নাহ, এবার একটা রিকশা না নিলেই আর চলছে না। কতটুকুই বা পথ; গ্রামে থাকতে এর চেয়ে কত দীর্ঘ পথ হেঁটে পার করেছে সামান আলী। কিন্তু মে মাসের এই খটখটে বিকেলে, মফস্বল শহরের ছোট গলির কার্পেটিং ওঠা রাস্তায়...... আপাদমস্তক শহুরে বেশে সজ্জিত সামান আলির পা দুটো অবশ হয়ে আসে। দৈর্ঘ্য- প্রস্থে সমান হয়ে আসা সামান আলির চালশেগ্রস্থ শরীর কাঁপতে থাকে, ঘামে ভিজে গায়ের শার্ট লেপটে থাকে স্বল্পদৈর্ঘ্য শরীরের সাথে বেমানান বিশাল ভুঁড়ির সাথে। লোকে বলে, ভুঁড়ি নাকি সুখের লক্ষণ!! তা আজ পর্যন্ত তাকে কেবল এই লক্ষণটায় হাত বুলিয়েই দিন গুণতে হয়েছে, অনাগত দিন সুখের হবে এই কথা ভেবে। এসব হাবিজাবি কথা ভাবতে ভাবতে, গলি ছেড়ে বড় রাস্তায় উঠে আসে সামান আলী।
এক হাত তুলে কোন রকমে, চোখদুটোকে সূর্যদেবের তীক্ষ্ণ তীরন্দাজি থেকে বাঁচিয়ে...... অন্য হাতে একটা খালি রিকশাকে ইশারায় ডাকে সে। তরুণ রিকশাওয়ালার চোখ তখন রাস্তার ওপাশে দাঁড়ানো এক তন্বীকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করার কাজে ব্যস্ত। ঘোরতর কৃষ্ণবর্ণ, মূর্তিমান কুমড়োপটাশ সামান আলির প্রতি সে ভ্রূ-ক্ষেপও করেনা। দ্বিতীয় খালি রিকশার সারথিও জমিদারতনয়সুলভ ভাব- গাম্ভীর্যের সাথে অতিক্রম করে তাকে। সামান আলির ডাকাডাকিতে কর্ণপাত করার মুড নেই তার, বিকালটা আজ বড়ই উদাস!!!
সঙ্গত কারণেই ক্ষুব্ধ হয় সামান আলী। নাহয় মেনেই নিলাম, সামান আলী দর্শনীয় কেউ নয়; মেনে নিলাম সস্তা দামের ছেঁড়াফাটা মানিব্যাগে, একটা তালিমারা একশ’ টাকার নোট আর চারটা দু’ টাকার নোটই তার যথাসর্বস্ব। তাই বলে ঐ অশিক্ষিত- ছোটলোক রিকশাওয়ালাটাও সামান আলীকে উপেক্ষা করে কোন সাহসে!!! পরনের শার্টের প্রতি এবার একটু সজাগ হয় সে। কাঁধের কাছটায় একটু ফেঁসে গিয়েছিল বটে, সেটা আবার বিশ্রীভাবে হাঁ করে সবার কাছে তার গুমর ফাঁক করে দিচ্ছে না তো? না, সেলাইটা ভালোই হয়েছে। বোঝার কোন উপায়ই নেই!! আস্বস্ত হয়ে সামান আলী আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে হাঁক ছাড়ে এবার। শুধু তাই নয়, রীতিমত দরদাম করে ভাড়া মিটিয়ে রিকশার ওপর জাঁকিয়ে বসে সে। তার গন্তব্য...... বন্ধুর বাসা।
এই ছোট শহরটায়, কোচিং সেন্টারের বাজার অতি রমরমা। প্রাথমিক স্কুল বা জেলা স্কুলে ভর্তি কোচিং, বৃত্তি কোচিং, ক্যাডেট কোচিং, এস এস সি- এইচ এস সি কোচিং...... এসবের পর বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং তো আছেই!! আয়তন অনুসারে কোচিং সেন্টারের ঘনত্ব বিচার করলে, এই শহরটা বোধহয় বিশ্বের এক নম্বর হবে। সামান আলী নিজেও এই শহরের একটা নামকরা কোচিং সেন্টারে, অনূর্ধ্ব অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত সামাজিক বিজ্ঞান আর ইসলাম শিক্ষা বিষয়ের একজন সম্মানিত শিক্ষক। না, সামান আলী ক্লাস নেয় না বটে; কিন্তু প্রতিদিন লেগে থাকা একের পর এক পরীক্ষার গার্ড দেয়া, খাতা মূল্যায়ন করার কাজে সারাদিন ব্যস্ত থাকতে হয় তাকে। গ্রামের স্কুলে মাস্টারি করার চাইতে, এই কাজে টাকা বেশি।
কিন্তু কেন যেন...... লাল কালির আঁচড়ে খাতার পাতাগুলো রক্তাক্ত করার সময়, সামান আলীর চোখের সামনে বারবার ভেসে ওঠে...... লাঙ্গল-কর্ষণে মথিত পুব পাড়ার ধানী জমি, যেটা এখন বন্ধকীতে বাঁধা। ক্লাসরুম ভরা এতগুলো বাচ্চা যখন তার আগমনে ছন্দবদ্ধ ভাবে উঠ-বস করে, সামান আলীর চোখের সামনে সেই পুব পাড়ার ধানী জমির কাঁচা সবুজ চারাগুলো যেন হাওয়ায় দোল খেয়ে যায়!!
