অরিত্রি

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ০২/০৯/২০১৩ - ১০:০৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মায়িশা তার সামনে বসা মানুষটার দিকে তাকাল।

লোকটা ফোনে কথা বলছে আর দাঁড়িতে হাত বুলাচ্ছে। লোকটার মুখভর্তি দাঁড়ি। মায়িশা দাঁড়িওয়ালা মানুষদের এমনিতেই পছন্দ করে না। তাদের ম্যাথ টিচার, দবিরউদ্দিন, ওই লোকটারও এরকম দাঁড়ি; অবশ্য খুবই কাটছাঁট করা। তার বন্ধুরা বলে, দবিরউদ্দিন চুলের থেকে দাঁড়ির পিছনে সময় বেশি খরচ করে।

ওই দবিরউদ্দিন কী একটা কারণে মায়িশাকে একদম দেখতে পায়না। মায়িশা অনুমান করতে পারে, কিন্তু নিশ্চিত না। মায়িশা এমনিতেই ম্যাথে খুব ভাল, বরাবর ক্লাসে সেই হাইয়েস্ট মার্ক-হোল্ডার। কিন্তু কখনই একশ পায় না। ইচ্ছে করে তিনি হ্যান্ড-রাইটিংয়ে তাকে দু-এক নম্বর কম দেয়। তার বন্ধুরা বলে, দবিরউদ্দিন নাকি নিজে কখনও একশ পায়নি তাই কাউকে একশ দেয়না।

লোকটা ফোন রেখে প্রশ্ন করে, “আরো কিছু খাবে?”

মায়িশা ‘না’-সূচক মাঠা নাড়াল। সে গত এক ঘণ্টা ধরে একটা বার্গারই খাচ্ছে। তাদের স্কুলের ক্যান্টিনে যে বার্গার পাওয়া যায় সেটা একদমই ফালতু। তার বেস্টফ্রেন্ড রিচির ধারণা ওগুলোর উপর দিয়ে ইঁদুর দৌড়োদৌড়ি করে। তাদের স্কুলের সামনের ফাস্টফুডে যে বার্গারটা পাওয়া যায় সেটা অনেক মজার। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে মায়িশার মা তাকে ওদিকে যেতে দেন না। ওখানে নানান মানুষ থাকে। ইলোরা জাহান তার মেয়েকে অচেনা কারো সাথে মিশতে দেন না।

আচ্ছা, তার সামনে বসা মানুষটাও তো তার অচেনা! অচেনা কেউ মায়িশার সাথে সন্দেহমূলক কথা বললে মায়িশার কর্তব্য হচ্ছে চুপিচুপি জামশাদ আঙ্কেলকে ফোন করা। ইলোরা জাহান বারবার বলে দিয়েছেন। মায়িশার কাছে একটা গোপন মোবাইল আছে। এটা তার বেস্টফ্রেন্ড রিচি ছাড়া কেউ জানে না। সেখান থেকে ফোন দিলেই জামশাদ আঙ্কেল এসে সেই লোকের আদ্যপ্রান্ত বের করে ফেলবে।

মায়িশা সাথে করে তার যে ডিজনিব্যাগটা এনেছে সেটার এক কোণে ফোনটা আছে। সে ইচ্ছে করলেই এখন ফোন দিতে পারে। জামশাদ আঙ্কেল সাথে সাথে ছুটে আসবেন। জামশাদ আঙ্কেলের কাজই হল মায়িশা বাইরে গেলে তাকে চোখে চোখে রাখা। আর বাসার ভিতরে নীতু আন্টি।

কিন্তু এখন জামশাদ আঙ্কেলকে ফোন দেওয়া যাবে না। কারণ মানুষটা তার অচেনা হলেও অপরিচিত নয়। কারণ মানুষটা তার বাবা। শুধু বাবা না, সত্যিকারের বাবা !

