সাল ১৯৪৫, ৩রা মার্চ।
সুইস-জার্মান সীমান্তবর্তী ছোট্ট গ্রাম ব্রাগা। পশ্চিমদিকে ছড়ানো ছোট ছোট বাথানগুলো টুকরো টুকরো ছবির মতো দেখায়। পাশে খরখরে নীস নদী নীল রঙের নিশ্চল বিজ্ঞাপন হয়ে দর্শক আকর্ষনে ব্যর্থ।
দূরে আল্পসের রূক্ষতা প্রকাশিত স্বল্প সময়ের গ্রীষ্মতে; এবড়ো-থেবড়ো বরফ এখানে ওখানে কয়েক চাপড়া। দূর থেকে সবুজের মাঝখানে শ্বেতির মতো দেখা যায়। কবছর আগেও ছবির মতো সাজানো গ্রামটিতে খুশীর হল্লা বয়ে যেত। কাঠের দোতলা লগকেবিনগুলোর ফায়ারপ্লেস দিয়ে মৃদু লালচে সাদা ধোঁয়া কিছুদূর উঠেই পাহাড়ের ঠান্ডা জোলো বাতাসে বরফ হয়ে ঝুরঝুর ঝড়ে কেবিনের টালির ছাদে আইসক্রিমের মতো ঝুলে থাকতো।
জার্মানরা দখল করে নেবার পরে জায়গাটা দর্শনীয় হয়েছে আরো। তবে দেখে শান্তি হবে না কারো মনে; বীভতস স্মৃতি হয়ে বিবমিষা জাগাবে বাকী জীবনটা; নিশ্চিতভাবেই।
পূর্বপ্রান্তে পোস্টঅফিসটা এখন একটা সামরিক ক্যাম্প। গেস্টাপো আর নাজি বাহিনীর কন্স্ট্রেনশান ক্যাম্প। এটাকেই সেন্টার ধরে এ অঞ্চলের যুদ্ধ পরিচালিত হচ্ছে।
সিদরকাপ্রি স্টেশনের পূর্ব প্রান্তে বড় প্রেইরিটাতে ক্যাম্প করেছে তারা।
হাতে বানানো সিগারে সুখটান দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিল- হের কাপিতান মুয়ালার; মুখটা তিতকুটে একটা স্বাদে ভরে গেলো।
ধ্যাত্তেরিকা, এই পোলিশ তামাকটা এত বিচ্ছিরি! জিভ কষটা হয়ে যায়। তবুও এর চেয়ে ভালো জিনিস পাওয়া কঠিন। যুদ্ধের সময় এতো বাছ-বিছাড় করলে চলে না।
আনমনে শার্টের এখানে-সেখানে শুকিয়ে যাওয়া ছোপ ছোপ রক্তের দিকে তাকিয়ে পিত্তি চটকালো রাইখ-এর। নিশ্চিত ব্যাটা পায়ের উপর পা তুলে শিকাগো কর্বিয়নি খাচ্ছে; কোন ব্যালেরিনার বক্ষলগ্না হয়ে মজা লুটছে আর তাদের জন্য কি কাজ রেখেছে!
অচেনা বিজাতিয় কিছু মানুষ কে স্বর্গে/নরকে পাঠানোর কাজে লাগিয়ে রেখেছে। একে বেয়নেট চার্জ করো তো তাকে গুলি করে ঘিলু উড়িয়ে দাও।
প্রতিদিন খাওয়ার সময় হাতে রক্তের গন্ধ পায়, ঘুমানোর সময় শার্টে শুকানো রক্তের ঘ্রানে বুকের কাছে পোকামাকড় ঘুরে বেড়ায়। কোথায় পরিবার, কোথায় পরিজন!
হাতের কাছে একবার পেলে এক ঘুষিতে.....ছি: ছি: ছি:, জিভ কাটলো সে এইরকম সাতসতের ভাবতে ভাবতে; চকিতে আশেপাশে তাকালো- কেউ শুনে ফেললেই, ঠাস! গুল্লি!! থার্ড রাইখ হিটলার সবার কাছে ঈশ্বরের চেয়েও বাস্তব; ভাগ্য নিয়ন্ত্রক।
শেষ কথাটা কি জোরেই বলে ফেল্লাম। আঁতকে উঠলো কাপিতান!
