আসলে মাছ মারা আর পাতাগোনিয়ার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সাথে কোনও সম্পর্কই নেই এই মুভির চিত্রনাট্যের! প্রধান চরিত্র মার্কো জীবনে মাছই ধরেনি কখনো। বন্ধুর কাছ থেকে ধার করে বড়শি নিয়ে এসেছে পাতাগোনিয়াতে। সেই পুঁটি মাছের বড়শি দিয়ে তো আর হাঙ্গর মাছ শিকার করা যাবেনা, তাহলে কি ভুল জায়গায় এসেছে মার্কো?
ভুল জায়গায় আসেনি সে, এখানেই ফিল্মের প্রথম টুইস্ট। এতদূর আসার একটাই উদ্দেশ্য, আনাকে খুঁজে বের করা। একমাত্র সন্তান আনা পাতাগোনিয়াতেই থাকে বলে শুনেছে মার্কো। মেয়ের সাথে দেখা হয়না অনেকদিন। সংসারটা ভেঙ্গে গেছে সে বহুদিন। মদ্যাসক্তি সারাটা জীবন পিছু ছাড়েনি বেচারার, স্ত্রী-কন্যা দুটোই হারিয়েছে সেই ভয়াল নেশার ছোবলে। একজন আদর্শ স্বামী বা পিতা হবার সুযোগটাও নষ্ট করেছে নেশার জালে জড়িয়ে। হালে কিছুটা স্বাভাবিক জীবনধারায় ফিরে এসেছে মদ্যাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে বহুদিন কাটিয়ে। আপ্রাণ চেষ্টা করছে মার্কো এলকোহল থেকে নিজেকে দূরে রাখতে। জীবনের ভুলগুলিও উপলব্ধি করতে শিখছে নিঃসঙ্গতার পীড়নে প্রতিনিয়ত দগ্ধ হয়ে। দেখতে বড্ড ইচ্ছে হচ্ছে একমাত্র সন্তান আনাকে।
লোকাল রেডিও স্টেশনের সহায়তায় মিলেও যায় মেয়ের জামাইয়ের দেখা। ছেলেটা নিজে থেকেই মার্কোর হোটেলে এসে নিজের পরিচয় দিয়ে(আমি আপনার মেয়ের বর) বলে চাইলে মার্কো মেয়ের সাথে দেখা করতে আসতে পারে তাদের বাড়ি যা আরও ১১০ কিলোমিটার দূরে। ভদ্রলোক পরেরদিন মেয়ের বাড়ি যেয়ে দেখে সে ততদিনে নানা হয়ে গেছে।
খুব সংবেদনশীল কিছু মুহূর্ত দেখতে পাই সিনেমার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে। মেয়ের শীতল চাহুনির সামনে অপ্রস্তুত এক পিতার চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেছেন আলেহান্দ্রো আওয়াদা(Alejandro Awada)। আপন মেয়ের কাছে প্রত্যাখ্যাত হলেও মনের কষ্টটা বুঝতে দেননি দর্শককে, শিশুসুলভ এক নিষ্পাপ হাসি লেগে থাকে সারাক্ষণ এক পুনর্জীবন প্রত্যাশী পিতার চোখে-ঠোটে। আমাদের প্রয়াত খ্যাতিমান অভিনেতা গোলাম মোস্তফার মতন মুখের বলিরেখার সংকোচন-প্রসারন আর চোখের দৃষ্টির গভীরতায় অভিনয়ে পটু সুদূর আর্জেন্টিনার এই দক্ষ অভিনয় শিল্পী। আমি স্তব্দ হয়ে উপভোগ করেছি মার্কো চরিত্রের এই অভিনেতার পারদর্শিতা। মুভিটা এক কথায় ভলিউম অফ করেও উপভোগ করা যাবে বলে মনে হয়।
পরিচালক কার্লোস সরিন কিপটে লোক হিসেবেই আর্জেন্টিনায় পরিচিত, অতি কম বাজেটে ভালো সিনেমা বানিয়েছে বেশ কিছু। দিয়াস দে পেসকা টিমে অভিনয় শিল্পী আর টেকনিকাল লোকজন মিলিয়ে সর্বমোট ১৪ জন মানুষ দিয়েই ফিল্ম বানিয়ে ছেড়েছেন। দুই জন বাদে বাকি সব ননপ্রফেশনাল অভিনেতা/অভিনেত্রী। সংলাপও অনেক কম এই মুভিতে, কিন্তু আছে নিস্তব্দতার প্রাধান্য। অভিনয় শিল্পীদের অভিব্যক্তি, পাতাগোনিয়ার সেই ঝড়ো হাওয়া আর কাঁদা মাটিতে থপ থপ করে ফেলা বুটের শব্দে অনেক না বলা কথা বলা হয়ে যায় অতি সহজেই। দুটো সংলাপের মাঝের বিরতি দর্শককে চিন্তার খোরাক যোগায়, সিনেমার ভাষায় কি একেই সাইলেন্স টেম্পো বলা হয়?
