মাস দুয়েক আগে ট্রেকিং করতে গিয়েছিলাম রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রানী অভয়ারন্যে দুই সঙ্গী সহ। অফিসের এক ঘেয়েমি কাজ আর জ্যামে অতিষ্ঠ হয়ে ঢাকার বাইরে যাবার জন্য প্রানটা ত্রাহি ত্রাহি করছিলো। চট জলদি যাওয়া যায় এমন একটি জায়গা খুজতে গিয়ে হঠাৎ মাথায় এলো এ জায়গাটির কথা। বছর দশেক আগে বেশ ক’বার যেতে হয়েছিলো একাডেমিক প্রয়োজনে, জীব-বৈচিত্রের উপর একটি গবেষনা কাজের জন্য। যারা জাঙ্গল ট্রেকিং আর ওয়াইল্ড লাইফ পছন্দ করেন তাদের জন্য অল্প খরচে চমৎকার একটি অভিজ্ঞতা হতে পারে। যাহোক দেড় দিনের ট্রেকিংয়ে বনের ভিতর ব্যাপক ঘুরাঘুরি, জানা অজানা গাছ-গাছালি, বাহারি অর্কিড আর ওয়াইল্ড লাইফ দেখে দারুন কিছু সময় কেটেছে। ছবি দেখার আগে চলুন এই অভয়ারন্য সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে নেই-
রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্য হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলায় অবস্থিত। এটি মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার খুব কাছে এবং ভারতের ত্রিপুরা সীমান্ত সংলগ্ন। রাজধানী ঢাকা থেকে সড়র পথে এর দূরত্ব প্রায় ১৩০ কিলোমিটার। হবিগঞ্জ জেলা বনবিভাগের কালেঙ্গা রেঞ্জের তিনটি বিট: কালেঙ্গা, রেমা আর ছনবাড়ী নিয়ে এই অভয়ারণ্য গঠিত।
এটি বাংলাদেশের একটি সংরক্ষিত বনাঞ্চল এবং বন্যপ্রানীর অভয়ারণ্য। বনের প্রকৃতি অনুযায়ী এটি একটি শুকনো ও চিরহরিৎ বন এবং সুন্দরবনের পর বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক বনভূমি। এছাড়াও এটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বণ্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এবং জীব ও উদ্ভিদবৈচিত্র্যে দেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ বনাঞ্চল। রেমা–কালেঙ্গা অভয়ারণ্য ১৯৮২ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে এটির আরো সম্প্রসারণ করা হয়। বর্তমানে এই অভয়ারণ্যের আয়তন ১৭৯৫.৫৪ হেক্টর। বাংলাদেশের যে কয়েকটি প্রাকৃতিক বনভূমি এখনো মোটামু্টি ভাল অবস্থায় টিকে আছে, রেমা-কালেঙ্গা তার মধ্যে অন্যতম। তবে নির্বিচারে গাছ চুরি ও বন ধ্বংসের কারণে এ বনভূমির অস্তিত্বও বর্তমানে হুমকির মুখে।
এই অভয়ারণ্য বিরল প্রজাতির জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ। বর্তমানে এই বনে ৩৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ১৬৭ প্রজাতির পাখি, সাত প্রজাতির উভচর, ১৮ প্রজাতির সরীসৃপ ও ৬৩৮ প্রজাতির গাছপালা-লতাগুল্ম পাওয়া যায়। বিভিন্ন বিরল প্রজাতির পাখির জন্য এই বন সুপরিচিত এবং এদের মধ্যে রয়েছে — ভীমরাজ, টিয়া, হিল ময়না, লাল মাথা কুচকুচি, সিপাহি বুলবুল, বসন্তবৌরি, শকুন, মথুরা, বনমোরগ, পেঁচা, মাছরাঙা, ঈগল, চিল প্রভৃতি।