এ-হেন সামান আলীর বাল্যবন্ধু রাশেদুল করিম সাহেব পেশায় এলজিইডি’র প্রকৌশলী। সামান আলী ও রাশেদুল করিম সাহেবের শৈশব কেটেছে পাশের জেলার এক নিভৃত পল্লীতে। ভূমিহীন কৃষক জনকের ‘ব্যাটা’ সামান আলী অনেক হোঁচট খেয়ে, খোঁড়াতে- খোঁড়াতে তিনবারের চেষ্টায় উচ্চ মাধ্যমিকের বেড়া ডিঙ্গিয়ে ক্ষান্ত দেন। আর রাশেদুল করিম সাহেবের পিতৃদেব ছিলেন তিন গাঁয়ে একমাত্র হাইস্কুলের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী শিক্ষক, তাও আবার ইংরেজি আর গণিতের মতো সাংঘাতিক বিষয়ের। তাঁর কড়া মেজাজ ও বেত্রাঘাতের নির্মমতা, সেই কালে দূরতম গ্রাম পর্যন্ত প্রসিদ্ধ ছিল। তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র বড় ইঞ্জিনিয়ার হবে- এতে আর আশ্চর্য কী!!
যাই হোক, সামান আলী রিকশায় বসে “নীলাকাশের নীচে আমি......” গুনগুন করে। রাস্তাঘাট বেশ ফাঁকা, মোড়ে-মোড়ে টিভি সেট করে খেলা দেখছে এলাকার গৃহপালিত হিপ-হপ তরুণসমাজ। ও হ্যাঁ, আজ আবার বাংলাদেশ-জিম্বাবুয়ের খেলা আছে। সিরিজ নির্ধারণী ম্যাচ বলে উত্তেজনায় ফুটছে পুরো দেশ। আর যথারীতি তাতে উদারহস্তে ঘি ঢালছে প্রচার মাধ্যমগুলো। রিকশায় আসীন সামান আলী উঁকি মেরে দেখে, ম্যাচ এখনও শুরু না হলেও খেলা শুরু হয়ে গেছে। দু’জন সাবেক ক্রিকেটার আর এক উথাল-পাথাল করা যুবতী খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে আজকের ম্যাচে দু’ দলের শক্তি-সম্ভাবনা বিচার করছেন।
এই সময় রিকশাওয়ালা বলে ওঠে,
“যাই কন ছার, ঐ শাহাদতরে বাদ না দিলে বাংলাদেশের কুনো উন্নতি হোবো না। খেলার চিয়া ঢং করবো বেশি ...... এবা পিলারের কাম বাজে নাই। আঙ্গর নাসির, শাকিবরে দ্যাহেন......” ইত্যাদি ইত্যাদি।
রিকশাওয়ালার ক্রিকেটীয় প্রজ্ঞা দেখে চমৎকৃত হয় সামান আলী। দেশের ক্রিকেটের উন্নতির এত সহজ ও অনায়াস পথ...... কেন যে কর্তাব্যক্তিদের মাথায় ঢোকে না, কে জানে!! অতঃপর রিকশাওয়ালার সাথে দেশের ক্রিকেট দলের বিশ্ব জয়ের উপায় আলোচনা করতে করতে, সামান আলী এক সময় তার বাল্যবন্ধুর সরকারী বাসভবনের সামনে এসে উপস্থিত হয়। আজ তার বন্ধুর বাড়ি আগমনের অন্যতম কারণ- একটু আয়েশ করে খানিক ক্ষণ খেলা দেখা। দ্বিতীয় আরেকটা কারণ অবশ্য আছে, তবে তা ক্রমশঃ প্রকাশ্য।
রাশেদুল করিম সাহেবের বাড়িতে সামান আলীর প্রায়ই পদধূলি পড়ে। যে কারণে, এ বাড়ির সবাই তার মার্কামারা অবয়বের সাথে পরিচিত। ভেতরে ঢুকতেই সামান আলীকে সাদরে অভ্যর্থনা জানান তার বিদুষী বন্ধুপত্নি,
“আরে সামান ভাই যে!! আসেন, আসেন। আপনাকে তো দেখাই যায় না। মাঝে-মাঝে আসতে তো পারেন.....”
