বাংলা অনুবাদে ‘বন্দরের বাজার’ বললেই তো মনটা উল্লসিত হয়ে ঊঠে। নদীমাতৃক বাংলাদেশের অনেক নৌবন্দরে ভুরিভোজের আনন্দময় অভিজ্ঞতা আছে। গোয়ালন্দ ঘাটের সেই ঝুপড়ি হোটেলে মধ্যরাতে ইলিশ মাছের ঝোলে মাখা মোটা চালের ভাত আর মাওয়া ঘাটের টমেটো মেশানো কাতল মাছের পেটি খাওয়ার সুখস্মৃতি দুই দশক পেরিয়ে গেলেও তো ভুলতে পারিনি আজও। মাছেভাতে এক বাঙালির জন্মভুমি থেকে সাত সমুদ্র আর তের নদী পেরিয়ে সুদূর মন্তেভিদেওতে গ্রীষ্মের এক মধ্যাহ্নভোজের অভিজ্ঞতা নিয়েই আজকের এই আয়োজন।
Mercado del Puerto মানে পোর্ট মার্কেট। অবস্থান একেবারে উরুগুয়ের রাজধানী মন্তেভিদেওর নৌবন্দরের মূল ফটকের উল্টোদিকে। কলোনিয়াল স্থাপত্যশৈলীর এই ভবনটি স্প্যানিশরা প্রায় দুই শতক আগে বানিয়েছিল প্রাতাহিক বাজার হিসেবেই। মাছ, মাংস, ফল, সবজি সবই কেনাবাচা হত সেইসময়। কালের বিবর্তনে এই ভবন আজ রূপান্তরিত হয়েছে নিরামিষীদের নরকে! ১০০% মেছো বাঙ্গালীও খুব একটা সুবিধা করতে পারবে না এখানে গিয়ে! এই দুই শ্রেণীর বাইরে যারা আছে তারা সাদরে আমন্ত্রিত সপ্তাহের প্রতিটি দিন মধ্যাহ্নভোজের স্বর্গীয় সুখের অন্বেষণে!
উরুগুয়ের মানুষের গোমাংস প্রীতি নিয়ে কিছুমিছু লিখেছিলাম অতীতে। বছরে গড়ে ৪৭ কিলো মাংস ভক্ষণকারীরা গরুর শিং আর চামড়া ছাড়া বাকি সবটাই তপ্ত আগুনের ওই গ্রিলে বসিয়ে দেয়। মন্তেভিদেওতে ঘুরতে গিয়ে সেই গ্রিলফুড ভক্ষণের সবচেয়ে উত্তম স্থান মেরকাদো দেল পুয়ের্তো। গোটা বিশেক স্থায়ী খাবারের দোকান নিয়েই এই পোর্ট মার্কেট। সবার মেন্যু ঘুরে ফিরে ওই একই, আগুনে ঝলসানো মাংস যেটাকে ওরা বলে আসাদো(ASADO)। গ্রিলের সাইজটা অবশ্য অনেক বড় যার নাম পারিশা(Parilla)।
মন্তেভিদেও ঘুরবার সবচেয়ে উত্তম মাধ্যম টুরিস্টবাস। একেক এজেন্সি একেক রুটে টুরিস্ট নিয়ে ঘোরাঘুরি করে ঘড়ির কাঁটা বারোটা বাজার আগেই মেরকাদো দেল পুয়ের্তোর সামনে এসে ট্যুর শেষ করে। রাস্তা দেখিয়ে দিতে হবেনা, অন্ধ টুরিস্টও ওই এসি বাস থেকে নেমে পোড়া মাংসের গন্ধ শুঁকে ঠিক পৌঁছে যাবে উঁচু এই কাঠের পিঁড়িতে।
ছবি: গুগল
রেস্তোরাঁর বাবুর্চি কাম ওয়েটারদের আন্তরিকতা আর বন্ধুত্বসুলভ ব্যবহারে পরিবেশটা একদম আপন মনে হবে পর্যটকদের। আমাকে তো হাত ধরে টেনে নিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়েছে এদের আসাদো রন্ধনশৈলীর খুঁটিনাটি। ইংরেজিটাও দেখি ভালই রপ্ত করেছে দোকানদারেরা। বছরে ৩ মিলিয়ন টুরিস্ট আসে ৩৩ লাখ মানুষের এই দেশে, ভাষাজ্ঞানটা এদের কাজে লাগে মেরকাদো দেল পুয়ের্তোর মতন টুরিস্ট স্পটগুলিতে। বুয়েনেস আইরেস থেকে ফেরীতে চেপে দলবেঁধে তরুণ-তরুণীরা মাংস চিবুতে এসে পড়ে ছুটির দিনগুলিতে। আর্জেন্টিনার নাগরিকদের অত পাসপোর্ট ভিসার ঝামেলা পোহাতে হয়না।
