দিপু যেনো বিশ্বাসই করতে পারছিলো না! আজ এই পরিস্থিতিতে সে সন্ধ্যাকে দেখবে কখনো চিন্তাই করেনি। সন্ধ্যাও দিপুকে দেখে চমকে উঠলো। মুহূর্তটা ফ্রিজ হয়ে থাকলো কিছুক্ষন। দিপুই প্রথম প্রকৃতিস্থ হলো। সন্ধাকে এড়িয়ে ইমার্জেন্সী মেডিকেল অফিসারকে জিজ্ঞেস করলো রোগীর আত্নীয় স্বজন কেউ আছে কি না।
“আমিই রোগীর স্ত্রী,” সামনে এগিয়ে এসে স্বাভাবিক কন্ঠেই বললো সন্ধ্যা। দিপুর কাছে মনে হলো কন্ঠটা কী একটু কেঁপে উঠলো! সেই পরিচিত কন্ঠস্বর! বহুদিনের পরিচিত! “প্রায় দুই ঘন্টা আগে কথা কথা বলতে বলতেই হঠাৎ করে খিচুনী শুরু হয়। এক দুই মিনিটের মতো ছিলো, এরপর বমি করলো,” জানালো সন্ধ্যা।
দিপু রোগীর দিকে তাকালো। বয়সে ওর থেকে কিছুটা বড়ই হবে। দেখতেও সুদর্শন, মায়া মায়া লাগে। পুরুষদের চেহারায় মায়া মায়া ভাবটা মনে হয় থাকা উচিত নয়, সেখানে থাকবে কিছুটা রুক্ষতা! দিপু সেটাই ভাবে। দ্রুত শারীরিক পরীক্ষা করে দেখলো, শরীরের বাম দিক কিছুটা দুর্বল, কথা অবশ্য পরিষ্কার। এই মুহূর্তে সম্পূর্ণ সজ্ঞানও বটে। দিপু ওর প্রফেসরের সাথে ফোনে কথা বলে এমআরআই ব্রেন করার উপদেশ দিলো।
জায়েদ, সন্ধ্যার স্বামীকে কিছুক্ষনের মধ্যেই এমআরআই রুমে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। কম্পিউটার স্ক্রীনের সামনে বসে রইলো দিপু। পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা সন্ধ্যাকে নিয়ে তখন দিপুর ভিতরে উথাল পাথাল অবস্থা! ফিরে গেলো যেনো দশ বছর আগের দিনে।
মেডিকেলের প্রথম দিনেই ওদের পরিচয়। প্রতিদিন আড্ডা। তারপর একদিন সন্ধ্যাই ওকে বলেছিলো। এক বিকেলে ফোন করে সন্ধ্যা বললো, “আজ আমি একটা কথা বলবো। বলা শেষ হলেই ফোন রেখে দিবো। তোমাকে কিছু বলতে হবে না! তুমি সেদিন হিমুর হাতে কয়েকটি নীল পদ্ম বইটি পড়েছ। সেখানে একটা থিওরী আছে। একজন মানুষের হাতে পাঁচটি নীল পদ্ম থাকে। কেউ যদি এই পাঁচটি নীল পদ্ম একবারেই কাউকে দিয়ে দেয়, তাহলে সে কখনোই তাকে ভুলতে পারে না! আমার হাতে এখন একটিও নীল পদ্ম নেই, সব একসাথে দিয়ে দিয়েছি!” এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলেই সন্ধ্যা ওপাশ থেকে লাইন কেটে দিলো। দিপু হতভম্বের মতো চিন্তা করতে লাগলো সন্ধ্যাতো আগে কখনো ওকে তুমি করে বলতো না!