মনে মনে ভদ্রমহিলা ভাবেন, “কাইল্যা ব্যাটা...... হাজার পাওয়ারের লাইটেও তো তোরে দেখা যাবে না। আজকে আবার কোন মতলব? আগের পাঁচ হাজারই তো ফেরত দিস নাই এখনো।”
হ্যাঁ, সামান আলীর আগমনের আরেকটা কারণ তার বিদুষী বন্ধু পত্নিটি ঠিকই আঁচ করতে পেরেছেন। সামান আলীর উদ্দেশ্য বন্ধুর কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নেয়া। আগামী দুই দিন টানা হরতাল, তারপর সরকারী ছুটি, সাপ্তাহিক ছুটি মিলে বেশ বড় একটা বন্ধ পাওয়া গেছে। তাই সে ভাবছিল বাড়ি থেকে ঘুরে আসবে একবার। বাড়ি গিয়ে পরিবারের সবাইকে নিয়ে একবেলা ভাল-মন্দ খাওয়ার ইচ্ছা কার না হয়!! কিন্তু মাসের শেষ, হাত একেবারে খালি। তাই অগত্যা বন্ধুর শরণাপন্ন হওয়া। রাশেদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে, সন্ধ্যার পর বাস ধরবে সে।
রাশেদুল করিম সাহেবের দুই সন্তান, দুটোই ছেলে। বড় ছেলে ক্লাস নাইনে পড়ে। জেলা শহরের বিখ্যাত ‘ভালো ছেলে’ দের মাঝে সে অন্যতম। পাশাপাশি খেলাধুলা আর শিল্প- সংস্কৃতিতে ইতিমধ্যেই সে নিজের উত্তাপ, থুড়ি...... আলো ছড়াতে শুরু করেছে। অতএব, স্বাভাবিক ভাবেই...... “দুনিয়ার সব বিষয় বুঝে ফেলেছি” জাতীয় একটা পলকা ভাব, তার মুখে বিরাজমান। এই ভাবটুকু যেন, তার সদ্য ফোঁটা কচি ঘাসের মতো গোঁফের ওপরে শিশির বিন্দুর মতো টলোমলো করে। কঠিন পরিস্থিতিতে পড়ামাত্র তা ঝরে পড়ে টুপ করে। পিতৃবন্ধুর আগমনে সে খানিকটা সংশয়ে আছে। এমতাবস্থায় তার আনন্দিত হওয়া উচিত, নাকি মুখে বিরক্তিমূলক ভাব-গাম্ভীর্য ফুটিয়ে তোলা উচিত...... এটা সে এখনো বুঝতে পারছে না। মা’র মুখের ভাব দেখেও ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, কোনদিকে পাল তুললে তাকে স্মার্ট দেখাবে।
এ বাড়ির কনিষ্ঠতম সদস্যের বয়স দশ, সে পড়ে ক্লাস থ্রিতে। সামান আলীর আগমনে সে স্পষ্টতঃ মহাবিরক্ত। কারণ, বাবার এই কাইল্যা বন্ধুটা যেদিনই খেলা দেখতে আসে, সেই দিনই বাংলাদেশ হারে। ব্যাটা একটা কুফা।
সামান আলীর নিজেরও থার্ড ক্লাস পড়ুয়া একটি পুত্র সন্তান আছে, যার আবার আছে একটা নতুন সাইকেলের শখ। গ্রামের সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে সে। পড়ে মানে, মাঝে-মধ্যে স্কুলের দিকে আসা-যাওয়া করে আর কী। বাদ বাকি অফুরন্ত সময় সে ব্যয় করে বহুমাত্রিক ডানপিটেমো করে। এর-ওর সাইকেলের সর্বোচ্চ পরিমাণ সদ্ব্যবহার করে, হাঁটু- কনুইয়ের চামড়া জন্মাতে না দিয়ে সামান আলীর ‘ছাওয়াল’ বর্তমানে নিপুণ দক্ষতার সাথে সাইকেল দাবড়াতে পারঙ্গম। গ্রামের এবড়ো- থেবড়ো পথে কিংবা ক্ষেতের সরু আইলের ওপর দিয়ে সে তার সাইকেল-কুশলতার পরিচয় দিয়ে বেড়ায় সময়-অসময়ে। এখন তার এক দফা- এক দাবী, সাইকেল চাই...... কবে দিবি। পুত্রের স্নেহশীলা জননীও এই দাবীর যথার্থতা ও যৌক্তিকতা তুলে ধরে সামান আলীর কাছে,
“চাইর-ডো বিটির পরে আল্লায় একখান ছাওয়াল দিসে। ছাওয়ালের মনের একটো হাউশ মিটাবার পারো না, তুমি কেবা বাপ?? গ্যাদাডো আমার ডেলি-ডেলি রোইদের মইদে আইটা ইসকুলে যায়, তুমার পরানডো ইটটুও পুরে না???”
