২০১০ এর অগাস্ট মাসের কোন এক ভোর রাতের কথা। ঢাকা ঘুমিয়ে পড়েছে, তবুও কোলাহলে জেগে ছিল ঢাকা বিমানবন্দর। এপাশের মানুষরা কাঁচের দেয়াল পার হয়ে ওপাশে যায়, স্বজনরা তাকিয়ে থাকে তখনও। তারপর আরও কয়েকটা কাঁচের দেয়াল, স্বজনদের ক্ষীণভাবে দেখা যায় ঐ দূরে। এরপর, আর দৃষ্টিসীমায় ধরা পড়ে না- এতগুলো কাঁছের দেয়াল ভেদ করে দেখা যায়না কাউকে। এরকম করেই একদল লোকের সাথে বিষণ্ণ মন আরা ক্লান্ত শরীর নিয়ে উড়োজাহাজের পেটে ঢুকে বসেছিলাম। পুরো পথে ঘুমাতে পেরেছিলাম মাত্র ২ ঘন্টা, মাটিতে নেমে দাঁড়াতে পারছিলাম না পেটের প্রচন্ড ব্যাথায়।
শুরুতে খুব মন খারাপ লাগত। প্রতিদিন সকালে সুপারভাইজার আসতেন গত ২৪ ঘন্টার গবেষণায় কি কি মহার্ঘ্য বিষয় আমি উদঘাটন করেছি তার সন্ধানে। শতকরা ৯৯ ভাগ দিনই হতাশ করেছি তাঁকে, হলাকা পাতলা কিছু হুমকি মেশানো, চাইনিজ ভাষায় চিবানো অথচ মোটামুটি স্পষ্ট ইংরেজিতে অসন্তোষ প্রকাশ করে বেড়িয়ে যেতেন তিনি। তারপর, করিডোরে এসে দাঁড়াতাম। ঘড়ি দেখে হিসেব কষতাম, এখন ক'টা বাজে বাংলাদেশে। মুঠোফোন হাতে নিয়ে পিনলেস ভিওআইপি প্রোভাইডারের নম্বরে কল করতাম। কয়েক মিনিটের জন্য পেতাম বাংলাদেশের ছোঁয়া। আমিও যে অনলাইনে পত্রিকা পড়ে দেশের খোঁজ খবর সব রাখি এটা দেখিয়ে চমকে দিতে চাইতাম বাবা-মাকে। ফোনটা রেখে করিডোর দিয়ে বাইরে তাকাতাম। পাহাড়ের উঁচুতে বলে করিডোর থেকে একটা লেকও দেখা যেত দূরে। মনে মনে ভাবতাম, আবার কবে যাব আমি বাংলাদেশে? আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেকান থেকে আমাদের দেশ ঠিক পৃথিবীর অপর প্রান্তে; অনেক, অনেক দূরে।
তারপর, কেটেছে ৩ বছরেরও বেশি সময়, এখানে আমি ৩ বছর বেশি বুড়ো হয়েছি, কিঞ্চিত বিদ্যা ঢুকেছে পেটে, বেড়িয়েও গিয়েছে অনেক। তারচেয়ে বেশি মাথায় ঢুকেছে ক্রেডিট স্কোর১, ডিল, কুপন, ক্যাশব্যাক, টিপস, ফুট লং সাব২, স্টপসাইন, রাইট অভ ওয়ে ৩, রোডসাইড অ্যাসিস্ট্যান্স৪, সেলফ চেকআউট৫, এক্সপ্রেস চেকআউট, ব্ল্যাকফ্রাইডে, ওবামা কেয়ার,...। ওদিকে দেশে অনেকে জায়গা বদলেছে, সবজির দাম বেড়েছে, ইলিশ মাছের ফলন বেড়েছে, কেউ দেশ ছেড়েছে, কেউ বাবা-মা হয়েছে, যাদের পিচ্চি সাইজের দেখে এসেছি, তারা বড় হয়েছে...।