পরের দিন যখন ক্লাসরুমে দেখা, এক ফাঁকে সন্ধ্যা বিব্রতবোধ করে জানতে চাইলো দিপু কী চিন্তা করছে। দিপু হেসে বলেছিলো, “তুই যে নীল পদ্মগুলো আমাকেই দিয়েছিস, সেটা কিন্তু বলিস নি! কিন্তু আমি নিয়ে নিলাম। আর একটা ব্যাপার, আমি কখনই তোকে তুমি বলতে পারবো না”। সেই থেকে শুরু দুজনার একসাথে পথ চলা।
কম্পিউটার স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে নিরবতা ভাঙ্গলো দিপুই, “কেমন আছো তুমি?” সন্ধাও তাকিয়ে আছে স্ক্রীনের দিকে, সেখানে ধীরে ধীরে জায়েদের ব্রেনের ভিতরের ছবি ভেসে উঠছে। সেদিকে তাকিয়েই উৎকন্ঠিত স্বরে সন্ধ্যা জানালো, “ভালো। তুমি কিন্তু আমায় আজ তুমি বললে!” হেসে উঠতে গিয়েও থেমে গেলো দিপু। দৃষ্টি তখন স্ক্রীনে আটকে গেছে। সন্ধ্যাও ডাক্তার, ব্রেনের একটি অংশ দেখিয়ে উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চাইলো, “এটা কি?”
দিপুর সময় যেনো থমকে গেছে। কোনো উত্তর দিতে পারছে না! মনে হলো বহুকাল পর যেনো বলে উঠলো, “মনে হচ্ছে কোনো বস্তু সেখানে দলা পেকে আছে!” টেকনিশিয়ানকে রঞ্জক পদার্থ দিয়ে প্রতিতুলনা করতে বললো দিপু। সন্ধ্যার বুঝতে আর বাকী রইলো না!
***********
দিপু অপারেশন থিয়েটারে ডাক্তারদের জন্য বিশ্রাম কক্ষে চুপচাপ বসে আছে। শূন্য দৃষ্টিতে দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে। টিক টিক করে সময় বয়ে যাচ্ছে, দিপুর যেনো কোনো সময় যাচ্ছে না। দিপু সন্ধ্যাকে খুব ভালোবাসতো। ওর এখনো স্পষ্ট মনে আছে, মধুমিতা সিনেমা হলে যখন সন্ধ্যার সাথে টাইটানিক দেখছিলো, ওদের দুটো হাত পরস্পরের সাথে লেগে ছিলো। মনে হচ্ছিলো এ বাঁধন কখনো ছিন্ন হবে না। দিপুর প্রতি সন্ধ্যার ভালোবাসার প্রকাশটা ছিলো উচ্ছ্বল, দিপু সেভাবে প্রকাশ করতে পারতো না। এই প্রকাশ না করাটাই যেনো কাল হলো! একদিন পড়ন্ত বিকেলে রমনা উদ্যানের এক প্রান্তে বসে সন্ধ্যা হঠাৎ করে বলে উঠলো, “তুমি বোধহয় আমাকে খুব একটা ভালোবাসো না”। সেদিন কিছু বলতে পারে নি দিপু। ওর কাছে মনে হয়েছে ভালোবাসাটা দেখানোর কোনো বিষয় নয়, এটা একান্ত মনের ব্যাপার। সেইদিন থেকে যে কী হলো! মেডিকেলের চৌহদ্দি পেরোনোর আগেই দিপু আবিষ্কার করলো, ওদের মধ্যে সম্পর্কের উষ্ণতা সেই আগের মতো নেই। অথচ কোনো মনোমালিন্য, কোনো সমস্যা কোনোকিছুই ছিলো না। তারপর একদিন দিপু দেখলো সন্ধ্যা আর সন্ধ্যা তারা হয়ে ও জীবনের আকাশে উঠবে না।