মাই মাই! রোমেলকেই ছাড় দিল না, শুনতে পেলে একবারে রুশ ফ্রন্টিয়ারের দাগেস্তানের মতো কোথায় যে পাঠিয়ে দেবে- জেসাস জানে!!
আনমনে, পাছায় লেগে থাকা ধুলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়াল। এলোপাথাড়ি হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা দূরে লেফটেন্যান্ট পল- এর চৌকিতে পৌছাল। মাথা জুড়ে চলছে শ্যাম্পেন,কভাস আর অ্যাভোক্যাডোর সাথে রোজমেরী মেশানো শিকাগো কর্বিয়নির চিন্তা; ভালরিয়ানা যা চমতকার তৈরি করেঃ আহ!
কেন যেন যুদ্ধ পছন্দ নয় তার। কোথায় যেন শুনেছে, যাদের শান্তি পছন্দ তারাই প্রকৃত যোদ্ধা- তবে এর অর্থ পরিষ্কার নয় তার কাছেই।
চোখ পরল পলের দিকে, বেচারার হাত এ একটা পিন-আপ; বেচারা পুলকের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল; ইস, এই সব ছেলে-ছোকরা যাদের স্কুলে আর গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ডেটে চমতকার একটা সন্ধা কাটানোর কথা! তাদের কিনা মেশিন-গান নিয়ে ধস্তাধস্তি!
নিকুচি করি ফাদারল্যান্ড আর রাইখ এর; সব গুখোরে ব্যাটা।
চমকে লাফিয়ে দাঁড়াল লেফটেনান্ট পল; কাহিল অবস্থা- হের কাপিতান আসার আর টাইম পেল না!
সবেমাত্র ১ ঘণ্টার রেস্লিং শেষ করে বেশ একটা সন্ধির কাছাকাছি আসছিল, ধ্যাত! কোনমতে একহাতে প্যান্ট এর বকলস সামলে বেশ জোরের সাথেই স্বাগতম জানালো,
গুটেন মরন, হের কাপিতান।
আনমনা কাপিতান তখন অন্য জগতে,
আচ্ছা, তোমার কাছে হাভানা চুরুট আছে না? একটা দাও- একি ওরকম জোকারের মতো দাড়িয়ে আছ কেন?
ফোঁস করে নি:শ্বাস ফেললো পল; এটা স্বস্তির। ফুহ! এ যাত্রা লজ্জার হাত থেকে বেঁচে গেল। কাপিতান টের পায় নি। তারই বা কি করার আছে? ছাঁতার দেশ। এখানকার মেয়েগুলো সাদা-নির্জীব; যুদ্ধ নারীদের ভীত-সন্ত্রস্ত করে, সেক্স অ্যাপিল কেড়ে নেয়। থরথর করে কাঁপতে থাকা ইহুদীদের উপর চড়াও হবার চেয়ে তাই জার্মান পিন-আপ নিয়ে হাতের উপর ভরসা করাই ভালো। চেস্ট থেকে একটা প্যাকেট বের করলো সে।
একটা চুরুট পুড়তে বেশ সময় লাগল, ফাঁকে-ফাঁকে আলগা রসিকতা জুড়লো পল- ফ্রাউ ভালারিয়ানা আপনাকে দশদিন চুমু খেতে দিবে না হের, যদি এই বিটকেলে গন্ধ নাকে আসে!
আর চুমু, তোমাদের মত হুমদো পুরুষের সাথে থেকে থেকে তার গায়ের ঘ্রাণই ভুলে যেতে বসেছি। তোমরাই ভাল আছহে ছোকরা- আপনা হাত জগন্নাথ!
হের কাপিতান এর কথায় লজ্জা তেমন না পেলেও শিউড়ে উঠে পল, কি জাঁহাবাজ চোখরে বাবা!
