ইয়াকুব স্যার বেঁচে আছেন, থাকবে

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৫/০৭/২০১৩ - ১১:৩৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বেশ ভালই দিন চলে যাচ্ছিল। সকালে ঘুম থেকে উঠে বাবাকে নিয়ে বাজারে যাই, বাবাকে চায়ের দোকানে বসায় রেখে আমার ঘুরাঘুরি শুরু হয়ে যায়। ৩০/৪০ মিনিট পর পর এসে দেখে যাই বাবা অন্য কোথাও যাবে কি না অথবা কোন কিছু লাগবে কি না? বেশ ভালই কাটছিল দিনগুলি। সময় ১৯৯৬, ক্লাশ এইটে উঠেছি। বলতে পারছি না যে আমি ক্লাশ এইটে পড়ি। পারিবারিক সমস্যা, বাবার অসুস্থতার জন্য ক্লাশ এইটে উঠে আমার পড়াশুনা স্থগিত। ঐ বছরের মাঝ পর্যন্ত কোন পড়াশুনা নাই। ছোট ছিলাম বলে পারিবারিক সমস্যাগুলো তেমন কোন প্রভাব বিস্তার করত না আমার মাঝে। বেশ ভালই কেটে যাচ্ছিল সময়।

বইগুলো ট্রাংকে তালাবদ্ধ করে বাবার সাথে পরামর্শ করে ঠিক করে ফেললাম, যেহেতু বছরের ৬/৭ মাস চলে গেছে, এই বছর আর পড়াশুনা করে লাভ নাই, সামনের বছর নতুন করে ক্লাশ এইট শুরু করব। বাবার সম্মতি পেয়ে আমার আনন্দ দেখে কে। তখনই আমার জীবনে ইয়াকুব স্যারের আগমন। একদিন আমি ও বাবা সহ রাস্তায় স্যারের সাথে দেখা, সেদিন ছিল স্যারের সাথে আমার প্রথম পরিচয়। জানলাম উনি বাবারও শিক্ষক ছিলেন, টুকটাক কিছু কথাবার্তার পরে যেটা দাড়াল, স্যার আমাকে স্যারের স্কুলে ঐ সময়েই পড়াশুনা শুরু করে দিতে বলল। স্যারের পুরনো ছাত্র বলে বাবাও তেমন কোন আপত্তি করল না। আমার মাথায় যেন বইয়ের ট্রাংক চেপে বসল। স্যার চলে যেতেই বাবাকে ধরলাম, তোমার সাথে না আমার কথা হল যে আমি আগামি বছরে শুরু করব? বাবার উত্তর, "স্যার যদি তোকে ঠিক-ঠাক গাইড করে এই বছরেই এইট পার করে দিতে পারে, তাহলে একটা বছর গ্যাপ দিয়ে কি লাভ"?

সেই প্রথম ইয়াকুব স্যারকে দেখা। ৭০'র কাছাকাছি বয়স, মুখে সাদা দাড়ি (একটু পর-পরই চিরুনি দিয়ে দাড়ি ঠিক করে), গোফ নাই, মাথায় পাকা চুল। চোখের ভ্রুগুলো কাঁচা-পাকা, কপালে নামাজ পড়ার দাগ। মাঝারি গড়নের শরীরে সাদা পান্জাবি-পায়জামা। দেখেই কেমন জানি মনে হয়, মনে হয় আপাদমস্তক একজন সুখি-মানুষ। তবে স্যারের যে ব্যাপারটা আমাকে অবাক করেছে তা হল স্যারের হারিকেন ঝুলানো বাই-সাইকেল (দিন-রাত কোন ব্যাপার না, হারিকেন থাকবেই)। সাইকেলে রডে বাধা একটা কাঠের ছাতা (স্যার সবসময় কাঠের ছাতা ব্যবহার করত, এর কারণ স্টিলের ছাতায় জং ধরে উনার সাদা পান্জাবি যেন নষ্ট না হয়)। পরবর্তিতে স্যারকে যতদিন দেখেছি, এই পোষাকের কোন পরিবর্তন হয় নাই, সাইকেল-হারিকেন-ছাতার ও না। ‌স্যারের বয়সটা শুনে একটু আশ্চর্য হয়েছিলাম, এই বয়সেও কি করে সাইকেল চালিয়ে প্রায় ৪/৫ কিমি যাওয়া আসা করত?

তো, আমিও কিছুক্ষন গাইগুই করে ভাবলাম, দেখি কি হয়। আমার প্ল‌্যান ছিল কোন মতে আর কিছুদিন ইয়াকুব স্যারকে ফাঁকি দিয়ে পার করে দেয়া। তাহলেই ২য় সাময়িক পরীক্ষা হয়ে যাবে আর স‌্যারও আমাকে ঘাটাবে না। কিন্তু কিসের কি? পরেরদিনই স্যার আমাকে খুজে বের করে তাগদা দেয়া শুরু করল আমি যেন স্যারের স্কুলে গিয়ে ভর্তি হয়ে যাই। স্যারকে বললাম যে আমি তো আগের স্কুল থেকে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট আনি নাই, আরও কিছু দিন সময় লাগবে ভর্তি হতে। স্যারের উত্তর, "তোর কিছুই লাগবে না, শুধু বই নিয়ে স্কুলে চলে আসিস"। এরও দুই/তিন পর স্কুলে গেলাম। স্কুলে গিয়ে যেটা বুঝলাম, স্কুলে শিক্ষকদের অধিকাংশই স্যারের প্রাক্তন ছাত্র। ট্রান্সফার সার্টিফিকেট ছাড়া ভর্টি হতে কোন সমস্যাই হল না।

