পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক রাখাটা কি জরুরী? (প্রথম পর্ব)
আগের পর্বে লিখেছিলাম পাকিস্তানের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক না রাখার যৌক্তিকতা সম্পর্কে। এই পর্বে আমরা দেখবো পাকিস্তান থেকে আমদানী না করে এবং পাকিস্তানী বিনিয়োগ (এফডিআই/জেভি) না নিয়েও আমরা নির্বিঘ্নে চলতে পারি কিনা।
প্রথমে দেখা যাক পাকিস্তান থেকে আমরা কী কী আমদানী করে থাকি। ২০১২-১৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে যা আমদানী করেছে কোটি টাকায় তার হিসেবঃ
তুলা, সুতী সুতা ও সুতী কাপড় = ২,৭৫০.৭০
নীট কাপড় = ২৭৪.৬০
কৃত্রিম সুতা = ১৩০.৭০
যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ = ৮১.১০
কৃত্রিম সুতার কাপড় = ৪০.৯০
গাড়ী ও অটো পার্টস = ৩২.৮০
সিরিয়াল = ১২.১০
অন্যান্য = ৫৯০.৮০
মোট = ৩,৯১৩.৭০ যা বাংলাদেশের মোট আমদানীর ১.৭% মাত্র।
দেখা যাচ্ছে, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ খুব বেশি আমদানী করে না। ১.৭% আমদানীর হেরফের হলে সেটার প্রভাব দেশের গোটা অর্থনীতিতে খুব একটা হবার কথা না। এই আমদানীতে তুলা, সুতা আর সুতী কাপড় বাদ দিলে বাকি পণ্যের মোট মূল্য ১,১৬৩.০০ কোটি টাকা। সেই টাকাতে আবার ৪৪৬.২০ কোটি টাকার জিনিস প্রত্যক্ষভাবে টেক্সটাইল সংক্রান্ত। তাহলে ২,৭৫০.৭০ + ৪৪৬.২০ = মোট ৩,১৯৬.৯০ কোটি টাকার জিনিসই হচ্ছে তুলা-সুতা-কাপড়-টেক্সটাইল সংক্রান্ত। এটাই মূল। এটাকে ঠেকানো গেলে বাকি ৭১৬.৮০ কোটি টাকার আমদানী এমনি এমনিই বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু এটা কীভাবে ঠেকানো যাবে?
তার আগে অন্য একটা তথ্যের দিকে চোখ ফেরানো যাক। ২০১২-১৩ সালে বাংলাদেশ তুলা, সুতী সুতা ও সুতী কাপড় মোট আমদানী করেছে ৪২,৫৪৩.০ কোটি টাকার। তার মানে, এই খাতে পাকিস্তানের শেয়ার মাত্র ৬.৪৭%। তুলা, সুতী সুতা ও সুতী কাপড় খাতে বাংলাদেশের বড় বড় আমদানী উৎসগুলো হচ্ছেঃ
(২০১২-১৩ সালে আমদানী, কোটি টাকায়)
চীন = ১১,২৫১.২০
ভারত = ১০,০৬১.০০
উযবেকিস্তান =৪,৩৪৪.৮০
হংকং = ১,২১৮.০০
আমদানীর জন্য আরো দেশ আছে, তবে সেখান থেকে আমদানী উল্লেখযোগ্য নয়। বিকল্প হিসাবে কাঁচা তুলার জন্য উযবেকিস্তান আর চীন, সুতা আর কাপড়ের জন্য ভারত আর চীন দিয়ে পাকিস্তান থেকে আমদানী প্রতিস্থাপন করা সম্ভব।
তবে দীর্ঘমেয়াদী চিন্তা করলে বাংলাদেশের উচিত সুতা আর সুতী কাপড়ের বদলে কাঁচা তুলা আমদানী করা। উযবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, গ্রীস ও ব্রাজিল থেকে সাশ্রয়ী মূল্যে তুলা আমদানী করা সম্ভব। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে যে কন্টেইনার ভরে তৈরি পোশাক যায়, ঐ কন্টেইনারেই ফিরতি পথে তুলা ছোট ছোট বেল আকারে আনা সম্ভব। এতে দেশে সুতা ও সুতী কাপড় তৈরি করলে মূল্য সংযোজনের হার যেমন বাড়বে তেমন স্থানীয় উৎপাদন ব্যয় কম বলে বস্ত্র ব্যবসায়ে মুনাফার পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। এই ব্যাপারে আরো কৌশল প্রয়োগের সুযোগ আছে, তবে এই আলোচনায় সেগুলো নিয়ে কথা বাড়ানোর প্রয়োজন নেই। মোট কথা, পাকিস্তান থেকে তুলা, সুতী সুতা ও সুতী কাপড় তথা টেক্সটাইল সামগ্রী আমদানী না করেও আমরা অনায়াসে চলতে পারবো।
