যাঙ খুঁজে পাওয়া গেল। প্রাণীবিদরা ভেবেছিলেন- ব্যাঙ প্রজাতির অনেকগুলি সদস্যের মধ্যে আরেকটি সদস্য মাত্র যোগ হল। তখনও বোঝা যায়নি এই ব্যাঙের মাহাত্ম!

দুইবছর পর, অর্থাৎ ১৯৭৪ সালে, এই ব্যাঙ প্রজাতি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে এক অদ্ভুত জিনিস দেখে চমকে উঠলেন এডিলেড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর মাইক টাইলার। তিনি খুঁজে পেলেন এই ব্যাঙের বংশধারণের এক অদ্ভুত উপায়। ব্যাঙটি তার মুখ দিয়ে বাচ্চা প্রসব করছে! আসলে নিজের পাকস্থলীকে গর্ভে রূপান্তরের এক দারুন ক্ষমতা ব্যাঙটির আছে। ব্যাঙটির নাম তাই দিলেন গ্যাষ্ট্রিক ব্রুডিং ব্যাঙ (gastric-brooding frog)।

আসলে ডিম পাড়ার পর ব্যাঙটি তার ডিমকে গিলে ফেলে। কিন্তু ঝামেলা হল, পাকস্থলীতে থাকে খাদ্য ভাঙার বিভিন্ন রাসায়নিক। এদের মধ্যে সবচেয়ে প্রবল এবং কার্যকরী হল হাইড্রোক্লোরিক এসিড। কিন্তু ডিম গেলার সময়েই ব্যাঙ মা পেটের মধ্যে হাইড্রোক্লোরিক এসিড বানানো বন্ধ করে দেয়, যেন তার শিশুকে সে নিজেই হজম না করে ফেলে! প্রায় ২০ থেকে ২৫ টা শিশু (টেডপোল) একসাথে পাকস্থলীতে ভ্রূণ থেকে বেড়ে উঠতে পারে। পরবর্তী ৬ সপ্তাহ মা কিছুই খায়না। তার পাকস্থলী এতই বড় হয়ে যায় যে ফুসফুস বন্ধ হয়ে যায়। তখন নিজের ত্বক দিয়ে শ্বাসপ্রশ্বাসের কাজ চালায় ব্যাঙ মা। সবশেষে বমি করে বের করে দেয় পূর্ণাঙ্গ ব্যাঙ শিশুগুলিকে।

যখন এই ব্যাঙগুলির খবর পৃথিবীজুড়ে প্রাণীবিদদের কাছে পৌঁছালো তারা বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না এমনটা হতে পারে। তাদের কাছে ব্যাপারটা অনেকটা যেন সাইফাই ছবির মত। বারবার পরীক্ষা করে তারা নিশ্চিত হলেন। এই ব্যাঙের অদ্ভুত ক্ষমতা ব্যাবহার করে মানুষের গ্যাষ্ট্রিক আলসার সারানো যায় কিনা সেটা নিয়ে পরীক্ষায় নামলেন কিছু বিজ্ঞানী।

তবে বিপত্তি ঘটলো অন্য জায়গায়। ১৯৮১ সালের দিকে, অর্থাৎ আবিষ্কারের ১০ বছর পরই হঠাৎ এই ব্যাঙ পরিবেশ থেকে উধাও হয়ে গেল। শেষ ব্যাঙটি বেঁচে ছিল ১৯৮৩ পর্যন্ত একটা গবেষণাগারে। সেটা মারা যাওয়ার সাথে সাথে এই প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটল চীরতরে।

কিন্তু পরের বছরই একটা ভাল খবর পেলেন বিজ্ঞানীরা। একই ধরনের আরেকটি নতুন প্রজাতির খোঁজ পাওয়া গেল কুইন্সল্যানডেরই একটি ন্যাশনাল পার্ক এ। কিন্তু এই স্বস্তি বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। পরেরবছরই এই প্রজাতিটিও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, সেই সঙ্গে বিলুপ্ত হয়ে যায় গ্যাষ্ট্রিক ব্রুডিং ব্যাঙ।

ইউনিভার্সিটি অফ নিউ সাউথ ওয়েল্স এর বিজ্ঞানী মাইক আর্চার ভাবলেন, এইরকম দূর্লভ একটি প্রজাতি হারিয়ে যাওয়া খুবই দুঃখজনক। একে পূনরজ্জীবন দান করা যায় কিনা ভেবে দেখতে হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। তিনি যোগাযোগ করলেন সেই মাইক টাইলারের সঙ্গে, যিনি প্রথম এই ব্যাঙটির অদ্ভুত ক্ষমতা আবিষ্কার করেছিলেন। মাইক তার ফ্রিজার খুঁজে বের করলেন ব্যাঙটির কিছু সংরক্ষিত টিস্যু।

