ঈশ্বরদীর হুজুর হেকমত আলী মাস ছয়েক আগে হঠাৎ একটি চিঠি পেলেন। তার মাদ্রাসার এক ছাত্র ঢাকা থেকে চিঠিটা পাঠিয়েছে। চিঠি পড়ে জানতে পারলেন তার ছাত্রের এলাকার মসজিদের জন্য একজন ইমাম প্রয়োজন। ছাত্র মকসুদ সেখানকার মসজিদ কমিটির মেম্বার, তাই সে হেকমত সাহেবকে চিঠি পাঠিয়েছে তিনি যাতে দয়া করে ঢাকায় মসজিদে ইমামের দায়িত্বে যোগদান করেন। এই ছাত্রটি হেকমত সাহেবের খুব কাছের একজন, তার কথা ফেলে যায় না। তাই তল্পিতল্পা গুছিয়ে মোটামুটি তিনি যখন এসে পৌঁছান, তখন থেকেই এলাকার লোকজন তাকে মাথায় তুলে রেখেছে। দিনে তিনবেলা এলাকার নামী হোটেল থেকে খাবার আসে, কোনবেলায় পোলাও, গরুর মাংস, কোন বেলায় খিচূড়ি আবার কোন বেলায় খাসির বিরিয়ানী। তার পাশাপাশি বাসায় বাসায় মিলাদ পড়াতে গেলেও খাওয়ার ব্যবস্থা থাকে, সাথে বাড়তি আয় তো আছেই।
ফজরের নামাজ পড়ে তসবিহ পড়তে পড়তে হেকমত সাহেব এসবই ভাবছিলেন। একে তো রমজান মাস, তার উপর আজ আবার শুক্রবার। জুমু'আর সময় প্রচুর মানুষ হবে। তসবিহ গোণা শেষ করে দোয়া করলেন। তারপর আতরের শিশি থেকে তুলায় একটু আতর নিয়ে হাতে ঘষলেন, বাকি দুই গালে ঘষে তুলাটা কানের ভাজে গুঁজে রাখলেন। এমন সময় তার সাথের মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। জহুরা বেগম ফোন করেছেন। হেকমত সাহেব একটু বিরক্তই হলেন। মেয়েমানুষের খেয়ে দেয়ে কাজ নাই, সকাল বেলা নামাজ পড়েই ফোন করতে হবে। কেন যে তাকে মোবাইল কিনে দিয়েছিলেন! হাতে মোবাইল ফোনটা নিয়ে কল রিসিভ করলেন,
"আসসালামু আলাইকুম জহুরা বেগম! কি সমাচার?"
"আসসালামু আলাইকুম, আপনি কেমন আছেন?"
"ওয়ালাইকুম সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ! আমি ভালো আছি! তোমারে না বলেছি আমাকে সকাল সকাল ফোন দেয়ার কোন দরকার নাই? আর সালামের উত্তর দাও নাই কেন? জাহান্নামবাসী হইতে চাও?"
"মাফ করে দেন! ভুল হয়ে গেছে।"
"মাফ করার মালিক আল্লাহ, আমি না! তা কি জন্যে ফোন করেছ?"
"ইয়ে ঘরের কাজ তো আল্লাহর রহমতে ভালো চলতেছে, আরো কিছু টাকা প্রয়োজন! আর ঘরেও খরচপাতি লাগবে!"
"তার জন্য ফোন দেয়ার কোন প্রয়োজন নাই, টাকা সময়মত পেয়ে যাবা ইনশাল্লাহ! আর শোন, সকাল সকাল আমাকে এইভাবে ফোন দিবা না। আমি যিকিরে মশগুল থাকি, আমার যিকিরে ব্যাঘাত ঘটে। এখন রাখ, খোদা হাফেজ!"
"জ্বি আচ্ছা, আসসালামু আলাইকুম!"
হেকমত সাহেব ফোন রেখে দিলেন।
রমজান মাসে মানুষ একটু বেশিই পরহেজগার হয়ে যায়! ধর্ম কর্মের প্রতি টান বাড়ে!
