সত্য ঘটনার ছায়া অবলম্বনে নির্মিত এই সিনেমার গল্পের প্রধান উপাদান দরিদ্র মানুষের বিশ্বাস, বন্ধুত্ব, আশা আর স্বপ্নভঙ্গের বাস্তবতা। দেশ-কাল-পাত্রভেদে চরিত্রের নাম হয়ত বদলে যায় কিন্তু সমাজের দারিদ্রসীমায় প্রতিনিয়ত জীবনযুদ্ধে লড়তে থাকা মানুষগুলির বেঁচে থাকার গল্পে খুব বেশি পার্থক্য থাকে কি? সুদূর উরুগুয়ের মেলো শহরের বেতো নামের এক পুরুষের জীবন সংগ্রামের কাহিনীতে সুস্পষ্ট দেখতে পাই বাংলাদেশের খেটে খাওয়া হতদরিদ্র কোনও আদম সন্তানের মুখচ্ছবি।
পেশায় বেতো(Beto) একজন স্মাগলার। উত্তর–পূর্ব উরুগুয়েতে ব্রাজিলের সীমান্তে অবস্থিত শহর মেলোর(Melo) এক গ্রামে স্ত্রী কারমেন আর একমাত্র কন্যা সিলভিয়াকে নিয়ে হতদরিদ্র সংসার তার। ৬০ কিলোমিটার দূরে সীমান্তের ওপারে ব্রাজিলের আচেগুয়া(Acegua) শহরে প্রতিনিয়ত বাজার করতে যায় বেতো সাইকেলে চেপে। নিত্যপ্রয়োজনীয় সওদার প্যাকেটে লুকিয়ে নিয়ে আসে কয়েক ডজন ব্যাটারি নয়ত দুই বোতল হুইস্কি। মেলো শহরের মুদি দোকানগুলিতে সেই সব ছোটখাটো চোরাকারবারি জিনিস সাপ্লাই দিয়েই জীবিকা নির্বাহ করে। উরুগুয়ের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর চেকপোস্ট এড়াতে মূল সড়কপথ ছেড়ে ঘুরপথে জলকাদা মাখা মেঠো পথে সাইকেল নিয়ে চলাটাই স্বাভাবিক। তারপরও মাঝেমাঝে পুলিশের পেট্রোল গাড়ির পরিদর্শনের মুখোমুখি হয়ে হারাতে হয় সেই দিনের উপার্জন। অসাধু পুলিশের সাথে গোপন বোঝাপড়ায় কিন্তু ঠিকই মোটরসাইকেলে চেপে মূল সড়কপথেই হরদম চলছে চোরাচালানী। বেতোর মত হতদরিদ্র সাইকেল আরোহী চোরাকারবারিরাই হারিয়ে বসে সর্বস্ব।
এখন প্রশ্ন হল আমাদের এই ছিঁচকে চোরাকারবারি বেতোর সাথে ক্যাথলিক ধর্মগুরু পোপের টয়লেটের কি সম্পর্ক? পোপ তো থাকে ভ্যাটিকানে, বেতো মশাই পোপের জন্য টয়লেট বানিয়ে কি করবে? এখানেই ইতিহাসের একটি অতি ছোট্ট মুহূর্তের বাস্তব অবতারণা।
১৯৮৮ সালে তৎকালীন পোপ দ্বিতীয় জন পল দক্ষিন আমেরিকা ভ্রমণকালে পদধূলি রেখেছিলেন উরুগুয়ের মেলো শহরে, হাঁ আমাদের বেতোর বাড়ির কাছেই। সাজসাজ রব পড়ে গিয়েছিলো পুরো শহরে। বেতোর স্ত্রী কারমেনের মত ধর্মপ্রাণ মানুষের হৃদয়ে পোপকে সামনাসামনি দেখার একটি সুযোগ যেমন আনন্দ বয়ে আনে তেমনি দারিদ্রের যাঁতাকলে পিষ্ট মেলোর কিছু মানুষ পোপের আসন্ন তীর্থযাত্রার মাঝেই খুঁজে পায় টুপাইস কামানোর ধান্ধা।