টিস্যুগুলি থেকে ডিএনএ বের করে আনলেন আর্চার। এবার একটি অন্য ব্যাঙের ডিম্বাণুতে ডিএনএটি ঢুকানোর পালা। আর্চার পছন্দ করলেন ব্যারেড ব্যাঙ (barred frog), একধরনের অস্ট্রেলিয় ভূমি ব্যাঙ (ছবি দেখুন)। অর্থাৎ এই ব্যাঙটি থেকে ডিম্বাণু নেয়া হবে এবং এই ব্যাঙটিই পরবর্তী গ্যাষ্ট্রিক ব্রুডিং ব্যাঙ শিশুর মা হবে। ব্যাঙটি থেকে ডিম্বকোষ নেয়ার পর এবার সেই কোষের ডিএনএ টা নষ্ট করে তাতে গ্যাস্ট্রিক ব্রুডিং ব্যাঙের ডিএনএ প্রতিস্থাপনের পালা [পদ্ধতিটির নাম somatic-cell nuclear transfer (SCNT)]। UV রেডিয়েশান দিয়ে ডিএনএ ধ্বংস করা যায়। শতাধিকবার চেষ্টা করার পর মাত্র একটি ডিম্বাণুতে ডিএনএ প্রতিস্থাপন করা গেল। কিন্তু দেখা গেল প্রতিবার ই গ্যাস্ট্রুলেশান (ভ্রূণ বৃদ্ধির একটা ধাপ) এর সময় পর্যন্ত ব্যাপারটা আর এগোয়না।

ব্যারেড ব্যাঙ

এটা মাত্র ছিল ব্যাঙটি ক্লোনিং এর প্রথম ধাপ। পূর্ণাঙ্গ ব্যাঙ পর্যন্ত পেতে আরও অনেক বাধা অতিক্রম করতে হবে। কিন্তু আর্চার হাল ছেড়ে দেননি। আশার কথা হল আসলে এবছরের (২০১৩) মার্চ মাসে সফলভাবে ভ্রূণ তৈরি করা গিয়েছে যা একটি মা ব্যাঙের গর্ভে স্থাপনের জন্য প্রস্তুত। এবার একটি পূর্ণাঙ্গ গ্যাষ্ট্রিক ব্রুডিং ব্যাঙ পাওয়ার চেষ্টা, যেমনটি করা হয়েছিল আইবেক্স এর ক্ষেত্রে। হয়তো অচীরেই আমরা এমন ব্যাঙ আবার খুঁজে পাবো যেটা আবার তার মুখ দিয়ে প্রসব করবে। কি মজার ব্যাপারই না হবে!

কোন এক শিল্পীর চোখে গ্যাস্ট্রিক ব্রুডিং ব্যাঙ

বাংলাদেশের ৫ প্রজাতির ব্যাঙ গত ২০০ বছরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। [জার্ডনের কোলা ব্যাঙ (Hoplobatrachus crassus), ছাগল ডাকা ব্যাঙ, (Occidozyga lima), বামন ব্যাঙ (Sphaerotheca breviceps), শুকর ডাকা ব্যাঙ (Humerana humeralis), সবুজ ধানী ব্যাঙ (Hylarana erythraea)] আরও কিছু আছে তালিকায় যারা প্রায় বিলুপ্তির পথে। এদেরকে আমরা ছাড়া বাঁচাবে কে? বিলুপ্ত প্রাণী পূর্নজ্জীবিত করতে কত হ্যাপা সেটা তো দেখলেনই। আমাদের দেশে সেই টেকনিকাল সুবিধাও নাই। হারিয়ে যাওয়ার আগেই তাই বাঁচাতে হবে। হারিয়ে যাওয়ার কারণ খুজতে হবে। সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।

সূত্রঃ
১) http://phenomena.nationalgeographic.com/2013/03/15/resurrecting-the-extinct-frog-with-a-stomach-for-a-womb/

২) http://anupsadi.blogspot.ca/2012/06/checklist-of-extinct-amphibians-of.html

৩) http://en.wikipedia.org/wiki/Gastric-brooding_frog

আগের পর্বঃ
আইবেক্স এর ফিরে আসা!

খান ওসমান


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

গ্যাষ্ট্রিক ব্রুডিং ব্যাঙ এর চলমান ক্লোনিং প্রজেক্টটির নাম 'ল্যাযারাস প্রজেক্ট'।

তারেক অণু এর ছবি

চমৎকার সিরিজ, লেখার জন্য ধন্যবাদ, ছবির সুত্র উল্লেখ করবেন কি ?

কৌস্তুভ এর ছবি

একটা মত বলে, দুনিয়া থেকে প্রতি বছরই শয়ে শয়ে প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যায়, আগেও তাই হত, পুরোনো প্রজাতি বিলুপ্ত হত আর নতুন গজাত, ডাইনোসরদের বিপুপ্তি আর স্তন্যপায়ীদের উত্থানই তার প্রমাণ - অতএব আমাদের সীমিত রিসোর্স এসব ছোটোখাটো জীবদের পেছনে ক্ষয় করে কী লাভ? কেবল বেশি দরকারী জীবেদের ফেরাবার জন্যই চেষ্টা করা হোক।

অতিথি লেখক এর ছবি

প্রশ্ন হল, বেশি দরকারী জীবটা বেছে বের করবেন কিভাবে?
লক্ষ্য করলে দেখবেন মানুষ নিজের এলাকার অধুনা বিলুপ্ত জীবগুলিকেই নিজেদের গবেষণাগারে ক্লোণ করার চেষ্টা করছে। ডিএনএ সহজে এবং প্রায় অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায় বলে অধুনা বিলুপ্তদের ক্ষেত্রে করা সহজ।

অতিথি লেখক এর ছবি

খুব-ই আকর্ষণীয় লেখা, বেশ ভাল লাগল।
- একলহমা

অতিথি লেখক এর ছবি

লইজ্জা লাগে

অতিথি লেখক এর ছবি

হেহে.. ভুল ইমো গেসে। হবে এইটা হাসি

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

দারুণ লেখা। চলুক

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

অতিথি লেখক এর ছবি

হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।