অনেক জল গড়িয়েছে, এই কয় বছরে। এবার অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ করে শেষমেষ, টিকেট কিনে ফেললাম একটা। অনেক কল্পনা মাথায় কিলবিল করছিল টিকেট কেনার পরের দিন থেকেই। এখানে, বাংলাদেশি যার সাথেই দেখা হবার পর বলছি, দেশে যাচ্ছি। প্রতিক্রিয়া একটাই, এই সময়ে! সাবধানে থেকো। কিছু করতে পারবে না মনে হয় এবার দেশে গিয়ে, সারাদিন বাসায় একলা বসেই কাটাতে হবে।
অথচ, আমি তো ফিরে এমন বাংলদেশ দেখতে চাইনি! আমি তো চেয়েছিলাম সকাল বেলা হাতে কাগজে ছাপা নিউজপেপার নিয়ে কিছু ভালো খবর পড়তে, কিছু হাশি-খুশি মানুষের ছবিতে চোখ রাখতে। ট্রাভেল অ্যালার্ট নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না, আমি তো আমার দেশেই যাচ্ছি।
কি লিখতে বসেছিলাম তা ঠিক বুঝতে পারছি না এ পর্যায়ে এসে, হয়ত দেশটাকে একটা অন্যরকম পরিস্তিতিতে দেখব বলে অবচেতন মন সেটা মেনে নিতে চাইছে না। এখনও একটা অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করতে হবে, অল্প কিছু সময় হাতে আছে, একটা টেক-হোম এক্সামও বাকি। সবকিছু ছাপিয়ে, প্রতিটি মুহূর্তে মস্তিষ্কের নিউরনে বেজে চলেছে, "এবার, আমি বাড়ি যাবো। এবার, আমি বাড়ি যাচ্ছি"
বাংলাদেশের সবার ভালো হোক। ৬
[মেঘলা মানুষ]
মন্তব্য
ক্রেডিট রেটিংয়ের জন্য তিনটা কোম্পানী আলাদা আলাদা করে তিনটা রেটিং দেয়, একটা না।
আপনি বলার পরে বাক্যটা আবার পড়লাম। আসলেই, আমার টীকা পড়ে পাঠকের মনে হবে ৩ কম্পানি মিলে বুঝি একটা সম্মিলিত রেটিং দেয়। আর, লেখার সময় আমার মনে হয়েছিল, আসলে তো তিনজনই একটা আলাদা করে রেটিং দিয়ে থাকে।
মডারেটরকে বিনীত অনুরোধ করছি ভ্রান্তি এড়াতে সংশোধন করে দেবার জন্য:
টীকা ১: টাকা ধার নিলে আপনি ফেরত দেবেন কিনা, সেটা বোঝার আজগুবি এক পদ্ধতি। আপনার আর্থিক লেনদেনের তথ্য নিয়ে ৩টা কম্পানি আপনাকে মূল্যায়ন করে
একটানম্বর দেয়।আরেকটা অনুরোধ: কাঁছের দেয়াল -> কাঁচের দেয়াল
ধন্যবাদ আপনাকে মাহবুব মুর্শেদ বিষয়টা নজরে আনার জন্য।
শুভেচ্ছা
বাংলাদেশের সবার ভালো হোক।
[মেঘলা মানুষ]
ঠিক করে দেয়া হয়েছে।
ধন্যবাদ, সন্দেশকে
মন হুহু করা পোস্ট!