নন-কমিশন্ড কর্পোরাল কাটজি এর প্রায় উড়ে আসাটা দু'জনের কারো চোখেই পরেনি। খট্টাস করে স্যালুট ঠুকে একরাশ ধুলো উড়িয়ে হাঁপাতে লাগল,
হের কাপিতান, লেফটেন্যান্ট স্যার, ইস্টার্ন ফ্রন্টে একপাল তুরকিকে আটক করেছি। কাট এর গলাই বেশ গর্বের ছোঁয়া।
কেনো যে এত লাফাও তুমি! এইটা কি বার্লিন পেয়েছ? শার্টের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে মুয়েলার এর বিরক্তি ভরা উত্তর।
মিইয়ে গেলো কাট।
এই ফ্রন্টের বাঘ হচ্ছেন কাপিতান। গত পরশুতো একাই চারটা ট্যাঙ্ক উড়িয়ে দিলেন। কি বিক্রম!
ইয়া বড় মেশিনগানটা গলাতে ঝুলিয়ে শত্রুর দিকে নির্ভীক এগিয়ে যাওয়া- তারপর শার্ট এর ফ্লাপ থেকে রক্ত মুছতে মুছতে নির্বিকার ভাবে পাউরুটি খাওয়া- স্বয়ং ফুয়েরার কদিন আগে ‘কংরাচুলাত লেতার পাথাইসেন সাথে আয়রন ক্রস’ উপহার দিয়েছে।
এই ফ্রন্টে এই প্রথম; কমান্ডার হিসাবে।
পা দুটো কাঁপতে লাগলো কাটের অজানা আশঙ্কাতে।
লেটস ওয়াচ দা সিচুয়েশান।
কাপিতানের ইশারাতে লেফটেনান্ট পিছু পিছু চললো নি:শব্দে। একটা জলপাই রঙা জীপে করে গেল তারা। জীপের ডান ফ্লাগ গার্ডে একটা স্বস্তিকা লাগানো পতাকা জার্মান সাম্রাজ্যের দম্ভে পতপত করে উড়ছে। পল বেশ স্পীডি ড্রাইভার; ইয়াং ব্লাড তো!
ওদিকে ইস্টার্ন ফ্রন্টে, রিফিউজি দলটা ঝড়ের ইউক্যালিপ্টাসের মতো কাঁপছে; তাদের জীবন হঠাত থমকে দোদুল্যমান সামনে দাঁড়ানো ক্ষমতাবানদের অঙ্গুলি হেলনের ওপর।
ওদিকে বন্দীরা ১৭ জনের একটা দল ছিল, তুরস্ক থেকে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে পালিয়ে ফিরছে; বিশাল এক যৌথ পরিবার- এইমূহুর্তে তাদের পাঁচ জন নিজেদের তৈরি রক্তের পুকুরে সাঁতার কাটছে; বাকীরা থরথর করে অপেক্ষা করছে পরবর্তী ঘটনার। তাদের দিকে নল উঁচিয়ে থাকা জার্মান সৈন্যরা নিজেদের ভেতর ফিসফিস করছিল।
কাপিতানের আগমনেই ফিস ফিস থেমে গেলো- লেফটেনান্ট বোমার রিপোর্ট দিল-
অকস্মাত হামলা চালিয়ে আমাদের দুজন কর্পোরাল কে আহত করে এরা। যাদের ভেতর, রংরুট হিসেবে গতো পরশু জয়েন করা রিউয়াস মারা গেছে।পুরনো আমলের উইনচেস্টার নিয়ে করা তাদের হামলা কিছুক্ষনের মধ্যেই দক্ষতার সাথে প্রতিরোধ করি; তারপরই পাল্টা হামলা চালিয়ে এদের ধরে ফেলি।
পাশ থেকে আনন্দের আতিশয্যে একজন কর্পোরাল বলল- হের রিউয়াস একাই তিনজন কে মেরে তারপর নিজে মরেছেন, বিশুদ্ধ রক্তের মর্যাদা অক্ষুন্ন।
রিউয়াসের মৃত মুখটার দিকে একবার দেখে নিল মুয়েলার, এর মধ্যেই মাছি ভনভন করছে গালের উপর তৈরি ক্ষতটা ঘিরে, তার সম্পর্কে কতো ভাল ভাল কথা হচ্ছে অথচ আর্যগৌরবের খুশি নিয়ে নরকে চলে গেছে!
