খুব ছোটবেলা থেকেই যেদিকে আমার চোখ খুব কম নিবিষ্ট হয়েছে তা হল কাঁচের আয়না। চেহারা দেখতে কেমন তা আমার সহধর্মিণীকে বহুবার জিজ্ঞাসা করেও খুব ভালো সদুত্তর পাইনি। তবে ইনিয়ে বিনিয়ে সে যা বোঝাতে চেয়েছে তাতেই বুঝে নিয়েছি মোটামুটি চালিয়ে নেয়ার মত। যাহোক সে কারনে নয় আসলে একটু অগোছালো থাকার কারনে নিজের এলোমেলো ভাবটাকে এই স্বচ্ছ বস্তুটির সামনে খুব একটা উপস্থাপনের উৎসাহ পাইনি। তবে মনের আয়নায় নিজেকে দেখবার আগ্রহ আমার সীমাহীন। প্রতিদিন দু একবার এই আয়নার সামনে আমাকে দাড়াতে হয় বৈকি। আমার সারাদিন ধরে ঘড়ি ধরে চলা যে জীবন সেখানে প্রতিদিনের কাজের শেষে একবার এই আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজেকে দেখে নেই। সেখানে প্রতিদিনের নানা আকৃতির আর বিচিত্র রকমের এই আমিকে আমি খুঁজে পাই। সময়ের স্রোতে বয়ে চলা মুহূর্তে নিজের সামান্য কিছু অবদান যেমন খুব পরিচ্ছন্ন ভাবে ফুটে ওঠে ওই কাচের ওপাশে একইভাবে অতৃপ্তির আর অসম্পূর্ণতার অমানিশায় কখনও আবছা অথবা ঘোলাটে মনে হয় নিজেকে।
এভাবে শুধু মনের আয়নায় নিজেকে খুঁজে ফেরার সাথে সাথেই আমার ঘরের সাদা চুনের দেয়ালে লেপটে থাকা আয়নাতেও চোখ পড়ে। কদাচিৎ হলেও এর সামনে গেলে সে অনেক ভুলের পরিশুদ্ধতা এনে দেয়। আমার সাড়ে তিন বছরের ছেলেটিও কেন জানি মাঝে মাঝেই আনমনে দাড়িয়ে থাকে আয়নার সামনে। নানা ভঙ্গিমায় সকলের অলক্ষেই সে নিজেকে দেখে নেবার এক নিবিড় অনুশীলনে মেতে ওঠে। কখনও একটু দাঁত বের করে দেখে নিচ্ছে দুই পাটি ভরাট দাতে তাকে কেমন লাগছে অথবা দুই বাহু দুজনের ওপর মেলে দিয়ে পরবর্তী ছবি তোলার সময় কোন ভঙ্গিমায় দাঁড়াবে তারও বোধ হয় একটা ড্রাই রিহারসেল সেরে নেয় সে।কথায় আছে যার হয় তার শুরু থেকেই। কথাটি আমার বেলায় না হলেও আমার ছেলের বেলায় বোধ হয় ঠিক হতে চলেছে।
সেদিন বোটে করে ছুটে যাচ্ছিলাম রাঙামাটির শুভলং খালের উপর দিয়ে। বেশ কয়েক দিনের টানা বর্ষণের পর এক ফালি রোদের উপচে পড়া হাসি। তার হাসিতে আমিও আহ্লাদিত হই। দুপুরের একটু কাছাকাছি সময়। তখনও অনেক দূরে কালো মেঘেদের উড়ে যেতে দেখলাম নিজ গৃহে। বেশ তিন চারদিন টানা বেড়াতে এসে একবারে পুরো দমে মনের মত করে সপ্তাহটা উপভোগ করে এবার নিজ গন্তব্যে সবেগে প্রস্থান যাকে বলে। কালো মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকলে সাদা মেঘের দ্যুতি বোধহয় আরও বেড়ে যায়। আর সাদার নিচে নীলাম্বরী মেঘ যেন এই ফাঁকে আরও গাঁড় নীল রঙের তুলিতে নিজেকে শানিত করে নেয়। খুব চমৎকার এক রঙের দোলা যেন স্বচ্ছ পানির আয়নার পুরোটা ফ্রেমে নিজেকে বন্দী করে ফেলেছে তখন।
(১)
(৩)
