এই বিষাক্ত জিনিসটা আমাকে আর ছাড়ল না, নাকি আমি একে ছাড়তে পারছি না? ৯/১০ বছর বয়সে হাতেখড়ি। ১৯৯০-১৯৯১'র সময়, তখন একে জানতাম বিড়ি নামে। আমাদের এলাকায় তখন নেত্রকোণার বিনোদ বিড়ির খুবই প্রচলন। দুই টাকার এক বান্ডেল বিড়ি (বিড়ির প্যাকেটটা দেখতে গোলাকার হওয়ার জন্যই মনে হয় সবাই প্যাকেটের পরিবর্তে বান্ডেল বলত), এক বান্ডেলে ২৫ কাঠি বিড়ি। একটাকায় ১২ কাঠি বিড়ি। সেই সময়ে এক টাকা ছিল আমার দিনের হাত খরচ। যে সময় থেকে বিড়ি খাওয়া শুরু করলাম, তখন টাকাটা পেলেই প্রথমে ২৫ পয়সার বিড়ি (৩ কাঠি) কিনতাম। বাকি ৭৫ পয়সা স্কুলে খরচ করতাম। বিড়ি খাওয়ার যায়গাটা ছিল আমার কাছে খুবই আকর্ষনীয়, আমাদের বাসার সামনেই। আমাদের বাসার সামনের দিকে এক মিনিট হেটে গেলেই একটা দো'তলা বিল্ডিং, সেই বিল্ডিং'র পাশে একটা বেশ বড় টিনের গুদাম ঘর, মাঝখানে একজন মানুষ হেটে যাওয়ার মতন যায়গা। এই ফাঁকা যায়গাটার একপাশের মুখ টিন দিয়ে আটকানো ছিল বলে বেশ অন্ধকার ছিল। কোনমতে একবার ঢুকে গেলে কেউ দেখে ফেলার কোন ভয় নাই।
সপ্তাহ খানেক এই চিপা যায়গাতেই বিড়ি ফুকতে থাকলাম। তখন আমার বাবাকে দেখতাম স্টার সিগারেট (এখন এই সিগারেট এখন আর পাওয়া যায় না, তখন ৭ টাকায় ১০ কাঠির নীল রঙের এক প্যাকেট স্টার সিগারেট পাওয়া যেত) খাইত। বাবাকে দেখে আমার মনেও স্টার সিগারেট খাওয়ার ইচ্ছা হল, মনে মনে ঠিক করলাম একদিন স্টার সিগারেট খাব। যেই ভাবা সেই কাজ, একদিন এক টাকা পেয়ে একটা স্টার সিগারেট এবং ৩ কাঠি বিনোদ বিড়ি কিনে চিপায় গিয়ে বসলাম। প্ল্যান ছিল একটা বিড়ি খেয়ে পরে সিগারেট খাব। বিড়িটা খাইতে খাইতে মাথায় আসল, স্টার একটা দামি সিগারেট, চিপায় বসে খাওয়ার কোন মানে হয় না। এটা খেতে হবে প্রকাশ্যে, সবাই যেমন রাস্তায় হেটে যেতে যেতে খায়। কিন্তু মুশকিল হল পরিচিত কেউ দেখে ফেললে বাসায় বলে দিবে, আর মা একবার জানতে পারলে আমার আর রক্ষা নাই। এইসব চিন্তা করতে করতে ঠিক করলাম, সিগারেট টা ধরিয়ে এইখান থেকে বের হয়ে এই এলাকা থেকে দুরে গিয়ে খেয়ে আসব।
প্ল্যান মোতাবেক বিড়িটা শেষ করে সিগারেটটা ধরিয়ে ঐ চিপা থেকে বের হতেই শুনলাম রাস্তার অপর পাশ থেকে কে যেন আমাকে ডাকছে। তাকিয়ে দেখি আমারই সমবয়সী এক বন্ধু তার বড় বোনের সাথে দাড়িয়ে আমার সিগারেট নিয়ে বের হওয়ার সাক্ষী হয়ে গেল। এর পর থেকেই আমার বন্ধু এবং তার বড় বোন আমাকে দেখলেই বাসায় মার কাছে বলে দিবে বলে ভয় দেখাত। আমিও ভয় পেয়ে এদেরকে এড়িয়ে চলি। বিড়ি-সিগারেট খাওয়ার দিন এইভাবেরই বেশ কয়েক সপ্তাহ চলল। একদিন কি জানি মনে করে এক টাকার ১২ টা বিড়ি একসাথে কিনে ফেললাম। ১২ টা এক সাথে কেনা যায়, খাওয়া যায় না। সারাদিনে ৪/৫ টা খেয়ে বাকিগুলো বিছানার তোষকের নিচে রেখে দিলাম। ঠিক সেদিনই মা বিছানা ঠিক করতে গিয়ে বিড়ি আবিস্কার করল। বাবা বাসায় আসলে বাবার থেকে জেনে নিশ্চিত হল, ঐ বিড়িগুলো বাবা বা বাবার কাছে যারা আসে তাদের কারো না। আমি এই ঘটনা আঁচ করতে পেরেই বাসা থেকে পালাই। ৯-১০ বছর বয়সে কাহাতক আর বাসার বাইরে থাকা যায়? ক্ষুধা-ক্লান্তি সহ্য করে ৩/৪ ঘন্টা বাইরে থেকে সন্ধ্যায় বাসার আশে পাসপাশে ঘুরাঘুরি করতে থাকলাম। সামনের বাসার এক পিচ্চি এসে বলে গেল, "দাদা বাসায় যায়েন না, গেলে আপনের খবর আছে"।
