(১)
সম্প্রতি পড়া বইগুলোর মধ্যে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের “ভ্রমণ সমগ্র” বইটা নানা কারণেই ভালো লাগল। প্রথমত, সঞ্জীবের স্নিগ্ধ ও কখনো তীর্যক হাস্যরসাত্মক গদ্যশৈলী এবং দ্বিতীয়ত, সবুজ দ্বীপ আন্দামানের প্রকৃতি, জীবনসংগ্রাম এবং ইতিহাসের সাবলীল বর্ণনা। সংকলনটিতে রয়েছে দুটি গ্রন্থ, ১। আন্দামান। ভারতের শেষ ভূখণ্ড এবং ২। দানব ও দেবতা। আমার কাছে দুটো ভ্রমণকাহিনীই ভালো লেগেছে, তবে দ্বিতীয়টিকে একটু মেদবহুল বলে মনে হয়েছে। আক্ষেপের বিষয় আলোচিত কোন স্থানেই যাবার সুযোগ আমার ঘটেনি। বাংলাদেশের আর দশটা তরুণ পেশাজীবির মতোই আমার অর্থ এবং সময় দুটোরই ভীষণ টানাটানি। ভ্রমণের ক্ষেত্রে অর্থ একমাত্র শর্ত না হলেও অন্যতম তো বটেই। কাজেই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর জন্য ভ্রমণ কাহিনী পাঠ এবং মানস-ভ্রমণ, বিলকুল বিনে পয়সায়!
লেখকের সব ভ্রমণই কর্মসূত্রে অর্থাৎ পত্রকার হিসেবে। বইয়ের ভূমিকাতেই তিনি বলছেন, “অকারণে ভ্রমণ আমার ভাগ্যে ছিল না। ১৯৭৮ এ ভেসছি সাগরে। তারপর উড়েছি আকাশে। সবই কারণে। ভ্রমণের সঙ্গে মিশেছে- স্থান, কাল, পাত্র, ইতিহাস। তর্ক-বিতর্ক। ধারাবাহিক হয়েছে সংবাদপত্রে। অনেকটা জায়গা ও সময় জুড়ে বিস্তার। একত্রে অনেক রকমের অভিজ্ঞতা- লঘু ও গুরু।” অর্থাৎ গৌরচন্দ্রিকায়ই বোঝা যাচ্ছে যে, নিছক ভ্রমণকাহিনী এ নয়।
বইয়ের শুরুতেই অন্তঃসারশূণ্য আমলাতান্ত্রিক দাম্ভিকতার প্রতি লেখকের শ্লেষাত্মক বর্ণনার শেলবর্ষণ! কলমের খোঁচায় কেন্দ্র ও প্রাদেশিক দপ্তরগুলোর মধ্যে ল্যাং মারামারির ছবি। কিন্তু সব তিক্ত অভিজ্ঞতা নিমেষে উবে যায়, যখন লেখক আমাদের নিয়ে যান আন্দামানের স্বপ্নময় প্রকৃতি, আর বিদ্রোহ-বিষাদ-নির্যাতন-পুনরুজ্জীবনের ইতিহাসের রাজত্বে। আন্দামানের রাজধানী পোর্ট ব্লেয়ার পৌঁছে তিনি বলছেন, “পোর্ট ব্লেয়ার শব্দটার মধ্যে কেমন যেন একটা বারুদ-বারুদ, কামান-কামান গন্ধ আছে। অতীতে আমাদের সুদীর্ঘ দাসত্বের, উৎপীড়নের কলঙ্কে কলঙ্কিত পোর্টব্লেয়ার, অদৃশ্য একটি উৎপীড়ক মূর্তির মত অথই জলে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকবে ইতিহাসের শেষ দিন পর্যন্ত।” একটু একটু করে সঞ্জীবের কলম হয়ে ওঠে রেনোয়াঁর তুলি – ইম্প্রেশনিস্ট ছবির মত ফুটে ওঠে আন্দামানের রূপ- “ফেব্রুয়ারি-মার্চ। বছরের বাকি আট মাস আন্দামানের আকাশে মৌসুমি মেঘ। উদ্দাম বাতাস। নিশ্ছিদ্র বর্ষা। পৃথিবীর সর্বাধিক বর্ষণসিক্ত বনমণ্ডিত দ্বীপপুঞ্জ। নীল স্ফটিকের মত উজ্জ্বল আকাশ। নীচে পড়ে আছে রেকসিন সুটকেসের মতো ভাঁজ ভাঁজ মোলায়েম সমুদ্র।”
আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের জীবনযাত্রার সংক্ষিপ্ত অথচ প্রাঞ্জল বর্ণনা দিয়েছেন লেখক। সময়কাল ১৯৭৭। ব্রিটিশ শাসনামলে স্বাধীনতা-সংগ্রামের বিপ্লবী সৈনিকদের নির্বাসন দেয়া হত এই বিবিক্ত দ্বীপে। শুধু নির্বাসন দিলেই তো আর শাসকদের লোভ মিটত না। কাজেই এই নির্বাসিতদের দাসের মত খাটিয়ে তৈরি করা হল শহর, পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ মৎস্য-বিপণিকেন্দ্র, নারকেল তেলের প্রাচুর্যের ধারায় প্রবহমান মুনাফার স্ফীত স্রোতস্বিনী। উদয়াস্ত পাশবিক শ্রমের বিনিময়ে এই তরুণ অরুণদের জুটত চাবুক আর বুটের প্রাণঘাতী পদাঘাত। আর স্বাধীন বাংলায় আমরা স্বাধীনতাবিরোধী গো আজমকে পুষছি মুরগীর সুরুয়া, ডিমসেদ্ধ, মধু –ইত্যাদি লালাস্রাবী খাদ্য দিয়ে! সত্যিই সেলুকাস! কি বিচিত্র এই দেশ!
যাই হোক সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য এই দ্বীপপুঞ্জ দখলের প্রয়োজন হয়ে পড়ল। শুরু হল আদিবাসী জারোয়া আর ওঙ্গিজদের বিরুদ্ধে লোলুপ সভ্যতার আগ্নেয়াস্ত্রসজ্জিত বর্বরতা। ১৯২১ সালে নির্মূল হয়ে গেল কোল, ১৯৩১ এ হারিয়ে গেল জুগয়াই,বোজিগিয়াব, কেদে, টোবা, বালয়া ইত্যাদি জাতি। মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দীদের আন্দামানে জমি বরাদ্দ দিয়ে পুনর্বাসন করার ব্যবস্থা হল। এর মধ্যে ছিল নানা জাতের অপরাধীরা। বিপ্লবীদের অবশ্য মুক্তি জুটত না। ১৯০৮ সালের আলিপুর বোমা মামলার দায়ে দ্বীপান্তরিত হয়েছিলেন বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমচন্দ্র দাস, উল্লাসকর দত্ত, ইন্দুভুষণ রায়, হেম কানুনগো, শচীন সান্যাল, পুলিন দাস প্রমূখ। লেখকের মর্মবিদারী সত্যভাষণ, “সেদিন সেলুলার জেলে ইন্দুভূষণ রায় আত্মহত্যা করেছিলেন। উল্লাসকর উন্মাদ হয়ে মাদ্রাজের উন্মাদ আশ্রমে ফিরে এসেছিলেন। আজকে সারা দেশ জুড়েই তো উন্মাদ আর আত্মঘাতীর দল।”
পোর্ট ব্লেয়ারের হাওয়া ভেজা নীল রাতে, মৃদু আলোকিত নারকেল সারির ভেতর দিয়ে পথ করে নেওয়া প্রায় নির্জন পথে আমরা সঞ্জীব চাটু্য্যের সঙ্গে প্রকৃত জীবনের খোঁজ সাঙ্গ করে ভেসে যাই নিকোবরের উদ্দেশ্যে। নিকোবরের নামের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে থাকা বিশপ রিচার্ডসনকে লেখক স্মরণ করেছেন গভীর শ্রদ্ধায়। ছোট ছোট সরস বাক্যের মধ্য দিয়ে আমাদের চোখে ফুটে ওঠে নিকোবারিজদের জীবনযাত্রা, জীবিকার তাগিদে সেখানে বসবাসরত স্বেচ্ছাসেবী, নার্স, চিকিৎসক-শিক্ষকদের নিরাসক্ত-নির্লিপ্ত অথচ কর্মময় জীবন। ক্ষণে ক্ষণেই কলম হয়ে ওঠে তেল রঙের লম্বা হাতার ব্রাশ, বাক্য নয় ছোট্ট স্ট্রোক- “পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সমুদ্র-সৈকত নিকোবারেই। হালকা হলুদ রঙের মিহিদানা বালি। যেন রসে ফেলার আগে ভাজা মিহিদানা।...বালি তো নয় যেন কাচের দানা! ঝলমল করছে সূর্য। এত আলো, চোখ ছোট হয়ে আসে। এত হাওয়া মনে হয় বাকি জীবনের জন্যে সবটাই ফুসুফুসে হ্যাংলার মত ভরে রাখি। এক একবার ঢেউ ভাঙছে, পায়ের কাছে ছড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে বহু বর্ণের জ্যান্ত ঝিনুক, মরা খিনুকের খোলা। সাদা নিটোল কড়ি। মাছ ধরার জাল, হাওয়ার গোল ফানুসের মত উড়ছে বাঁশের মাথা থেকে।”