সেলফ চেকআউট বিষয়টি পাদটীকা থেকেও পরিষ্কার বুঝতে পারিনি। এক্সপ্রেস চেকআউটের এমনকি পাদটীকাও নেই।
প্রথম প্যারাতে কিছু টাইপো রয়েছে।
বিশ্বময় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য বাংলাদেশী নাগরিকের মনের অনুভূতি সার্থকতার সাথে ধারণ করতে সক্ষম হয়েছে আপনার এই ছোট্র লেখাটি।
.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল
ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য। রাতে কাজ করতে করতে হঠাৎ করে লিখে ফেলেছি, টাইপো এড়াতে প্রিভিউ পড়েছিলাম, কিন্তু মাথা ঠিক কাজ করছিল না। ক্ষমা চাচ্ছি টাইপোর জন্য।
সেলফ চেকআউট: আপনি দোকান থেকে জিনিসপত্র ট্রলি (কার্ট বা বাগি ও বলে) তে তুলবেন। কয়েকটা কাউন্টার থাকে যেখানে কোন কর্মী থাকে না, আপনি নিজেই আপনার জিনিসপত্রগুলোর বারকোড স্ক্যান করবেন, তারপর কার্ডে মূল্য পরিশোধ করবেন। নগদ টাকা ঢোকানোর জন্য মেশিনে জায়গা থাকে, মেশিন টাকা গুনে আপনাকে খুচরো ফেরত দিতে পারে। আর, মানুষ ঠিকমত মূল্য পরিশোধ করছে, স্ক্যান না করে ব্যাগে পুরল কিনা এসব দেখার জন্য ৪ টা বা ৬ কাউন্টারে একজন কর্মী থাকেন। এতে করে ১ জন কর্মীর বেতনে বেশ কয়েকটা কাউন্টার সামলানো যায়।
এক্সপ্রেস চেকআউট: যদি কেউ ১০টা (বা কোন কোন দোকানে ২০ টা) পণ্য কেনে তাদের জন্য আলাদা কাউন্টার যেন তাদেরকে যারা অনেক বেশি জিনিস কেনে তাদের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকতে না হয়। আপনি কম জিনিস কিনলে এমন কারো পেছনেই দাঁড়াতে পারছেন যারা কম সংখ্যক জিনিস কিনছে।
শুভেচ্ছা
[মেঘলা মানুষ]
হুমায়ুন আজাদের একটি কবিতা আপনার জন্যে
মাসুদ সজীব
কবিতার লাইনদুটো কোট করার জন্য আপানকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
সবার সময় আসুক, বাংলাদেশের সবার ভালো হোক।
[মেঘলা মানুষ]
____________________________
ধন্যবাদ, প্রফেসর আপনাকে।
তেইশ বছর হয়ে গেছে। এখন এই মার্কিন দেশ-ই স্বদেশ আমার। মাঝে মাঝে ঘুরে এসেছি জন্মভূমি ভারতবর্ষ। পাল্টে গেছে কত কি, বিশ্বজগৎ-এ, মনোজগৎ-এ। কিন্তু আজো সমান তীব্রতায় জ্বলজ্বল করে প্রথম পাঁচ বছর-এর সেই দিনগুলোর স্মৃতি - আপনি যেমন লিখেছেন - বন্দীত্ব। আর, তার পর মুক্তির সবুজচিঠি হাতে নিয়ে প্রথমবারের সেই দেশে যাওয়া - অসাধারণ!
লেখা ভাল লেগেছে।
যেমন-ই হোক দেশের অবস্থা, ঘুরে আসুন, ভাল লাগবে।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে মন্তব্যের জন্য।
আমি চাই সবাই যান প্রিয়জনের প্রতি ভালোবাসা নিয়ে দেশের মাটিতে পা রাখে।
বিমানবন্দরে নেমে কিভাবে বাসায় ফিরবো, আজ কতগুলো প্রাণ ঝরবে -এটা যেন কাউকে ভাবতে না হয়।
শুভেচ্ছা
ভাল লিখেছেন।
বাপ্পা মজুমদারের একটা গান আছে শুনেছেন কিনা জানি না। আপনার দেশে ফেরার আবেগ আর স্মৃতিময় কথামালা দেখে গানটার কথা মনে পড়ে গেল, অনেকদিন পর তাই আবার বেশ কয়েকবার শুনা হলো গানটা। গানের কথাগুলো ছিলো এমন
দেশে থাকার সময়টুকু আনন্দে কাটুক, নিরাপদে কাটুক এই শুভকামনা।
মাসুদ সজীব
ধন্যবাদ, মাসুদ সজীব আপনাকে।
শুভেচ্ছা
ভাল লেগেছে তবে আমরা যারা দেশেই থাকি তারা হয়ত আপনার অনুভুতি সম্পুর্ন অনুভব করতে পারবোনা।
অভিমন্যু .
________________________
সেই চক্রবুহ্যে আজও বন্দী হয়ে আছি
আসলেই এই অনুভূতি অন্যরকম, অন্যরকম একটা কষ্টের।
ধন্যবাদ, অভিমন্যু।
শুভেচ্ছা
নতুন মন্তব্য করুন