মায়িশার বাবা (নকল) ফরিদা আহমেদের সাথে এই লোকটাকে কোনভাবেই মেলানো যায় না। লোকটা জিনস্‌ আর স্কাই-ব্লু কালারের গেঞ্জি পড়ে আছে। মাথাভর্তি ঝাঁকরা চুল আর মুখভর্তি দাঁড়ি। আর তার নকল বাবা ফরিদ আহমেদ থাকেন সবসময় ফরমাল ড্রেসে। ক্লিনশেভ্‌ড আর মাথার টাক ঢাকার জন্যে পরচুলা। তিনি সবসময় ভাব দেখান যে নিজের ছেলে ফারহানের থেকেও মায়িশাকে তিনি বেশি ভালবাসেন। কিন্তু মায়িশা ভালভাবেই জানে সেটা মিথ্যা।

মায়িশা তাকে প্রচুর ঘৃণা করে। সে প্রতিদিন ঘুমানোর আগে তিনবার তাকে মনে করে ‘I hate you’ বলে ঘুমোতে যায়। মাঝে মাঝে তার ইচ্ছে করে লোকটাকে রিভলবার দিয়ে গুলি করতে। কিন্তু শুধু মায়ের জন্যই সে কাজটা করে না। কারণ মাকে সে খুব ভালবাসে।

মায়িশার এতদিন ধারণা ছিল তার মাও তাকে খুব ভালবাসেন। কিন্তু যতই সে বড় হচ্ছে সে বুঝতে পারছে মায়ের জন্য সে একটা বোঝা হয়ে গেছে। পার্টির মধ্যে গেস্টরা যখন তাকে দেখে বলে, ‘ ইলোরা এটা তোমার মেয়ে?’ মা তখন ভারি অপ্রস্তুত হন। তাড়াতাড়ি নীতু আন্টির সাথে তাকে কোথাও পাঠিয়ে দেন।

মায়িশা বুঝতে পেরেছে বাবা-মা মিলে তাকে বাইরে পাঠিয়ে দিতে চাচ্ছে। সে কিছুই বলে না, তার বলার কিছু নেই, কেউ নেই।

ক্লাসেও সে চুপচাপ থাকে। মিস্‌ বলে, অরিত্রি তুমি এত সাইলেন্ট কেন? (একমাত্র মিস্‌ই তাকে তার ভাল নাম অরিত্রি ডাকে) সে কিছু বলে না। কাউকেই না; একমাত্র রিচি ছাড়া। রিচি খুব বুদ্ধিমান। এই বয়সেই সে তার মোটা চশমাটা দিয়ে অনেক বই পড়ে ফেলেছে। ও বলে এসব নিয়ে কখনও না ভাবতে। কিন্তু কীভাবে?
যেগুলো সে তার মন থেকে বের করে দিতে চায়, সেগুলোই তাকে ঘিরে রাখে।

মায়িশা এখানে আসার সময় অনেকক্ষণ ধরে ভেবেছে তার বাবা কি রকম হবে। তাদের বাসায় তার বাবার কোন ছবি নেই। তবে তার ঘরে বাবার আঁকা একটা অয়েল-পেন্টিং আছে। দুটা মৎস্যকন্যার পানিতে নাচার ছবি। এটাও নাকি মা রাখতে চাননি। সুন্দর জন্যেই নাকি নকল বাবা ছবিটা রেখেছ, আর অন্য কোন কারণে নয়।
মায়িশা যতবারই ছবিটা দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়। ইশ! সে যদি তার বাবার মত আঁকতে পারত!

তার বাবা! সত্যিকারের বাবা !! বাবা দেশে এসেছেন একটা এক্সিবিশনের জন্য। এক্সিবিশন শেষ হলেই চলে যাবেন। যাওয়ার আগে তার ইচ্ছে ছিল মায়িশার সাথে দেখা করার। মায়িশার মা প্রথমে রাজি হননি। যে মানুষটা সাত বছর মেয়ের কোন খোঁজ নেয়নি এখন কী দেখতে চায়? ভালভাবে রেখেছে কিনা এটা দেখতে এসেছে? নাকি মেরেছে এটা দেখতে?