আমি জানিনা আকাশের নিচে থাকা মাটিতে এই মেঘ কখনও নিজেদের দেখতে পাই কি না । তবে এই স্বচ্ছ পানির উপরে যে তারা বিভিন্ন ভঙ্গিমায় নিজেকে দেখে নিচ্ছে তা বেশ ভালোই বোঝা গেল। নীল আকাশের ওপর শুভ্র মেঘেরা তখনও দোল দিয়ে যাচ্ছে। কখনও খণ্ড মেঘ কখনও আবার একসাথে জমাট বাঁধা সাদা তুলার দল ভেসে যাচ্ছে এক জায়গা থেকে অন্য অজানায়। তাদের চলার পথের বাকে একটু থেমে নিজেদের ঝালিয়ে নিতে দেখলাম।
(৪)
(৫)
(৬)
কেউ একাই ছুটে চলেছে তার পথে কেউ আবার হারিয়ে যাচ্ছে খুব চেনা সঙ্গ থেকে অজানার বাকে। খুব জানতে ইচ্ছে করছিল মেঘেদের মাঝে গেয়ে যাওয়া গুঞ্জন। আসলে মেঘেরা কি কথা বলে। ওরা কি নিজেদের সুন্দর করে নিতে আদৌ কোন প্রয়াস চালায়। এই প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খেয়েছে যখন দূর থেকে ভেসে আসা মেঘ মনে হল যেন আচমকা কোথাও দাড়িয়ে গেছে। মুহূর্তেই স্বচ্ছ পানিতে কিছু সময়ের স্থবিরতা। মেঘ তাদের নিজেদের প্রসাধন করে নিচ্ছে। কাজেই পানিদের এ সময় নড়াচড়া করতে নেই পাছে শুভ্র কেশী মেঘেদের আয়না দেখতে অসুবিধে হয়। এ যেন মেঘ আর পানির স্বচ্ছতার সাথে বহু বছর ধরে করে চলা এক অলিখিত সন্ধি।
(৭)
(৮)
(৯)
কিন্তু পানি চাইলেই সন্ধি অনুসারে তাদের সেই চুক্তি রক্ষা করতে পারে না। পানির উপর দিয়ে বয়ে চলা জলযান এ কাজে তাদের বড় প্রতিবন্ধক। আর সে কারনেই মেঘেরা খুব দ্রুত নিজের এলোমেলো ভাবটা ঠিক করে নিতে ব্যাকুল। তবে মেঘেদের স্থলে আমি হলে এই সব যানদের কপালে নিশ্চিত কটু কথা বরাদ্দ থাকতো। শুভ্র মেঘদের এই ঢেউয়ের ঝাঁপটা কিভাবেই না প্রসাধনে ব্যাঘাত ঘটায় আর তাতেই যে পানিদের কি অসহায়ত্ব তা সত্যি বেশ নিন্দনীয় কাজ। মেঘ আর পানিদের করা অলিখিত সন্ধির বাস্তবায়নে ব্যঘাত ঘটালেও আমার পুলক কিন্তু ধরে না। কি বিশাল নীল আকাশ আর অসীম পানির মাঝে ক্ষণিকের শুভ্র মেঘের ছোঁয়ায় উন্মুক্ত বিশাল আয়না।
(১০)
(১১)
(১২)
(১৩)
(১৪)
(১৫)
শিল্পীরা তাদের যে অসাধারণ শিল্প ফুটিয়ে তোলেন তাদের তুলির আঁচড়ে তাতো এই প্রকৃতির কাছ থেকেই ধার নেয়া। হরেক রঙের যে অপূর্ব খেলা তাতো এই প্রকৃতির কাছ থেকেই চেনা। এদের কাছে আমরা সবাই ঋণী। আজ মেঘের আয়নায় এই নীল আকাশ, শুভ্র মেঘ আর পানির যে বোঝাপড়া তা সত্যি প্রকৃতির কাছে আমাদের যে ঋণ তাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। এদের মোহনীয় রুপ আর প্রকাশভঙ্গীর যে সরলতা তা যেন এক অসাধারণ দ্যুতির প্রতিবিম্ব হয়ে ফিরে যাই আমাদের মননে আর প্রাণে। আর সেই তাগিদেই হয়তো এই সুদূর নদী বলি আর খাল বলি এদের সবার মাঝে নিজেকে সমর্পণের জন্যে আমাদের ছুটে আসা।
অমি_বন্যা
মন্তব্য
অপূর্ব, সবকটা ছবিই! তার মধ্যে ৯, ১০, ১৩ আর ১৫ নম্বর ছবিগুলো দেখে রাজহাঁস হয়ে যেতে মন চাইছে! কি করা যায়!