সেই থেকেই স্যারের শিষ্যত্ব। প্রতিদিন স্কুল শেষে আসরের নামাজ পর্যন্ত স‌্যারের কাছে প্রাইভেট পড়া, এরই মাঝখানে স্কুল স্কাউটিং, স্কুলের মাঠ পরিস্কার করা। সন্ধ্যার পর আবার স্যারের প্রাইভেট (এই প্রাইভেট পড়ানোর জন্য স্যার আমাদের থেকে নির্ধারিত কোন ফি নিতেন না। যার যেমন সামর্থ্য ছিল, সে তেমনই দিত। কেউ না দিতে পারলেও কোন সমস্যা ছিল না)। স্যারের এই ম্যারাথন প্রাইভেট পড়ার মুল কথা ছিল যে, বাসায় যদি একা একা পড়া হয় না, তাছাড়া পড়ার মাঝখানে কোথাও আটকে গেলে স্যার যেন তা বুঝিয়ে দিতে পারেন। বিকেলে স্কুলে, রাতে স‌্যারের এক ছাত্রের বাসায় ব্যাচ করে আমাদের পড়া চলত। এই করে করে কিভাবে যেন ক্লাশ এইট ঐ বছরই পাশ করে ফেললাম, শুধু পাশ না - ক্লাশের মেধা তালিকাতেও নাম ছিল আমার। একই ভাবে, একই নিয়মে আরও দুই বছর পর মেট্রিকও পাশ করে ফেললাম।

এই আড়াইটা বছর ছিল আমার জীবনের খুবই গুরুত্বপুর্ণ একটা সময়। স্যার যদি ঐদিন বাবাকে বলে আমাকে স্কুলে না নিয়ে যেতেন, আমার জীবনের চ্যাপ্টারটাই হয়ত অন্য রকম হয়ে যেত। এই সময় টাতে বিভিন্নভাবে স্যার আমাকে এত কিছু শিখিয়েছে যা আজ পর্যন্ত আমার জীবনে খুবই গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। স্যারের একটাই কথা ঠিক-ঠাক খাওয়া-দাওয়া এবং কঠোর পরিশ্রম, এর কোন বিকল্প নাই। এখানে তো শুধু আমার একার কথা বললাম, আমার মত এমন শত-শত ছেলেকে স‌্যার গাইড করেছেন, জীবনের মানে শিখিয়েছেন, অনুপ্রেরণা দিয়েছেন যারা আজকে সমাজে খুবই ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত। স্যারকে উনার প্রাক্তন ছাত্রদের সাফল্যের কথা বলে খুবই গর্ব করতে দেখতাম, স্যারের চোখেমুখে যে সুখের ছায়া দেখতে পেতাম তার কোন মূল্য নাই।

স্যার গত হয়েছেন অনেক বছর। এর মধ্যে আমন একটা দিন নাই যে স্যারকে আমি মনে করি নাই। আজকে আমি একটা সৎ-সভ্য জীবন যাপন করতে পারছি তার সূচনা স্যারই করে দিয়েছিলেন। স্যার বেঁচে থাকুক আমার মত ছাত্রদের মনে, স্মৃতিতে। ইয়াকুব স্যারকে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা।

[স্যারকে নিয়ে অনেক মজার স্মৃতিও আছে। সেগুলো নিয়ে পরের বার লিখব আশা করি]

আমি জানি না


মন্তব্য

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

শ্রদ্ধা

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

আমি জানি না এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

রকিবুল ইসলাম কমল  এর ছবি

চলুক

আমি জানি না এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

বনজোছনা এর ছবি

স্যারকে শ্রদ্ধা ।

আমি জানি না এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

অতিথি লেখক এর ছবি

মন ভাল করে দেওয়া লেখা। প্রেরণা যোগানোর লেখা। খুব ভাল লাগল। আরো লেখার অপেক্ষায় থাকলাম।
- একলহমা

মর্ম এর ছবি

বলল> বললেন, দিত> দিতেন, থাকবে> থাকবেন- এ ধরণের কিছু ভুল চোখে পড়ল, শিরোনামটাতেই যেমন! শুদ্ধ করে নেবেন?

প্রথম লেখা হয়ত আপনার, সচলে স্বাগতম! আরো আরো লিখুন, পড়ার অপেক্ষায় রইলাম চলুক

~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...

আমি জানি না এর ছবি

ভুলগুলি ধরিয়ে (+ উৎসাহ ) দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। এটাই প্রথম লেখা না, কিন্তু প্রায় দুই বছর পরে লেখা।

আয়নামতি এর ছবি

স্যারের প্রতি শ্রদ্ধা। আপনার সৌভাগ্যকে অভিনন্দন।

আমি জানি না এর ছবি

আপনাকেও ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।

আমি জানি না

অতিথি লেখক এর ছবি

শ্রদ্ধা
ইসরাত

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।