প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় জামা-কাপড় নিয়ে আরেকটি কথা বলবো। বাংলাদেশের কিছু নারীর কাছে পাকিস্তানী লন কাপড় বা লনের পোশাক এবং পাকিস্তানের জর্জেট/শিফনের ওপর জরি-চুমকি-ডলার-লেস ইত্যাদি দিয়ে কারুকাজ করা কাপড় বা পোশাক খুব জনপ্রিয়। এই পণ্যগুলোর ক্ষেত্রে কয়েকটি তথ্যঃ
১. জর্জেট/শিফনের পণ্যগুলোর মূল মেটেরিয়াল অর্থাৎ কাপড়, প্রধানত চীন থেকে পাকিস্তানে আমদানী করা, কারুকাজগুলো পাকিস্তানের।
২. পাকিস্তানী লন/জর্জেট/শিফন বলে বাংলাদেশের বাজারে বিক্রি করা হয় এমন পণ্যের একটা বড় অংশ আসলে ভারতে বানানো।
৩. তুলা বা রেশম তন্তুর থান কাপড় বা তৈরি পোশাকের ওপর বাংলাদেশে আমদানী শুল্ক ও কর অত্যন্ত বেশি। ফলে, অনেক ক্ষেত্রেই নানা প্রকার মেলা/প্রদর্শনীর নামে, ব্যক্তিগত ব্যবহারের নামে বা মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে এসব পণ্য বিপুল পরিমাণে আনা হয়। ফলে বাংলাদেশ সরকার তার প্রাপ্য রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়।
মেটেরিয়াল চীনের হোক আর ভারতের হোক, ট্যাক্স দেয়া হোক বা না হোক পণ্যটি যদি পাকিস্তানী উৎস থেকে কেনা হয়ে থাকে তাহলে বাংলাদেশী ক্রেতার টাকা পাকিস্তানের ঘরেই যায়। আর পাকিস্তানের ঘরে টাকা গেলে সেটা কীভাবে আর কী জন্য আবার বাংলাদেশে ফিরে আসে সেটা আগের পর্বে বলা হয়েছে।
আমি কারুকাজ করা শিফন/জর্জেট বা লনের পোশাক পরার বিরোধীতা করছি না। আপনার ইচ্ছে হলে আপনি তা অবশ্যই পরবেন। তবে সেটা পাকিস্তানের না হলেই হয়। চীন, ভারতসহ দুনিয়ার বহু দেশই এসব কাপড় বানায়। ‘পাকিস্তানের কারুকাজ/লন-ই ভালো’ - এমন অন্ধ বিশ্বাস থেকে বেরিয়ে আসুন, দেখবেন সারা দুনিয়া আরো অনেক রঙ-বৈচিত্র্য নিয়ে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।
পাকিস্তান থেকে আমদানী বন্ধের বা হ্রাসের এই উদ্যোগটা কয়েক তরফে হতে হবে। যে সব আমদানীকারক পাকিস্তান থেকে পণ্য আমদানী করে থাকেন তারা যদি একটু সচেতন হয়ে বিকল্প উৎস থেকে আমদানী শুরু করেন তাহলে সবচে’ বড় কাজটাই হয়ে যায়। পাকিস্তানের জিনিস মানেই দামে সস্তা বা মানে ভালো এমনটা নয়। তুলার কথাই ধরুন। গত বছর পাকিস্তান গড়ে ১৪৮ টাকা/কেজি দরে তুলা রফতানী করেছে। অথচ গত বছর ১০০ টাকা/কেজি বা তারও কম দরে বহু দেশ সমমানের তুলা রফতানী করেছে। তাহলে খামোখা বেশি দাম দিয়ে পাকিস্তান থেকে তুলা কেনা কেন? এখানে ভিন্ন ধরনের দুটো কারণ আছে যা আপাতদৃষ্টিতে দেখা যায় না।