শুভকামনা
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
রাজহাঁস হতে মানা নেই তবে সাতার জানা আছে তো? ভালো থাকবেন সবসময়।
আরে, ওটাই তো জানা নেই
দারুণ দারুণ দারুণ সব ছবি।
(শুধু ৮ নম্বরটা একটু জ্বলে গেছে)
ধন্যবাদ ইয়াসির ভাই।
হুম একটু জিলে গেছে বৈকি।
ধন্যবাদ সুবোধ ভাই। ভালো থাকুন।
লেখা ছবি দুইটাই দারুণ লাগল।
নীল আকাশে জমে থাকা সাদা মেঘপুঞ্জি সারাদিন হাঁ করে বসে দেখতে পারবো। প্রকৃতির এই লাইভ এনিমেশন অনেক ভাল লাগে।
পোষ্টের শেষ ছবিটা পুরাই ডেস্কটপ ওয়ালপেপার!
……জিপসি
প্রকৃতির এই খেলা সত্যি দারুন। তবে এদের দেখার জন্য যে সময় দরকার ছিল তা দিতে পারিনি। চলতি পথেই যেটুকু দেখতে পেরেছি। মনে হয় যেন আরও অনেক্ষন ধরেদেখতে পারলে ভালো লাগতো আরও বেশী।
মন্তব্যেরজন্য ধন্যবাদ জিপসি
পোস্টের নাম না দেখেই পড়া শুরু করেছিলাম বা দেখলেও ততটা খেয়াল করে দেখিনি। পোস্টের শেষ লাইনে এসে যখন থেমেছি তখন ভাবছিলাম পোস্টের নামটি কী; আমি হলে নাম দিতাম মেঘের আয়না। স্ক্রল করে উপরে উঠে দেখি পোস্টের নাম সত্যিই মেঘের আয়না!!!
দারুণ সব ছবি। লেখাও ভালো লেগেছে।
মেঘেদের এই অসম্ভব সৌন্দর্য যেদিন ক্যামেরা বন্দী হয়েছে সেদিনই এই নাম ঠিক করেছি। আপনার ভাবনার সাথে মিলে গেলো, দারুন লাগছে।
বেশ কয়েকটি ছবি প্রায় একি রকম। আরেকটু বৈচিত্র্যময় হলো ভালোলাগা টা আরো বেশি হতো (হয়তো আমার চাওয়ার মাত্রা টা একটু বেশি তাই এমন মনে হতে পারে)। যে ছবিগুলোতে আকাশ পুরো নীল হয়ে এসেছে, জলের মাঝে মেঘের প্রতিচ্ছবি পড়েছে সেগুলো দুর্দান্ত হয়েছে (১,৩,৫ প্রভৃতি) আর শেষের টি বোধহয় সবচেয়ে বেশী আকর্ষনীয় হয়েছে।
মাসুদ সজীব
মাসুদ ভাই, আসলে এরচেয়ে বেশী বৈচিত্র আনতে পারিনি কারণ খুব বেশী সময় দিতে পারিনি। আবার ফিরে আসার পথেও এদের দেখা মেলেনি ঠিক আগের মত করে।
মন্তব্যের জন্য । ভালো থাকুন।
জলরাশি দেখতে ভাল লাগে, যদিও সাঁতার জানা নেই। আর, তার ওপর মেঘের ছায়া আরও ভাল লাগলো।
ছবিগুলো কি সব ডাঙা থেকে তোলা?