সামান আলীর স্ত্রীকে দোষ দেয়া যায় না। তার স্বামী শহরের ‘চাহইরা’ (চাকুরীজীবী)। তার কি উপার্জন কম? কিন্তু সামান আলীর পাষাণ দিল; স্ত্রী ও চার কন্যার কথা বাদ দিলাম...... একমাত্র পুত্রের শখ-আহ্লাদের প্রতিও তার কোনই খেয়াল নাই!! সামান আলীর স্ত্রীর ঘোরতর সন্দেহ, নির্ঘাত সামান আলী শহরে আরেকটা সংসার পেতেছে। নয়ত মদ-জুয়ার বদ নেশায় পড়েছে। এদিকে চার-চারটা পিঠে-পিঠি মেয়ে, সবগুলোই ‘ডাঙ্গর’ হয়ে উঠেছে। বড় দুই মেয়ে দেখতে হয়েছে বাপের মতো, আর ছোট দুইজন মায়ের ‘জ্যোৎস্না’ নাম রক্ষা করে সমস্যাকে আরো জটিলতর রূপ দিয়েছে। এতসব জটিল সমস্যার মাঝে পুত্রের এই ‘সাইকেল রোগ’ কীভাবে সামাল দেবে...... সামান আলীর তা মাথায় খেলে না। তাই সে এই সমস্যার আপাত সমাধান হিসেবে, পুত্রকে ঈদের সময় সাইকেল কিনে দেবার বিপজ্জনক অঙ্গীকারে আবদ্ধ হয়। মনে মনে ভাবে, পুত্র তার অস্থিরমতি...... ক’দিন পরেই নতুন কিছু নিয়ে মেতে উঠবে নিশ্চয়ই।
ওদিকে খেলা এগিয়ে চলেছে দুর্দান্ত গতিতে। দামী সোফায় আধশোয়া হয়ে সামান আলী চোখ পিটপিট করে টিভির দিকে তাকিয়ে থাকার চেষ্টা করে। না, তার চোখে কোন সমস্যা নেই। তবে এই ক্লান্তিকর বিকেলে নরম সোফাতে গা এলিয়ে দিলে কার না চোখ বুজে আসে! তার উপর রাশেদের নতুন কেনা এসিটার যে ফাটাফাটি পারফরম্যান্স!! আধবোজা চোখে সামান আলী টিভি স্ক্রীনের দিকে চেয়ে থাকে। দেশের সোনার ছেলেরা ব্যাট হাতে মাঠে নামে আর ব্যাট বগলে চেপে ফিরে আসে। একই দৃশ্যের পুনঃ পুনঃ দৃশ্যায়ন।
এবার গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে সামান আলী, বন্ধুপুত্রকে শুধায়, “তোমার আব্বু কখন আসবে আংকেল?’’ বন্ধুপুত্র কাটা জবাব দেয়,
“জানিনা।”
এই সময় সামান আলীর বন্ধুপত্নি চা-নাস্তা নিয়ে আসেন, ভদ্রমহিলা আচরণ ও কথাবার্তায় বেশ মিশুক। বিস্কিটের পিরিচ এগিয়ে দিয়ে বলেন,
“ ভাই, আপনার বন্ধু তো অফিসের কাজে জামালপুর গেছে। দুদিন পরে ফিরবে। আপনি কিন্তু আজ রাতে খাওয়া-দাওয়া করে যাবেন।”
“না ভাবী, আজ তাহলে আর দেরি করবো না। সামনে কয়েকদিন বন্ধ আছে, বাড়ি যাব আজ। তাই ভাবলাম, এদিক দিয়েই যাচ্ছি যখন...... একবার দেখা করে যাই।”
