গ্রীক মিথলজি ২৭ (এপোলোর গল্পকথাঃ আমাদের রাজার গাধার কানের সোনালী স্পর্শ)

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বুধ, ২৭/১১/২০১৩ - ৭:৪৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মারসায়াসের সাথে সুরের প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়ে এপোলো তাকে কঠোর শাস্তি দিয়েছিলেন। কিন্তু দেবতা প্যানের সাথে ভিন্ন আচরণ করলেন। হয়তো দেবতা বলেই প্যানকে মারসায়াসের ভাগ্য বরণ করতে হয়নি!

দেবতা প্যানের সাথে এপোলোর প্রতিযোগিতার কাহিনীর আগে দেবতা প্যান সম্পর্কে কিছু বলা যাক। দেবতা প্যান ছিলেন মেষ পালকদের দেবতা, ছিলেন বন্য জন্তু, শিকার এবং লোকগানেরও দেবতা। তিনি অলিম্পাস পাহাড়ে বসবাসের জন্য জায়গা পাননি। তার বাসস্থান ছিলো আর্কাডিয়াতে। সেখানে তিনি পশু চড়াতেন, মধুর চাকা ভেঙে মধু সংগ্রহ করতেন। তবে বেশিরভাগ সময় অকর্মন্যের মতো পাহাড়ী ও জলের নিম্ফদের সাথে ঘুরে বেড়াতেন।

যাহোক, তিনি সিরিঙ্কস নামের এক নিম্ফের পিছনে ছুটতে গিয়ে তাকে না পেয়ে নলখাগড়া দিয়ে একটি বাঁশি তৈরী করেছিলেন। সেই বাঁশিটিকে বলা হতো সিরিঙ্কস বা প্যান-পাইপ।


দেবতা প্যান

দেবতা প্যান তার প্যান-পাইপ বাঁশিতে চমৎকার সুর তুলতে পারতেন। কিন্তু এপোলো যখন তার বীণায় সুর তুলতেন, অলিম্পাস কিংবা মর্ত্যে কেউ অমর সুর তুলতে পারতেন না। শুধু মিউজদের সুরের সাথেই এপোলোর বীণার সুরের তুলনা চলতে পারে। কিন্তু প্যানের সুরে যারা মোহিত হতেন, তারা বলাবলি করতেন, প্যান এপোলোর চেয়েও সুন্দর সুর তুলতে পারেন। প্যান আত্মতুষ্টিতে অহংকারী হয়ে একদিন এপোলোকে প্রতিদ্বন্দ্বিতারই আহবান করে বসলেন।

এই প্রতিযোগিতায় রাজা মিডাস ছিলেন অন্যতম এক বিচারক। রাজা মিডাস- যার স্পর্শে সবকিছু সোনায় পরিণত হয়ে যেতো। আরেকজন বিচারক ছিলেন নদীর দেবতা টোমুলাস।

প্রথমে প্যান তার বাঁশি বাজানো শুরু করলেন। তার সুরের মূর্ছনায় গাছের পাতাগুলি কেঁপে উঠলো, ঘুমন্ত লিলিফুলগুলো জেগে উঠলো। পাখিগুলো তাদের উড়া থামিয়ে দিয়ে তন্ময় হয়ে গান শুনতে লাগলো, তারপর আত্মহারা হয়ে সঙ্গীনীর সাথে মিলনের জন্য ছুটতে লাগলো। পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য যেনো আরো প্রস্ফুটিত হতে লাগলো, সমস্ত ভয় যেনো দূর হয়ে যেতে লাগলো। প্যানের বাঁশি বাজানো চলতেই লাগলো, সমস্ত নিম্ফ, উপদেবী, স্যাটির- সবাই আনন্দে নাচতে লাগলো। যখন প্যান থেমে গেলেন, মনে হলো সমগ্র পৃথিবী যেনো ক্ষনিকের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলো, নিশ্চুপ হয়ে গেলো। গর্বিত প্যান ঘুরে এপোলোর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললেন, “পারবে আমার মতো বাজাতে?”

