মেঘের অন্তরালে

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বুধ, ০৪/১২/২০১৩ - ২:১৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আশ্চর্য! এই অসময়ে অনাকাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি! সারাদিন ঝিরঝির বৃষ্টি হেমন্তের হীম যেন আরও বাড়িয়ে দিল। বৃষ্টি ভেজা মেটে গন্ধ বাতাসে। রমা বুক ভোরে নিঃশ্বাস নিল। সেই দিনটাও তো আজকের মত ছিল। ধূসর কালো মেঘের ছড়াছড়ি ছিল সারা আকাশ জুরে। যদিও মন খারাপ করে দেয়ার মত পরিবেশ, তবুও সেদিন রমা ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মেয়ে।

ডাক্তার কাকু ফোন করে বললেন,”একটা সুখবর আছে মা। তুই এক নতুন জীবনের জন্ম দেয়ার সৌভাগ্য লাভ করেছিস রে।” রমার গাল বেয়ে পানি নেমে এলো। রমা কিছুক্ষণ বুঝলনা কি করবে। আসিফ কে ফোন করে জানাবে খবরটা? না থাক এভাবে নয়। ও আগে বাসায় এসে নিক। এত সহজে তো এত বড় খবরটা দেয়া যাবে না তাকে। দুজনের কত প্রতীক্ষার ইতি টানবার পালা আজ, একটু রহস্য না করলেই না। রমা ভাবতেই পারছেনা, অবশেষে তার জীবন পূর্ণতা পেতে যাচ্ছে। তৃষিত মনের শত বছরের তৃষ্ণা মেটানোর আশীর্বাদ দিয়ে জীবন আজ তাকে চিরকৃতজ্ঞ করে নিল।

প্রচণ্ড শব্দে কোথাও বজ্রপাত হল, যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে মাটিতে। রমার হাতের কাপ থেকে কিছুটা চা ছলকে ওর পায়ে পড়ল। রমা বাস্তবে ফিরে এলো। গভীর একটা শ্বাস নিল সে। জীবন একই সাথে কখনো দয়ার সাগর কখনোবা পাথরের মত পাষাণ। জীবনটা ঠিক পয়সার মত এপিঠ আর ওপিঠ করে মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রন করে যাচ্ছে।

রমা আর আসিফের জীবনটা বাস্তবতার চার দেয়ালে বন্দী হয়ে গিয়েছিল। প্রতিদিনের একঘেয়ে অফিস আর অফিস থেকে বাড়ী ফেরা। কখনোবা ছুটির দিনে কোন রেস্তরাঁয় বসে খাওয়া। এই নিষ্ঠুর বাস্তবতা মেনে নিয়েছিল ওরা। ওদের জীবনে কোন নতুন অতিথির আগমনী বার্তার অপেক্ষাও ছেড়ে দিয়েছিল তারা। হঠাৎ ডাক্তার কাকুর ফোন নতুন করে যেন জীবন দান করল রমাকে। পাশের দোকান থেকে একগুচ্ছ রজনীগন্ধা আনিয়ে নিল সে। রজনীগন্ধা আসিফের প্রিয় ফুল। খাটের পাশে রাখা ছোটো টেবিলে ফুলগুলো সাজিয়ে নিজেও পরিপাটি করে সেজে নিল রমা। আকাশী রঙের শাড়ি জড়িয়েছে গায়ে। আসিফ সবসময় বলে, “তোমাকে আকাশী শাড়িতে বেশ মানায়। মনে হয় আকাশটা আমার ঘরে নেমে এসেছে। আর আমি সেই আকাশে মেঘের ডানায় ভেসে বেড়াচ্ছি।” রমা মুচকি হেসে ফোনটা হাতে তুলে নিল। এই সুখবরটা শোনার পর আসিফের চোখে মুখে যে খুশি ফুটে উঠবে সেটা দেখার জন্য রমার আর তর সইছেনা।

“হ্যালো, কাজ শেষ হয়েছে তোমার?”
“হ্যাঁ শেষ। বের হয়েছি অফিস থেকে। গুরিগুরি বৃষ্টি পড়ছে। রিক্সা পাচ্ছি না। এই ধরো বিশ মিনিট লাগবে আসতে। কেন বলতো?”
“একটা খুব খুব ভাল খবর আছে।”
“কি?”
“এখন তো বলা যাবে না। আগে তুমি বাসায় আসো পরে বলছি।”
“এমন কি কথা যেটা ফোনে বলা যাবে না?”
“আহা ধৈর্য ধর।”
“ঠিক আছে। আসছি।”
“সাবধানে এসো।”