মসজিদে সমাগম হওয়া বিশাল মানুষের স্রোতের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলেন হেকমত আলী। উত্তর মহল্লার গাঁজাখোর কাসেমও দেখি টুপি পরে নামাজ পড়তে চলে এসেছে! অন্য সময় তো মামুনের চায়ের দোকানে হিন্দী গান শুনে আর গাঁজা টেনে দিন পার করে! আল্লাহ এদের হেদায়েত করুন!
নামাজের আগের ওয়াজ শুরু করলেন হেকমত আলী। এই রমজানের প্রতি শুক্রবারের মত আজকেও রমজান, যাকাত এর ফযীলাত নিয়ে আলোচনা করলেন। তারপর একটু দম নিয়ে হাতের ঘড়ির দিকে তাকালেন, এইবার শুরু করা যায়। একটু দম নিয়ে হেকমত আলী শুরু করলেন,
"ভাইয়েরা আমার! আগেই বলেছি এই রমজান ত্যাগের মাস! মহিমার মাস! কিভাবে ত্যাগ করতে হয় তা শেখার মাস! আপনার অনেক ধন সম্পদ, কিছুটা যদি আল্লাহর রাস্তায় ত্যাগ করবেন, আপনার সম্পদ হয়তো কমবে! কিন্তু মনে রাখবেন, রোজ কেয়ামতে আপনার এই সম্পদ! আপনার জন্য দোয়া করবে বলেন সুবহানআল্লাহ!
সমাগমের মধ্যে মৃদু গুঞ্জন ওঠে। তৃপ্তির হাসি দিয়ে হেকমত আলী আবার শুরু করেন,
"আপনারা অনেকেই বলেন, পরকালের চিন্তা করেন। সেই চিন্তা করে নিজের কবরের জন্য জমি কিনে রাখেন। কিন্তু কে বলবে আপনার কপালে জমি আছে কি নাই? আপনি যদি হজ্বে গিয়ে মক্কা শরীফে মারা যান, তাহলে আপনার কবরতো সেখানেই হবে! তাহলে এই জমি কি করবেন? আমি বলতেছি না এই জমি কেনা গুনাহ, আমি বলতেছি যে কেন অনিশ্চিত বিষয়ে টাকা খরচ করবেন? আপনারা জানেন, আমাদের মসজিদের জন্য জমি কেনা আবশ্যক। আপনাদের টাকায় সেই জমি কেনা হইতেছে। আরো টাকা লাগবে। কবরের জমির দাম কত? বার স্কয়ার ফিট, প্রতি স্কয়ার ফিটের দাম ছয় হাজার হইলে বাহাত্তুর হাজার টাকা হয়! ভাইয়েরা আমার, কেন এত টাকা অনিশ্চিত কাজে খরচ করবেন? এই বাহাত্তুর হাজার টাকা আল্লাহর রাস্তায় দান করেন, আল্লাহর মসজিদের জন্য দান করেন। কে আছেন ভাই? নিজের কবরের জায়গা আল্লাহর রাস্তায় দান করবেন? ভয় নাই, আপনি দান করেন, আল্লাহ আপনার জন্য কবর নয়, জান্নাতের বাগিচা বানায়ে দেবেন! কেউ আছেন ভাই, হাত তোলেন!
আগ্রহী কাউকে দেখা যায় না!
"ভাবতেছেন, এত টাকা দিলে লস হয়? হায়রে ভাই! দুনিয়ার টাকায় কি হবে, কিছুই তো সাথে নিতে পারবেন না! আচ্ছা ঠিক আছে, কে আছেন এর অর্ধেক দেবেন? ছয় স্কয়ার ফিটের টাকা দান করবেন?"
একজন উঠে দাঁড়ালেন। এই লোককে হেকমত আলী চেনেন, সিমেন্টের দোকান আছে ভদ্রলোকের। নাম ইদ্রিস।
"আলহামদুলিল্লাহ! আমাদের ইদ্রিস ভাই মসজিদের জন্য ছত্রিশ হাজার টাকা দান করেছেন। আর কেউ আছেন? যান আরো কমায়ে দিলাম! এক স্কয়ার ফিটের টাকা কেউ দান করবেন? ছয় হাজার? ছয় হাজার? কেউ দিলে তাড়াতাড়ি বলেন, নামাজের সময় পার হয়ে যাইতেছে!"