তখন দেবতা এপোলো, যার রক্তবর্ণ পোশাক তার দেহের পরিপূর্ন অংগ-সৌষ্ঠব খুব একটা ঢাকতে পারেনি, যার পাকানো চুলে লরেল পাতার রাজকীয় মুকুট, প্যানের দিকে দেবতাসুলভ আভিজাত্য নিয়ে তাকালেন এবং মৃদু হাসলেন। কিছু সময়ের জন্য তার হাতের আঙ্গুলগুলো আলতোভাবে বীণার সোনালী তারগুলোর উপর মৃদুভাবে খেলা করলো। ঠিক সেই সময়ে মনে হলো যেসব সৃষ্টির আত্মা আছে, সেগুলোর যেনো পাখা গজিয়ে গেলো আর সেই পাখায় ভর দিয়ে সেই আত্মাগুলো যেনো অলিম্পাসের দিকে ছুটতে লাগলো। সেখানে যেনো মরণশীলদের মাঝে এক নির্মল আনন্দে বসবাস করতে লাগলো। সেখানে থাকলো না কোনো কোলাহল, কোনো অশান্তি। রইলো না অপরিচিতের সাথে পরিচিতের ভয়ংকর কোনো যুদ্ধ। পৃথিবীর সব পশুরা যেনো মানবীয় হয়ে উঠতে লাগলো, নিম্ফরা হয়ে গেলো বাকরুদ্ধ। প্রকৃতি যেনো সেজে উঠলো আপন মহিমায় অসাধারণভাবে। কোনোভাবেই যেনো এপোলোর বীণার সুরের সাথে অন্য কারো তুলনা চলে না! এপোলো যখন থামলেন, সমগ্র পৃথিবী যেনো নিশ্চুপ হয়ে রইলো, স্তব্ধ হয়ে রইলো ক্ষণকাল।

এপোলো মৃদু কন্ঠে জানতে চাইলেন, “কে বিজয়ী?” এবং পাহাড়, সাগর, আকাশ ও পৃথিবীর সব সৃষ্টি যেনো একসাথে বলে উঠলো, “আপনি, হে স্বর্গীয় দেবতা এপোলো, আপনিই বিজয়ী”। বিচারক টোমুলাসও বিজয়ী ঘোষনা করলেন এপোলোকে। শুধুমাত্র একটি কন্ঠ ব্যতীত।

আর সেই কন্ঠটা হচ্ছে রাজা মিডাসের।

রাজা মিডাস বিভ্রান্ত হয়ে বোঝা যায় না এমন স্বরে বলে উঠলেন, “যদি প্যান আবার বাজাতেন! তাহলে বোধহয় আমি বেঁচে থাকতাম! একমাত্র প্যানের সুরই আমাকে নতুন জীবন দান করে। আমার খুব ভালো লাগে প্যান-পাইপের সেই সুমধুর সুর, মনে হয় জীবনে এটি বসন্ত নিয়ে আসে। প্যানের বাজানো শুনলেই মনে হয় আমি আরো রেড ওয়াইন পান করি, এবং জীবনটাকে আনন্দের সাথে উপভোগ করি”! এরপর মিডাস তার কন্ঠস্বর উঁচু করলেন এবং জোরে জোরে ঘোষনা করলেন, “প্যানের সুর এপোলোর সুর অপেক্ষা শ্রুতিমধুর এবং বাস্তবানুগ। আমার কাছে প্যানই জয়ী হয়েছেন এবং আমি, রাজা মিডাস, তাকে বিজয়ীর মুকুট দিচ্ছি”।


টোমুলাস, যিনি হাত তালি দিচ্ছিলেন, তার পিছনেই বসে আছেন রাজা মিডাস। এপোলো তখন বীণা বাজাচ্ছিলেন। (শিল্পী- নিকোলাস এন্ড্রে মনসিয়াও, ১৮০৬ সাল)