রমা অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে আছে। এক ঘণ্টা পেরিয়ে গেল আসিফ এলো না, তবে একটা ফোন এলো।

“এই ফোন থেকে শেষবার আপনাকে কল করা হয়েছিল। আপনি কি রমা বলছেন?”
“আপনি কে? আসিফ কোথায়?”
“আমি হাসপাতাল থেকে বলছি। আসিফ সাহেব গুরুতরভাবে আহত।”
“কি হয়েছে?” রমার হাত পা থরথর করে কাঁপছে।
“অবরোধকারীদের ছোড়া ককটেলে উনি ভীষণভাবে আহত হয়েছেন। বাঁচার আশা আসলে খুবই কম।”
“ও-ওকে বাঁচিয়ে রাখুন প্লিজ। আমি আসা পর্যন্ত অন্তত বাঁচিয়ে রাখুন। সুখবরটা যে ওকে জানতেই হবে। ওকে বাঁচতে হবে। আমার জন্য, আমাদের অনাগত সন্তানের জন্য।”

“আফা চা এর কাপটা দেন আমি ধুয়ে রাখি।” রমা টের পেলো সে স্মৃতিতে হারিয়ে গিয়েছিল। স্মৃতির পাতায় লেখা অক্ষরগুলো বড্ড বেশি নিখুঁত, যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। হাতের কাপটা কাজের মেয়েটা দিয়ে রমা আবারও অতীতে ফিরে গেল।

রমার দুচোখ বেয়ে শুধু পানি পড়ছে। নিজের অজান্তে কখন মাটিতে লুটিয়ে পরেছে সে। না না এ হতে পারে না। আসিফ তাকে একা ফেলে যেতে পারে না। আসিফ ওয়াদা করেছিল। রমা উঠে দাঁড়ালো। হাসপাতালের উদ্দেশে ছুটল। দুটা সিঁড়ি নামতেই রমার পা এলোমেলো হয়ে আসলো। কিছু বুঝে উঠার আগেই রমা সিঁড়ি গড়িয়ে পড়ে যেতে লাগলো। পড়ে যেতে যেতে শুধু বলার চেষ্টা করল… ‘আসিফ আমি আসছি। আমাদের সন্তান আসছে…’

যখন হুঁশ ফিরে পেল তখন চিৎকার করে জানতে চেয়েছিল আসিফ কেমন আছে। তখন সে জানত না জীবন আসলে রমার জন্য দ্বিগুণ আঘাত নিয়ে অপেক্ষা করছে। আসিফ নেই, তাদের সন্তান নেই, নেই কোন স্বপ্ন। “আসিফকে একবার আমি জানাতেও পারলাম না…” এই হাহাকার বুকে নিয়ে আজও বেঁচে থাকতে হচ্ছে রমাকে। জীবন তাকে বেঁচে থাকার শাস্তি দিয়েছে।

আজকে এই মেঘলা দিনে বসে রমা ভাবল, রাজপথের সেদিনের সেই সামান্য একটা ঘটনা, ছোট্ট একটি মুহূর্ত তার সমস্ত জীবনটা এলোমেলো করে দিয়ে গেছে। যে ককটেল মেরেছিল, সে কি একবারও ভেবেছিল পৃথিবীর কোন প্রান্তে একজন রমা তার স্বামীর জন্য অপেক্ষা করছিল, একটি নতুন প্রাণ তার বাবাকে নিজের অস্তিত্তের কথা জানাতে চেয়েছিল। ভাবেনি, কেউ আজও ভাবেনা। আসিফ আর তার সন্তান রাজনৈতিক সংঘাতে প্রাণ হারানো একটি সংখ্যা হয়ে রয়ে গেছে। আর রয়ে গেছে রমার হুইল চেয়ার।

মেঘের গর্জন, এই টিপটিপ বৃষ্টি কিছুই তো পাল্টেনি। শুধু বদলেছে রমার জীবনের গল্প। রমা ধীরে ধীরে জানালার কাছ থেকে সরে এলো। কানে ভেসে এলো বৃষ্টির আওয়াজ।

সানজানা শাহ্‌নাওয়াজ (Sanjana Shahnawaz)


মন্তব্য

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

চমৎকার লেগেছে!