আস্তে আস্তে চোখ ঘুরিয়ে সবাইকে দেখলেন কাপিতান।
একটা বৃহৎ চাষি পরিবার। নিজস্ব হুস রাইফেল আর উইনচেস্টার দিয়ে আক্রমন করেছে। মূল কারনটা অবশ্য দেখাই যাচ্ছে- জীবিত এক ডজনের মধ্যে ৩টা অপূর্ব সুন্দরী মাল রয়েছে যে!
ইস, যুদ্ধকালীন নারীদের উপর সবার অধিকার জন্মে যায়।
পুরো প্লাটুনের বুভুক্ষু একপাল পুরুষ এরই মধ্যে জান্তব অভিব্যক্তি প্রকাশ করছে। উসখুস করছে কখন জানোয়ারের মতো ঝাঁপিয়ে ছিঁড়ে খাবে। এ ওকে ইশারা করছে ভাগাভাগির দাবি নিয়ে। সিরিয়াল ঠিক করছে।
যেহেতু, কাপিতানের সাথে সবচে ভাল সম্পর্ক পলের; সে ফিস ফিস করে কি যেন দাবি করতে যাচ্ছিলো- হয়তোবা ১৬/১৭ বছরের কচিটাকেই?
বিচারপর্ব চলছে।
চারজন যুবক গোঁয়ারের মতো তাকিয়ে আছে ওদের দিকে; মৃত্যুর ভয় চোখ থেকে উঁধাও। সামনে তাগ করা চারটা জার্মান রাইফেল গাম্ভীর্যের সাথে মৃত্যু সংবাদ দিচ্ছে তাদের।
কাপিতান দীপ্ত কণ্ঠে হুকুম দিলো- সাথে সাথে এক পশলা বুলেট বন্দীদের চিড়ে বেরিয়ে গেলো বুকে-পিঠে বড় বড় ফুঁটো তৈরি করে; গলগল করে রক্ত ঝরছে।
অবাক কান্ড, কাঁদছে না তারা; হাসছে। তারা জানে তাদের মৃত্যুর চেয়েও কুতসিত করা হবে জার্মানগুলোর মৃত্যু। ধেয়ে আসছে জেনারেল টমসনের নেতৃত্বে মিত্র বাহিনী।
গুলির আওয়াজ বেড়ে গেলো কিছুক্ষনের মধ্যেই; কানে তালা লাগার যোগাড়।
মিত্র বাহিনীর একটা ব্রিগেড ঘিরে ফেলেছে এই তামাশার সুযোগে- সমস্ত চৌকি খালি করে নারী মাংস লোভী জার্মান প্লাটুন এক জায়গাতে জড় হয়ে গেছে।
সেই সুযোগে প্লান করা এই হামলা।
বৃষ্টির মত গুলিতে লুটিয়ে পড়ছে একের পর এক জার্মান যোদ্ধা।
ঘটনার আকস্মিকতা থেমে গেলে তৎপর জার্মান সেনারা কাপিতান এর নেতৃত্বে সংঘবদ্ধভাবে প্রত্যুত্তর দিতে লাগলো, কয়েকজন আশ্রয় নিয়েছে আশেপাশের বাংকারে। সম্মুখ যুদ্ধের একতরফা পাখি শিকার বন্ধ। ঠুসঠাস একটা দুটা গুলি-পাল্টা জবাব যুদ্ধের ইজ্জত রক্ষা করে চলেছে। ট্যাকটিকসের খেলা চলছে বোধহয়।
দুপুর গড়িয়ে এলো; উভয়পক্ষ কেউ কাউকে বাগে আনতে পারছে না।
হঠাত সাউথ ফ্রন্টে তীক্ষ্ণ চিৎকার যুদ্ধের জান্তব শব্দ চিড়ে দিলো, নারী কণ্ঠের হৃদয় গ্রাহী আর্তনাদ। বীর ব্রিটিশরা এর মাঝেই লালসা পূরণে ব্যস্ত। লেফটেনান্ট পল, কর্পোরাল হ্যাগার্ড সবার মনেই রাগ!