প্রবল ঘৃণা নিয়ে এপোলো মিডাসের দিকে তাকালেন, কিছুক্ষণ চুপ থেকে এপোলো বলে উঠলেন, “একমাত্র গাধার কানই আমার সুরের মর্মার্থ বুঝতে পারবে না। আর মিডাসের কানও গাধার মতো বলেই সে আমার সুরের মর্মার্থ বুঝতে পারেনি”।

প্রচন্ড আশংকা নিয়ে মিডাস তার কানে হাত দিয়ে দেখলেন তার কান দুটো গাধার কানের মতো লম্বা হয়ে গেছে। চমকে উঠলেন রাজা মিডাস। সেই প্রতিযোগিতায় উপস্থিত সবাই হো হো করে হেসে উঠলেন। লজ্জায় সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচলেন মিডাস।

কিন্তু পালিয়ে যাবেন কোথায়? তিনি ফিরে এলেন ফ্রিজিয়াতে, সাথে থাকলো কান ঢাকার জন্য একটি ফ্রিজিয়ান টুপি। মুহুর্তের জন্যও তিনি টুপি খুলতেন না, যাতে কেউ তার গাধার কান দেখতে না পারে। এমনকি ঘুমাবার সময়ও তিনি টুপি পরে থাকতেন। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতেন- শীত পড়েছে খুব! তাই শীতের জন্য টুপি পরেছেন। কিন্তু একজনের নিকট থেকে ব্যাপারটি লুকোতে পারলেন না রাজা মিডাস, আর তিনি হচ্ছেন মিডাসের নাপিত।

মিডাস অবশ্য নাপিতকে আগেই সতর্ক করে দিয়েছিলেন, এই কথা যাতে বাইরে কেউ না জানতে পারে। নাপিতটি রাজার কথামতো কাউকে বললেন না। কিন্তু কিছুদিন পর নাপিতটির পেটে কথা থাকতে চাইলো না, পেটে ভুটভুট শব্দ করতো। তাই নাপিতটি এক মাঠে গিয়ে গর্ত করে সেখানে মুখ এনে বললেন, “আমাদের রাজার গাধার কান”। এই কথা বলে তিনি হালকা বোধ করলেন। তারপর গর্তটি মাটি চাপা দিয়ে আসলেন।

এরপর একদিন শীত চলে গেলো, এলো বসন্তকাল। সেই মাঠে গাছপালা জন্মালো, ফুলে ফুলে শোভিত হতে লাগলো। মৃদু বাতাসেই যখন গাছগুলো দুলে উঠতো, তাদের এক আওয়াজ শোনা যেতো। তারা যেনো বলতো, “আমাদের রাজার গাধার কান”, যা গাছপালার নিচের মাটিতে সমাধিস্থ করে গিয়েছিলেন মিডাসের সেই নাপিত। ধীরে ধীরে এই কথা সমস্ত রাজ্যে ছড়িয়ে পড়লো। রাজ্যের সবাই সেই মাঠে গিয়ে রাজার গোপন কথা শুনে আসতেন আর বিড়বিড় করতেন, “আমাদের রাজার গাধার কান”। তারা অবশ্য কেউই রাজার সামনে এই কথা বলতেন না, কিন্তু মিটিমিটি করে হাসতেন।

এপোলোর সাথে তার এক সন্তান সিনাইরাসেরও সুরের প্রতিযোগিতা হয়েছিলো। সেই প্রতিযোগিতায় সিনাইরাস পরাজিত হলে লজ্জায় আত্মহত্যা করেন।

রাজা মিডাসকে নিয়ে অবশ্য সবচেয়ে মজার কাহিনী হচ্ছে তার সোনালী স্পর্শ। দেবতা এপোলোর সাথে কাহিনীটির কোনো সংযোগ না থাকলেও কাহিনীটি এখানে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না।

