ফুটবল ম্যাচ

সুবোধ অবোধ এর ছবি
লিখেছেন সুবোধ অবোধ (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৯/০৮/২০১৩ - ৪:৩৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

স্কোর লাইন উল্টা হলে ঠিক ছিল। উল্টা হবার-ই কথা ছিল। হবার কথা ছিল বিয়ত ৪ - ১ আন বিয়ত। অথচ হয়ে গেল বিয়ত ১ - ৪ আনবিয়ত।
শ্যামপুর গ্রামে প্রতি বছর ঈদে এই ফুটবল খেলার আয়োজন হয়। বিবাহিত বনাম অবিবাহিত। সেখান থেকেই বিয়ত আর আনবিয়ত! তুমুল প্রতিযোগিতা পূর্ণ খেলা। মান সম্মানেরও ব্যাপার স্যাপার থাকে। বিয়ত এর চিন্তা - হেরে গেলে শুনতে হবে "বাচ্চা বাচ্চা পুলাপানের সাথে হাইরা গেলা? ছিহ!" আবার ওইদিকে আনবিয়তদের চিন্তা হল হেরে গেলে সবাই বলবে -"বুইড়াগোর সাথে হাইরা গেলি? তোগরে দিয়া কি হইবো?!" গত খেলায় হেরে যাবার পর আনবিয়তের ছেলেপুলেদের কয়েকদিন খুব প্যানার মধ্যে কেটেছে। পাড়ায় মুখ দেখানো দায় হয়ে গিয়েছিল।

হাফ টাইমের আগে আগে লাফ দিয়ে উঠে জমির মিয়া চিৎকার করে উঠল - "লাথি মাইরা হারামিডার হোগার দাঁত ফালায়া দেয়া দরকার!"
জমির মিয়ার বয়স ৫০ বছরের উপরে। গত টার্মে গ্রামের মেম্বার ছিল। কাজের কাজ তেমন কিছুই করে নি বলে লোকজন আড়ালে ডাকে চুরা জমির। ফলাফল -পরের বার ইলেকশনে ফেল। বিবাহিত। আর তাই এমন ভয়ানক রকম খেপে আছেন। দলের এই করুণ দশা মেনে নিতে পারছেন না কোনমতেই।
পাশ থেকে মন্টু বলে উঠল - "অবজেকশান! ওইখানে দাঁত হয় না।" তার গলা যথেষ্ট গম্ভীর। সে এলাকার কলেজ থেকে ডিগ্রী পাস করে এখন প্রাইভেটে 'ল' পড়ছে। তাই কিছু এদিক সেদিক হলেই গলা গম্ভীর করে সে বলে - "অবজেকশান"
"ধুত্তোরি, রাখ তোমার 'অবজেকশান', যার মুখের কথা আর কামে এত ফারাক, তার মুখ আর হোগার মইধ্যে কোন পার্থক্য নাই!" -রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলে জমির মিয়া।

পেছনে ভীড়ের মধ্যে থেকে কে যেন টিপ্পনি কাটে -"নির্বাচনে জিতনের আগে ভাঙ্গার মোরে একখান 'বিরিজ' করার কথা দিছিলেন!"

চেহারা খানা দেখার মত হয় জমির মিয়ার! ফর্সা লোকটা রাগে লাল হতে হতে প্রায় কালো হওয়ার দশা হয়!
জমির মিয়ার খাস চামচা ছগীর হুঙ্কার দিয়ে উঠল - "কুন হালার পুত কইল রে এই কথা?"
ততক্ষণে বলনেওয়ালা হাওয়া।
মঞ্জু ব্যাপারী পাশে থেকে বলে উঠে - "ধ্যাত্তুরি মিয়ারা! কিয়ের মইধ্যে কি শুরু করলা?"

কয়েক মুহুর্ত কেউ কিছু বলে না। শুধু একটা নেড়ি কুকুর মাঠের কোনা দিয়ে ভিতরে অনধিকার প্রবেশ করার সময় কোন এক দুষ্টু ছেলের ইটের ঢেলার আঘাতে 'কেউ' করে উঠে দৌড়ে পালায়। মাঠের চার পাশে ভ্যান গাড়িতে করে ফেরিওয়ালা কোক বিক্রি করে মাইকে গান বাজাতে বাজাতে। আর মাঠ থেকে ভেসে আসে প্লেয়ারদের পরিশ্রমী ‘হাই হুই’ আওয়াজ,মাঝে মাঝে রেফারির বাঁশি।