প্রথম কারণটা ভাষাগত। বাংলাদেশীদের একটা বড় অংশের ধারণা তারা হিন্দী-উর্দু জানে। হিন্দী সিনেমা-সিরিয়াল দেখে তাদের এই ধারণা হয়েছে। বাস্তবে তাদের খুব কম জনই শুদ্ধ হিন্দী/উর্দু বলতে পারে। বাকিরা শুনলে হিন্দী কিছুটা বুঝলেও উর্দুর বেশিরভাগ কথা বুঝতে পারে না। এক-আধজন কষ্টেসৃষ্টে হিন্দী সাইনবোর্ড পড়তে পারে কিন্তু উর্দুতে না। আর কেউ এক অক্ষর হিন্দী/উর্দু লিখতে পারে না। তারচেয়ে বড় কথা, বলার ক্ষেত্রে হিন্দী আর উর্দুর পার্থক্য কী সেটাই তারা জানে না। প্রথাগতভাবে হিন্দী/উর্দু ভাষা না শিখলে এমনটাই হবার কথা। তো উর্দু জানা সম্পর্কে এই ভুল ধারণা থেকে অনেকে মনে করে পাকিস্তানের সাথে ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে ভাষার বাধা নেই। বাংলাদেশের কোথাও পাকিস্তানী পণ্যের মেলা হলে দেখতে পাবেন সেখানে এক শ্রেণীর বাংলাদেশী মোটামুটি হাত কচলে, জীভ মুচড়ে, হাত-পা নেড়ে, মাথা ঝাঁকিয়ে বাংলা-হিন্দী-উর্দু-ইংরেজী’র এক মিশেল ভাষায় কথা বলছে। এতে যে কাঙ্খিত কমিউনিকেশনটা হয় তা নয়। প্রায়ই ভুল বোঝাবুঝি হয় এবং এর জন্য মাশুলও গুনতে হয়। ক্রেতাকে বুঝতে হবে তাকে বোঝানোর দায় বিক্রেতার। সুতরাং, ক্রেতা যদি নিজের মাতৃভাষায় বা আন্তর্জাতিক কোন ভাষায় কথা বলেন তাহলে বিক্রেতা বাধ্য হবে ক্রেতার বোধগম্য ভাষায় কমিউনিকেট করতে। আমাদের ব্যবসায়ীরা নিজের ভাষার ব্যাপারে যদি একটু উচ্চ ধারণা পোষণ করেন এবং নিজের মাথাটা উঁচু রাখেন তাহলে সারা দুনিয়ার সেরা উৎস (মূল্য ও মান বিবেচনায়) থেকে তিনি পণ্য কিনতে পারবেন।
দ্বিতীয় কারণটি ধর্মীয়। তাদের ভাষায় পাকিস্তান হচ্ছে তাদের ‘মুসলিম ভাই’। খুব সহজ যে যুক্তিটি তাদের মাথায় ঢোকে না সেটি হচ্ছে — ১৭ কোটি ৮০ লাখ মুসলিম আছে বলে পাকিস্তান যদি তাদের ‘মুসলিম ভাই’ হয়, তাহলে ১৭ কোটি ৭২ লাখ মুসলিমের দেশ ভারত তাদের ‘মুসলিম ভাই’ নয় কেন? ইন্দোনেশিয়া-মালয়েশিয়া-ইরান-তুরস্ক-মিশর-উযবেকিস্তানের মতো মুসলিম প্রধান দেশগুলোর কথা আর নাই বা বললাম। আর তাদের মুসলিম ভাই পাকিস্তান তাদেরকে কী চোখে দেখে, তাদেরকে কেমন মুসলিম মনে করে সেটা এই ঐতিহাসিক ভাষণ আর তাতে করা পাকিস্তানীদের কমেন্টগুলো পড়লে কিছুটা বোঝা যাবে।
http://www.youtube.com/watch?v=51I1WWXH0Gc
বাংলাদেশ সরকার যদি কোন কারণে পাকিস্তানের ওপর বাণিজ্যিক অবরোধ আরোপ করে, কেবল তাহলে পাকিস্তান থেকে আমদানী পুরোপুরি বন্ধ করা যাবে। কিন্তু চাইলেই কোন সরকার অবরোধের মতো কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারে না। তবে সরকার চাইলে দেশে পাকিস্তানী পণ্য আমদানী নিরুৎসাহিত করা সম্ভব। পাকিস্তান থেকে আমদানীকৃত পণ্যের শুল্কায়ণের ক্ষেত্রে ‘সর্বোচ্চ শুল্কায়ণযোগ্য মূল্য” নীতি গ্রহন করলে পাকিস্তানী পণ্যের কস্টিং বৃদ্ধি পাবে, ফলে আমদানীর পরিমাণ হ্রাস পাবে। বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক ও আঞ্চলিক ফোরামে পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের করা চুক্তিগুলোর আওতায় যে যৌথ কর প্রত্যাহার বা শুল্ক-কর হ্রাসের ব্যবস্থা আছে মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে সেগুলো আর নবায়ণ না করলে অনেক পণ্যের আমদানী শুল্ক-করের হার বেড়ে যাবে, ফলে আমদানী নিরুৎসাহিত হবে। বাংলাদেশে পাকিস্তানী পণ্যের মেলা/প্রদর্শনী এবং পাকিস্তানী নাগরিকদের বাংলাদেশে ট্রেডিং-এর অনুমতি আর দেয়া না হলে অথবা সেগুলোর ক্ষেত্রে উচ্চ হারে করারোপ করলে এগুলোর মাধ্যমে পাকিস্তানী পণ্যের আমদানী হ্রাস পাবে।