শালারা, তাদের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়েছে, ডাসা ডাসা তাজা মালগুলো। ভার্জিনও থাকতে পারতো। শুকনা ঠোট জিভ দিয়ে চেটে আশেপাশে মাথা ঘুরিয়ে নালিশ করতে গেলো কাপিতানের কাছে; কিন্তু, কোথায় মুয়েলার?
ঘেমে নেয়ে উঠছে তার শরীর। হাভানা চুরুটটা শরীরে শিথিলতা এনেছিল, হঠাত শুরু হওয়া যুদ্ধের ধকল ছাঁপিয়ে নারী কণ্ঠের আর্তনাদ কানে অসহ্য ঠেকছিল তার কানে; মনে হচ্ছিলো ভালেরিয়ানা ডাকছে তাকে।মুয়েলারের চোয়াল শক্ত, তার শরীরের বিশুদ্ধ আর্যরক্তে নারীর সম্মান রক্ষার প্রাকৃতিক ডাক পুরুষে পরিনত করেছে তাকে।
হাতের মাউজারটা ছুড়ে ফেলে কমান্ডো নাইফটা মুঠো চেপে নিঃশব্দে এগিয়ে গেলো সে, শব্দের উতস লক্ষ্য করে। বাম হাত দিয়ে শার্টে লেগে থাকা ইনসিগনিটোগুলো থেকে ছিঁড়ে ফেলল আয়রন- ক্রস টা।
ধিক! সেই সৈনিক জীবন- যেখানে মানুষ-পশু পার্থক্য নাই।
চারজন সৈনিক তিনজন যুবতীর দেহের উপর কুকুরের উন্মত্ততায় ঝাঁপিয়ে পরেছে।
আদিম লালসায় যৌনতার প্রাকৃতিক নিয়ম লঙ্ঘন করে নারীকে খাবারের মতো ব্যবহার তাদের। এ স্রেফ যৌনক্ষুধা মেটানো- ভালবাসা নিদারুনভাবে অনুপস্থিত।
নারীকন্ঠে কাঁকুতি নেই- নেই মুক্তির জন্য উচ্ছাস; স্রেফ প্রচন্ড যন্ত্রনা সইতে না পেরে চেঁচাচ্ছে তারা। শরীরের সবগুলো ফুঁটোর উপর আক্রমন শরীর মেনে নিতে পারছে না।
কেউই টের পায়নি নি:শব্দে পেছনে এসে দাঁড়ানো মুয়েলারকে।
তার হাতে ঝলসানো ছুড়িতে প্রতিফলিত হচ্ছে দুপুরের সূর্য।
মুহূর্তেই ঘাতক নাইফ ল্যাজ কেটে দিলো সেইসব মানুশ-কুকুর গুলোর; এক এক করে। বৃহন্নলায় পরিনত হলো তারা।
অপ্রত্যাশিত নির্যাতন বন্ধের ঘটনাচক্রে- অত্যাচারিত যুবতীদের চোখের তারায় নতুন আশঙ্কা ঝিকঝিক করছে।
এ বুঝি মাংসলোভী চিতার উপর হায়নার আক্রমণ; হরিণী হিসাবে তারা দুজনেরই খাদ্য, স্রেফ দখলের লড়াই চলছে।
আশ্বস্ত করল জলদগম্ভীর একটা পুরুষালি কণ্ঠ,
আমি সৈনিক, শিশু-নারী হত্যাকারী নই।
মুয়েলার তার নাইফটার রক্ত সার্টের সাথে ঘষে শুকিয়ে খাপে রেখে, পাশ থেকে কোলে তুলে নিল পাশে খেলতে থাকা তিন বছরের শিশুটিকে- মিষ্টি একটা মেয়ে; ঠিক তার মেয়ে ফারিয়ার মতো দেখতে।
যেখানেই জন্ম হোক শিশুরা সবখানেই একইরকম, নিষ্পাপ-নিষ্কাম-নির্ভীক মানুষের বিজ্ঞাপন তারা।
দূর থেকে পুরো জার্মান প্লাটুন দেখছিল তাদের হের কাপিতান (যাকে গতকাল পর্যন্ত রাক্ষস মনে হতো!) একটা শিশু কোলে দাঁড়িয়ে আছে, এমনকি হিটলারী গোঁফের আড়ালে কর্কশ ঠোঁটে মৃদু এক টুকরো হাসি ঝুলছে!
