বেশকিছুদিন ধরে হরতাল, অবরোধের কারণে অফিসে পৌছাই সকাল সকাল। কখন কি ঝামেলায় পড়ি, তাই আগেই রওনা দেই।অফিস আওয়ার শুরু হবার ঘন্টা খানেক আগে গিয়ে বসে থাকি।
আমার মতো আরো অনেকেই এই রকম সকাল সকাল এসে পড়েন আজকাল। কাজ পুরোপুরি শুরু হবার আগে কিছুক্ষণ সবাই চা খাই, কোনো একটা ডেস্ক এর কাছাকাছি উপস্থিতেরা কয়েকজন একসাথে আলাপ করি।
আজকেও সকালে পৌছে ডেস্কে বসে চা খাচ্ছি, উল্টোদিকের সিটের নিউ জয়েনার আপু চায়ের কাপ নিয়ে আমাদের ডেস্কের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে, পেছনের দুই ডেস্কের ভাইরাও চেয়ার ঘুরিয়ে আমাদের দিকে ফিরে চা খাচ্ছে আর কথা বলছে।
এমন সময় পাশের ডিপার্টমেন্টের এক ভাই এগিয়ে এসে আমাদের কথায় যোগ দিলো। সে এমনিতে একটু চুপচাপ ধরণের, বেশি কথা বলে না। আজকে দেখি তোর চোখ মুখ লালচে। একজন জিজ্ঞাসা করলো, শরীফ ভাই ঠান্ডা লেগেছে?
সে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, ‘ভাই আসলে মন ভালো রাখা যায় না, দেশের অবস্থা যেইরকম...’। সবাই একমত প্রকাশ করলো দেশের অবস্থা যে ভালো না। আমরা প্রায় প্রত্যেকেই বাসে বা লেগুনায় আসি যাই, দুশ্চিন্তা থাকেই।
শরীফ ভাই আমাদের কথাবার্তা কিছুক্ষণ শুনে এবার বললেন, ‘অবস্থা ভালো হবে কিভাবে, যেভাবে এইদেশে শুরু হয়েছে, কালকে আমাকে আপনাকে ফাঁসি দিলেও তো কেউ কিছু বলার নাই। একজনকে এইভাবে ফাঁসি দিয়ে দিলো, অনেক জানাশোনা লোকেও বলে এই কাদের মোল্লা সেই কাদের মোল্লা নয়। ফেইসবুকেও ছড়ায় গেসে। যে দেশে আইনের শাসন নাই সেই দেশে ভাই আপনি জীবন রক্ষা করে স্বাভাবিক কাজকর্ম চালাবেন কিভাবে?
সবাই একটু চুপ করে গেল। নিউ জয়েনার আপুটা খানিকটা দ্বিধাগ্রস্ত কন্ঠে বললো, ‘হ্যাঁ ফেইসবুকে সবাই বলছে, এই কাদের মোল্লা নাকি সেই কাদের মোল্লা না। অন্য আরেকজনকে মেরে ফেলছে। এটাকি সত্যি নাকি?’
আশে পাশের দুই একজন একটু উশখুশ করছিল। একজন বললো, কি জানি, হওয়ার তো কথা না।
শরীফ ভাই আরো কিছুক্ষণ বলে গেলেন। সবাই শুনছিলো।
পেছনের ডেস্কের ওয়াজেদ ভাই গম্ভীর ধরণের পরহেজগার মানুষ। শরীফ ভাই একটু থামলে বললেন, ‘যারা এই জানাজায় শামিল হয়েছে সবার খবর আছে।‘
শরীফ ভাই সাথে সাথে সায় দিলেন, পুলিশ নিশ্চয় এদের হয়রানি করবে, ধরে নিয়ে জেলে ভরে অত্যাচার করবে।
ওয়াজেদ ভাই শান্তস্বরে বললেন, ‘জেনেশুনে একজন মুসলমান কোনো খুনীর জানাজায় অংশ নিতে পারে না। ভুল করে যদি কারো দ্বারা খুন হয়ে যায়, তাহলেও হয়তো মানা যায়। কিন্তু জেনে বুঝে ঠান্ডা মাথায় যে খুন করে, তার জানাজায় যারা অংশ নিবে আর ইমামতি করবে, তাদের তো ক্ষমা নাই।‘
শরীফ ভাই চুপ হয়ে গেলেন। অনেকেই সায় দিলো। পাশের সিটের ভাইয়া বললো, ‘সে যদি অন্য কাদের মোল্লাই হবে, দেশের সুপ্রীম কোর্টে সেটা প্রমাণ হবে না?’
আরেকজন বললো, ‘আর তার এত বাঘের মত নামিদামি উকিলরা, এই ঘটনা সত্যি হলে বাঁচাইতে পারতো না তারে??’
একজন দুই জন করে বাকিরাও কথা বলতে শুরু করলো। আলোচনা যখন পুরো উদ্যমে চলছে, তখন দেখি শরীফ ভাই চুপচাপ নিজের ডেস্কে চলে গেল।
তার লালচে মুখ বোধহয় আরো কয়েক দফা লাল হবে আসছে দিনে।
==========
[পুনশ্চঃ সব নাম পরিবর্তন করা হয়েছে]
মোঃ সাইফুল্লাহ্
মন্তব্য
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
আইসসালা... আজকে অফিসেও প্রায় একই কাজ করে এক কলিগের মুখ লাল করে দিয়ে আসছি দেখা যায়...
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
ওদের সবসময় ঐ মুখ লাল করেই ফিরে যেতে হয় - যেতে হবে।
____________________________
ঠিক এমন অভিজ্ঞতা আমারও হয়েছে, সাহস করে শুধু সত্যটাকে বলা শুরু করলে দেখবেন আপনার সহযোদ্ধার অভাব নেই। এ যুদ্ধে আমাদের জয় হবেই।
মাসুদ সজীব
নতুন মন্তব্য করুন