বেশ খানিকটা হতাশা নিয়ে বন্ধুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে সামান আলী। সামনেই বাস স্ট্যান্ড, সেদিকে হাঁটা ধরে। রাস্তাঘাটের অবস্থা বেশ উত্তপ্ত, দেশের অবস্থা ভালো না। চিরকাল নিরীহ-নির্বিবাদী মানুষ সে, দলাদলির রাজনীতিকে যথা সম্ভব এড়িয়ে চলে। জীবনের এমন পর্যায়ে এসে সেই অর্থে কোন দেশপ্রেম, কিংবা রাজনীতি সচেতনতা অনুভব করে না আর। দেশকে নিয়ে কোন স্বপ্ন দেখার সাহস হারিয়ে ফেলেছে অনেক আগেই...... শুধু নিজের পরিবার আর সন্তানদের অনাগত ভবিষ্যৎ নিয়েই সমস্ত চিন্তা তার। এই ২০১৩ সালে এসে, সব কিছু কেমন যেন গোলমেলে লাগে সামান আলীর কাছে। এটুকু তার বোঝা হয়ে গেছে, ক্ষমতায় যেই থাকুক, বা যত বড় বিপ্লবই ঘটে যাক...... তার মত মানুষের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন কোন কালেই হবেনা। তাই শাহবাগের মানুষ দেখে তার বিস্ময় জাগে, আর ইসলাম রক্ষাকারীদের দেখে আতঙ্ক জাগে...... এর বেশি কিছু না। এদের সবাইকেই কেমন ভিন জগতের প্রাণী মনে হয় যেন!!
হরতালের নেতিবাচক দিকটা সে বোঝে, তবু মনে মনে খুশি না হয়ে পারে না সামান আলী। হরতালের কল্যাণেই আজ বাড়ি যাবার এই অযাচিত সুযোগ লাভ...... এটা তো আর মিথ্যে না। শুধু পকেট খালি বলে মনটা একটু খচ-খচ করতে থাকে তার। বাড়ি যাবার সময় ছেলেমেয়েদের জন্যে কিছু নিয়ে যেতে পারলে ভালো লাগে। কিন্তু তার যে কপাল, রাশেদকে পেলে তবু হয়তো আপাতত একটা ব্যবস্থা হতো। এখন উল্টো বাড়ি থেকে ফেরার সময় আবার হয়তো হাত পাততে হবে কারো কাছে।
বাসে উঠে মোবাইল ফোনে তার বাড়ি আসার খবর জানায় সামান আলী। সূর্য ডুবে গিয়ে পশ্চিমাকাশে এখন রঙ বদলের খেলা, সেদিকে তাকিয়ে বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সন্তর্পণে। আজও মাগরিবের নামাজ পড়া হল না। প্রায় প্রতিদিনই সংকল্প করে নিয়মিত নামাজ পড়ার, কিন্তু কেন যেন হয়ে ওঠে না। আর এই সন্ধ্যাবেলাতেই সমস্ত পাপবোধ আর অপ্রাপ্তিগুলো চেপে ধরে, সকল দুখের প্রদীপ সন্ধ্যাবেলায় জ্বলে ওঠে হাজার ওয়াটের বৈদ্যুতিক বাতি হয়ে।
লোকাল বাসের গায়ে কন্ডাক্টরের ক্রমাগত আঘাত, চিৎকার করে যাত্রী ডাকে সে। ভেতরে প্রচণ্ড গরমে হাস ফাস করে সামান আলী। এর ভেতর দুজন লোক গলা চড়িয়ে তর্ক করছে......
“ ধুর মিয়া, শাহবাগের পোলাপাইনের ঈমানের ঠিক নাই, সব নাস্তিক গুলা একখানে হইছে রাজাকারের বিচারের নামে আলেম মানুষগুলারে মারার জন্য। এরা আসলে দেশে থিকা ইসলামের নিশানা মিটাইয়া ফালাইতে চায়। এই কুত্তার বাচ্চাগুলারে ধইরা ধইরা জবো করনের কাম......’’