এই বনে তিন প্রজাতির বানরের বাস, এগুলো হল: কুলু, রেসাস ও নিশাচর লজ্জাবতী বানর। তাছাড়া এখানে পাঁচ প্রজাতির কাঠবিড়ালি দেখা যায়। এর মধ্যে বিরল প্রজাতির মালয়ান বড় কাঠবিড়ালি একমাত্র এ বনেই পাওয়া যায়। বন্যপ্রানীর মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য আরও রয়েছে মুখপোড়া হনুমান, চশমা হনুমান, উল্লুক, মায়া হরিণ, মেছোবাঘ, বন্যশুকর, গন্ধগোকুল, বেজি, সজারু ইত্যাদি। কোবরা, দুধরাজ, দাঁড়াশ, লাউডগা প্রভৃতি সহ এ বনে আঠারো প্রজাতির সাপের দেখা পাওয়া যায়। জানা যায় ৬০ এর দশকে এই বনে চিতাবাঘ আর বেঙ্গল টাইগারের ভালো বিচরন ছিলো। (তথ্যসুত্র- উইকি, নিসর্গ প্রজেক্টের বুকলেট)
ঢাকা থেকে এই অভয়ারন্যে দু ভাবে যাওয়া যায়, শায়েস্তাগঞ্জ হয়ে চুনারুঘাট থেকে অথবা শ্রীমঙ্গল থেকে। চুনারুঘাট থেকে যাওয়া তুলনামুলক ভাবে সহজ আর সময় ও কম লাগে। যেতে হবে ঢাকা হবিগঞ্জ কিংবা ঢাকা সিলেটের বাসে। চুনারুঘাট দিয়ে যেতে হলে নামতে হবে শায়েস্তাগঞ্জ বাইপাসে। সেখান থেকে শেয়ারের (অথবা রিজার্ভ) সিএনজি ট্যাক্সিতে চুনারুঘাট, সময় ১৫ মিনিট। চুনারুঘাট থেকে অভয়ারন্যের প্রবেশ পথ পর্যন্ত সিএনজি সার্ভিস আছে অনিয়মিত যদিও, সময় লাগে আধা ঘন্টা থেকে ৪৫ মিনিট। তবে রিজার্ভ নিয়ে গেলেই ভালো, ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা ভাড়া নিবে। শ্রীমঙ্গল থেকে যেতে হলে গাড়ী রিজার্ভ করে যেতে হবে, সময় লাগে দেড় থেকে দু ঘন্টার মতো। শ্রীমঙ্গল শহরে থাকার জন্য চলনসই মানের হোটেল আছে। এছাড়া টি বোর্ডের রিসোর্টে ও থাকার ভালো বন্দোবস্ত আছে। অভয়ারন্যে রাতে থাকার জন্য বনের প্রবেশ মুখে বন বিভাগের বিট অফিসের লাগোয়া নিসর্গ প্রজেক্টের ইকো ফ্রেন্ডলি কটেজ আছে। দু রুমের কটেজ, ৫-৬ জন থাকা যায়। বাংলোর কেয়ারটেকার ফরমায়েশ অনুযায়ী রান্না করে দেয়। খাবারের দাম রিজনেবল, মানসম্মত ও। বনে ঘোরাঘুরির জন্য নিসর্গের ট্রেনিংপ্রাপ্ত গাইড আছে, বেশ নলেজেবল, পারিশ্রমিক সারাদিন ট্রেকিংয়ের জন্য ৬০০ টাকা, খুব বেশি না। ট্রেকিং করার জন্য বেশ কটি ট্রেইল আছে এ অভয়রান্যে, এক ঘন্টা, দেড় ঘন্টা, তিন ঘন্টা আর সীমান্তবর্তী রেমা বিটে গিয়ে ফিরতে হলে ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ট্রেক করতে হবে। বর্ষাকালে যেতে পারলে বনের পুর্নাঙ্গ রূপ দেখা যায় কিন্তু জোকের খুব উপদ্রব থাকে, ইচ্ছে মত কামড়েছে আমাদেরকে। যারা আরো ইভেন্ট যোগ করতে চান তারা অদুরেই সাতছড়ি অভয়ারন্যে কিংবা লাউয়াছড়া অভয়ারন্যে ও ট্রেকিং করতে পারেন। আরো আছে চা বাগানের ভিতর দিয়ে ড্রাইভ করে মাধবপুর লেক দর্শন এবং সদ্য আবিস্কৃত হাম হাম জলপ্রপাত ট্রেকিং যা এডভেঞ্চারপ্রিয়দের ভালো লাগবে অবশ্যই । বলে রাখা ভালো নিসর্গ প্রজেক্ট হচ্ছে বাংলাদেশের প্রটেক্টেড ফরেষ্ট রক্ষা ও এর যথাযত ব্যাবস্থাপনার জন্য ফরেষ্ট ডিপার্টমেন্ট আর ইউএসএইডের একটি যৌথ উদ্যোগ। এবার তাহলে আমার আনাড়ি হাতে পয়েন্ট এন্ড শ্যুট ক্যামেরায় তোলা নট সো গুড ছবি দেখি-