ফিল্মের আবহসংগীত নিয়ে কিছু কথা বলতেই হয়। সুরকারের নাম নিকোলাস সরিন, ছবির প্রযোজক-পরিচালক-এডিটর কার্লোস সাহেবের পুত্র। মন্দ লোকেরা হয়ত বলে বসবে ‘কিপটে লোক, পয়সা বাঁচাতে নিজের ছেলেকেই সুরকার বানিয়েছে!’ আমি আবহসঙ্গীতটি পোস্টে জুড়ে দিচ্ছি, বিচারের ভার পাঠকের। সিনেমায় ফাঁকে ফাঁকে এই অসাধারণ সুরলহমা বেজেছে পাতাগোনিয়ার দৃশ্যাবলী আর পুনর্জীবিত মার্কোর নতুন করে বাঁচার প্রয়াসের গল্পে।
Nicolas Sorin - Dias de Pesca.mp3
ফিল্মের দ্বিতীয় টুইস্ট আমি বলব না। আগ্রহী পাঠককে নিজে থেকেই খুঁজে বের করতে হবে গল্পের সমাপ্তি। চিত্রনাট্যের শেষ প্যারা পরিচালক সাহেব দর্শকের জন্য উন্মুক্ত রেখেছেন, গল্পের শূন্যস্থান পূরণ করতে হবে নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী। পাঠকের জন্য ট্রেলার জুড়ে দিলাম।
ট্রেলার, দিয়াস দে পেসকা এন পাতাগোনিয়া
.........জিপসি
(পাদটীকাঃ সহজ বাংলায় এই জাতিয় মুভিকে বলে ‘তারছিড়া’ সিনেমা। দিয়াস দে পেসকা দেখে মেজাজ খারাপ করে আমার কাছে পয়সা ফেরত চাওয়া যাবেনা। আমি গরিব মানুষ, বিফলে মূল্য ফেরত দেয়ার সামর্থ্য আমার নেই। তবে যাদের ভালো লাগবে তারা একাধিকবার দেখবে বলে আমার বিশ্বাস।)
মন্তব্য
দেখব, নাম শুনেই পছন্দ হয়ে গেছে, আর্জেন্টিনার সিনেমা ভালু পাই
facebook
আমিও আর্জেন্টিনার সিনেমা ভালু পাই, চাপে দুই নম্বর হইলেও চলচিত্র শিল্পে ল্যাটিন আমেরিকার সেরা!!!
.....জিপসি
ভীষণ ভাবে ইচ্ছে করছে দেখতে। নেটফ্লিক্স স্ট্রীমিং-এ পেলাম না। কি ভাবে দেখা যাবে এই মুভী?