জীবনানন্দের কবিতাকে রবিঠাকুর বলেছেন চিত্ররূপময়। আমার কাছে সঞ্জীবের এই ভ্রমণকাহিনীটির গদ্যও চিত্ররূপময়, প্রকৃতির বুকে জীবনের এক মনোজ্ঞ আলেখ্য। এক ভাষাহীন পরাবাস্তবতার দোলাচলে হারিয়ে যাচ্ছি আমি, “রঙের সঙ্গে রঙ মিলিয়ে প্রবাল তৈরি করেছে বহু বর্ণের তটভূমি। সমুদ্র সেই ঠোঁটে চুমু খেতে খেতে দক্ষিণে চলেছে, চলেছে, পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বন্দর নানাকৌড়ির দুটি প্রবেশপথ পেরিয়ে, গ্রেট নিকোবারের খবর নিয়ে, পিগম্যালিয়ান পয়েন্ট দাঁড়িয়ে ভারতের শেষ ভূখণ্ডকে বিদায় জানিয়ে চলে গেছে নতুন স্থলভাগে নতুন সভ্যতা সংস্কৃতির বীজ বুনতে।”
(দ্বিতীয় পর্বে সমাপ্য)
নির্ঝর অলয়
মন্তব্য
দারুণ!
আন্দামান নিকোবরে যাওয়ার লোভ বহুদিনের। জানি না সুযোগ পাবো কি না।
এই বইটি পড়া হয়নি। পড়তে আগ্রহ থাকলো।
আন্দামান নিকোবরে বিপ্লবীদের দ্বীপান্তরে পাঠাতো বৃটিশ সরকার। আর দেশভাগের পর বাঙ্গালিদের পুনর্বাসনেও পাঠানো হয়েছিলো আন্দামানে।
এই পুনর্বাসন কাজ তদারকিতে যে বাঙালি করেছেন টানা দেড়যুগ, সেই ভদ্রলোকের নামটা ভুলে গেছি। তাঁর লেখা একটা বই আছে আন্দামানে পুনর্বাসন নিয়ে... 'আন্দামানে পুনর্বাসন, এক বাঙালির স্মৃতিকথা' নামে। ভ্রমণের না যদিও, আন্দামানের উপর আগ্রহ থাকলে পড়ে দেখতে পারেন।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
সুযোগের অপেক্ষা না করে সুযোগ বানিয়ে নিয়ে চলে যান। না হলে হবে না। আমারও খুব আগ্রহ ছিল এক সময় - প্রধানত সমুদ্র ভ্রমণের আশায়। আন্দামানে যাওয়ার সহজ পথ অবশ্য প্লেন, কিন্তু আমার কাছে অনেক বেশি আকর্ষনীয় মনে হয় এখানে জাহাজে যাওয়ার সুযোগটা। মূল ভূখণ্ড থেকে এত বিশাল দূরে না যে জাহাজে যেতে অনেক সময় বা দিন লাগবে, আবার এত কাছেও না যে সেণ্ট মার্টিন্সের মত সাগরের মাজেজা কিছু বুঝে উঠার আগেই চোখের নিমেষে পৌঁছে যাবেন। কোলকাতা আর সম্ভবত মাদ্রাজ থেকে জাহাজে যাওয়া যায় - মাসে ৪টা ট্রিপ আছে। কোলকাতা থেকে আন্দামানের রাজধাণী পোর্ট ব্লেয়ার ১২০০ নটিকাল মাইল দূরত্ব - জাহাজে ৪ বা ৩ দিন ৩ রাত সময় লাগে। সাধারণ ট্যুরিস্টের জন্য সম্ভবত আইডিয়াল ডিউরেশন। ডিসেম্বর-জানুয়ারি আইডিয়াল সিজন, সাগর শান্ত থাকে। পূর্ণিমার সময় হলে আরও দারুন - এসময় রাতের সাগরের দৃশ্য নাকি অপূর্ব।
