পাঁচ মিনিটের প্যাঁচ

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ৩০/১২/২০১৩ - ১২:৪১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মাত্র পাঁচ মিনিটের জন্য বাসটা মিস্‌ করলাম। পরের বাস আরো ঘন্টাখানিক পর। অলরেডি অফিসের জন্য লেইট হয়ে গেছি। এই দেশে বাসের কঠিন সময়ানুবর্তীতার উপর সঙ্গত কারণেই মেজাজ খারাপ হলো। ‘ইশ্‌, আর মাত্র পাঁচটা মিনিট দেরি করে এলে বাসের কি এমন ক্ষতিটা হতো’ ভাবতে ভাবতে বাস স্টপে বসলাম। স্টপে আমার পাশেই আরো একজন বৃদ্ধ ভদ্রমহিলা বসে আছেন। রুপ দেখলেই বোঝা যায়, এক সময় ডাকসাইটে সুন্দরী ছিলেন তিনি। দুইজনই পাশাপাশি চুপচাপ বসে আছি। কী জানি হলো, হঠাত করে দেখি ভদ্রমহিলা “জন্‌” “জন্‌” বলে চেচাতে শুরু করেছেন। বৃদ্ধা প্রাণপনে চেচাচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু উনার গলা দিয়ে ঠিক করে শব্দ বের হচ্ছে না। ভালোমত এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখি রাস্তার উল্টো পাশের ফুটপাথ দিয়ে একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক হেঁটে যাচ্ছেন। বেশ চওড়া রাস্তা। বৃদ্ধার চিৎকার জন্‌ সাহেবের কান পর্যন্ত যাচ্ছে না। তাছাড়া অন্য গাড়ির শব্দে আরও কিছু বোঝা যাচ্ছে না। বার্ধক্য রুপের সাথে সাথে বৃদ্ধার গলার জোরও খেয়ে ফেলেছে। আমি চুপচাপ বসেই রইলাম। যতদূর জানি অন্যের ব্যাপারে নাক্‌ গলানোটাকে এইদেশে অভদ্রতা হিসেবে ধরা হয়। দরকার কী শুধু শুধু ‘অভদ্র’ হয়ে।

যাই হোক, বেশ কয়েকবার ডাকার পরেও ‘জন্‌’ যখন বৃদ্ধার ডাক শুনলেন না হঠাত করে বৃদ্ধা তখন খুব অস্থির হয়ে পড়লেন। রাস্তায় কোন গাড়ি আছে কি নেই সেসব খেয়াল না করেই বৃদ্ধা তাঁর তিন পা দিয়ে রাস্তা পার হতে শুরু করলেন। নিজের দুই পা আর তাঁর লাঠি, এই মিলে হলো তিন পা। যে গতিতে উনি হাঁটছেন সে গতিতে জন্‌কে উনি আজীবনেও ধরতে পারবেন না। কারন ততক্ষনে জন্‌ নিজেও বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়েছেন এবং প্রতি সেকেন্ডেই আরো একটু এগিয়ে যাচ্ছেন। আমার কানে হেডফোনে তখন বাজছে শিরোনামহীনে’র গান, “তুমি চেয়ে আছো তাই, আমি পথে হেঁটে যাই...।” গানটা হঠাত কেমন যেন নতুন অর্থ নিয়ে আমার কানে বাজছে। কিন্তু কী সেই অর্থ সেটা ঠিকমত ধরতে পারছি না।