শিশুটির কোমল হাতটা যেন কাপিতানের গোঁফ টানছে?
সর্বনাশ! মুয়েলার তখন ধুলোমাখা ঠোঁটে চুমু একে দিল মিরিয়ামের গালে।
আহা! কন্যার গালে পিতার চুম্বন, কি অপার্থিব অনাবিলতা!
একটাই শব্দ হল; ঠুঁস করে।
পয়েন্ট ফাইভ কিলো দূর থেকে একটা মাত্র গুলি গেঁথে দিলো পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ভাস্কর্য টাকে।
আবেগ আক্রান্ত পিতার ভূমিকায় যোদ্ধা মুয়েলার মাশুল দিলো নির্মমভাবে তার ফ্রন্টে অন্যমনস্কতার। এর জন্যই যোদ্ধাদের আবেগশূণ্য করার ট্রেইনিং দেয়া হয়।
সাল ২০৪৩, মার্চ ২৯।
একঘর শিক্ষার্থী আর স্রোতা নিয়ে ব্যস্ত প্রফেসর আহমেদ; ভাল বক্তা তিনি। কথার জালে নিমিষেই সবাইকে নিয়ে ভিন্ন-ভূবনে আসা-যাওয়া করেন তিনি। নিজের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হিসাবে পৃথিবীজোড়া খ্যাতি আত্মভোলা মানুষটার চোখের স্বপ্নীল আবেশে বাস্তবতার কাঁদা মাখতে পারেনি।
দূর-দূরান্ত থেকে বাংলাদেশে আসে স্টুডেন্ট আর রিসার্চাররা। এখানে হাজার বছরের সভ্যতা নিয়ে গবেষণা হয়। ঠিক কি সে কারন, যার জন্য অন্যান্য প্রানিদের চেয়ে শ্রেষ্ঠত্ব মানুষের? যুগে যুগে দশ হাজার বছর ধরে, ক্রমান্বয়ে জীবনমান উন্নত হয়েছে জোটবদ্ধ মানুষে চিন্তার উতকর্ষে- কেন? মানুষ নিজের স্বার্থ ত্যাগ করে পাশের জনের জন্য- এটা পরীক্ষীত সত্য। কিন্তু কেন? তা স্পষ্ট নয়।
মানবদেহের সব অর্গানের ব্যবচ্ছেদ করা গেছে বাট ব্রেইন আর হার্টের একটা সিনক্রোনাইজেশান আছে অপ্রকাশিত। যার উপর শরীরের মালিক মানুষের তেমন নিয়ন্ত্রন থাকে না। সময় সময় বেয়াড়া আচরণ আর প্রথাবিরূদ্ধ সিদ্ধান্ত প্রজন্মের জন্য নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। সেসব নমস্য ব্যক্তির চরিত্র বিশ্লেষণ এখানকার প্রাথমিক ডাটাবেজ হিসাবে সুসিদ্ধ।
'মানুষ' সাবজেক্ট হিসাবে পড়ানোর অনুমতি পৃথিবীর সব শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান পায় না। বাংলাদেশের হিলট্রাক্টসে এশিয়ার সবচেয়ে বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান 'সংশপ্তক বিশ্ববিদ্যালয়ে এটা একমাত্র সাবজেক্ট। তাই, ইউনেস্কোর সরাসরি তত্ত্বাবধায়নে পরিচালিত এই প্রতিষ্ঠানের সাফল্য কিংবা গবেষণার উপর পৃথিবীর দার্শনিক ভবিষ্যত নির্ধারিত হয়।
হিউম্যান প্যারা-এনাটমি ভার্সেস স্কাল্পচার’ কোর্সের আজ প্রথম দিন।
নতুন ‘অ্যান্ডরাল বেনজয়েট’- নামের কেমিক্যালটা নিয়ে আজ প্রায় দশ বছর কাজ করার পর জীর্ণ একটা কঙ্কালের এনভি আকার বের করতে পারছেন।
শুধু জড়ান তালগোল পাকানো অনেকগুলো হাড় থেকে এক শতাব্দী আগের মানুষের গল্প বলছিলেন তিনি; গভীর সেই দর্শনে ঘৃণা-যুদ্ধ-বিশৃঙ্খলার মাঝে মানুষের ভালবাসার ক্ষমতার উতস দর্শন নিয়ে আলোচনা।
হুইগান একজন শ্রোতা (ইরেলান্দ রিপাবলিক এর ছাত্র) জিজ্ঞাসা করলো,
তাহলে এই কাঠামোটা কি মুয়েলার অ্যান্ড মিরিয়াম এর?