পাকিস্তানের বিনিয়োগ ছাড়া আমাদের কি চলবে?
কাদের মোল্লার বিচারের রায় কার্যকর হবার পর সংবাদ মাধ্যমগুলোতে এমন খবর আসতে থাকে যে, যদি এভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর হতে থাকে তাহলে বাংলাদেশে ১০ হাজার পাকিস্তানী বিনিয়োগকারী তাদের ১৬,০০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে চলে যাবে। বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগ নিয়ে যাদের নূন্যতম ধারণা আছে তাদের কাছে ১০ হাজার বিনিয়োগকারী এবং ১৬,০০০ কোটি টাকা দুটো সংখ্যাই অবিশ্বাস্য বলে মনে হবে। তো খবরে দেয়া এই তথ্যগুলোর উৎস কী? তারা কিছু বলেননি, আমিও কোথাও খুঁজে পাইনি। বরং বাংলাদেশের সরকারী উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্য হচ্ছে ১৯৭৭ থেকে ২০১০ এই তেত্রিশ বছরে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে মোট ১৬টি ইউনিটে বিনিয়োগ মাত্র ১৩.১৪৩ মিলিয়ন ডলার বা ১০৫ কোটি টাকা যা বাংলাদেশে মোট বৈদেশিক বিনিয়োগের ০.১৯% মাত্র। এবং এই ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে মাত্র ১,৪৬৮ জনের। এই ১০৫ কোটি টাকাকে নেট ইনফ্লো ধরলেও মোট বিনিয়োগ কখনোই ১৬,০০০ কোটি টাকা হতে পারে না। এবং বাংলাদেশে একটা মাঝারী আকারের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতেও দেড় হাজারের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়।
তাহলে এই ১০ হাজার বিনিয়োগকারী কোথায় এবং বাকি ১৫,৮৯৫ কোটি টাকাই বা কই? এই গল্পের সম্ভাব্য দুটো ব্যাখ্যা হতে পারে। এক, কোন প্রকার তথ্যপ্রমাণ ছাড়া উদ্দেশ্যমূলক ভাবে এই সংখ্যাগুলি ছড়ানো হয়েছে যাতে সাধারণ মানুষের মধ্যে এমন ধারণা তৈরি হয় যে, যুদ্ধাপরাধের বিচার চালিয়ে গেলে পাকিস্তান বাংলাদেশকে বিপুল আর্থিক ক্ষতির সন্মূখীন করতে সক্ষম হবে। দুই, ১৬,০০০ কোটি না হলেও বাংলাদেশে পাকিস্তানীদের বিপুল বিনিয়োগ আছে যার মধ্যে উৎপাদন/সংযোজন হচ্ছে ১০৫ কোটির আর বাকিটা (যত কোটিই হোক) পুরোটাই ট্রেডিং। এটাও বোঝা যাচ্ছে, এই ট্রেডিং-এ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমাদের সরকারের কাছে সম্ভবত পুরো তথ্য নেই। বাংলাদেশ সরকারকে ফাঁকি দিয়ে বা মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে ট্রেডিং করলে এমনটা হবার কথা। এই বর্ণচোরা ট্রেডারদের অনেকেই আগের পর্বে বলা পাকমনপেয়ারু ট্রেডিং (পিটি) গোত্রের সন্ত্রাস লালনকারী হওয়া অসম্ভব কিছু নয়।
এখন পর্যন্ত পাকিস্তান বাংলাদেশে টেক্সটাইল, চামড়া, স্টিলের সামগ্রী, হাউজহোল্ড, অটোমোবাইল ইত্যাদি খাতে বিনিয়োগ করেছে। বস্তুত পাকিস্তান প্রযুক্তিগতভাবে এতোটা উন্নত নয় যে এইসব খাতে পাকিস্তানের বাংলাদেশে বিনিয়োগ বিশেষ গুরুত্ব বহন করবে। আবার পাকিস্তান এমন বিপুল পরিমাণ অর্থও বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেনি যা এখানে বিপুল পরিমান কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। অতএব, বাংলাদেশে পাকিস্তান আদৌ কোন বিনিয়োগ না করলেও আমাদের কোন ক্ষতি নেই।
এইখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানা থাকা দরকার। পাকিস্তান নিজে বিপুল পরিমাণ তুলা, সুতা ও কাপড় তৈরি করলেও আজ পর্যন্ত তৈরি পোশাক রফতানীতে বাংলাদেশের ধারেকাছেও পৌঁছাতে পারেনি। ২০১২ সালে তৈরি পোশাক খাতে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের রফতানী ২৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আর পাকিস্তানের রফতানী ৪.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। পাকিস্তান তার তৈরি পোশাক রফতানীর ইতিহাসে কখনো ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়াতে পারেনি। বাংলাদেশে যেখানে সব তৈরি পোশাক রফতানীকারক রফতানী শুল্ক-করাদি মওকুফ পান, সেখানে পাকিস্তানে অল্প কিছু রফতানীকারক এই সুবিধা ভোগ করে। তৈরি পোশাক প্রস্তুতের জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি আমদানীর জন্য ঋণপত্র খোলা, বিনাশুল্কে কাঁচামাল আমদানী ও তৈরি পোশাক রফতানীর জন্য অনুমতি ইত্যাদি সম্পন্ন করতে বাংলাদেশে সময় লাগে মোটামুটি দুই ঘন্টা, আর একই কাজ করতে পাকিস্তানে সময় লাগে ২৬ সপ্তাহ। এমনসব বাস্তব কিছু প্রতিবন্ধকতা এবং বিদেশী বিনিয়োগকারীদেরকে বাংলাদেশ সরকারের দেয়া কর মওকুফসহ অন্যান্য আকর্ষণীয় সুবিধার কথা বিবেচনা করে পাকিস্তানের গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশে ফ্যাক্টরি দেবার জন্য মরিয়া হয়ে আছে। সস্তায় বাংলাদেশের জমি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, দক্ষ শ্রমিক ব্যবহার করে পাকিস্তানী গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশে বসে পাকিস্তানের বৈদেশিক আয় বাড়াতে চাইছে। সঙ্গত কারণে বিজিএমইএ প্রথম থেকেই পাকিস্তানের এই পরিকল্পনার বিরোধীতা করে আসছে। বাংলাদেশের প্রধান রফতানী খাতে পাকিস্তানীরা থাবা বসানোর আগেই তা রুখতে হবে।
এতক্ষণ পর্যন্ত যা কিছু বলা হলো সেখানে আমাদের সরকার এবং আমাদের ব্যবসায়ীরা কী করে বাংলাদেশে পাকিস্তানী পণ্যের আগ্রাসণ ঠেকাতে পারেন তা আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু এই ব্যাপারে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কি কিছুই করার নেই? না, অবশ্যই আমাদেরও কিছু করার আছে। সাধারণ নাগরিকগণ একটা ছোট কাজ করলেই চলে। বাজারে কোন কিছু কেনার সময় দেখে নিতে হবে বা জেনে নিতে হবে পণ্যটি পাকিস্তানের তৈরি কিনা। যদি তা হয় তাহলে বিক্রেতাকে বলুন বিকল্প উৎস (বাংলাদেশ/অন্য কোন দেশ) থেকে আসা পণ্য দিতে। বিক্রেতা বিকল্প কিছু দিতে না পারলে সোজা অন্য দোকানে চলে যান।
পাকিস্তানের সাথে ব্যবসায়ের ফলটা বাংলাদেশ কীভাবে পাচ্ছে সেটা গত পর্বে দেখেছেন। সুতরাং —
- পাকিস্তানী জ্যুস খাবার সময় দেখুন স্ট্র দিয়ে যা যাচ্ছে সেটা কি আসলেই জ্যুস, নাকি আপনার ভাইয়ের রক্ত!
