গত তিন বছর ধরে প্ল্যান করছি শিব চর্তুদশীর মেলার সময় চন্দ্রনাথ যাব। কিন্তু নানান ঝামেলার কারনে যাওয়া হয়ে উঠেনি। অবশেষে ঈদের পরের দিন চন্দ্রনাথ ধাম দর্শন করে আসলাম। সাথে বোনাস হিসাবে সীতাকুন্ড ইকোপার্ক। আমরা ছয়জন ঈদের দিন সন্ধ্যায় ফেনীতে এক বন্ধুর বাসায় উঠলাম। পরদিন ভোর ৬.৩০ টায় আমরা ৭ জন সীতাকুন্ডের উদ্দ্যেশে যাত্রা করলাম।
দেড় ঘন্টা পর সীতাকুন্ড বাজারে নেমে নাস্তা করে চন্দ্রনাথ পাহাড়ে যাওয়ার জন্য মাথাপিছু ১০ টাকা করে সিএনজি ভাড়া করলাম। চলার পথের দুইধারে অনেক মন্দির, তীর্থ যাত্রী নিবাস ও ধর্মশালা চোখে পরবে। ১৫ মিনিটের মধ্যেই পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছে গেলাম। এরপর শুরু হলো আমাদের হন্টন যাত্রা।
গেট পেরোলেই বাম পাশে আছে হনুমানজীর মন্দির আর ডান পাশে সীতা মন্দির, সীতা, রাম ও লক্ষনের স্নানের কুন্ড। যদিও এখন কোন জল নাই। ধারনা করা হয় সীতার স্নান করার এই কুন্ড থেকেই এই জায়গার নাম হয়েছে সীতাকুন্ড। কিছুক্ষন পর চোখে পড়বে বড় একটি মন্দির। এখানেই মূল পূজা হয়। যারা উপরে উঠতে পারে না তারা এইখানে পূজা দিয়া চলে আসেন।
ঢালু পথ ও ছোট ছোট সিঁড়ি দিয়ে সামনে এগোলে ডান পাশে দেখতে পাবেন জগন্নাথ দেবের মন্দির। আরো কিছুদুর গেলেই চোখে পড়বে ছোট একটা ঝর্ণা। এখান থেকেই পাহাড়ে উঠার পথ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। ডানদিকের দিকের রাস্তা প্রায় পুরোটাই সিঁড়ি করা আর বামদিকের রাস্তাটি্র বেশীর ভাগই পাহাড়ী ঢালু পথ এবং মাঝে মাঝে কিছু ভাঙ্গা সিঁড়ি আছে। ডানের পথ ধরে গেলে প্রথমে পড়বে চন্দ্রনাথ মন্দির। তারপর বিরুপাক্ষ মন্দির। আর বামের পথ ধরে উঠলে আগে বিরুপাক্ষ, পরে চন্দ্রনাথ। বাম দিকের পথ দিয়ে উঠা সহজ আর ডানদিকের সিঁড়ির পথদিয়ে নামা সহজ।
পথ বাছাইয়ের পর শুরু হবে খাড়া উপর দিকে চলা। কিছুক্ষন চলার পর আপনি হাঁপিয়ে উঠবেন নিশ্চিত। আপনার পা বিদ্রোহ করবে। তখন সিঁড়িতে বসে বিশ্রাম নিন আর চারপাশের নয়ন ভোলানো সবুজ পাহাড় ও দূরের নীল সাগরের জলরাশির অপূর্ব দৃশ্য উপভোগ করতে থাকুন। ৫ মিনিটেই আপনার সব ক্লান্তি চলে যাবে। তারপর আবার শুরু করুন হাঁটা। ৪/৫ বার বিশ্রাম নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এক সময় পৌঁছে যাবেন পাহাড় চূড়ায়। চারিদিকে শুধু সবুজের মিছিল। সারি সারি সবুজ পাহাড়, নীল আকাশ আর দূরের বঙ্গোপসাগরের নীল জলরাশির দিকে তাকালে মনে হবে পাহাড়ে উঠার কষ্ট সার্থক। চন্দ্রনাথ মন্দির, বিরুপাক্ষ মন্দির, বৌদ্ধের পায়ের ছাপ দেখে আস্তে আস্তে সাবধানে নেমে আসুন। পাহাড়ের পাদদেশে শঙ্কর মঠে দুপুরের খাবার না খেলে চন্দ্রনাথ ভ্রমন পূর্ণতা পাবে না। ১২.৩০ টার আগে এসে প্রসাদের টোকেন নিতে হবে। জনপ্রতি ৪০ টাকা। খাওয়া শেষ করে হেঁটে হেঁটে চলে আসুন সীতাকুন্ড বাজারে। আসার পথে দেখে নিন বিভিন্ন মন্দির, ব্যাসকুন্ড। সীতাকুন্ড বাজার থেকে সিএনজি নিয়ে চলে আসুন সীতাকুন্ড ইকোপার্ক। ভাড়া ১৩০ টাকা।