সুজানা গত সপ্তাহে নিকারাগুয়া থেকে এসেছে। এখনও এখানকার ক্লাসের আবহের সাথে পরিচিত না। স্যারের কথা ক্রিটিকালি নোট করছিল সে, কোথায় যেন আবেগ এসে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। মানুষের ভালবাসা আর স্নেহের প্রকাশ মন টলিয়ে দেয়। এখন চোখের কোণ ভিজে আসছে। মুয়েলারকে প্রথমে তার নিষ্ঠুরতার প্রতিমূর্তি মনে হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা জার্মানদের রাক্ষসরূপে ইতিহাসে ঠাঁই করে দিয়েছে, কেননা ইতিহাস বিজয়ীদের স্তুতিকথা মাত্র।
কিন্তু, যে পক্ষের যোদ্ধাই হোক না কেন! তার মানবস্বত্বা অটুট ছিল।
নানান জাতির এই পৃথিবীর সন্তান মানুষেরা প্রকৃতিগতভাবে একই রকম, ভিন্ন বাসস্থান-খাদ্যাভাস-জীবনমান তাদের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে মাত্র। ভালবাসা তাদের উত্তেজনায় এক সুতোয় বাঁধে!-
সারা ক্লাসের বিভিন্ন জাতির ৬০০ জন ছাত্রের মধ্যে ক্রীটের অ্যারন শুধু মাত্র গল্পে দ্রবীভূত হয়নি। কাঠ কাঠ মুখ করে বসে আছে।
সারা বিশ্বের ৬ লাখ আবেদনকারীর মধ্যে মাত্র ৫০০ প্লাস সাবকন্টিনেন্টের ১০০ মোট ৬০০ জনের- এই স্পিশাল কোর্সে আসার আগেই তার ইন্সিটিউট হেড বলে দিয়েছেন,
সবসময়ই খেয়াল করবা সমাপ্তি লাইনেরটা। এই মূহুর্তে তাই সে প্রফেসরের বটম লাইনের জন্য কান খাড়া করে রেখেছে। এটাই কি মেইন ফিলসফি উন্মোচনের সময়!
উন্মুখ হয়ে শুনতে পেলো স্টেরিও ফোনের বায়বীয় মাধ্যমে ভেসে আসা, প্রফেসরের মায়াভরা ফিস ফিস-
'মাই ডিয়ার ফেলোস, মানুষ এক অদ্ভুত সৃষ্টি- তাকে বিচার করবে যুগপৎ ভাবে, দুর্বলের উপর মমতা কিংবা শক্তিশালীর বিরুদ্ধে সাহসিকতা দিয়ে- এ এক অসমসত্ত্ব মিশ্রণ- কেবল মানুষই পারে- এইখানেই আমরা পশুদের হারিয়েছ দিয়েছি। মস্তিষ্ক আর হৃদয়ের গোপন যোগসাজস এক তালিসমান; যা সময় সময় পরিস্থির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে অপ্রত্যাশিত ঘটনার জন্ম দেয়।’
কথাগুলো হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে পুরো ক্লাসকেই পরিনত করলো জীবন্ত একটা ভাস্কর্যে।
ক্লাসের সবাই টের পায়নি যে লেকচার শেষ। ফার্স্ট সিটের ঘানার আব্দেল রাশিদ শুধু দেখল- আহমেদ স্যার পকেট থেকে এক খণ্ড সাদা কাপড় বের করে হাড়গুলো দিয়ে তৈরি শক্ত অবয়বটার একটা জায়গাতে মুছে দিচ্ছেন আর বিড়বিড় করছেন নিজের মনেই।
ভাল করে লক্ষ্য করে দেখে শরীর কাটা দিল আরমেনিয়ান নিকলাস এর- সে চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ব্রাগার সেই ফ্রন্টটা- দুপুরের উত্তপ্ত গরমে প্রচন্ড গোলাগুলির একপ্রান্তে শক্তসমর্থ মুয়েলার এর কোলে মিরিয়ম কে, সেই স্বর্গীয় চুমুটা তাকে স্নেহের ক্লাসিক পশ্চার দেখায়!