বাংক থেকে ডিল্যুক্স কেবিন সবই নাকি আছে - বিদেশীরা বোধহয় বাংক-টাংক নিতে পারে না, ভাল কেবিনই নিতে হয়। ৮-১০০০০ টাকা লাগে মনে হয়। আর বিদেশীদের মনে হয় পার্মিট নেয়া লাগে যেতে, যেটা নাকি চাইলেই পাওয়া যায় এখন। তবে আন্দামানেই যাওয়া যাওয়া যায়, নিকোবর নিষিদ্ধ। চলে যান। ঘুরে এসে ছবিসহ একটা ভ্রমণ-পোস্ট দেন
****************************************
তথ্যের জন্য ধন্যবাদ। ইচ্ছে আছে... দেখা যাক
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের আরেকটা বই পড়েছি আমি- পালামৌ। অসাধারণ তার বর্ণনা
লেখাটা পড়ার জন্য ধন্যবাদ লীলেন ভাই।
'পালামৌ' অবশ্য এই সঞ্জীব চাটু্য্যের লেখা নয়, ওটা বঙ্কিমের অগ্রজ সঞ্জীব চাটুয্যের লেখা, বাংলা ভাষার প্রথম ভ্রমণ কাহিনী। ওটা নিয়ে আলোচনার ইচ্ছে আছে, রবিঠাকুর আগেই বিস্তৃত সমালোচনা করে গেছেন
বইটার। তারপর লেখার যোগ্যতা তো আমার নেই!
ইনি অন্যজন? হায় হায়
হ, দুজন ভিন্ন
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
হ্যাঁ, দুই বাংলায়-ই স্বাধীনতার জন্য যাঁরা নিজেদের উৎসর্গ করেছেন স্বাধীন দেশের আমরা তাদের ভুলতে পারার জন্য কিছুই করার বাকি রাখছি না। বাঙালি ছাড়া পৃথিবীর আর কোন জাতির এমন বৈশিষ্ট্য দেখা গেছে কি? একেক সময় মনে হয় আমাদের ঘৃণাও কীটদষ্ট!
আপনি তবু বইটা পড়েছেন, আমি আন্দামান বেড়াবার সুযোগ পাচ্ছি সঞ্জীবের লেখার উপর আপনার এই লেখা পড়ে। আপনার লেখার গুণে আমার অভিজ্ঞতাটা মোল্লা নাসিরুদ্দীনের গল্পের মাংসের সুরুয়া খাওয়ার মত হয়নি!
পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।
- একলহমা
আন্দামান আর নিকোবরের প্রতি একটা আকর্ষন ছিল বরাবরই - লেখাটা পড়ে তা আরো একটু বেড়ে গেলো।
কবেযে যেতে পারবো!
ইসরাত
আন্দামান যাবার মত সুযোগ এখন নেই, তবে বইটা পড়ে ফেলা অবশ্যকর্তব্য মনে হচ্ছে।
আপনার লেখাটাও খুব জীবন্ত হয়েছে
সব কৃতিত্ব সঞ্জীবের।
"পাষাণের ভাঙালে ঘুম কে তুমি সোনার ছোঁয়ায়"
ধন্যবাদ।
বাহ।। দাড় টেনে যাব আন্দামান !।
facebook
কততম বার? আমাকেও সাথে নেবেন, হাল ধরব!
পরের পর্বের জন্য অপেক্ষায় থাকলাম্
আব্দুল্লাহ এ এম
রিভিউ দারুণ লাগলো। আজিজে বেশ কয়েকদিন দেখেছি, এরপর গেলেই কিনে ফেলবো।
পরের পর্বের অপেক্ষায়
______________________________________
যুদ্ধ শেষ হয়নি, যুদ্ধ শেষ হয় না
ধন্যবাদ অডিন ভাই, রিভিউ এর আদ্ধেক ভাষা তো ধার করা! আমার আর কতটুকু। পরের অংশ বিশাল। মনে হয় সময় লাগে। এমন বিটকেলে পেশাগত জীবন।
আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ - কি রহস্যময় লাগে নামটি শুনতে।
আপনার হাত ধরে বেশ খানিকটা ঘুরে এলাম। আরো ঘোরার ইচ্ছে রইলো।
--------------------------------------
কামরুজ্জামান পলাশ
তবে সশরীরে ভ্রমণই বেশি আনন্দদায়ক- কী বলেন?
নতুন মন্তব্য করুন