সীতাকুন্ড বাজার থেকে ১৫/২০ মিনিট লাগবে ইকোপার্কে আসতে। জনপ্রতি ১০ টাকা করে টিকিট কেটে ভিতরে ঢুকতে হবে। আমার কাছে মনে হলো সবাই সহস্র ধারা ও সুপ্তধারা ঝর্ণা দেখতেই আসে। কেউ গাছপালার দিকে নজর দেয় না। দেড় কিলোমিটার পাহাড়ী পথ হাটার পর চোখে পড়বে সুপ্তধারা যাওয়ার রাস্তা। ভাঙ্গা সিঁড়ি ও বন জংগল পেরিয়ে নিচের দিকে ১৫ মিনিট হাঁটলে সামনে দেখবেন পিচ্ছিল নালা পথ। এই পথ ধরে আরো মিনিট পনের হাঁটলেই সুপ্তধারা ঝর্ণা। শীতকালে নাকি এই ঝর্ণায় পানি থাকে না। তাই এর নাম সুপ্তধারা। সুপ্তধারা দেখে ফেরার পথে আপনাকে আবার ভয়াবহ খাড়া সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হবে।
এখান থেকে সহস্র ধারা ঝর্ণা আরো তিন কিলোমিটার। আপনার মন যেতে চাইলেও আপনার পা সাড়া দিতে চাইবেনা। কিন্তু না গেলে পস্তাবেন। আস্তে আস্তে হাঁটা শুরু করুন। দেখবেন দলে দলে লোকজন উঠছে আর নামছে। গাছপালা দেখতে দেখেতে একসময় সহস্র ধারার কাছে চলে আসবেন। আবার আপনাকে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে হবে। নিচে নামলেই অপার বিস্ময়ে দেখবেন আপনার সামনে তুমুল গর্জন করে পাহাড় থেকে নেমে আসছে জলধারা। ঝর্নার শীতল পানিতে নেমে পড়ুন। সারাদিনের ক্লান্তি এক নিমিষেই উধাও হয়ে যাবে।
জলকেলি শেষ করে উপরে উঠে হাল্কা কিছু খেয়ে নিন। এখন ফেরার পালা। যদি কষ্ট করতে মন না চায় তাহলে সিএনজি করে গেটে চলে আসুন । ভাড়া ৫০ টাকা জনপ্রতি। সিএনজি করে নামার সময় আপানার মনে হবে এতটা পথ আমি হেঁটে উপরে উঠেছি ! ঢাকায় আসার পর আমার ৩/৪ দিন সিঁড়িফোবিয়া দেখা দিয়েছিল ফুট ওভার ব্রিজের সিঁড়ি দেখলে ভয় পেতাম। নিচ দিয়ে পার হতাম তবে যাইহোক ট্যুরটা ছিলো দারুন দারুন সব অভিজ্ঞতায় পূর্ণ এবং অবশ্যই উপাদেয়। একদিন সময় করে ঘুরে আসুন। শতভাগ নিশ্চিত থাকুন ভালো লাগবে।
টিপ্সঃ ভারি ব্যাগ নিবেন না। সবার কাছে ১টা করে হাফ লিটার পানির বোতল, কয়েক প্যাকেট বিস্কিট, চিপ্স, চকলেট, মন্দির থেকে কেনা বাতাসা রাখবেন। ইচ্ছা করলে একটা লাঠি নিতে পারেন। লাঠি আপানার উপরে উঠার কষ্ট অনেকটা কমিয়ে দিবে। আর সাথে অব্যশই ক্যামেরা। দলবেঁধে থাকবেন। দয়া করে যেখানে সেখানে খালি বোতল, চিপ্সের প্যাকেট ফেলবেন না। একসাথে করে নিয়ে এসে নিচে ডাষ্টবিনে ফেলুন।
আমার অন্যান্য -
রাঙ্গামাটির পথে লো...
বান্দরবন-১: নীলগিরির পথে লো..
বান্দরবন-২: নীলাচল ও অন্যান্য
অবশেষে কক্সবাজার...
ইদ্রাকপুর কেল্লা : কালের সাক্ষী..
ঢোলসমুদ্র দিঘি : বিলুপ্তির পথে আরেকটি দিঘি
সেন্টমার্টিন ভ্রমণঃ ছবি ব্লগ-১
লালকমল
মন্তব্য
কয়েকটা ছবি খুবই চমৎকার। বিশেষ করে পাহাড় আর আকাশ মিলে যে ছবিগুলো। ওগুলো কি এইচডিয়ার করেছেন নাকি এম্নিতেই ওরকম অসাধারণ রঙ?