“আরে রাখেন!!! আপনেরা কত ইসলাম রক্ষা করেন, দেখা আছে। একটা কথা কন...... শাহবাগে যে আন্দোলন হইছে, তাতে কোন মানুষের কোন ক্ষতি হইছে?? তারা কোন মানুষ মারছে, না কোন গাড়ি ভাঙছে??? আর আপনেরা ইসলাম রক্ষা করবার যাইয়া তো সব শ্যাষ কইরা ফালাইতাছেন......”
এইসব চেঁচামেচি সামান আলীর সত্যিই ভালো লাগে না। তবে তার মাঝে মাঝে মনে হয়...... ক্যান রে বাপু, রাজাকারের ফাঁসি হইলেই কি সব সমস্যা মিটা যাইব?? এইগুলা হইলো শহরের মানুষের শখের আন্দোলন।
বাসটা এর মধ্যে ভরে গিয়েছে অনেক আগেই, সামান আলী নিজে বসেছে একদম পেছন দিকে। তারপরও যাত্রী উঠছে, দাঁড়ানোর জায়গা ভরে আসে প্রায়। সামান আলীর পাশের জানালায় পা রেখে দুদ্দাড় করে বাসের ছাদে উঠে যায় দুজন। এক সময় বাস ছাড়ে অবশেষে, খোলা জানালার ফাঁক দিয়ে হু হু করে আছড়ে পড়ে বাতাস। মুখমণ্ডলে আর চুলের গোঁড়ায় বাতাসের হুল্লোড় অনুভব করে সামান আলী, চলন্ত বাসে বসে হঠাৎ সে অনুভব করে...... জীবনটা নেহাত মন্দ না!! বাড়ি ফিরে প্রিয় মুখগুলো দেখার সুখ স্বপ্নে বিভোর সামান আলী ঘুমিয়ে পড়ে এক সময়।
সামান আলীর ঘুম খুব গভীর, একবার ঘুমোলে মানুষটাকে সহজে ডেকে তোলা যায়না...... মোসাম্মৎ জোছনা খাতুনের অজানা নয় তা। নিশ্চয়ই গাড়িতে ঘুমিয়ে পড়েছে মানুষটা, কিন্তু মোবাইল কেন বন্ধ তার!! জোছনা খাতুনের ভালো লাগেনা, ছেলে-মেয়েগুলো ঘুমিয়ে পড়েছে বাবার জন্য অপেক্ষা করতে করতে। এতক্ষণ তো লাগার কথা না পৌঁছতে!!!
জোছনা খাতুন জানে না, উল্লাপাড়াতে একটা বাসে আগুন দিয়েছে কারা যেন...... তিনজন মানুষ বাসের ভেতর পুড়ে ছাই। জোছনার আদরের ছেলে তাই ঘুমের মাঝে সাইকেলের স্বপ্ন দেখে, মেয়েরা স্বপ্ন দেখে নতুন জামা, টি ভি কিংবা প্রসাধনীর।
জোছনা খাতুন জানেনা, তাই বারবার ফোন করে শুনতে থাকে যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর...... “এই মুহূর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না”। জোছনা খাতুন ঘুণাক্ষরেও জানেনা...... সুতো ছিঁড়ে গেছে, সংযোগ আর কখনোই দেয়া সম্ভব না।।
-গবেট গব্লিন
মন্তব্য
সরি, পোস্টের ট্যাগে 'কাইল্যা ব্যাটা' লেখার মানে বুঝিনি।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
আসলে কিছু না ভেবেই ট্যাগে ঐ শব্দটা উল্লেখ করেছি। সামান আলীর মতো অতি সাধারণ মানুষদের আমরা সচরাচর এই ধরণের আরোপিত নামেই ডাকি তো!!! গল্পটা পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
সাধারণ একটা ঘটনা,কিন্তু সুন্দরভাবে উপস্থাপন ও সুচারু বর্ণনা,একটা ভাল গল্পের জন্য এই যথেষ্ট।
মাঝে মাঝে আঞ্চলিক কথাগুলোর ব্যবহারটা ভাল লাগল।
সবচেয়ে মজা পেলাম,
"এক দফা- এক দাবী, সাইকেল চাই...... কবে দিবি"
চালিয়ে যান।আরও কিছুর অপেক্ষায় রইলাম...
অসংখ্য ধন্যবাদ।
নতুন মন্তব্য করুন