জায়েদের ব্রেন টিউমার হয়েছিলো। ডায়াগনোসিস চূড়ান্ত করার জন্য ওরা অপারেশন করতে চাইলো, যদিও এমআরআই দেখেই মনে হয়েছিলো খুব খারাপ ধরনের টিউমার। দিপুই সন্ধ্যাকে বলেছিলো অপারেশনের আগে যদি জায়েদের কোন কাজ থেকে থাকে, যেসব জায়গায় ওর স্বাক্ষর লাগতে পারে, সেগুলো যাতে করে ফেলে। এবারো দিপুর কথা সন্ধ্যার বুঝতে কষ্ট হয় নি! ওদের একটা ছোট মেয়ে আছে, তিন বছর বয়স হবে। জায়েদকে যখন অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে আসছিলো, দিপু তাকিয়ে ছিলো মেয়েটির চোখের দিকে- কী অদ্ভুত মায়াবী চোখ! মেয়েটি মায়ের চোখ পেয়েছে।
অপারেশনটা খুব জটিল ছিলো। ব্রেনের এমন জায়গায় টিউমারটা ছিলো- জায়গাটা ছিলো রক্তনালীতে পরিপূর্ণ। ওদের উদ্দেশ্যই ছিলো বায়োপসির জন্য যতটুকু দরকার, ঠিক ততটুকুই নিয়ে আসা। একবার ওর প্রফেসর দিপুকে বলেছিলো, ওর কোনো সমস্যা হলে না আসতে। দিপু রাজী হয় নি। অকম্পিত হস্তে মাথার খুলি কেটে যখন ব্রেনে প্রবেশ করলো, অবস্থা ধারণার চেয়েও খারাপ দেখলো । তারপর হঠাৎ করেই এক রক্তনালী কেটে রক্তপাত শুরু হলো......।
পারে নি, দিপু পারে নি জায়েদকে বাঁচাতে। ওর পাঁচ বছরের নিউরোসার্জারীর ক্যারিয়ারে এই প্রথম কোনো রোগী অপারেশনের টেবিলেই মারা গেলো, তাও আবার জায়েদ, সন্ধ্যার স্বামী। ওর প্রফেসর মাথাটা সেলাই করছে এখন, দিপু ওটি থেকে অফ হয়ে এসে একাকী বসে আছে বিশ্রাম কক্ষে। ওর প্রফেসর বললো, দিপু সন্ধ্যাকে জানে, তাই দিপুই খবরটা সন্ধ্যাকে জানাক।
*********
অপারেশন থিয়েটারের বাইরে সন্ধ্যা আর ওর মেয়েটা অপেক্ষা করছে। দিপু সমস্ত দ্বিধা দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ওদের সামনে এসে দাঁড়ালো। বাচ্চা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে দেখলো আনমনে হাসপাতালের রেলিং ধরে খেলা করছে। সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে দেখলো, সেই চোখে একসাথে খেলা করছে আশা আর উদ্বিগ্নতা। সন্ধ্যার চোখের দিকে স্থিরভাবে তাকিয়ে দিপু কথা বলা শুরু করলো..................।
দিপুকে নিয়ে আগের লেখাগুলোঃ
ক্যাডাভার
অণুগল্পঃ জীবন যেখানে যেমন
লেখকঃ
এস এম নিয়াজ মাওলা
মন্তব্য
গল্প ভাল লেগেছে। এই ধরণের গল্প পড়তে গেলে খুব মন খারাপ লাগে। ডাক্তাররা কেন যেন শুধু অসুখ বিসুখ নিয়ে গল্প লিখে। কাউকে না মেরে শান্তি হয় না। আমার বরের ক্ষেত্রেও এই ব্যাপার দেখি। সব জটিল জটিল অসুখ নিয়ে মন খারাপ করা গল্প লিখে।
--------------------------------------------------------
আমি আকাশ থেকে টুপটাপ ঝরে পরা
আলোর আধুলি কুড়াচ্ছি,
নুড়ি-পাথরের স্বপ্নে বিভোর নদীতে
পা-ডোবানো কিশোরের বিকেলকে সাক্ষী রেখে
একগুচ্ছ লাল কলাবতী ফুল নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছি
মেঘাপু, ডাক্তাররা খুব কসাই হয়, তাই মানুষ মেরে ফেলতে খুব পছন্দ করে!