- পাকিস্তানী সিরিয়াল খাবার সময় দেখুন চামচে যা উঠে আসলো সেটা কি আসলেই সিরিয়াল, নাকি আপনার মায়ের মগজ!
- পাকিস্তানী নুডল্স খাবার সময় দেখুন ফর্কে যা পেঁচিয়ে নিলেন সেটা কি আসলেই নুডল্স, নাকি আপনার বাবার নাড়িভুড়ি!
- পাকিস্তানী লন-এর পোশাক পরার সময় দেখুন গায়ে ওটা কি চাপাচ্ছেন? ওটা কি কোন কাপড়, নাকি আপনার বোনের গায়ের চামড়া!
আপনার অভ্যস্ততা পাল্টানোর দরকার নেই, শুধু পণ্যের উৎস পাল্টান। আপনার তরফ থেকে এই উদ্যোগটুকুই বাংলাদেশে পাকিস্তানের বাণিজ্য বন্ধ করার জন্য যথেষ্ট।
(সমাপ্ত)
ইফতেখার আলী
মন্তব্য
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
সেটাই, পণ্যের উৎস পাল্টালেই হয়। পাকিস্তান থেকে কোন ইউনিক কিছু আমরা আমদানি করিনা, আমদানিকারকরা বিকল্প উৎসগুলোর দিকে আগ্রহী হলেই পাকিস্তান থেকে আমদানি করা একটা নির্দিষ্ট সময়ের টার্গেট নিয়েই বন্ধ করে দেয়া সম্ভব।
----------------------------------------------------------------
''বিদ্রোহ দেখ নি তুমি? রক্তে কিছু পাও নি শেখার?
কত না শতাব্দী, যুগ থেকে তুমি আজো আছ দাস,
প্রত্যেক লেখায় শুনি কেবল তোমার দীর্ঘশ্বাস!''-সুকান্ত ভট্টাচার্য
____________________________
দেশের বাইরে সস্তায় পেয়েও অনেক কাপড় চোপড় হাতে তুলে নেবার পর রেখে দিয়েছে, ওগুলোতে লেখা ছিল Made in pakistan [ছোট অক্ষরের p ইচ্ছাকৃত]।
অনেক সময় কাপড় কেনার উদ্দেশ্য না থাকলেও ভবিষ্যতে কাজে লাগবে ভেবে কিনেছি যখন লেখা দেখেছি Made in Bangladesh
আপনি অনেক পরিশ্রম করে তথ্য যোগাড় করে এই লেখাটা লিখেছেন, সেজন্য আপনাকে সাধুবাদ।
খুব অল্প সময়ে স্মৃতি থেকে হারিয়ে যাবার আগেই আপনি দু'পর্ব শেষ করেছেন, সেজন্যেও আপনাকে ধন্যবাদ।
শুভেচ্ছা:
এই পোস্টটি সবাই যে যার সামাজিক পরিসরে ছড়িয়ে দিন প্লিজ।
৫ তারা।
সুন্দর করে গুছিয়ে লেখা অত্যন্ত জরুরী পোস্ট।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
খুবই চমৎকারভাবে এবং সবোর্পরি আসল কথাগুলোই বলা হয়েছে। লেখককে অনেক ধন্যবাদ।
একটা ছোট্টো অনুরোধ করব, পোস্টে উল্লিখিত সংখ্যাবাচক তথ্য-উপাত্তগুলোর রেফারেন্স যোগ করে দিলে অনেক জ্ঞানপাপী তার্কিকের সাথে লড়তে আরেকটু সুবিধা হোতো।।।
সুবোধ অবোধ
উপরে পার্থ বলেছেন, আরো অনেকে হয়তো ভেবেছেন কেন আমি পোষ্টে দেয়া তথ্যগুলোর কোন রেফারেন্স দেইনি। এই ব্যাপারে আমার মত হচ্ছে, তথ্যের রেফারেন্স দিলে পাঠকদের কেউ কেউ হয়তো লিঙ্ক (যদি থাকে) ক্লিক করে থাকেন। লিঙ্ক ক্লিক করলেই যে একেবারে হাতে বানানো আকারে উপাত্তটা পাওয়া যায় তা না। বেশিরভাগ সময়ে সেখানে হিসেব নিকেশ করার ব্যাপার থাকে। অনেক ক্ষেত্রে গ্রাফিক্যাল প্রেজেন্টেশনগুলো থেকে ইন্টারপ্রেটেশন দাঁড় করাতে হয়। মোট কথা লিঙ্কওয়ালা রেফারেন্স দিলে সেখানে পাঠককে খাটাখাটুনি করে লেখকের সাথে একমত বা ভিন্নমত হতে হয়। আবার রেফারেন্স যদি লিঙ্ক ছাড়া হয় তাহলে পাঠককে তো লেখকের মতো দৌড়াদৌড়ি করে রেফারেন্সগুলো জোগাড় করতে হবে। এতে পাঠকের প্রতি কতোটা ন্যায়বিচার করা হয়?