গমগম করে উঠে দুপুর ১২টা থেকে ৩টা পর্যন্ত পুরো পরিবেশটা নানা বর্ণের, হরেক পেশার মানুষের কোলাহলে। এযেন মাংস-ভক্ষণকারীদের ডিজনিল্যান্ড! পানাহারের টেবিলে বসেই রাস্তার ওপাশে দেখা যায় বন্দরে ভীরে আছে পর্যটকবাহী কোনও ক্রুজশিপ, ভারী ক্রেনে উঠানামা হচ্ছে মালবাহী কন্টেইনার। স্মৃতিরপটে ভেসে আসে শৈশবে দেখা ঢাকার ব্যস্ত সদরঘাটের ছবি।
ছবি: গুগল
মন্তেভিদেওবাসিরা একটা নির্দিষ্ট বিরতিতে পেটপূজায় হাজির হয় এখানে। রবিবারদিন এরা বাসায় আসাদো বানাতেই পছন্দ করে। হোমমেইড আসাদো পরিবারের সবাইকে নিয়ে খাওয়ার যে আনন্দ আর মেরকাদো দেল পুয়ের্তোর পিঁড়িতে বসে উপভোগের যে প্রশান্তি তাঁর দুটোই আমি পেয়েছি। লোকাল মানুষদের সাথে এক লাইনে বসে মেদিও মেদিও(Medio Medio) নামের সেই পানীয়ের সাথে ঝলসানো গোমাংসের বিভিন্ন অংশ, ব্লাড সসেজ, সাথে মুরগি মাংসের কিছু আইটেম ভক্ষণে ব্যায়িত দুটি ঘণ্টা ছিল স্বর্গীয় সুখের অনুভুতি। তৈলাক্ত মাংসের টুকরো মাখিয়েছি পুদিনা পাতা আর রসূনের চাটনিতে আর স্মৃতির পাতায় উঁকি দিয়েছে ঢাকার সন্ধ্যায় ফুটপাথের সেই খালাম্মাদের বানানো ভাপাপিঠা আর শুঁটকির চাটনি খাওয়ার সুখস্মৃতি।
হোমমেইড আসাদো
পেটানো লোহার ছাদে ঢাকা এই বাজারে ঠুনকো আভিজাত্যের বালাই নেই। খাদ্যের স্বাদটাই বড় ব্যাপার, থালাটা সোনার না রূপার সেই ধার কেউ ধারেনা। গরম কয়লার উপরে কড়াই ভর্তি মাংস উদরপূর্তি না হয়া পর্যন্ত আসতেই থাকবে। ফিক্সড রেট, যত পারেন তত খাবেন!
(পাদটীকা: খুব ইচ্ছে ছিল ফিরতি ফ্লাইট ধরার আগে আবার যাব মেরকাদো দেল পুয়ের্তো। ঠিক করেছিলাম এবার যাব আমার জানা উরুগুয়ে নিবাসী একমাত্র বঙ্গসন্তানকে সাথে নিয়ে। ওখানে যে কোনও দেশীভাই থাকে তা উরুগুয়ে যাত্রার পূর্বে ভাবিনি। উরুগুয়েতে বাংলাদেশের কনসাল জেনেরাল হিসেবে যিনি আছেন তিনিই সৌজন্য
সাক্ষাতের সময় হাতে ধরিয়ে দেন সেই ভদ্রলোকের মোবাইল নাম্বার।
কাগজটা সাথেসাথে ফেলে দিলেই ভাল হতো, টুরিস্ট হিসেবে উরুগুয়ে ভ্রমনে অসৌজন্যতার একমাত্র উদাহারন হিসেবে কোনও বঙ্গসন্তান আবির্ভূত হতেন না।
সে আরেক গল্প……হবে অন্যদিন।)
……জিপসি
মন্তব্য
বাহ,
ঘুরে এলাম এরপর গন্তব্য কোথায়?
প্রথম প্যারা পড়ে মাওয়া ঘাটে রাত্রি দ্বিপ্রহরের তরতাজা সডিম্ব ইলিশ ভাজার কথা মনে পড়ে গেল...
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
কতদিন হয়ে গেলো তাজা ইলিশের ডিম ভাজা খাইনা ..... প্রবাসজীবনে একবার ফ্রোজেন ইলিশের ডিম ট্রাই করেছিলাম..... খেতে কটকটির মত লেগেছিল
.....জিপসি
যাবেন নাকি সী-লায়োনের দ্বীপে? তাহলে সাথে থাকুন..... সেখানে অবশ্য খানাপিনার আয়োজন নেই!