মায়িশার কান্না পায়। মা এমনভাবে বাবাকে ব্লেম করে যেন বাবাই মা’কে ছেড়ে গিয়েছিল। মা নিজেই বাবাকে ডিভোর্স দেয় নি। অন্য কাউকে বিয়ে করেনি। আজব! মা কিছুতেই মায়িশার বাবার সাথে তার দেখা করতে দিবেন না। পরে ফরিদ আহমেদের চাপাচাপিতে রাজি হয়েছেন। দু ঘণ্টার জন্য মায়িশাকে তার বাবার সাথে দেখা করতে। মায়িশা ভালভাবেই জানে নকল বাবা এটা মন থেকে করেন নি, অন্যরা যাতে তাকে ভাল বলে এই জন্য করেছেন।

মায়িশা তার বাবার কাছে যাওয়ার আগে এই দু ঘণ্টা নিয়ে অনেক কিছু ভেবেছে। কি বলবে সে? বাবাকে সে কি ডাকবে? সে কি বাবার উপর রাগ করেছে? এতদিন না আসার জন্যে?

বাবা যখন তাকে “আমার অরু-মাম্মাটা কেমন আছে” বলে ডাকল মায়িশা তখন থরথর করে কেঁপে উঠেছিল। যা যা ঠিক করেছিল সব ভুলে গেল। তার বয়স যখন দেড় বছর তখন তার বাবা-মা’র ছাড়াছাড়ি হয়। সে তার বাবাকে নিয়ে এতটুকুই সম্বল করে এসেছিল যে তার বাবা তাকে ‘অরু-মাম্মা’ ডাকে।

বাবা যে তার প্রথম দেখায় এটা বলেই ডাকবে সেটা কি আর সে ভেবে রেখেছিল?

আচ্ছা, এই ছাড়াছাড়িটা না হলে কী হত?

মায়িশা ভাবতে পারে না, তার ছোট্ট বুকটা ভারী হয়ে আসে।

ফিরে আসার আগে সে তার বাবাকে সরাসরি প্রশ্ন করে, ‘আচ্ছা বাবা, মা’র সাথে তোমার ছাড়াছাড়ি হল কেন?’

বাবা মনে হয় থতমত খান। তবে দ্রুতই সামলিয়ে ওঠেন। মায়িশার কোমল হাতটা ধরে একটু হেসে বলেন, “যে যাকে ভালবাসে তার তো সেখানেই যাওয়া উচিৎ, তাই না মামণি?”

মায়িশা কিছু বলে না। তার মনটা খারাপ হতে শুরু করেছে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলিয়ে রাখছে। বাবার সামনে সে কিছুতেই কাঁদবে না। তবে চলে যাওয়ার সময় যখন সে দেখল তার সত্যিকারের বাবাটার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে তখন আর সে থাকতে পারল না। তার ছোট্ট শরীরটা আবার কেঁপে উঠল। সে তার বাবার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁদতে শুরু করল।

“প্লিজ বাবা আমাকে নিয়ে যাও। আমাকে কেউ ভালবাসে না, প্লিজ নিয়ে যাও...’’

বাবা তার অরু মামণিকে জড়িয়ে ধরে বলল, “হ্যাঁ মা, তোকে নিয়ে যাব। তোকে ছাড়া আমি যাব না। তুই সত্যি যাবি আমার সঙ্গে?”
মায়িশা চোখ মুছে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।

সত্যিই তো, যে যাকে ভালবাসে তার তো সেখানেই যাওয়া উচিৎ!

রাসিক রেজা নাহিয়েন


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

আরো লিখুন, লিখতে থাকুন, পড়ার অপেক্ষায় থাকব।
- একলহমা

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ! আপনার অপেক্ষা আমার তাগিদ হয়ে উঠুক।

রাসিক রেজা নাহিয়েন

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক
ইসরাত

অতিথি লেখক এর ছবি

লইজ্জা লাগে

রাসিক রেজা নাহিয়েন

অতিথি লেখক এর ছবি

আমার খুব ইচ্ছে হলো গল্পটা শেয়ার করতে।
করে ফেললাম।
আপনার জন্য শুভকামনা।

-------------------------------
কামরুজ্জামান পলাশ

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ আপনার শুভকামনার জন্য।

ভাল থাকবেন।

রাসিক রেজা নাহিয়েন

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

বাহ,
হেপ্পি এন্ডিং এর জন্য আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

যে যাকে ভালবাসে তার তো সেখানেই যাওয়া উচিৎ!