এই কাহিনী হচ্ছে মিডাসের, গ্রীক মিথলজির অন্যতম ট্রাজিক কমেডিয়ান।

অনেক অনেক দিন আগে এক রাজ্য ছিলো, ফ্রিজিয়া। রাজ্য ছিলো, কিন্তু কোনো রাজা ছিলো না। সে রাজ্যের জনগণ রাজার জন্য দৈববানীর সাহায্য চাইলেন। দৈববানী করা হলো, “যে ব্যাক্তি সর্বপ্রথম শকটে (ষাড় চালিত গাড়ি) করে শহরে প্রবেশ করবে, তিনিই হবেন ফ্রিজিয়ার রাজা”। সেই দিন ছিল একটি ধীরে চলা দিন। কারো কোনো কাজ কর্ম ছিলো না, সবাই অপেক্ষা করছিলেন সেই প্রথম ব্যাক্তির জন্য যিনি শকটে করে শহরে প্রবেশ করবেন।

ফ্রিজিয়া থেকে বেশ দূরের ম্যাসিডোনিয়াতে বসবাস করতেন এক দরিদ্র কৃষক, গর্ডিয়াস। তিনি ছিলনে বলকান অঞ্চলের রাজকীয় পরিবার ব্রাইগেসের বংশধর। তিনি একদিন দেখলেন তার শকটের একপ্রান্তে এক ঈগল পাখি এসে বসলো, তিনি এটিকে দেবতা প্রদত্ত ইশারা বুঝতে পারলেন। এর মানে বোঝার জন্য তিনি পূর্ব দিকের পুরানো ধর্মীয় শহর টেলমিসসাসের দৈববানীর মন্দিরের দিকে রওয়ানা দিলেন। সেই সময়ে টেলমিসসাস ছিলো ফ্রিজিয়ার রাজধানী।

শহরের প্রবেশমুখে তার সাথে দেখা হলো এক নারী ভবিষ্যতদ্রষ্টার। তিনি গর্ডিয়াসকে জিউসের উদ্দেশ্যে কিছু উৎসর্গ করতে বললেন। তিনি বললেন, “হে কৃষক, আমাকে তোমার সাথে আসতে দাও, আমি দেখব তুমি উৎসর্গের জন্য ঠিক জিনিসটিই বাছাই করতে পারো কি না?” গর্ডিয়াস প্রত্যুত্তরে বললেন, “যে কোন পরিস্থিতিতেই তোমাকে খুব জ্ঞানী এবং দয়ালু নারী মনে হচ্ছে। তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে?” নারীটি তখন মৃদু হেসে বললেন, “যত দ্রুত তুমি উৎসর্গের কাজ শেষ করতে পারবে”। এরপর গর্ডিয়াস শকটে করে সেই নারীকে নিয়ে যখন শহরে প্রবেশ করছিলেন, শহরের প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশ করা মাত্রই জনতা উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। ‘স্বাগতম রাজা’, ‘স্বাগতম রানী’ বলে সম্বোধন করতে লাগলেন, শহরে স্বাগত জানালেন। এইভাবেই গর্ডিয়াস ফ্রিজিয়ার রাজা হলেন, প্রতিষ্ঠা করলেন এর নতুন রাজধানী গর্ডিয়াম।

রাজা হওয়ার কৃতজ্ঞতাস্বরুপ তার শকটের ষাড়গুলোর জোয়াল একটি জটিল গিঁটের সাহায্যে আটকিয়ে রাখেন। এই গিটটিকেই বলা হয়ে থাকে ‘গর্ডিয়ান গিঁট’ বা ‘গর্ডিয়ান নট’। বলা হয়ে থাকে, গ্রীক বীর আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট ৩৩৩ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে ফ্রিজিয়াতে এসে তার তলোয়ারের এক কোপেই এই গিঁটটি খুলে ফেলেন। মিথ ছিলো, যে এই গিঁটটি খুলতে পারবেন, তিনিই সমগ্র এশিয়া মাইনর দখল করতে পারবেন।


আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট গর্ডিয়ান গিঁটকে কাটছেন (শিল্পী- জন সিমন বেরথেলেমি, জীবনকালঃ ১৭৪৩-১৮১১ সাল)

রাজা গর্ডিয়াসেরই সন্তান ছিলেন মিডাস।

রাজা গর্ডিয়াস যেহেতু প্রথম জীবনে দরিদ্র কৃষক ছিলেন, তিনি তার সন্তান মিডাসকে শিখিয়েছিলেন অর্থের চাহিদা। গর্ডিয়াসের জীবনের নাটকীয় পরিবর্তনের মাধ্যমে যেনো গর্ডিয়াস বুঝতে পারলেন পৃথিবীতে অর্থই সব। আর অর্থের সবচেয়ে ভালো প্রতীক হচ্ছে সোনা। যার কাছে যত সোনা থাকবে, সে তত অর্থের মালিক হবে, তার তত ক্ষমতা থাকবে। গর্ডিয়াস তার এই জীবনবোধ পুত্র মিডাসের মধ্যেও সঞ্চারিত করেছিলেন। তাই মিডাসের মনেও সোনার প্রতি এক দুর্নিবার আকর্ষন ছিলো।

একদিন রাজা মিডাস তার সভাষদসহ বাগানে ঘুরছিলেন। হঠাৎ দেখতে পেলেন এক বোকা কিসিমের আলু থালু আত্ম-ভোলা বৃদ্ধ মানুষ উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। মিডাস খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন, তিনি হচ্ছেন দেবতা ডায়োনিসাসের অভিভাবক এবং সাথী স্যাটির সাইলেনাস। মিডাস তাকে স্বসম্মানের সাথে গ্রহন করলেন, তার সাথে খুব ভালো ব্যবহার করলেন, তাকে ভালো খাবার দিলেন, সোজা কথা, মিডাস সাইলেনাসকে খুব আরাম আয়েশেই রাখলেন। এভাবে দশদিন দশরাত পেরিয়ে যাবার পর একাদশতম দিনে ডায়োনিসাস তার গুরুকে খুঁজতে খুঁজতে রাজা মিডাসের কাছে এলেন। ডায়োনিসাস সাইলেনাসকে খুব ভালোভাবে দেখে মিডাসের প্রতি প্রচন্ড খুশি হলেন। তিনি মিডাসকে বর দিতে চাইলেন।

মিডাস দেবতা ডায়োনিসাসের কাছে বর চাইতে এক মুহূর্তও দেরী করলেন না।

“আমি সোনা চাই”, খুব দ্রুত উত্তর দিলেন মিডাস, “অনেক সোনা। আমি এমন ক্ষমতা চাই, আমি যাই স্পর্শ করবো সেটাই সোনাতে পরিণত হবে”। ডায়োনিসাস, যিনি জানতেন মিডাস এবং তার বাবা গর্ডিয়াসের কথা, খুব ব্যথিত চিত্তে রাজী হলেন মিডাসকে তার দাবীকৃত বর দিতে।

ডায়োনিসাস এবং সাইলেনাস গান গাইতে গাইতে চলে গেলেন, মিডাস প্রবৃত্ত হলেন তার ক্ষমতার সত্যতা পরীক্ষা করতে। কাছেই একটি অলিভ গাছ ছিলো। রাজা মিডাস সেই অলিভ গাছটাকে স্পর্শ করলেন। গাছের সমস্ত পাতা, ডাল, শাখা-প্রশাখাসহ গাছটি মুহূর্তের মধ্যে সোনায় পরিণত হলো। মিডাস বুঝতে পারলেন ডায়োনিসাস তার সাথে প্রতারণা করেননি। খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলেন মিডাস। যাই ধরেন, তাই সোনাতে পরিণত হতে লাগলো। তিনি আপেল স্পর্শ করেন, সেটা সোনা হয়ে যায়। তিনি প্রাসাদের স্তম্ভ স্পর্শ করেন, সেটা সোনা হয়ে যায়। রাজা মিডাস তার এই ক্ষমতা উপলক্ষে এক বিশাল ভোজের আয়োজন করলেন।