অবজার্ভেটরী থেকে দৃশ্যমান বনের ক্যানপি লাইন-
টম কাকার কুটির (ফরেষ্ট ভিলেজারদের মক্তব)-
সর্বনাশা ক্রিপার (ভিতরে মৃত গাছ)-
খন্ড খন্ড টিলা জুড়ে গহিন বন মাঝখানে ধান ক্ষেত-
মুখ পোড়া হনুমান (কেপ্ড লেংগুর)-
জায়ান্ট স্কুইরেল (কাঠবিড়ালি), শুধু এই বনেই দেখা মেলে-
গ্রীন পিজিয়ন (অসম্ভব লাজুক এই পাখিটির ছবি তোলা দুস্কর)-
টি ইন্ডিকেটর গুল্ম (এই ফুল যেখানে দেখা যায় সেখানকার মৃত্তিকা চা চাষের উপযুক্ত বলে ধরা হয়)-
মন্তব্য
এমা দারুণ সব ছবি, উফফ এত্ত সবুজ।আপনার হাত মোটে ও আনাড়ি না।
প্রশংসার জন্য ধন্যবাদ। একটা ডিএসএলআর তাহলে কিনে ফেলতেই হয়।
চমৎকার - খুব যেতে ইচ্ছে করছে ট্রেকিংএ।
লেখকের নাম কোথায়? ছবির লিংকে দেখলাম ফ্লিকারে রাজীব ট্রেকার নামে আপলোড করা। তহলে আপনার আরো ট্রেকিং করা আছে নিশ্চয়ই? লেখা এবং ছবি চাই।
ছবি দেয়ার সময় নম্বর দিয়ে দিলে সুবিধা হয়। উপর থেকে ৮ নম্বর ছবিতে ওগুলো বনের মাঝে চাষের জমি নাকি? এভাবে কি বন উজাড় করা হচ্ছে নাকি এটাই স্বাভাবিক?
____________________________
সরি, অতিথি লেখক এর পাশে নিবন্ধিত নিকটা (অচিন পাখি) কিভাবে দিতে হয় জানিনা। মন্তব্য অংশে নাম প্রকাশ করতে হয়। খুব হাস্যকর শোনাল মনে হয়! বনের মাঝে চাষের জমি ই। এক সময় কন্টিনিউয়াস ফরেষ্ট কাভার ছিলো কিন্তু নিচু সমতল ভূমি গুলো এখন চাষের জমিতে রুপান্তরিত হয়েছে। আমাদের বন ব্যাবস্থাপনার যে অবস্থা তাতে বাকিটুকু বিলীন হতে সময় লাগবে বলে মনে হয়না। অন্যান্য ট্রেকিংয়ের লেখা কিছু এসেছে (অন্নপুর্না বেস ক্যাম্প ট্রেকিং, সান্দাকফু ট্রেকিং), আরো লিখছি। ধন্যবাদ পড়া/দেখার জন্য।
দারণ
আমার শৈশব কেটেছে এরকমই কিছু জঙ্গলে; দেখি ছবি থেকে কয়টা চিনতে পারি:
পত্রশূন্য গাছটা কি শিমুল?
কুটিরের উপরে গোলাচি গাছ?
এটা কি গ্রিন পিজিয়ন? আমরা একটাকে নীল ঘুঘু নামেই তো জানতাম
সাদা বুনো ফুলটা 'বুনো টগর/দুধফুল' নামেই পরিচিত
লাল ফলটার লোকাল নাম সম্ভবত 'কাউয়ালুলি' যদি তাই হয়ে থাকে তবে মারাত্মক বিষাক্ত। খেলে মানুষ মারা যায়। তার নীচের টি ইন্ডিকেটর ফুলটা সম্ভত 'লুটকি' দারণ কালি হয় এর ফল থেকে।
লটকনের সিলেটি নাম 'বুবি' আর এটা জঙ্গলেই হয়
আর সব শেষে; মৌচাকের গাছটা- চাম কাঁঠাল; দারুণ এক দুর্ধষ ফল
মাহবুব ভাই আপনার প্রতিটা অবজারভেশন ই সঠিক, শুধু লাল ফলটা আমার জানার বাইরে। গাইড কে জিজ্ঞেস করলে হয়তো বলতে পারতো। ধন্যবাদ।
বনের মাঝে চাষের জমি ই। এক সময় কন্টিনিউয়াস ফরেষ্ট কাভার ছিলো কিন্তু নিচু সমতল ভূমি গুলো কালক্রমে চাষের জমিতে রুপান্তরিত হয়েছে। আমাদের বন ব্যাবস্থাপনার যে অবস্থা তাতে বাকিটুকু উজার হতে সময় লাগবে বলে মনে হয়না। অন্যান্য ট্রেকিংয়ের লেখা কিছু এসেছে (অন্নপুর্না বেস ক্যাম্প ট্রেকিং, সান্দাকফু ট্রেকিং), আরো লিখছি। ধন্যবাদ পড়া/দেখার জন্য।
সুন্দর লেখা, সুন্দর ছবি। কিন্তু, লেখকের নাম কোথায়?