- একলহমা
আমিতো টরেন্ট ফাইল খুঁজে পেয়েছি বেশ সহজেই..... পাইরেট বেতে একটু ঢু মেরে দেখুন.... না পেলে আমাকে জানাবেন
.....জিপসি
লিঙ্কটা এখানে দিবেন নাকি? খোঁজ দ্য সার্চের চেয়ে সহজ হোক
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
একটা লিঙ্ক পাইলাম, ডাউনলোড করে দেখন।
অলমিতি বিস্তারেণ
ভালো লাগলো। সিনেমাটা দেখি নাই, দেখার আগ্রহ জাগলো। দেখবো
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
আলো বন্ধ করে আবহসঙ্গীত টা শুনে কেমন জানি একটা বেদনা মিশ্রিত শান্তি অনুভূত হলো,গল্পের প্রথম পাঠটা খুব সাধারনি মনে হলো,তবে দ্বিতীয় পাঠ আর পরিচালকের গল্প অসমাপ্ত রাখার জন্যেই ছবিটা দেখতে হবে।কারন সাধারন মানুষের নিষিদ্ধ কিংবা অব্যক্ত বিষয়ের উপর মানুষের আকর্ষন বেশি,আমি সেই সাধারনের কাতারে।
মাসুদ সজীব
নিকোলাস সরিনের এই সাউন্ডট্রেক বেশ অনেক আগেই বনে গেছে আমার ফোনের রিংটোন!
আর্জেন্টিনার আরেক সুরকার গুস্তাভো সান্তাওল্লালা অনেক নামি শিল্পী, দা মটরসাইকেল ডাইরিস থেকে শুরু করে বলিউডের ধোবিঘাট ফিল্মেও অসামান্য মিউজিক করেছেন
.....জিপসি
রিভিউ পড়েই দেখবার ইচ্ছা হচ্ছে খুব। আপনার ফরজ ছিল এটার লিংক দেয়া খুঁজে এলাম সম্ভাব্য জায়গাতে, পাইনি
নীতিমালাবিরুদ্ধ হবে।
কিছুমিছুর একটা লিঙ্ক দিলাম। নীতিমালা ভাঙি নাই কিন্তু।
অলমিতি বিস্তারেণ
ছরি জান্তাম না তো!
.....জিপসি
লেখা ভালো লেগেছে। সিনেমাটা সম্পর্কে নেটে অল্পস্বল্প পড়লাম, আগ্রহ আরো বাড়লো।
সিনেমাটা ডাউনলোড করলাম, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সেই সোর্সে কোনো সাবটাইটেল নেই। স্যাম আঙ্কেলের দেশে থাকার কারণে টরেন্টের স্বর্ণালী দিন এখন অতীত। আপনি যেহেতু বলছেন, আপনার কাছে ইংরেজি সাবটাইটেল আছে, তাই প্রশ্ন এবং অনুরোধ হলো- যদি সাবটাইটেলটা হার্ডকোডেড না হয়ে, .srt কিংবা .sub এক্সটেনশনের আলাদা ফাইল হয়, সেটা কি আমাদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারবেন?
আর যদি হার্ডকোডেড সাব হয়, তবে অন্তত টরেন্টের লিঙ্কটা?
লেখার জন্য আবারো ধন্যবাদ। পছন্দের সিনেমা নিয়ে ভবিষ্যতে আরো লিখবেন বলে আশা করি।
অলমিতি বিস্তারেণ
সিনেমাটা দেখেছি কয়েক মাস আগে। হার্ডকোডেড সাবটাইটেল ছিল...... কিন্তু কোথা থেকে ডাউনলোড করেছি মনে পড়ছে না। আমি চেষ্টা চালিয়ে যাব আপনার জন্য .srt ফাইল খুঁজে পেতে। যদি মিলে যায় তবে সিরিজের পরবর্তী পোষ্টে জানিয়ে দিব।
ধর্মগ্রন্থে লিখা আছে ভালো করে খুঁজলে ঈশ্বরকেও পাওয়া যায়…… আমি মিরা নাইরের দ্যা পেরেজ ফ্যামিলি ইংরেজি ভার্শন খুঁজে পেতে ৩ বছর কাটিয়ে দিয়েছি……অবশেষে মিলেছে! এখন গত ৩ মাস ধরে খুঁজছি এর স্প্যানিশ সাবটাইটেল!
খুব ভালো হয় যদি আসছে সামারে স্প্যানিশ ভাষার একটা শর্ট কোর্স করে ফেলেন…… মুভি অফ দা উইক সিরিজের আগামী কিছু পর্বে স্প্যানিশভাষী কিছু সিনেমা দেখার আমন্ত্রণ থাকবে।
সবশেষে বলতেই হয় আপনার এই আগ্রহে আমি আনন্দিত। আশা করি সাথে থাকবেন।
……জিপসি
নতুন মন্তব্য করুন