রুমালটা নামিয়ে চশমা মুছে ফিস ফিস করে প্রফেসর আহমেদ বলছেন,
আই স্যালুট দি ম্যান ইন সাইড ইউ- হের কাপিতান মুয়েলার, দ্যাট ইজ ইউ এজ আওয়ার এক্সাম্পল।
উচ্চকণ্ঠে বললেন- উইল মিট নেক্সট মান্থ স্টুডেন্টস, ক্লাস ইস ওভার।
স্বপ্নীল সমন্যামবিউলিস্ট
30/08/2011
(ঠিক ইতিহাস নয়, আবার অর্থহীণ প্রলাপ নয়। কী যেন লিখতে চাইছিলাম! প্লটটা তাই যুতসই নয়, তবে দর্শন চিরন্তন- এইটা গ্যারান্টেড। )
মন্তব্য
লেখাটা পছন্দ হইছে, গুছিয়ে লিখছেন। একটা টাইম ফ্রেম থেকে আরেকটা টাইম ফ্রেমে আসাটাও খারাপ হয় নাই।
ভালো বলছেন? আরেকটা লেখা আছে হুমায়ূন স্যার নিয়া, স্বপ্নের ফেরিওয়ালা নামে। ওইটা পড়ে দেখবেন? আমার আসলে জানা দরকার আমার লেখার স্ট্যান্ডার্ড কি? আরও লিখব নাকি বাদ দিব।।। আর লেখার দর্শনটা কি ভেরি সিম্পল হয়ে গেল? (স্বপ্নীল সমন্যামবিউলিসট)
ভালো লেগেছে। আর মাত্র ২০ বছর বাকি!
স্বয়ম
২০ বছর! ভালো লেগেছে জেনে ভাল লাগলো। (স্বপ্নীল সমন্যামবিউলিস্ট)
বেশ ঝরঝরে ভাষা ...পড়ে আরাম পেয়েছি । অকিঞ্চর পাঠক হিসেবে মতামত লেখা চালিয়ে যান ।
মতামত লেখা চালিয়ে যাচ্ছি, যেটা ভাল লাগছে পড়ছি, কিন্তু অকিঞ্চর পাঠক কথাটা মাথার উপর দিয়া গেছে (!) (স্বপ্নীল সমন্যামবিউলিসট)
স্যরি , মোবাইলে 'ন' কখন 'র' হয়ে গেছে খেয়ালই করিনি ।
লেখা ভাল লাগল, জার্মান উচ্চারণগুলো কি সব ঠিক আছে?
facebook
পয়েন্টে ধরছেন!! আসলে জার্মান উচ্চারণ ঠিক আছে কি না যাচাই করি নাই!! মনে হলো, আমি জার্মান হলে এভাবেই বলতাম, তাই লেখলাম। উতসাহের জন্য ধন্যবাদ (স্বপ্নীল সমন্যামবিউলিসট)
ভাই আপনার পার্সোনাল ব্লগ আছে কোন? থাকলে লিংকটা দিয়েন
নাহ, আমি আসলে আমার লেখাগুলো মূলত: ফেসবুকে দেই। কখনো সচলে। (স্বপ্নীল সমন্যামবিউলিসট)
নতুন মন্তব্য করুন