জমির মিয়া ফের গজগজ করতে থাকে -"হারামজাদার চাপা হুনছিলা কাইল? - 'আরে আমি গোল বারের তলায় খাড়াইলে আর জালে গোল ঢুকব কোনহান দিয়া?!!' আর এহন একটা বল ধরবার পারে না ছাগলের বাচ্চাডা!!"
সব রাগ যেন গিয়ে পরে গোলকিপার সুমনের উপর। সুমন গত বছরও আনবিয়তের দলে ছিল,কিন্তু এখন সে বিবাহিত। তাই এবার বিয়তের গোলকিপার।
"ধরবো কেমনে? হারামজাদার ছোট ছোট বল ধইরা অভ্যাস, বড় বল কি হাতে আঁটে?"- জমির মিয়ার মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে ছগীর বলে।
"ছোট ছোট বল!!" - বলে ফ্যাচ ফ্যাচ করে হাসি দিয়ে ইঙ্গিত পূর্ণ চোখ টিপ মারে পান্নু।
"তুই আবার ক্যালাইতাছস ক্যান? ও ক্রিকেট খেলায় উইকেট কিপার দাঁড়ায় না? “- পান্নুর ইঙ্গিত বুঝতে পেরে কথা ঘুরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে ছগীর। "পান্নু হারামীটা একটা খাচ্চর, সবার সামনে খালি কথা উল্টাপাল্টা দিকে নিয়া যায়!" -মনে মনে গালি দেয় পান্নু কে।
“আরে মিয়া এত চেতার কি আছে? নিজেগো মধ্যে খেলা,জিতলেই কি আর হারলেই কি?”-মঞ্জু ব্যাপারী পরিস্থিতি ঠান্ডা করার চেষ্টা করে।
“এইডা আপনে কি কন?! একটা মান সম্মান আছে না? এমনেই এই পোলাপাইনগুলা সব বদের হাড্ডি,কথা বার্তা হুনে না। হাইরা গেলে উপায় আছে?!”-ছ্যাঁত করে উঠে জমির মিয়া।
জমির মিয়ার এত রাগের আরো কিছু কারণ আছে। আনবিয়তের পক্ষে হ্যাট্রিক করেছে শাহিন,তার চোখের কাঁটা! শাহিনের মুখ দেখা তো দূরের কথা,নাম শুনলেও তার গায়ে আগুন ধরে যায়। দু’বছর আগে এই শাহিনের জন্য মেম্বার হওয়ার পরও তাকে চুড়ান্ত নাজেহাল হতে হয়েছিল। নিজের ছেলের সাথে শমশেরের মেয়ে,শাহিনের বোনের বিয়ের কথা বার্তা চলছিল। সব প্রায় ঠিকঠাকই ছিল। বাগড়া বেঁধে গেল মেয়ে দেখতে গিয়ে, মেয়ের বাড়ির উঠানে বসে মেয়ের সাথে প্রশ্নোত্তর পর্ব চলার সময়।
জমির মিয়া একটু কায়দা করে মেয়ে কে ‘দোয়া কুনুত’ বলতে বলেছিল এই ভেবে যে স্কুল কলেজে পড়া মেয়ে ঠিকঠাক বলতে পারবে না,সেই সুযোগে চার-পাঁচ যায়গায় ভুল ধরে যৌতুকের অঙ্কটা একটু বাড়িয়ে নিবে। পরিকল্পনা আগাচ্ছিলও ঠিক মতই-দোয়া কুনুত ‘পড়া শুরু’ করতেই সে ফটাফট দুই-তিন যায়গায় ভুলও ধরে ফেলেছিল অযথাই। আর তখনই বাগড়া দিল পেছনে দাড়িয়ে থাকা মেয়ের ভাই শাহিন। ফট করে বলে বসল-“ আপনি একটু একবার পড়ে শুনান না চাচা।”
প্রথমে সে গাঁইগুঁই করলেও নাছোড়বান্দা ছেলের জন্য বাধ্য হয়ে পড়া শুরু করল। আর সেই পুঁচকে ছেলে তার একের পর এক ভুল ধরা শুরু করল। ঘামতে ঘামতে সে বর পক্ষের সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে দেখে তারাও হাসছে নিচ দিকে মাথা দিয়ে মুখ টিপে!! সবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া চ্যাংড়া ছোকড়ার যুক্তির কাছে সে ধোপে টিকতে পারে নি আর। ছেলের বিয়ে তো দূরের কথা প্রচন্ড নাকাল হয়ে ফিরতে হয়েছিল সেদিন। সেইদিন থেকে তার কুটিল মন থেকে গেছে সুযোগের অপেক্ষায়-সুযোগ পেলে ওই ছেলেকে শিক্ষা সে দিয়েই ছাড়বে।