এই সত্যটা আমরা সবাই জানি যে, এই ব্লগটা সারা দুনিয়ার যে কোন জায়গা থেকে যে কেউ অ্যাক্সেস করতে পারেন। সেই বিশাল পাঠককূলের মধ্যে এমনসব বিশেষজ্ঞ ও জ্ঞানী মানুষ আছেন যাদের কাছে এই ব্যাপারে কোন চালাকি বা মিথ্যাচার চলবে না। তাই আমি বানোয়াট কোন তথ্য দেবার কথা ভুলেও ভাবি না, বা নিজের ভাবনাকে ফ্যাক্ট হিসাবে চালিয়ে দেবার চেষ্টা করি না। এই পোস্ট এমন একটা সাধারণ বিষয়ে লেখা যেখানে ছোট ধরনের মিথ্যাচার করলেও সাধারণ পাঠক ধরে ফেলতে পারবেন।
আমি জানি, তারপরেও কিছু জ্ঞানপাপী অযথাই তর্ক জুড়বে। কেউ অমন করলে আমি অনুরোধ করবো তারা যেন বিকল্প তথ্যটা রেফারেন্সসহ এনে রিফ্যুট করে। আর কারো যদি ইচ্ছে হয় তাহলে এই পোস্টের যে কোন তথ্যের ব্যাপারে এখানে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন। আমি চ্যালেঞ্জ গ্রহন করতে প্রস্তুত আছি।
ইফতেখার আলী
তথ্য হয়তো খুঁজলেই পাওয়া যাবে, তবুও আপনি যেসব সোর্স থেকে তথ্য নিয়েছেন সেগুলো লেখার শেষে দিয়ে দেয়া দরকার বলে মনে করি। এতে করে পোস্টের ওয়েটও বাড়বে।
পাকিস্তানি পন্যের চাহিদার একটা কারণ হতে পারে কনভেনিয়েন্স। বিষয়টা এরকম না যে যেহেতু পাকিস্তানি সেহেতু কেনা হচ্ছে। শহরের সবচে বড় মার্কেটে ঢুকে অর্ধেক দোকান পাকিস্তানি পন্যে ভরা থাকলে কিছু কিনতে গেলেই সেটাতে পাকিস্তানি কিছু থাকা সম্ভব। এগুলো নিয়ন্ত্রন করাটা খুবই সম্ভব।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
- পাকিস্তানী জ্যুস খাবার সময় দেখুন স্ট্র দিয়ে যা যাচ্ছে সেটা কি আসলেই জ্যুস, নাকি আপনার ভাইয়ের রক্ত!
- পাকিস্তানী সিরিয়াল খাবার সময় দেখুন চামচে যা উঠে আসলো সেটা কি আসলেই সিরিয়াল, নাকি আপনার মায়ের মগজ!
- পাকিস্তানী নুডল্স খাবার সময় দেখুন ফর্কে যা পেঁচিয়ে নিলেন সেটা কি আসলেই নুডল্স, নাকি আপনার বাবার নাড়িভুড়ি!
- পাকিস্তানী লন-এর পোশাক পরার সময় দেখুন গায়ে ওটা কি চাপাচ্ছেন? ওটা কি কোন কাপড়, নাকি আপনার বোনের গায়ের চামড়া!
নতুন মন্তব্য করুন