ভোজে ক্ষুধার্ত মিডাস যখন খাবারের প্লেট স্পর্শ করলেন, সেটাও সোনা হয়ে গেলো। যে খাবার তিনি খাবেন, তা স্পর্শ করলেন, তখন সেটাও সোনা হয়ে গেলো। খাওয়ার জন্য যাই স্পর্শ করতে লাগলেন, সেটাই সোনাতে পরিণত হতে লাগলো। ক্ষুধায় বিপর্যস্ত মিডাস মরিয়া হয়ে পিপাসা নিবারণের জন্য রেড ওয়াইনের গ্লাসে হাত দিলেন, কিন্তু পিপাসা আর নিবারণ হলো না। কারণ রেড ওয়াইনসহ গ্লাসটিও সোনাতে পরিণত হয়ে গেলো। মিডাস তার ভুল বুঝতে পারলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, সোনা ছাড়াও জীবন চলে, কিন্তু ক্ষুধা নিয়ে বেঁচে থাকা যায় না।

এমন সময় তার মেয়ে কাছে আসলেন। হতাশায় ভেঙ্গে পড়া মিডাস সান্তনার জন্য মেয়েকে ধরতে গিয়েই চরম ভুল করে ফেললেন। রাজা মিডাসের মেয়ে সঙ্গে সঙ্গে সোনাতে পরিণত হলেন। মিডাস প্রচন্ডরকম অনুতপ্ত হলেন। তিনি দেবতা ডায়োনিসাসকে খুঁজে বের করলেন, তার বর ফিরিয়ে নিতে বললেন।


মিডাস তার কন্যাকে স্পর্শ করা মাত্র সোনায় পরিণত হলো (শিল্পী-নাথানিয়েল হাওথার্ন)

তখন ডায়োনিসাস তার প্রতি দয়াপরবশ হয়ে বললেন, “সারডিস শহরে যাও। যে নদীর উপরে এই শহরটি তৈরী হয়েছে তার উৎসস্থল সন্ধান কর। সেই নদীর উৎসস্থলে গিয়ে অবগাহন করলেই তুমি বরমুক্ত হবে। তোমার মেয়েও বেঁচে যাবে”।

দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হলো মিডাসকে। ক্ষুধার্ত, পরিশ্রান্ত, বিধ্বস্ত মিডাস নদীর প্যাক্টোলাস নদীর উৎসস্থলে পৌঁছালেন, মনে হচ্ছিলো শরীরে আর কোনো শক্তি অবশিষ্ট নেই। ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে মিডাস কোনোক্রমে নদী পর্যন্ত গেলেন। মাথা এবং শরীর নদীর পানিতে ডুবিয়ে দিলেন। প্রতিমুহূর্তে আশংকা করছিলেন নদীর পানিও সোনায় পরিণত হবে, কিন্তু হলো না! বরঞ্চ তিনি অনুভব করলেন এক অবারিত স্বাধীনতার, অভিশপ্ত বর মুক্ত হওয়ার অনাবিল অপার আনন্দ। তিনি যখন নদীর পানিতে মাথা ডুবাচ্ছিলেন, দেখতে পাচ্ছিলেন এর তলার বালুতে প্রচুর সোনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সেই থেকে প্যাক্টোলাস নদীর উৎসস্থল সোনার জন্য বিখ্যাত হয়ে গেলো।

রাজা মিডাস এক চরম শিক্ষা পেলেন এই ঘটনা থেকে। কিন্তু তার শিক্ষা যেনো এখনো শেষ হয়নি।

তার এখন সোনার প্রতি কোনো আকাঙ্খা নেই, আকাঙ্খা নেই ক্ষমতার প্রতি। তিনি সাধারণ জীবন যাপন করতে লাগলেন আর বেশিরভাগ সময় কাটাতে লাগলেন গ্রাম্য গানের দেবতা প্যানের সাথে। প্যান পাইপে সুর তুলে দেবতা প্যান মিডাসকে মোহিত করতেন। এভাবেই যেনো পটভূমি তৈরী হলো "আমাদের রাজার গাধার কান"- এর!