ছবিতে নাম্বার থাকলে আলোচনা করতে সুবিধে হয়। কয়েকটা ছবি নিয়ে বলার ছিল কিন্তু নাম্বার ছাড়া বোঝানো তো বেশ কঠিন! আশা করি পরের বার খেয়াল রাখবেন। ভাল থাকুন।
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
উপরের ২টা পাহাড় - আকাশ এবং নিচের ২ট মন্দিরের পিক হাল্কা এইচডিয়ার করা পরের বার ক্যাপশন দিতে ভুল হবে না।
কমেন্ট করার জন্য ধন্যবাদ।
প্রকৃতি সবসময়ই অসাধারণ - কথাটা আবার উপলব্ধি করলাম। সাগর আর পাহাড়ের যুগলবন্দী নয়ন জুড়িয়ে দিল। ত্রিমাত্রিক কবির সাথে একমত - ছবিতে নাম্বার অথবা নাম দিলে সুবিধা হয়। আর লেখকের নাম কই? এটা যে লালকমলের লেখা, তা আগের লেখাগুলোর লিঙ্ক না দিলে বুঝতে পারতাম না।
____________________________
নামতো ভাই দিছে পুরাতন লেখার লিঙ্ক গুলোর নিচে। ক্যাপশন দিতে ভুলে গেছি।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
ঠিক! আমিই মিস করে গেছি!
____________________________
কবি আর প্রোফেসর-এ মিলে আমি যা বলতে চাই, বলে দিয়েছেন।
- একলহমা
ধন্যবাদ।
ইকোপার্কে শেষ গেছি বোধহয় বছর পাঁচেক হলো...। চন্দ্রনাথ, তারও দ্বিগুণ সময় হলো।
৯ এবং ১০ নং ছবিটা চমৎকার। এইচডিআর করা?
নাম্বার কিংবা ক্যাপশান থাকলে আরাম হতো আরেকটু।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
ধন্যবাদ। হ্যাঁ এইচডিয়ার করা। সব সময় ক্যাপশন দেই। আজ যে কেন দিলাম না। আমি নিজেও বুজতে পাড়ছি না।
কয়েকটা ছবিতো ভয়ংকর রকমের সুন্দর।
আপনার এই পোষ্টটি আমাকে একাধারে প্রফুল্ল ও স্মৃতিমেদুর করে। সেই ১৯৮৭ সালে আমরা একদল হাইকার হাইকিং করতে করতে ভাটিয়ারি থেকে অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে পৌছেছিলাম চন্দ্রনাথ পাহাড়ে। তখন আমি সতের বছরের যুবা, চুড়ায় উঠে চোখ দিয়ে গাঢ় সবুজ ভার্জিন জঙ্গল পেরিয়ে সাগরের দিকে তাকাতেই নয়ন সার্থক হয়েছিল। তবে মন্দিরের ডিটেইল সেভাবে দেখা হয়নি। আপনার চোখে আবার নোতুন করে দেখলাম!
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
এই ছবিগুলো আগে দেখেছি, আবিদের প্রোফাইলে!!!
পাহাড়ের কয়েকটা ছবি জম্পেশ হয়েছে
কাকতালীয় ব্যাপার হল কয়েকদিন আগে সচলে পুরোনো পোস্টে গিয়ে না কিভাবে জানি আপনার আগের পোস্টগুলি নজরে এসেছিল, সবগুলিও পড়া ও দেখা হয়েছে
ডাকঘর | ছবিঘর
ধন্যবাদ দাদা।
জায়গাটা কোথায়?
জায়গাটা সীতাকুণ্ড উপজেলায়, চট্টগ্রাম বিভাগে।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
৫২ শক্তিপীঠের ১টি হলো চন্দ্রনাথ মন্দির।
উইকি থেকে --- বাংলাদেশের সীতাকুন্ডের নিকটে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের উপরে অবস্থিত চন্দ্রনাথ মন্দির অন্যতম বিখ্যাত শক্তিপীঠ। এখানে হিন্দু পবিত্র গ্রন্থসমূহ অনুসারে সতী দেবীর দক্ষিণ হস্ত পতিত হয়েছিল। সীতাকুন্ডের চন্দ্রনাথ মন্দির তীর্থযাত্রীদের জন্য এক পবিত্র স্থান। এর পুরনো নাম ছিলো "সীতার কুন্ড মন্দির।
যাওয়া হয়নি এখনো, তবে আপনার লেখা পড়ে খুব যেতে ইচ্ছে করছে।
ভালো থাকুন খুব।
-নিয়াজ
ধন্যবাদ। ঘুরে আসুন । ভালো লাগবে।
এখানে গিয়েছিলাম প্রায় বছর দশেক আগে। কিছু ছবি তুলেছিলাম, সেগুলো হারিয়েছি
পোস্ট ভালো লাগলো। ছবিগুলো কি আপনার তোলা?
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
হ্যাঁ ভাই। আমিই তুলছি ছবিগুলো।
নতুন মন্তব্য করুন