লোকাল রেডিও-টেলিভিশনের অতি উৎসাহী সাংবাদিকরাও ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে পোপ আসার খবরটাকে খেঁটে খাওয়া সাধারণ জনগনের আকাশচুম্বী আশার প্রতীকে রূপান্তরিত করে তুলে। এত ছোট এক শহরে ৫০ হাজার তীর্থযাত্রী আসবে এমন আশায় একজন তো ঘরবাড়ি বিক্রি করে কিনে ফেলল দুটি গরু। জবাই করে সেই গোমাংস পুড়িয়ে আসাদো চাপ বানিয়ে একদিনেই করে ফেলবে দ্বিগুণ লাভ এমন আশায় ভিটেবাড়ি খোয়ানোর পরোয়া করতে পিছুপা হয়নি সে। আরেকজন কিনে ফেলল ৫ হাজার রুটি আর ৭৯ কিলো মাংস রাস্তার পাশে একদিনের জন্য ফাস্টফুড শপ খুলে বসবে বলে। রাতারাতি ভাগ্য পরিবর্তনের স্বপ্নে বিভোর আরও অনেকে খুলে বসল চায়ের দোকান, মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, গরম গরম চরিসো সসেসের ঝুপড়ী দোকান।
বেতো তো আরেক কাঠি সরস, সে ঠিক করল বানাবে পাবলিক টয়লেট, হাজার হাজার লোক আসবে...... কত খানাপিনা হবে...... প্রকৃতির ডাকেও তো তাদের সাড়া দিতে হবে। হিসেব করে দেখল যা কামাবে তা দিয়ে সব দায়দেনা চুকিয়েও কিনতে পারবে একটি মোটরসাইকেল, কন্যা সিলভিয়াকে ভাল পড়াশুনার জন্য পাঠাতে পারবে রাজধানী মন্তেভিদেওতে।
আমার শৈশবে-কৈশোরে দেখা বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের টয়লেটগুলির করুণ চিত্রের স্মৃতি এখনও উজ্জ্বল! আশির দশকের স্যানেটারি টয়লেট বিপ্লবের পূর্বে রাজধানীর থেকে মাত্র ২০ মাইল দূরত্বে থাকা মামাবাড়ি আর সুদূর দক্ষিণবঙ্গের দাদাবাড়ির টয়লেট ছিল সমান ভয়াবহ। উরুগুয়ের মেলো নিবাসী বেতোর নিজের টয়লেটের অবস্থাও সঙ্গিন! মোটামুটি মানের পাবলিক টয়লেট বানানোর পুঁজি তো কোনও জন্মেও তার ছিলনা। তারপরও হাল ছাড়ার পাত্র সে না, সন্তানের উচ্চশিক্ষার জন্য লুকিয়ে জমানো স্ত্রীর সঞ্চয় চুরি করতেও দ্বিধাগ্রস্থ হয়না দারিদ্র থেকে আজীবনের জন্য মুক্তি পাবার রঙ্গিন স্বপ্নে।
ফিল্মের বাকি গল্পটা ইতিহাসের এক নির্মম পরিহাস, সত্য ঘটনার ছায়া অবলম্বনে রচিত চিত্রনাট্যের শেষ অধ্যায় খুঁজে বের করে দেখার দায়িত্ব আগ্রহী পাঠকের হাতেই ছেড়ে দিলাম। ২০০৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত স্প্যানিশ ভাষী এই সিনেমার ইংরেজি সাবটাইটেল নেটে সহজলভ্য।
কম বাজেটের ভাল সিনেমার প্রতি আমার আগ্রহ চিরদিনের। এই ফিল্মের কেন্দ্রীয় চরিত্র বেতোর ভূমিকায় থাকা অভিনেতা Cesar Troncosco অভিনীত আরও কিছু সিনেমা দেখেছি, তবে নির্দ্বিধায় বলতে পারি বেতো চরিত্র তার সেরা কর্ম। সিনেমার বাকি সবাই মোটামুটি নন প্রফেশনাল আর্টিস্ট। রাজধানী যেয়ে উচ্চশিক্ষা আহরণের স্বপ্ন দেখা সিলভিয়া চরিত্রের বালিকার নিষ্পাপ মুখের নিস্তব্দতা যেন তাঁর মনের অনেক না বলা কথা বলে দেয়। লাতিন আমেরিকার ফিল্মগুলির আবহসংগীত চমৎকার হয়, এল বানিয়ো দেল পাপা সিনেমাটিও এর ব্যাতিক্রম নয়।