শুভেচ্ছা
ছবিগুলো চলার পথে বোট থেকেই তোলা। ডাঙা থেকে তোলার সুযোগ হয়নি।
ভালো থাকবেন। মন্তব্যের জন্য
আয়নাময় প্রথম ছবিটা দেখে কিছুক্ষণ অবাক হয়েছিলাম। রাঙ্গামাটি লেকের পানি এখনো এতটা স্বচ্ছ আছে? পরে বুঝলাম প্রতিফলনই স্বচ্ছতা নয়। আকাশ আর জলের মাখামাখি ভালো লাগলো
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
পরে বুঝলাম প্রতিফলনই স্বচ্ছতা নয় ।
রাঙামাটির লেকের পানি আগে কেমন ছিল জানিনা তবে এখন অস্বচ্ছ, নীড় দা। সেদিন অনেক বৃষ্টির পর একটু রোদের খেয়ালে মেঘমুক্ত আকাশের যে অবস্থা হয় আমার ছবিগুলো ঠিক সেই মুহূর্তে পানির ওপর পড়া স্বচ্ছ মেঘের প্রতিফলন।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।
সুন্দর
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
ধন্যবাদ নজরুল ভাই। ভালো থাকুন সবসময়
ভালো লাগলো।
ফেইসবুক
---------------------------------------------
এক আকাশের নীচেই যখন এই আমাদের ঘর,
কেমন ক'রে আমরা বলো হতে পারি পর. . .
সজল ছবির সাথে সরস লেখা - ভাল লেগেছে।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
সুন্দর কিছু দেখতে হলে দেখার চোখ লাগে। আর লাগে সুন্দর মন। ওই দুটো মিললে এমন ছবি বের করে আনার কথা কেউ ভাববে।
ছবির কারিগরীজ্ঞান আমার নেই। তাই আমার কাছে ছবি মানে হচ্ছে, দেখতে ভালো লেগেছে আর দেখতে ভালো লাগেনি। এই সিরিজের প্রত্যেকটা ছবি আমার ভালো লেগেছে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
পাণ্ডব দা, আপনার এমন মন্তব্যে আমার উৎসাহ আরও বেড়ে গেল। ভালো থাকবেন সবসময় ।
খুবই ভাল লাগলো।
ধন্যবাদ তানিম ভাই।
সুন্দর ছবি! সুন্দর লেখা!
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
ধন্যবাদ দাদা।
তবে তো মেঘেরাও আমার মত আয়না দেখতে খুব পছন্দ করে!!! ..........ভালো লাগলো ! ছবিগুলো সুন্দর , তার সাথে লেখাটাও ....
ওয়াসিকা
তাহলে তো মেঘের সাথে আপনার একটা মিল খুজে পাওয়া গেল মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। ভাল থাকবেন।
- আরাফ করিম
বেশ কয়েকদিন পরে আপনার দেখা পাওয়া গেল (মানে আপনার লেখার দেখা আর কি)। ছিলেন কোথায়?
লেখা আপনার মতই হয়েছে। ছবিগুলো সেরাম। আরো লিখুন।
____________________________
আসলেই অনেক দিন পর সচলে আমার লেখা দিলাম। সচলে লিখতে বরাবরই ভাল লাগে। আর লেখা ও ছবি ভাল লাগার জন্য ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন সব সময়।
দারুণ লাগলো ছবিগুলো।
টেডএ একটা টক আছে মেঘ দেখা নিয়ে। দেখতে পারেন…
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
ছবিগুলো সুন্দর। কয়েকটা ছবি একই রকম, যেমন ২-৪-৮, সেসব ক্ষেত্রে কিছু কাটছাঁট করলেও হত।
দারুণ!
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
ভালো, সুন্দর, দারুণ।
রাঙ্গামাটি যাওয়ার জন্য প্রাণের আইঢাই শুরু হয়ে গেলো আপনার ছবি দেখে।
পরের পর্ব দিতে ভুলবেন না।
ভালো থাকবেন অমি_বন্যা।
শুভেচ্ছা নিরন্তর।
----------------------------
কামরুজ্জামান পলাশ
নতুন মন্তব্য করুন