এইবার বেশ কিছু আগ্রহী দেখা যায়, পনের বিশ জন দাঁড়িয়ে যান। হেকমত আলীর চোখ চকচক করে ওঠে,
"আলহামদুলিল্লাহ! ভায়েরা আমার, এইরকম হৃদয়বান, আল্লাহপ্রেমিক ভাইদের জন্য আমি দোয়া করি! আল্লাহ তাদের জমীন জান্নাতের বাগিচা বানায়ে দেবেন, বলেন আলহামদুলিল্লাহ!"
নামাজ শেষ হয়। যারা টাকা দেবেন বলেছিলেন সবাই আছর ওয়াক্তে এসে টাকা দিয়ে যান।
ইফতারের পর হেকমত আলী মসজিদ কমিটির অফিসে যান। আজ যা যা দান উঠেছে, সব জমা দেবেন। হেকমত আলীকে দেখে মকসুদ উঠে দাঁড়ায়,
"আসসালামু আলাইকুম হুজুর, আসেন! বসেন এইখানে!"
"ওয়ালাইকুম সালাম, কি সমাচার মকসুদ? দিনকাল কেমন যায়?
"এই তো হুজুর! আল্লাহর রহমত আর আপনার দোয়া!"
"আমি আর কি? সব তারই উছিলা!"
একে একে কমিটির অন্য সদস্যরা এসে উপস্থিত হন। কাদের মিয়া, গোলাম রাব্বানী, আলিম আহমেদ, সবুর পাটোয়ারী সহ অন্যান্যরা।
হেকমত আলী শুরু করেন, "আল্লাহর অশেষ রহমতে আজ মসজিদে ভালই দান উঠেছে। ইদ্রিস আলী ভাইয়ের ছত্রিশ হাজার সহ আজকের অনুদান মোট পঞ্চাশ হাজার টাকা।"
আলিম আহমেদ অবাক হয়ে বলে উঠলেন, "সে কি হুজুর! মুয়াজ্জিন যে বলল দেড় লাখের মত টাকা উঠেছে?"
হেকমত আলী ঠান্ডা চোখে আলিম সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, "আমার বক্তব্য যদি বিশ্বাস না হয়, তাহলে আপনারা মুয়াজ্জিনরে গিয়ে ধরে হিসাব দিতে বলেন। আল্লাহর কসম! আমি যদি ভুল হই আল্লাহ আমার বিচার করবেন!"
মকসুদ তড়িঘড়ি করে বলে উঠল, "নাউযুবিল্লাহ হুজুর! আপনার কথায় অবিশ্বাস করি কিভাবে? আলিম ভাই, কি যে বলেন না! হুজুর কি মিথ্যা বলবে? মুয়াজ্জিনের বোধহয় ভুল হইছে কোথাও!"
আলিম সাহেব সমর্থন না পেয়ে চুপ করে রইলেন। বাকিরাও নীরব থাকলেন।
মিটিং শেষে নিজের বাসায় ফিরলেন হেকমত আলী। দরজা ভালো করে আটকিয়ে আলমারী খুললেন। পাঞ্জাবীর পকেট থেকে নব্বই হাজার টাকার বান্ডিলটা নিয়ে গোপন ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রাখলেন। কাল বাদে পরশু রবিবার সকালেই টাকাটা বাড়ি পাঠাতে হবে। এখানকার বাড়ির জানালা গুলো সুন্দর, এগুলোকে নাকি থাই গ্লাস বলে। ভাবছেন নিজের বাড়িতে নতুন করা চার তলা বিল্ডিঙয়ের জানালাগুলো তেও এই সিস্টেম করবেন। টাকাটা রেখে আলমারী ভালো করে বন্ধ করে হেকমত সাহেব মসজিদের উদ্দেশ্যে বের হলেন, একটু পর আবার তারাবীহ শুরু হবে!
এক সপ্তাহ পর!
হেকমত সাহেব জুমু'আর ইমামতি করবেন। ওয়াজ শুরু করলেন,
"ভাইয়েরা, আপনারা রাস্তায় অনেককেই দান করেন। কিন্তু সে কি আসলেই গরীব কি না তা জানার উপায় আছে কি? আপনার দান করা অর্থ সৎ কাজে যাচ্ছে কি? তাই বলি, আমাদের ফান্ডে জমা দিয়ে যান, আল্লাহর কসম! আমি নিজ হাতে তদারকি করে সেই টাকা মানুষের মাঝে বিলিয়ে দিব। আর একটা কথা, আপনাদের টাকায় মসজিদের জমি কেনার চেষ্টা চলতেছে, আরো কিছু টাকা লাগবে। আসেন ভাই, আল্লাহর রাস্তায় নিজেদের সম্পদ বিলায়ে দিয়ে জান্নাতের পথ সুগম করি! আছেন কেউ ভাই............?
