ভদ্রলোকের নাম লুইজি রোসেত্তো (Luigi Rosetto), পেশায় চিত্রশিল্পী। নামডাক বেশ আছে আশেপাশের ভ্যালিগুলিতে। থাকেন একটু দূরের এক শহরে কিন্তু স্টুডিও খুলে বসেছেন আমি যে শহরে থাকি সেখানকার ৯০০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত এক পাহাড়ি ছোট্ট জনপদ দুরলোতে (Durlo)। যতবারই হাইকিং করতে যাই কোনও পাহাড়ি ট্র্যাকে, ফেরার পথে মাড়াতে হয় সেই স্টুডিওর সামনের রাস্তা। চিত্রকলা আমার মাথায় ঢুকে না খুব একটা, সুন্দর ছবি দেখতে ভাল লাগে, কয়েক মুহূর্ত স্থির তাকিয়ে থাকি ব্যাস ঐটুকুই। স্কুলের ড্রয়িং খাতায় কোনদিন পাস মার্ক তুলতে পারিনি।
দুরলো নিয়ে কিছু লিখব বলে চিন্তাভাবনা ঘুরঘুর করছিল মাথায় বেশ কিছুদিন থেকেই। সারাবছর বসবাস করে মাত্র ৩০ জন মানুষ এমন শান্ত পাহাড়ি জনপদ হাঁটার উত্তম স্থান। ঠিক পিছনেই আছে প্রায় দুই হাজার মিটার ছুঁইছুঁই উঁচু পর্বতমালা। ড্রাইভিং লাইসেন্স হাতে পাবার পর থেকেই দুরলো যাওয়া-আসা শুরু, সেও তো এক দশক পেড়িয়ে গেছে। এবছর তো পায়ে হেঁটেই দুরলো যাবার রাস্তা আবিষ্কার করে ফেলেছি, মোটামুটি সেই জনপদের পুরো এলাকাটাই ভেজে খেয়েছি বলে মনে হচ্ছিল।
মন্তে টেলেগ্রাফো
দুরলোর শরত
ভুল ভাঙল লুইজির স্টুডিওতে কৌতূহলবশত ঢুঁ মারতে গিয়ে। সেদিন ছিল রবিবার, ট্র্যাকিং করতে গিয়েছিলাম দুরলোর ঠিক পিছনের টেলেগ্রাফ পর্বতশৃঙ্গে(Monte Telegrafo)। জানতাম এটিই সিজনের শেষ হাঁটাহাঁটি, অক্টোবর মানেই তো অঝোর বৃষ্টি আর হিম বাতাসে ভেসে আসা শীতের আগমনী বার্তা। ফেরার পথে ঠিক করলাম যাব আজ পেইন্টার বাবুর স্টুডিওতে, বরফ পড়া শুরু হলে তো আর আসা হবে না দুরলোতে। মানবশূন্য গ্যালারিতে ঢুকে বিস্ময়ে হতবাক হওয়ার যোগার, লুইজির আঁকা ছবিগুলি যেন আমার অতিচেনা। ব্যাটা রংতুলিতে অসম্ভব সুন্দর যে ছবিগুলি এঁকেছে তাঁর অনেকগুলিই তো আমার হার্ডডিস্কে আছে, হাইকিং করতে করতে ক্যামেরায় তোলা। আমাদের দুজনের দেখার দৃষ্টিভঙ্গিতেও মিল খুঁজে পেলাম।
অতি সজ্জন পেইন্টার বাবুর সাথে কিছুক্ষণ আলাপ করেও ভাল লাগল। দুরলোর প্রেমে পড়েই স্টুডিও খুলে বসেছে এখানে। খোলা থাকে শুধু রবিবারদিন, সপ্তাহের অন্যান্য দিনে পেশাগত কাজে ঘুরে বেড়ায় এক শহর থেকে অন্য শহরে। উত্তরপূর্ব ইতালির ভেনেতো প্রদেশের একেবারে সীমান্তবর্তী ক্রেসপাদোরো(Crespadoro) শহরে ১৯২১ সালে বাস করতো প্রায় তিন হাজার মানুষ। ৯২ বছর পরে জনসংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে অর্ধেকে! বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালীন শহুরে শিল্পায়নের ধারায় পাহাড়ি উপত্যকার বাপ-দাদার ভিটে ছেড়ে চলে গিয়েছে ক্রেসপাদোরোর অন্তর্ভুক্ত দুরলোর মানুষ। গুচ্ছগ্রামগুলিতে শুনশান নীরবতায় বৃদ্ধরা কাটিয়ে দিচ্ছে জীবনের শেষ দিনগুলি। লুইজির আঁকা ছবিগুলিতে দেখতে পাই দুরলোর সেই গুচ্ছগ্রামগুলির কালের পরিবর্তনের আবহমান ধারাক্রম।
হাইকিং সিজন শেষ হয়ে গেলেও দুরলো এমাসেই আরেকবার যেতে হবে। কাস্তানিয়া (castagna, chestnut) ফলের সুবিখ্যাত মেলায় আবার দেখা হবে পেইন্টার বাবুর সাথে। মন্তে পুরগা (monte purga) নামের পাহাড়টির আগ্নেয় মাটি শতবর্ষী কাস্তানিয়া বৃক্ষের সহায়ক বলেই আশেপাশের ভ্যালিগুলি থেকে অনেকগুণ বেশি কাস্তানিয়া গাছের দেখা মিলে দুরলোতে।
মন্তে পুরগার বাঁকে দুরলো
নীল আকাশ আর দুরলোর কাস্তানিয়া বৃক্ষ
গ্রীষ্মের কাঁচা কাস্তানিয়া
মাটিতে পড়ে থাকা পাকা কাস্তানিয়া (ছবি উইকিপিডিয়া)
৩৫ বছর থেকে চলে আসছে এই মেলা। হাজার হাজার লোকের এই সমাগমের পরেই দুরলো ফিরে যাবে তাঁর শান্ত কোলাহলমুক্ত চিরচেনা আবহে। ফিরে আসবে বরফে ঢাকা পর্বতমালার দিনগুলি যার তৈলচিত্র দেখেছি আমি লুইজির স্টুডিওতে।
পেইন্টার বাবু
......জিপসি
মন্তব্য
যেমন সুন্দর জায়গা, তেমন সুন্দর আঁকা, তেমন সুন্দর ফোটো, তেমন সুন্দর লেখা। মন ভরে গেল খুশীতে।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
বরফে ঢাকা দুরলোতে হাইকিং না করা পর্যন্ত আমার মনটা খুশিতে ভরে উঠছে না..... নতুন জুতো কিনে ফেলেছি এখন শুধু তুষারপাতের অপেক্ষা !
