হাত বাড়িয়ে বেডসুইচ খুজতে গিয়ে পেলেন না। কেমন একটা চোরা অস্বস্তি হল। নাকি অস্বস্তিটাও কাল্পনিক? গাঢ় গভীর ঘুম এবং পুরোপুরি জেগে ওঠার মধ্যবর্তী অবস্থার মাঝে একটা ছেড়াছেড়া আধা বাস্তব, আধা কল্পনা বা স্বপ্ন প্রসূত জগৎ থাকে, যেখানে তৈরী হয় বাস্তব-পরা বাস্তব-অবস্তাবের অপূর্ব গোলকধাঁধা ককটেল, স্বপ্নকে স্বপ্ন বলে মেনে নিতে কষ্ট হয় খুব। দিলীপবাবুর অবস্থাটাও সেরকম। এরম কেন হয় মাথামুন্ডু খুজে পাননা তিনি। এক দিনের ব্যাপার হলে সেটাও না হয় মানা যেত, তাও বছর কয়েক আগে হলেও পিতৃপুরুষের বারো ইঞ্চি দেওয়ালের পুরোনো নোনাধরা বাড়ীর হ্যাংওভার বলে দিব্বি চালানো যেত। কিন্তু ফ্ল্যাটে ওঠার ছ বছর পরেও একই ভুল? না, ভুল বললাম। বরং বলা যেতে পারে অভ্যেস, বদঅভ্যেস বা প্রলম্বিত অভ্যাসগত প্রতিবর্তক্রিয়া।
আসলে রাতে, আরো পরিষ্কারভাবে শেষরাতে একবার পেচ্ছাপ নাকরলে ঘুমিয়ে তৃপ্তি পান না দিলীপবাবু। আগে মাথার কাছটায় টুলে কুজো রাখতেন। তারপর সেটা বদলে গেল ঠান্ডা পাণীয়র বোতলে ভরা জল। এবং সেটা সোজা চালান একেবারে বিছানার ভেতর। ঘুমের মধ্যে স্লিপ ওয়াকিং এর মত কোন এক অলৌকিক জাদুবলে বোতলের ঢাকনা খুলে জল খেয়ে আবার ছিপি বন্ধ করতেন তিনি। প্রথম প্রথম স্ত্রী বিশ্বাস করতেন না। ভাবতেন, চিরাচরিত স্বামীসুলভ হ্যাজানো। কিন্তু একদিন আবিস্কার করলেন এই অসামান্য নৈপুণ্য, যা নিস্তরঙ্গ একঘেয়ে প্রাত্যহিকতায় টেলিফোনিক হিল্লোল তুলে বিদায় নিল।
-‘এই কাল যা একটা জিনিষ দেখলাম না। ঊঃ’
-‘কি গো কি?’
- ‘রাতে কি একটা খুচুরমুচুর শব্দ শুনে ঘুমটা গেল ভেঙে। জানিসত, আমার ঘুম পাতলা, কোন শব্দ হল তো ব্যাস। তো ঘুম ভেঙে ডিমলাইটের আলোয় দেখি তোর জামাইবাবু ঘুমের মধ্যেই ছিপি খুলে জল খেলো, জানিসত, ও মশারীর ভেতরে ঐ পেপসির বোতলে জল নিয়ে শোয়। তো জল খেয়ে ছিপি লাগিয়ে আবার ...
- ধুর পাগল নাকি? ঘুমের মধ্যে জল? তালে তো দেখতে হয়। দেবে, দেখতে?
- মার খাবি,বুঝলি। ঠিক আছে পুজোর সময়। ঠিক আছে, এখন রাখছি, ঠিক আছে?