সেইদিন সন্ধ্যায় মায়ের হাতে যে মাইরটা খাইছিলাম, সেটা মনে হলে আজও ভয় পাই। মা'র সেই মাইর হোক আর অন্য কোন কারণেই হোক, পরবর্তী ১২ বছর কোন বিড়ি বা সিগারেট আর খাওয়া হয় নাই। এর পর ইউনিভার্সিটিতে আবারও সিগারেট খাওয়া শুরু। স্বাধীন আমি, ইউনিভার্সিটি এলাকাতে ঘুরে ঘুরে সিগারেট খাই, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে দিতে সিগারেট খাই, ইউনিভার্সিটির বড় ভাইদের সাথে সিগারেট খাই, রুমমেটদের সাথে সিগারেট খাই। আহ্ কি স্বাধিনতা। এত স্বাধিনতার মাঝেও মায়ের মাইরের কথা প্রায়ই মনে হত, পরক্ষণেই তা ভুলেও যেতাম। এক বন্ধু কাম বড় ভাই শিখাইল কিভাবে চা'র সাথে সিগারটে খেতে হয়। আমিও আবিস্কার করলাম, আসলেই চায়ের সাথে সিগারেট খাইলে অন্য রকম এক স্বাদ, অন্য রকম একটা ভাব। আমার রুমমেট আর আমি প্রায়ই শেয়ার করে সিগারেট কিনতাম। দুই টাকার গোল্ডলিফ কেনার জন্য সে যখনই এক টাকার কয়েন বের করত, আমাকে বলতে হত না। আমিও নিজ থেকেই কয়েন বের করে রেডি।
বিনোদ বিড়ি দিয়ে শুরু, গোল্ডলিফ দিয়ে ইউনিভার্সিটি লাইফ, চাকরিতে ঢুকে বেনসন এন্ড হেজেস। এখন আছি মার্লবোরোতে। বিড়ি/সিগারেট খাওয়া, এককথায় ধুমপানের কোন সুফল নাই। এর শুধু কুফল আর কুফল, অর্থনীতি থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য, সব খাতেই এটা ক্ষতিকর। এর মাঝে অনেকবার ছেড়ে দেয়ার চেষ্টা করেছি। নিকোটিন গাম, প্যাঁচ অনেক কিছুই চেষ্টা করেছি। কোন ভাবেই এই ক্যান্সার স্টিক (আমার বস সিগারেটকে এই নামেই ডাকে) আমাকে ছাড়ে না। তার মানে আমি আসক্ত। এই আসক্তি থেকে বের হয়ে আসতে চাই। বিশ্বাস করেন, অনেক কঠিন এই আসক্তি থেকে বের হয়ে আসা। যাদের এখনো ধুমপানে হাতেখড়ি হয় নাই তাদের বলব, ভুলেও কোনদিন এই কাজ করবেন না। এটা একটা ইন্দ্রজাল, দুর থেকেই দেখতে ভাল লাগে। একবার ঢুকে গেলে কোনমতেই বের হতে পারবেন না। আর যারা ধুমপান ছেড়ে দিয়েছেন, তাদের স্যালুট। আমি এখনও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, আশা করি একদিন পারবো। মাঝে মাঝে খুব মনে হয়, মা যদি একবার এসে সেইদিনের মত একচোট মাইর দিয়ে যেত, আমি সিগারেট খাওয়াটা ছেড়ে দিতে পারতাম।
বি দ্র: কোনভাবেই বাচ্চাদের সামনে ধুমপান করবেন না, অনুরোধ রইল।
আমি জানি না।
মন্তব্য
ক্যান্সার হাসপাতাল ঘুরে আসুন। উপর, উপর নয়, ঘনিষ্ঠভাবে দেখে আসুন। আর তার পর লিখে ফেলুন যা দেখলেন - আমাদের কাউকে দেখানোর জন্য নয়। নিজে দেখার জন্য, বারে বারে। কোন বড় কাজ সহজে হয় না। আর সিগারেট ছেড়ে দেওয়াটা তো একটা মহৎ কাজ! শুধু ভাবলে হবে বস্? খচ্চা আছে! তকলিফ হবে, তবে, মোটেও অসম্ভব নয় কিন্তু।
- একলহমা
হুমমমম, খচ্চা যে আছে, তা ভাল করেই জানি। ধন্যবাদ।
সহমত।
কোন ভাবেই সিগারেট ধরতে পারলাম না আজ পর্যন্ত। তা সে বন্ধু বান্ধবদের চাপাচাপিতেই হোক আর লাইফের বিভিন্ন ক্রাইসিসের মুহূর্তেই হোক।
তবে বন্ধুবান্ধব রা প্রায় সবাই খাওয়ার কারণে আড্ডার সময় সেকেন্ডারী ভাবে খাওয়া হয়ে যায়।
খুবই ভালো কাজ করছেন না ধরে, আমি এখন পস্তাইতেছি। ধুমপান মুক্ত সুস্থ্য জীবন যাপন করুন। ধন্যবাদ।
সিগারেট ছেড়ে দেয়া খুব সহজ। আমি প্রতিদিন চার-পাঁচবার সিগারেট ছাড়ি।
--- মার্ক টুয়েন
---------
মিলন
স্বাধীনতা বানানটা খুব চোখে লাগলো। কিছু জায়গায় ভাষার ধরারবাহিকতা মনে হয় ব্যাহত হয়েছে। লেখা চলুক
স্বয়ম
ধন্যবাদ। নতুন লিখি, ভুল গুলি ধরিয়ে দিলেন বলে
নতুন মন্তব্য করুন