এই সিরিজের আগের লেখাগুলোঃ

সৃষ্টিতত্ত্বঃ
পর্ব-১: বিশ্ব-ব্রক্ষ্মান্ডের সৃষ্টি এবং ইউরেনাসের পতন
পর্ব-২: টাইটান যুগের সূচনা এবং অলিম্পিয়ানদের জন্ম
পর্ব-৩: প্রথম টাইটান যুদ্ধ এবং জিউসের উত্থান
পর্ব-৪: মানবজাতির সৃষ্টি, প্রমিথিউস এবং পান্ডোরা উপাখ্যান
পর্ব-৫: প্রমিথিউসের শাস্তি এবং আইও
পর্ব-৬: আবার যুদ্ধ- জায়ান্ট এবং টাইফোয়িয়াস
পর্ব-৭: ডিওক্যালিয়নের প্লাবন

দেবতাদের গল্পঃ
পর্ব-৮: জিউস, মেটিস এবং এথেনার জন্ম
পর্ব-৯: এথেনার গল্পকথা-প্রথম পর্ব
পর্ব-১০: এথেনার গল্পকথা- দ্বিতীয় (শেষ) পর্ব
পর্ব-১১: আফ্রোদিতির গল্পকথাঃ আফ্রোদিতি, হেফাস্টাস এবং অ্যারিসের ত্রিমুখী প্রেমকাহিনি
পর্ব-১২: আফ্রোদিতির গল্পকথাঃ অ্যাডোনিসের সাথে অমর প্রেমকাহিনী
পর্ব-১৩: আফ্রোদিতির গল্পকথাঃ এনকেসিসের সাথে দূরন্ত প্রেম
পর্ব-২০: আফ্রোদিতির গল্পকথাঃ লেমনসের নারী এবং অন্যান্য
পর্ব-২১: লেটোঃ এপোলো এবং আর্টেমিসের মায়ের কাহিনী
পর্ব-২২: আর্টেমিসের গল্পকথাঃ একটাওনের মন্দভাগ্য
পর্ব-২৩: আর্টেমিসের গল্পকথাঃ এলোয়াডি, আলফিউস ও আরেথুসা এবং ক্যালিষ্টোর কাহিনী
পর্ব-২৪: আর্টেমিসের গল্পকথাঃ অরিয়ন
পর্ব-২৫: এপোলোর গল্পকথাঃ ডেলফির মন্দির
পর্ব-২৬: এপোলোর গল্পকথাঃ মোর বীণা বাজে.........

ভালোবাসার গল্পঃ
পর্ব-১৪: পিগম্যালিয়ন এবং গ্যালাতিয়া
পর্ব-১৫: পিরামাস এবং থিসবি
পর্ব-১৬: হিরো এবং লিয়েন্ডার
পর্ব-১৭: বোসিস এবং ফিলোমোন
পর্ব-১৮: কিউপিড এবং সাইকী- প্রথম পর্ব
পর্ব-১৯: কিউপিড এবং সাইকী- শেষ পর্ব

লেখকঃ

এস এম নিয়াজ মাওলা

ছবি সূত্রঃ ইন্টারনেট


মন্তব্য

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

হুমম, এটাই মাইডাস টাচের কাহিনি!!

এই দেবতা প্যান তো তারেক অনুর সেই ব্লগের ছবির প্যান, নাকি?