মশারিটা বেশ কিছুক্ষন নিষ্ফল খামচাখামচি করে একটা ঝটকা লাগল মাথায়, হঠাৎ করে নেশা কেটে যাবার মত ভয়ানূভুতি হল। বুঝতে পারলেন, এ বাবা, কি করছিলাম এতক্ষণ? সাড়ে ছশ স্কয়ার ফুটের মার্বেল ফিনিশ ফ্ল্যাটে বেমানান বলে আনাই হয়নি বিয়েতে পাওয়া মশারীর ডাশা লাগানো ওরিজিনাল টিকের খাটখানা, যেটায় হঠাৎ করে একদিন বেডসুইচ লাগিয়ে নিজের ছেলেবেলা সুলভ কারিগরি কৃতকৌশলে অভিভূত হয়ে ভর সন্ধেবেলা ডাকব কি ডাকব না করেও মিলিকে ডেকেই ফেলেছিলেন। আসলে নিয়মকরে রুটিন মেনে ঘুমজাড়ানো চোখে গোঁজামশারী সরিয়ে টলতে টলতে চোখ ঘষটাতে ঘষটাতে আদ্দিকালের কালো সুইচ টিপে আলো জ্বালানো; সেখানেও একটু এদিক ওদিক হলেই বাড়তি পাওনা সুইচ বাবাজীর অভিমানী ঝটকা। আর সেটা সেই শেষরাতের তলপেট ফেটেযাবার মত দশায় খুব একটা সুখানুভূতি দেয় না, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কাঁহাতক আর সহ্য হয় একই প্যাঁচাল।
বেডসুইচ সেট করার দিন, না, ভুল বললাম, রাতে ঠিকঠাক ঘুম আসছিল না। খালি মনে হচ্ছিল, একটু জ্বাললে কেমন হয় মালটা, দেখিতো। আর সেটা করতে গিয়ে দিলীপবাবু আবিষ্কার করলেন, ঘুমন্ত মিলির কপালে বিরক্তিরেখা। ভীষন অবাক হয়ে দিলীপবাবু আর ওটার অপব্যবহার করেন নি। ছেলেবেলার নতুন জুতো-জামার একটা নতুন নতুন রেশ থাকে, ক-দিন পরেই আবার মিয়িয়ে যায় সেটা; পৃথিবীর আর সব উপকরণের মতই এই বেডসুইচেও অভ্যস্ত হয়ে গেলেন উনি। রাত তিনটা সাড়ে তিনটার দিকে শুধু একটা খট, মিনিট পাচেক পর আরেকটা খট। ব্যাস। আবার অন্ধকার।
সেসব গল্প, স্মৃতি মাঝে মাঝে মনে হয় পূর্বজন্মের, যদিও পূর্বজন্ম বলে কিছু আছে নাকি, সেটাই ধোঁয়া ধোঁয়া মনে হয় দিলীপবাবুর। আবার মাঝে মাঝে, বিশেষত শেষ রাতে, ঘুম ভাঙার সময় ওনার মনে হয়, এইত্ত, এক্ষুনি ছিল না জিনিষটা এখানেই? আবার মশারির সাবধানী খুচুরমুচুর। তারপর নিয়মমাফিক মস্তিষ্কে বিদুৎ তরঙ্গ। এই জন্ম থেকে ঘটনাটা, জিনিষটা, খুচরো স্মৃতিখানা সোজা পূর্বজন্মে চালান। নিজের খেয়ালে নিজেই নিঃশব্দে হেসে ওঠা।
আর, একটু বাদেই, বাথরুমে কমোড-ফ্ল্যাসের প্রলম্বিত হিশহিস থেমে গেলে দিলীপবাবু খুব সাবধানে মশারী গুজে দেয়ালে প্ল্যানমাফিক সেটিত সুইচখানার গায়ে একটা আলতো ছোঁয়া দেন। পুরোনো বেডসুইচটার ‘খটাশ’ শব্দটা খুজতে খুজতে বালিশে মাথা এলিয়ে দেন। রাস্তার আলোর ছিটে লাগে মিলির কপালে। দিলীপবাবু অভ্যাসমত পরখ করেন বিরক্তিরেখার গাঢ়ত্ব।
**************************************
# দীপালোক
মন্তব্য
বেডসুইচে শক খাবার ভয়াবহ স্মৃতি মনে করিয়ে দিলেন।
সত্যি কথা বলতে এ গপ্পটা পুরোটা বানানো নয়। জল আছে, তবে দুধও আছে।
ও, আরেকটা মিনি গল্প মনে পড়ল। (এটা বছর বিশেক আগের সত্যি ঘটনা )
এক লোক ছাগল কিনে এনে বাসায় রেখে বাথরুমে গিয়েছে ফ্রেশ হতে।
ছাগল দেখে মুখের সামনে বেডসুইচ, দেখেই কামড় বসিয়ে দিল সে। বেচারা ছাগলের জীবনের সমাপ্তি হয়েছিল সেখানেই।
[এরকম ভাবে, সব ছাগলের মুখের সামনে বেডসুইচ রেখে আসলে কেমন হয়? ]
____________________________
অভ্যাস বড় কঠিন সঙ্গী, কিছুতেই ছেড়ে যেতে চায় না।
লেখা ভাল লাগল।
২২০ ভোল্টের দুনিয়ায় বেড-সুইচ সাংঘাতিক জিনিস ছিল।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
মশারির ডাসা লাগানো খান, সেখানে বহু কসরত করে সেটিত বেডসুইচ, তার দিয়ে পিপড়ের ওঠানামা - টুকরো টুকরো ঘটনা, দৃশ্য স্মৃতি হয়ে আছে।
ছোটবেলায় ১ বার বাবাকে শক খাইয়েছিলাম এই বেড সুইচ এর চক্করে। ইঞ্জিনিয়ারিং টা একটু বেশি ই হয়ে গেছিল
আগের কমেন্টটায় নাম বলতে ভুলে গেছি। আমি ঋতম। আমি আজ জয়েন করলাম সচলে।
-- ঋতম
হে হে
ওফ ! খালি নাম লিখতে ভুল হচ্ছে।
---- ঋতম
ভাষার গাঁথুনীটা বেশ ভালো লাগল।
facebook
ভালো লাগলো, আরো ভালো চাই--------
-নিয়াজ
নতুন মন্তব্য করুন