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
অচিন পাখি। প্রশংসার জন্য ধন্যবাদ।
স্নিগ্ধ
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
অসাধারণ সব ছবি! আর অসাধারণ তার বর্ননা!
ছবিগুলো দেখে আসলেই অন্য জগতে হারিয়ে গিয়েছিলাম।
ভালো থাকুন খুব, আর এরকম ছবিওলা লেখা চাই আরো।
-নিয়াজ
আরো আসবে। শুভকামনার জন্য ধন্যবাদ। আপনিও ভালো থাকবেন।
কি অসাধারণ যায়গা!!! আর,কী অসাধারণ ছবি!!!
আরো আরো পোস্ট দিন...
ধন্যবাদ। আসলে দেশেই সুন্দর সুন্দর অনেক আন-এক্সপ্লোরড্ জায়গা আছে।
সবুজ দেখলে নাকি চোখ ভাল থাকে!
ধন্যবাদ ভাই, চোখ ভাল থাকতে দেওয়ার জন্য!!!
রাসিক রেজা নাহিয়েন
ভালো বলেছেন।
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
পোস্ট ভাল লাগলো। নিয়মিত পোস্ট দেবেন আশা করি।
ঠিক বলেছেন . . চেস্টা করবো আমার ট্রেকিংয়ের অভিজ্ঞতা গুলো শেয়ার করতে . . . ধন্যবাদ
ভাই, পয়েন্ট অ্যান্ড শুট ক্যামেরাতে ছবি খুব ভালোই আসছে/// কোন মডেল কাইন্ডলি নামটা বলেন?
Panasonic Lumix FZ-35
ইসরাত
আপনি লিখেছেন তিন প্রকার বানর; কুলু, কুলু, রেসাস ও নিশাচর লজ্জাবতী বানর। কুলু বানর কি জিনিস??
ছবি গুলি অসাধারণ, এক কথায় দুর্দান্ত
mayeenrana17
লেঙ্গুরের কোনো একটা সাবস্পিসিস বোধকরি কুলু বানর নামে পরিচিত . . ছবি ভালো লেগেছে জেনে ভালো লাগলো . . .
নর্দান পিগ টেইল্ড ম্যাকাক (macaca leonina) আসলে কুলু বানর নাম পরিচিত . . . লেজ খানি শুকরের লেজের মত চিকন আর ক্ষুদ্র সেই কারণেই এই নাম . . . দুঃখিত আগের তথ্য ভুল দেয়ার জন্য. . .
বুলবুলিটা কিন্ত আসলে ফিঙ্গে , আপনি নামের জন্য এশিয়াটিক সোসাইটির বইগুলো দেখতে পারেন, সব প্রাণীরই বাংলা নামে আছে সেখানে।
লেখা এবং ঘোরাঘুরি জারি থাকুক
facebook
বন দেখে প্রাণ জুড়িয়ে গেল। কবে যে যাব এসব বনে!
দুর্দান্ত ছবি তুলেছেন ভাই। Y)
বর্ণিল অর্কিড নামের রঙিন অর্কিড টি দেখতে সিঙ্গাপুরের জাতীয় ফুল "Miss Joaqium " অর্কিড এর মত। এর বিশেষত্ব হলো এটি মাটিতে হয় , কিন্তু পাটগাছের মত উপরদিকে খাড়া থাকে আর এতে পাতার পরিবর্তে আছে গোলাকার কান্ড যা থেকে ফুল বের হয়।
http://en.wikipedia.org/wiki/Vanda_'Miss_Joaquim'
নতুন মন্তব্য করুন