(সিনেমাটি দেখার সময় বারবার মনে পড়ে যাচ্ছিল উরুগুয়ে থেকে সাত সমুদ্র তের নদী পেড়িয়ে থাকা আমার জন্মভুমির কথা, পত্রিকার পাতায় পড়া ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী গরীব মানুষদের জীবনযুদ্ধের গল্প, কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলে থাকা কিশোরীর নিষ্প্রাণ দেহের ছবি। শুধুমাত্র বেঁচে থাকাটাই হতদরিদ্র মানুষের জন্য অত্যন্ত কষ্টকর তা পৃথিবীর সব দেশের জন্য সমান প্রযোজ্য।
বরাবরের মতই এটি কোনও ফিল্ম রিভিউ নয়, নিজের ভাল লাগাটাই শেয়ার করি। পোস্টের সব ছবি নেট থেকে সংগৃহীত)
......জিপসি
মন্তব্য
সুন্দর রিভিউ। মুভিটা দেখতে হচ্ছে
-আরাফ করিম
অবশ্যই দেখবেন ...... ডাইরিতে ফিল্মের নামটি লিখে রাখুন, সময় সুযোগমত যোগাড় করে নিবেন।
......জিপসি
যে বই আমি পড়ি নি সে বই নিয়ে আলোচনা কেউ করলে যেমন অসহ্য লাগে, তেমনি অসহ্য লাগে না দেখা ফিল্ম নিয়ে কথা বললেও...আশ্চর্য! যেটা আমি দেখি নি বা পড়ি নি সেটা আগেই যদি জেনে থাকি কতটা উপভোগ করব?
লেখককে অনেক ধন্যবাদ পুরো কাহিনী না বলার জন্য...!
যতটুকু অনুমান করা যায় করলাম, ফিল্মটা যদি দেখার সৌভাগ্য হয় আর যদি দেখি আমার অনুমানের সাথে একদম মিল নেই, তাহলে আমার থেকে খুশি কেউই হবে না !
রাসিক রেজা নাহিয়েন
আপনি তাহলে ফিল্ম রিভিউ সাইটগুলি এড়িয়ে চলবেন...... আমিও আগে রিভিউ পড়ে তারপর সিনেমা দেখিনা।
অচেনা দেশের ফিল্ম দেখাটা আমার একরকম শখ, অনেকসময় তো পোষ্টার দেখেই ডাউনলোড করতে বসে যাই......
......জিপসি
লা মিজারেবল মনে পড়ে গেল।
__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার
হায়রে বেতো......হায়রে দারিদ্র...
......জিপসি
ছবিটা দেখার আগ্রহ হচ্ছে
ইসরাত
পারলে ভাল কোয়ালিটির ফরম্যাটে ফিল্মটি দেখুন, উরুগুয়ের ল্যান্ডস্কেপ বড্ড সুন্দর!
......জিপসি
সবখানেই সাধারন মানুষের কাহিনিগুলো একই রকমের। জীবনের যাঁতাকলে পিষ্ট হতে হতে স্বপ্ন দেখা, উচ্চাশা আর সোনার হরিণের পেছনে ছুটতে চাওয়ার অদম্য বাসনা - পৃথিবীর যে কোনায়ই থাকুক না কেন, সব মানুষই আসলে এক, এক তাদের জীবন সংগ্রামের চিত্র।
____________________________
আপনি খুব সুন্দর করে পোষ্টের মূল বক্তব্বের সারমর্ম লিখে ফেললেন, আপনার অভিমতের সাথে আমি একমত।
......জিপসি
নতুন মন্তব্য করুন