ভালো থাকুন, খুব।
-এস এম নিয়াজ মাওলা
গল্প লেখা আপনার কাছে যেমন আশা করা যায়, ঠিক তাই - স্বচ্ছন্দ। কিন্তু মেঘাদিদির মত আমিও বলি - ডাক্তারদের ব্যপারটা কি? "শুধু অসুখ বিসুখ নিয়ে গল্প লিখে। কাউকে না মেরে শান্তি হয় না।" সামনের গল্পে এইটা কি পাল্টাবে?
- একলহমা
ভাইয়া, অসংখ্য ধন্যবাদ। চেষ্টা করবো পরের গল্পে অন্য কিছু লেখা যায় কি না।
ভালো থাকুন, খুব।
-এস এম নিয়াজ মাওলা
মন খারাপ লাগলো । ক্লিনিক্যাল দিকের স্ট্রেস নিতে না পেরে পাবলিক হেল্থ এ চলে এসেছিলাম পাস করার পর, আপনার লেখা পড়ে অনেকদিন পর আবার সেই স্ট্রেস ফিল করছি।
ইসরাত
ইসরাত আপু, আপনি ডাক্তার! আমিও নয় বছর নিউরোসার্জারীতে থেকে আপনার মতোই স্ট্রেস নিতে না পেরে পাবলিক হেলথে চলে এসেছি। এখন মাঝে মাঝে সেই অপারেশন থিয়েটারের দিনগুলোকে খুব মিস করি।
ভালো থাকুন, খুব।
-এস এম নিয়াজ মাওলা
আমি লাইন ছেড়ে পাব্লিক হেলথে গেছিলাম, আবার লাইনে আসছি, এসে মনে হইতেছে পাব্লিক হেলথই ভাল ছিল, আবার ধান্দা করতেছি পাব্লিক হেলথে যাওয়ার, আমি শিউর, আবার ফিরে আসার জন্য মন কাঁদবে।
-----------------------------------------------------------
আঁখি মেলে তোমার আলো, প্রথম আমার চোখ জুড়ালো
ঐ আলোতে নয়ন রেখে মুদবো নয়ন শেষে
-----------------------------------------------------------
-নিয়াজ
ছিমছাম সাবলীল গল্প ।
ধন্যবাদ আপনাকে। আপনার নামটা জানা হলো না!
-এস এম নিয়াজ মাওলা
ভাল লাগলো পড়ে।
র.নাহিয়েন
ধন্যবাদ আপনাকে। ভালো থাকুন খুব।
-নিয়াজ
ডাক্তার না হয়েও বহুদিন হাসপাতালের করিডরে কাটিয়েছি
গল্পটা ছুঁয়ে গেল... মনটাও খারাপ করে দিয়ে গেল
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
দুখিত ভাইয়া, মন খারাপ করে দেওয়ার জন্য। এরপর থেকে আর এই রকম গল্প লিখবো না!
-নিয়াজ
খুব বেশি প্রেডিক্টেবল ছিল শেষটা, তবে ভালো লেগেছে ভাইয়া।
অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে। ভালো থাকুন খুব।
-নিয়াজ
ভালো লাগলো গল্পটা। সব ধরণের গল্পেরই দরকার আছে - মিলনান্তক, বিয়োগান্তক- সবই।
চলুক লেখা।
____________________________
অসংখ্য ধন্যবাদ প্রফেসর ভাইয়া। ভালো থাকুন খুব।
-নিয়াজ
ধুর্ মনটাই খারাপ করে দিলেন।
সন্ধ্যার মেয়েটার জন্যও কি জায়েদ কে বাঁচানো যেত না?
আমি খুব আশা করেছিলাম যে দিপু সফল হবে।
ভালো থাকবেন নিয়াজ ভাই।
------------------------------
কামরুজ্জামান পলাশ
দুখিত মন খারাপ করে দেওয়ার জন্য। চেষ্টা করবো এর পরেরবার ভালো কিছু লিখতে-- আর হ্যাঁ, আপনিও ভালো থাকুন খুব।
-নিয়াজ
নতুন মন্তব্য করুন