......জিপসি
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
"গরম কয়লার উপরে কড়াই ভর্তি মাংস উদরপূর্তি না হয়া পর্যন্ত আসতেই থাকবে। ফিক্সড রেট, যত পারেন তত খাবেন!"
- উরি, উরি! এই হচ্ছে খাওয়ার আসল সুখ!
দারুন লাগল পড়তে, পুরাই জিপসি-জিপসি। আর সবশেষের ছবিটা তো এক্কেবারে উলুস-ঝুলুস!
- একলহমা
ছবির কড়াই খালি করতে বেশি সময় নেইনি..... পরের কড়াইটা অবশ্য শেষ করতে পারিনি..... আফসুস!
......জিপসি
আফসুস! আফসুস!
- একলহমা
ভাপাপিঠা না, আসলে চিতইপিঠা দিয়ে মাখিয়ে খেতাম সেই শুটকির চাটনি ! ঢাকার সন্ধেবেলায় অবশ্য ভাপাপিঠাও বানাতো সেই খালাম্মারা !
......জিপসি
বাহ, বেশ লাগল! সে দিন উরুগুয়ের দুই ছেলে এসেছিল ফিনল্যান্ডে, ফ্রেন্ডলি পোলাপান। পরের বার আর মিস দিব না।
লেখা চলুক
facebook
আজাইরা ফুটানি দেখায় না এরা..... স্বাক্ষরতার হার প্রায় শতভাগ! দক্ষিন আমেরিকার প্রেক্ষাপটে জীবনধারার সুচক উরুগুয়েতে অনেক ভালো
.......জিপসি
ঘুরে এলাম, বর্ননা চমৎকার কিন্তু ছবিগুলো দেখে ক্ষিধে পেয়ে গেছে
-আরাফ করিম
ঈদের দিনে তো এভাবে খিদে লাগার কথা না .... পরেরবার ভরপেট বিরিয়ানি খেয়ে তারপর সচলায়তনে লগইন করবেন!!
......জিপসি
আপনি তো মানুষটা খুব খারাপ! এতোসব গোমাংশের খাবারের ছবি দেখে লোভ সামলানো খুবই মুস্কিল ব্যাপার! কবে যে যাবো উরুগুয়েতে, আর কবে যে জিহবার স্বাদ ভঞ্জন করবো!
ঈদ কেমন কাটালনে? ভালো থাকুন খুব, খুব, খুব।
-এস এম নিয়াজ মাওলা
পাবলিক সেন্টিমেন্টের কথা ভেবেই তো রমজান মাসে এই লেখা ছাপিনি..... আর পকেটে মালকড়ি থাকলে সামনে বছর বিশ্বকাপ ফুটবল দেখতে ব্রাজিলে আসুন, সাথে উরুগুয়েটাও ঘোরা হয়ে যাবে!
.....জিপসি
চেষ্টা করে দেখবো, অবশ্যই।
-এস এম নিয়াজ মাওলা
মনে রাখবেন এই মার্কেটে শুধুমাত্র মধ্যান্নভোজ হয়! ডিনারে চিভিতো(উরুগুয়ের জাতীয় খাদ্য) খেতে যাবেন সমুদ্রের তীরে!
.....জিপসি
অনেকের নাকি মদ, টাকা আর মেয়ে দেখলে মাথা ঠিক থাকে না! আমার ঐরকম ফিলিংস হচ্ছে এইসব মাংসের আইটেম দেখে! গরুর মাংস এমনিতেই আমার মতে পৃথীবির শ্রেষ্ঠ মাংস। আর সাউথ আমেরিকার মাংস মানে আরেককাঠি সরেস। দেখি আল্লাহ কপালে রাখলে হবে। (কঠিন দীর্ঘশ্বাসের ইমো হবে)! বাই দ্য ওয়ে, ঐ বুফের দাম কতো পড়েছিলো বলবেন কি প্লিজ?
গরুর মাংস দুনিয়ার সেরা মাংস এই বিষয়ে কোনো মতভেদ নেই..... বিল কত পেসো হয়েছিলো ঠিক মনে নেই..... দেড় কড়াই গোমাংস খেয়ে আমারও মাথা আউলাঝাউলা হইয়া গেছিলো!
.....জিপসি
দারুন , কত রকমের আইটেম ইস দেখেই লোভ লাগে , তবে এবার আর গতবারের মত ভুল করিনি, খালি পেটে লেখা পড়ে গতবার খুবই কষ্ট পেয়েছিলাম তাই এবার ট্যাগএ রান্নাবান্না দেখে পিতজা খেতে খেতে লেখা পড়লাম
ইসরাত
.....জিপসি
নতুন মন্তব্য করুন