হাফ টাইমের বাঁশি হয়ে গেছে। প্লেয়ার রা সব মাঠের মধ্যে গোল হয়ে বসে বা শুয়ে লেবু বা চিউয়িঙ্গাম চিবুচ্ছে। আর এই দিকে জমির মিয়া ফন্দি আঁটছে যদি খেলার মোড় না ঘুড়ে তবে কিভাবে খেলা পন্ড করা যায়। সেই সাথে পূর্ণ করা যায় আরেকটা মনের খায়েশ!! ছগীর কে ডেকে কানে কানে কি যেন এক কানপড়া দেয় সে। ছগীর বোঝার ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। তারপর ছগীর আরো কয়েকজন কে ডেকে তাদের কানে কানে কিছু একটা বলে। দু’একজনের মুখে শয়তানি একটা হাসি ভেসে উঠে আবার মিলিয়ে যায়।

খেলা আবার শুরু হয়। বিয়ত রা গোল শোধ করবে কি,উল্টা খেয়ে বসে আরেকটা। স্কোর এখন আনবিয়ত ৫- ১ বিয়ত। রাগে হিংস্র হয়ে ওঠে জমির মিয়ার চোখ। সেই চোখের সাথে চোখাচোখি হয় ছগীরের। কি করতে হবে বুঝে নিয়েছে সে। হঠাৎ রেফারীর বাঁশি বাজে। ফাউল করেছে কে যেন। কোন দলের কে করেছে,কাকে করেছে এত কিছু দেখার দরকার নেই। ‘হই হই’ করতে করতে দলবল নিয়ে মাঠে ঢুকে যায় ছগীর। তাদের দেখাদেখি না বুঝেই চারিদিক থেকে আরো অনেকেই চিৎকার করতে করতে ঢুকে পড়ে মাঠে। শুরু হয়ে যায় এক ধুন্ধুমার কান্ড! ঈদের দিনের নিছকই একটা প্রীতি ম্যাচ মুহুর্তে পরিণত হয় রণক্ষেত্রে!! ছগীর ভীড়ের মধ্যে খুঁজতে থাকে শাহিন কে। অবাধ্যতার পাওনা তাকে আজ সে বুঝাবে এই সুযোগে!

কাকতালীয় ভাবেই কি না কে জানে কোকাকোলার ফেরিওয়ালার মাইকে ঠিক তখনই বেজে ওঠে-

“ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে
এল খুশির ঈদ...
...আজ ভুলে যা তোর দোস্ত দুশমন
হাত মেলা হাতে...”

*************************
সুবোধ অবোধ
*************************
শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি কেন এত বোকা হয়?!!


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

ঠিক, শয়তানেরা এইভাবেই নিজের, একান্ত নিজের মতলব হাসিল করে।
- একলহমা

সুবোধ অবোধ  এর ছবি

হুম। ঠিক...

অতিথি লেখক এর ছবি

গল্পটা যেভাবে এগোচ্ছিল, মনে হচ্ছে ঠিক সেইভাবে শেষ হতে পারলো না! তবুও ভালো লাগা জানিয়ে গেলাম। ভালো থাকুন খুব।

-নিয়াজ

সুবোধ অবোধ এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-
যেইভাবে আগাচ্ছিল,ওইভাবে শেষ করতে চাইলে আরো অনেকক্ষণ টানতে হত। ধৈয্য শক্ত কম!! খাইছে

ক্যাপ্টেন নিমো এর ছবি

অনেক ভালো লাগল, বিশেষ করে গল্পের ডিটেইল।। চালিয়ে যান

সুবোধ অবোধ এর ছবি

অসংখ ধন্যবাদ ক্যাপ্টেন।
দেঁতো হাসি

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

"অবজেকশান! ওইখানে দাঁত হয় না।"

হো হো হো হো হো হো হো হো হো

কই? ৯০ বচ্ছরের বুড়ো খোকার তো মুখভরতি দাঁত দেঁতো হাসি

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

সুবোধ অবোধ এর ছবি

আপনারে আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

আর ওইটাতো বুড়ো খোকা না,বুইড়া ভাম!!!! দাঁতগুলা প্লাস দিয়া তুলতে পারলে... রেগে টং

তারেক অণু এর ছবি

চলুক বেশ বেশ, টেনিদা টেনিদা মনে করাইদিলেন

সুবোধ অবোধ এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা- দাদা।
লজ্জা এবং দুঃখের কথা হইল-আমি টেনিদা একটাও পড়ি নাই!!! খাইছে

অতিথি লেখক এর ছবি

মজা পাইলাম পড়ে...

র.নাহিয়েন

সুবোধ অবোধ এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

বন্দনা এর ছবি

বেশ মজার লেখা।

সুবোধ অবোধ এর ছবি

ধন্যবাদ আপু। হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।