____________________________

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

গড়াগড়ি দিয়া হাসি আবার সেই অজাচার মনে করায় দিলেন প্রফেসর

পোস্ট যথারীতি... চলুক

মনে পড়ে গেল- মাইডাসের কাহিনী প্রথম পড়েছিলাম "টাকা জাদু জানে" বইটাতে...
কি সুন্দর একটা বই... কারো কাছে কি আছে?

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

কার লেখা বই? প্রকাশক কে? এই বইয়ের নাম শুনেছি বলে তো মনে পড়ছে না!!!

____________________________

অতিথি লেখক এর ছবি

আমিও বইটির ব্যাপারে জানতে চাই হাসি

-নিয়াজ

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

সে-এ-এ-ই ছোটকালে পড়েছি... লেখকের নাম বোধ হয় শামসুল হক... প্রকাশনী বাংলা একাডেমি নাকি মুক্তধারা মনে পড়ে না... সেই ষাটের দশকের বই... আম্মুর কপি, উত্তরাধিকারসুত্রে পেয়েছিলাম হাসি বাসায় গেলে চেক করে জানাব

কাগজী নোট, চা পাতা, লবন, কড়ি, ইয়াপ দ্বীপ, মার্কোপোলো, দ্য ভিঞ্চি, বাদশাহ জাহাঙ্গীর, রাজা মাইডাস... ... আরো কত্ত কি... টাকার মত নীরস জিনিসের ইতিহাস যে এত্ত সুন্দর করে গল্পের মত বলা যায় জানতামই না... মার্কোপোলো আর মাইডাসের কাহিনী যখন অনেক বড় হয়ে (নাইন বা টেনে বোধ হয়) ইংরেজী বইতে পেয়েছিলাম তখন খুব মজা পেয়েছিলাম... এই কথা জানতে এত বড় হওয়া লাগে নাকি? খাইছে

"বই পড়া ভারি মজা" সম্ভবত এই লেখকেরই... এটা কিনেছিলাম বড়কালে... আর নাম টা জেনেছিলাম প্রথম বইটাতে... এটাও সুন্দর... কিন্তু "টাকা জাদু জানে" যেভাবে জাদু করেছিল সেটা হয়নি... সময়ের দোষ, কিংবা বয়সের... ছোট্ট পাঠকের অপমৃত্যু ঘটে গেছে ততদিনে মন খারাপ

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

হাততালি

____________________________

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক অনেক ধন্যবাদ সত্যানন্দ ভাইয়া।
ভালো থাকুন খুব।

-নিয়াজ

অতিথি লেখক এর ছবি

হ্যা, অয়ন ভাইয়া, এই দেবতা প্যান, সেই ব্লগের দেবতা প্যান।
প্যান সম্পর্কে বিস্তারিত পরে বলা হবে ভাইয়া।
ভালো থাকুন, খুব।

-নিয়াজ

এক লহমা এর ছবি

গল্প যেমন ভালো হবার তাই হচ্ছে - একটা পর্বের পর আর একটা।
এই দেবী-দেবতাদের হিংসুটে স্বভাবের কোন সীমা-পরিসীমা দেখি না, এক্কেবারে মানুষদের মতই!

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেকদিন যাবত পর্বগুলি দিতে দেরী হচ্ছে, ব্লগেও খুব একটা সময় দিতে পারছি না। এর জন্য দায়ী আমার প্রফেশনাল ব্যস্ততা। তবুও যতটুকু পারি, চেষ্টা করে যাচ্ছি।
একলহমা ভাইয়া, ভালো থাকুন অবিরত।

-নিয়াজ

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

সেটাই - এরকম চরম হিংসুটিদেরকে কেন যে দেব-দেবীর তকমা দেওয়া হয়েছিল! মাঝে মাঝে মনে হয় হাতের কাছে পেলে থাপড়ে গাল (পড়ুন অন্যকিছু) লাল করে দেই!! শয়তানী হাসি

____________________________

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।