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ হাসি

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

মন খারাপ

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

দুঃখ পেয়েছেন??

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

লেখা ভালো লেগেছে... কিন্তু বিষয়টাই দুঃখজাগানিয়া মন খারাপ

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

অসাধারন মন খারাপ করে দেওয়া গল্প মন খারাপ মন খারাপ মন খারাপ

মাসুদ সজীব

অতিথি লেখক এর ছবি

অসাধারন বলার জন্য ধন্যবাদ দেয়া উচিত। কিন্তু মন খারাপ হয়েছে তাই কি লিখব ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। অ্যাঁ

ধুসর জলছবি এর ছবি

গল্পটা দারুণ। আপনি তো আমাকে ভয় ধরিয়ে দিয়েছেন।
কারণ এই অস্থির সময়ে অনাগত সন্তানের আগমনের দিন গুনছি। গত শুক্রবার রাতে বেঙ্গল এর অনুষ্ঠানে হটাত শুনলাম পরের দিন থেকে আবার অবরোধ, অনুষ্ঠানে মগ্ন ছিলাম বলে আমরা দেরিতে জেনেছি। আমার বর যেহেতু যশোর থাকে , সপ্তাহান্তের ছুটিতে ঢাকায় আসে, তাই তখনি রওয়ানা দিতে হবে। ছুটে বাসায় এসে সে ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে গেল তখন রাত ১ টা। সকালে পোঁছে ফোন দেয়ার আগ পর্যন্ত ঘুম হয়নি যদিও জানি এখন আমার জন্য না ঘুমান হারাম। মন খারাপ
হরতাল, অবরোধে থিসিসের কাজ করতে পারছি না, এদিকে সামনে আমার জন্য আরও কঠিন হবে সব। টেনশন হচ্ছে আবার টেনশন হলে ক্ষতি হতে পারে সেটা নিয়েও টেনশন হচ্ছে। হায়রে দেশ!!!
দেশের প্রতিটা মানুষই নিশ্চয়ই কোন না কোন ভাবে এরকম ভাবেই দিন কাটাচ্ছে। বেশিরভাগ মানুষ হয়ত এর চেয়েও খারাপ ভাবেই বেঁচে আছে। মন খারাপ মন খারাপ
লেখা ভাল হয়েছে। চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

একদম চিন্তা করবেন না। নিজের যত্ন নিবেন। সব ঠিক মতই হবে। বেঙ্গল এর শেষ দিনের মাঝামাঝি সময়ে সেখানেও দুটা ককটেল ফুটেছে। দেশ যে কোথায় যাচ্ছে!!

অতিথি লেখক এর ছবি

ভালো লেগেছে আপু। নিয়মিত লিখুন।

শব্দ পথিক

অতিথি লেখক এর ছবি

অসংখ্য ধন্যবাদ। চেষ্টা করবো লেখা চালিয়ে যেতে। হাসি

খেকশিয়াল এর ছবি

আরো লিখুন আর গল্পটা আরো একটু বড় হতে পারতো, চলুক

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

অতিথি লেখক এর ছবি

বড় করতে গিয়েও ভাবলাম মানুষের আগ্রহ কতোটা ধরে রাখা যাবে। তাই এখানেই ইতি টানলাম।

এক লহমা এর ছবি

নিশ্চয়ই এ গল্প কারো কারো জীবনের নির্মম সত্যি। কিন্তু শুধুই মন খারাপকে ছাপিয়ে আর একটু কিছুর জন্য এ পাঠকের একটা নাছোড় প্রতীক্ষা থেকে যায়, সেই কিছুটুকু পরের লেখায় পেয়ে যাবো, তাই না? অপেক্ষায় রইলাম।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

নিশ্চয়ই চেষ্টা থাকবে।

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

আবেগের পরশ দিয়ে আঁকা খাঁটি করুণ বাস্তবতা!! লেখা ভালো লেগেছে। তবে এদিকে ওদিকে দেখা দিয়েই মিলিয়ে যাওয়া দুয়েকটা সুতোকে আরেকটু বিস্তারিত করলে গল্পটা হয়তো আরো ভালো লাগতো। আর বৃষ্টি ও মেঘের গর্জনের সাথে রমার জীবনের কষ্টের বৃষ্টি আর বেদনার গর্জন মীয়ে দেয়াটা পছন্দ হয়েছে।

____________________________

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।