সকলেই সহি-সালামতে নিজ গন্তব্যে পৌঁছাক হাসি

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

সকলেই সহি-সালামতে নিজ গন্তব্যে পৌঁছাক

ধন্যবাদ আপনাকেও।

রাসিক রেজা নাহিয়েন

স্বপ্নীল সমন্যামবিউলিসট এর ছবি

জাফর ইকবাল স্যার এই ধরনের প্লট পঁচিয়ে ফেলেছে- তবুও- সাক্ষী র সাথে তাল মেলাই- সকলেই নিজ গন্তব্যে পৌছাক- সহি-সালামতে। আরো লেখা আসুক।

-------------------------------------------------
ভালবাসা কেবল নিজেকে দেয় এবং নিজ থেকে নেয়-
ভালবাসার যেমন নিজেরও কিছু নেই, তেমনি সেও কারো নয়;
কেননা, ভালবাসার জন্য শুধু ভালবাসাই যথেষ্ট।

সুবোধ অবোধ  এর ছবি

চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

জাফর ইকবাল স্যার এই ধরনের প্লট
পঁচিয়ে ফেলেছে, তাতে কী?

আমিও আমার নিজ গন্তব্যে পৌঁছাই ?!?!

রাসিক রেজা নাহিয়েন

স্বপ্নীল সমন্যামবিউলিসট এর ছবি

অবশ্যই, আপনার লেখার হাত ভালো- কিন্তু পরেরবার আশা করি সম্পূর্ণ নতুন কোন প্লট ভাববেন! কিছু ক্লিশে প্লট আছে- আবেগের বস্তা: সেগুলোতে ত্যানা প্যাঁচালে লেখক প্রতিভার ক্ষতি হতে পারে !! এহহে, কি সব বললাম- দুর্দান্ত আরেকটা লেখা দিয়ে আমার কথাগুলোকে উড়িয়ে দেন।

-------------------------------------------------
ভালবাসা কেবল নিজেকে দেয় এবং নিজ থেকে নেয়-
ভালবাসার যেমন নিজেরও কিছু নেই, তেমনি সেও কারো নয়;
কেননা, ভালবাসার জন্য শুধু ভালবাসাই যথেষ্ট।

তারেক অণু এর ছবি
স্বপ্নীল সমন্যামবিউলিসট এর ছবি

এইগুলান আমার কথা না, পান্ডবদা একদিন আমারে বলছিল- আজকে চান্সমতো ঝাইড়া দিলাম।
নকলবাজী বলতে পারেন। (ইমো আসে না- কেলানো দাঁতের হাসি)

-------------------------------------------------
ভালবাসা কেবল নিজেকে দেয় এবং নিজ থেকে নেয়-
ভালবাসার যেমন নিজেরও কিছু নেই, তেমনি সেও কারো নয়;
কেননা, ভালবাসার জন্য শুধু ভালবাসাই যথেষ্ট।

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাল লাগল। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আগ্রহ ধরে রাখতে পেরেছেন।

রাসিক রেজা নাহিয়েন এর ছবি

আপনাকে অনেক আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

সুলতান এর ছবি

গল্পটা সাধারণ, কিন্তু চোখের পানি সামলাতে পারি নাই।

লিখতে থাকুন।

ভালো থাকবেন।

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক

তবে স্বপ্নীল ভাইয়ার সাথেও একমত, ভেবে দেখতে পারেন।
ভালো থাকুন খুব।

-নিয়াজ

বন্দনা এর ছবি

শুরুটা বেশ হয়েছি। শেষটা বেশ তাড়াহুড়া হয়ে গেল। চালিয়ে যান।

অতিথি লেখক এর ছবি

ভালো লিখেছেন। আরেকটু বড় করতে পারতেন মনে হয়। হাসি

---এবিএম।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।