......জিপসি
আঁকা ছবি আর ফটোগ্রাফ পাশাপাশি দেখতে বেশ লাগছিলো।
লুইজির সব আঁকা ছবিগুলোতে বাস্তবচিত্র থাকলেও, আপনার দেয়া শেষ ছবিটাতে দাঁড়ানো দুরলোর পাশের পেইন্টিংয়ের ডানে (প্রায়) লুকানো বানরটা বেশ মজার।
ছবি ভালো লাগলো।
শুভেচ্ছা
......জিপসি
কি সুন্দর!!!!!! যেমন লেখা, তেমন ছবি আর তেমন সুন্দর জায়গা , চোখ আর মন দুই ই ভরে গেল
ইসরাত
কাস্তানিয়া ফলের মেলাতে আসলে পেটটাও ভরে যাবে!
১৮ অক্টোবর শুরু হবে তিনদিনের এই মেলা, পেইন্টার বাবুর ষ্টুডিও খোলা থাকবে মেলা উপলক্ষে
.....জিপসি
পাহাড় বোধহয় অনেকেরই খুব প্রিয় জায়গা (আমারও)। ভালো লাগলো আপনার লেখা।
একটা এলাকা ভেজে খেয়ে ফেলবার অনুভূতিটা বুঝতে পারছি
পাহাড়ের সৌন্দর্য একেক ঋতুতে একেকরকম, ঝরা পাতার এই দিনগুলি অসম্ভব সুন্দর! কাল সকালেও দুরলো গিয়েছিলাম মটিতে পরে থাকা কাস্তানিয়া টুকাতে!
.....জিপসি
তোলা ছবি আর আঁকা ছবির তুলনা দারুণ লাগলো । আপনার বর্ণনার ভিন্নতাও মুগ্ধ করলো ।
শুভেচ্ছা জানবেন ।
জেসমিন পলাশ ।
আপনাকে ধন্যবাদ, সাথে থাকুন..... পেইন্টার বাবুর দুরলোর শীতের চিত্রাঙ্কন নিয়ে লিখব সময়মত!
.....জিপসি
দারুণ!!!
.....জিপসি
আহা, দারুণ সব ছবি !
লুইজির আঁকা ছবিগুলি আসলেই খুব সুন্দর। বাকি ছবিগুলি নিয়ে আরেক কিস্তি লিখতে হবে দেখছি!
......জিপসি
আঁকা ছবিগুলো আমার কাছে অসম্ভব ভালে লেগেছে। ছবিগুলো নাম্বারিং করে দিলে আলোচনা করতে সুবিধা হতো। বিশেষ করে প্রথম দুইটি এবং পাহাড়ে কাজ করছে মানুষজন আর তারপরেরটি সত্যি অপূর্ব হয়েছে। পরের লিখার অপেক্ষায় থাকলাম। আপনার লিখাও ভালো লেগেছে ।
মাসুদ সজীব
ভবিষ্যতে ভেবে দেখব নাম্বারিং করা যায় কিনা।
আপনার ভাল লাগার প্রথম পেইন্টিং দুরলোর এক গুচ্ছগ্রামের, দ্বিতীয়টি মন্তে তেলেগ্রাফোর উল্টো পাশের জনপদ কাম্পোফন্তানার পাহাড়ি ভ্যালি।
দুরলো নিয়ে অবশ্যই আবার লিখব, তুষারপাতের অপেক্ষায় আছি!
......জিপসি
____________________________
থাম্বস আপ!
......জিপসি
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
থ্যাঙ্কু
......জিপসি
আমিও ভীষণ অবাক! আপনার তোলা ছবির সাথে পেইন্টার বাবুর আঁকা ছবির অদ্ভুত মিল!
লেখা খুব ভালো লেগেছে। ভালো থাকুন জিপসি ভাইয়া, খুব। আর হ্যাঁ, ঈদুল আযহার শুভেচ্ছা রইলো।
-এস এম নিয়াজ মাওলা
ভালো থাকব!
আপনাকেও ঈদের শুভেচ্ছা!!
.....জিপসি
আপনার তোলা ছবি আর পেইন্টিং এর মিল দেখে বেশ অবাক হলাম!
সবার আগে হতবাক তো আমিই হয়েছি!
ভাবছি একটা পেইন্টিং কিনেই ফেলব পয়সা জমিয়ে!
......জিপসি
নতুন মন্তব্য করুন