(বিঃ দ্রঃ - এই গল্পটি লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব অভিজ্ঞতা অবলম্বনে লিখিত। কোন প্রকার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত প্রদান কিংবা হেয় করার উদ্দেশ্যে লেখা হয় নি। তবে কারো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মিলে গেলে লেখক দায়ী নয়!)
মন্তব্য
লেখকের নামটা জানা গেলো না।
_____________________________________________________________________
বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখো দ্বিতীয় বিদ্যায়।
এসব বলে তো লাভ নেই। ধর্মীয় নুনুভূতি এসব অশিক্ষিত মোল্লাদেরকে সম্মানের আসনে বসিয়েছে। এদেরকে সম্মান করে আমাদেরই বাপ-চাচা সবাই। হতাশ লাগে।
লেখনী সচল থাকুক।
_____________________________________________________________________
বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখো দ্বিতীয় বিদ্যায়।
এমন ঘটনা অহরহই ঘটে। অথচ আমি যতদূর জানি মসজিদের নামে ভিক্ষাবৃত্তি বা এরকম চেয়ে চিন্তে টাকা উঠানো ইসলামে সরাসরি নিষিদ্ধ! ওয়াজ মাহফিলের নামে যা হয় সে নাহয় আর নাই বললাম!
সব টেকাটুকার কার বার !
পড়তে ভালই লাগছিলো ভাই। কিন্তু খটকা লাগলো এক জায়গায়। মসজিদের জায়গা কেনার টাকা তোলার মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মসজিদ কমিটির লোক থাকবেই, তাইনা? এটা খেয়াল রাখবেন পরবর্তীতে।
----------------------------------------------
কামরুজ্জামান পলাশ
সমস্যা হল, প্রকৃত ঘটনাতে ইমাম সাহেব নিজেই টাকা তুলছিলেন। মসজিদ কমিটির কেউ ছিল না।
গোজা মিলের লেখা , কিভাবে এগুলো ছাপা হয় !
টাকা কমিটির হাতে না দিয়ে ইমাম সাহেবের হাতে দেই এই কথা আগে শুনিনাই। অনেক মসজিদ কমিটি করাপ্ট। এইটা জানা কথা ।
রানা প্লাজার দুর্গতদের সাহায্যের জন্য মন্ট্রিয়াল এর বেশ কিছু মসজিদে আমরা এক জুম্মাবারে অর্থ সংগ্রহ করি। এর মধ্যে একটি মসজিদের ইমাম, যিনি কিনা মসজিদ কমিটিরও প্রধান (আরব দেশীয়), তিনি মসজিদ থেকে উত্তোলিত অর্থের ৫০% মসজিদের নামে নিয়ে নেন। বাকিটা আমরা পাই (প্রায় ৩০০ ডলারের মত)। পুরোহিত শ্রেণী বিশ্বের আদিমতম ব্যবসায়ী শ্রেণী: ধর্ম, বর্ণ, কাল নির্বিশেষে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে এরা।
ভাল লেখা
ইসরাত
আমার এলাকায় তিন টা মসজিদ আছেই, সেই সকাল থেকেই শুরু হয় ভিক্ষাবৃত্তি। তাদের মাইকের ডিজিটাল ভিক্ষার আওয়াজে অবস্থা খারাপ হবার দশা ।
এতো টাকা দেয়া হয় তারপরেও মসজিদের কাজ হয় না ।
কি আর বলবো
এদের পেট কোনদিনও ভরবে না। না ভরার কারণটা আমরা নিজেরাই। আগে থেকে এত্ত এত্ত খাইয়ে এমন অভ্যাস করছি যে এখন অল্পতে আর পেট ভরে না।
আমি জানি না
এখানে অশিক্ষিত লোকের গাঁজাখুরি পোস্ট কিভাবে পাবলিশ হয় বোধগম্য নয়।
নতুন মন্তব্য করুন