পরের বাস আসতে তখনও ঢের দেরি। গান শুনেই কিনা জানি না, আমি শেষ পর্যন্ত বৃদ্ধাকে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নিলাম। তারা আমাকে অভদ্র ভাবে ভাবুক। প্রথমেই বৃদ্ধাকে ধরে জোর করে আবার বাস স্টপে বসিয়ে দিলাম, তারপর ছুটলাম জন সাহেবের পেছনে। জন্‌কে ধরতে আমার মাত্র মিনিট খানেক সময় লাগলো। তাঁকে থামিয়ে বৃদ্ধার দিকে আঙ্গুল নির্দেশ করে বললাম যে, “ঐ ভদ্রমহিলা তোমাকে ডাকছেন”। আমার কথা শুনে জন্‌ প্রথমে কিছুক্ষণ আমার দিকে এবং তারপরে রাস্তার ঐপারে বসে থাকা বৃদ্ধার দিকে সরুচোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। তারপর ফ্যাস্‌ফ্যাসে রুক্ষ গলায় আমাকে বললেন উনি নাকি বৃদ্ধাকে চিনতে পারছেন না। বুঝলাম যে বার্ধক্য বৃদ্ধার রুপ আর গলা খেয়েছে, কিন্তু দৃষ্টিশক্তি অথবা স্মৃতিশক্তি যে কারটা খেয়েছে সেটা ঠিক করে বুঝতে পারলাম না। অবশেষে সেই মুহূর্তে জন্‌ সাহেবের কোন ব্যাস্ততা না থাকায় উনি বৃদ্ধার কাছে যেতে রাজি হলেন।

বৃদ্ধার কাছে এসে ‘জন্‌’ অপলকে কিছুক্ষণ বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে থেকে ধরা গলায় শুধুমাত্র “ক্যাথ্‌রিন” নামটি উচ্চারণ করলেন। তারপরেই উনার চোখ বেয়ে প্রথমে এক ফোঁটা এবং পরে টপ টপ করে ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়তে লাগলো। বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে দেখি তারও সেই একই দশা। একজন আরেকজনকে ছোট বাচ্চার মত জড়িয়ে ধরেছেন। আহা, কী মধুর এই মিলন দৃশ্য। দৃশ্যটা দেখে বুঝলাম যে বয়স স্বাস্থ্য-রুপ-স্মৃতি বা দৃষ্টিকে নষ্ট করতে পারলেও আবেগকে ছুঁতে পারে না মোটেই। নিজের আবেগ সামাল দিয়ে ‘জন্‌’ আমাকে জিগ্যেস করলেন, “এই মেয়েটির সাথে আমার পরিচয়ের গল্প শুনবে? এই যুগে তোমরা আর কী এমন প্রেম করো! আমাদের প্রেমের গল্প নাটক-সিনেমার গল্পের থেকেও অনেক বেশি ইন্টারেস্টিং”। আমি মনে মনে বললাম, “হায়রে! মেয়ে কোথায় পেলেন! ‘ক্যাথরিন’ তো একজন বৃদ্ধা ছাড়া কিছুই নন।” আর মুখে বললাম যে, “আলবৎ শুনবো আপনাদের প্রেমের গল্প।” ভাগ্যের কী পরিহাস, আমার কথা শেষ হবার সাথে সাথেই আমার বাস এসে পড়লো। এবারেরটা আর মিস্‌ করার উপায় নেই। মিস্‌ করলে আমার আর চাকরি থাকবে না। কী আর করা। মন খারাপ করে বাসে উঠে বসলাম। আবারও বাসের কঠিন সময়ানুবর্তীতায় মেজাজ হলো। এবারের মেজাজ খারাপটা গতবারের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। আর মাত্র পাঁচটা মিনিট দেরি করে আসলে বাসের কি এমন ক্ষতিটা হতো!!!

ক্ষতি আসলে হতো রে ভাই। ভেবে দেখুন এরকম পাঁচ মিনিট, পাঁচ মিনিট করতে করতেই একদিন আমরা বুড়া হয়ে যাই। অনেক গুলো পাঁচ মিনিটের সমষ্টিই আমাদের জীবন। আমার দাদার বাবাও এভাবেই বুড়া হয়েছেন। আমার দাদাও হয়েছেন। আমার বাবাও এখন হচ্ছেন। আমিও হবো। আপনিও হবেন। So try to live your life. Get the most out of it. মাস্তিপূর্ণ এবং অর্থময় করে তুলুন আপনার জীবনের প্রতিটা পাঁচ মিনিটকে। সবাইকে নতুন বছরের আগাম শুভেচ্ছা রইলো।

লিখেছেন;
নাঈম অঙ্কন


মন্তব্য

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

ক্ষতি তো আমাদের হল, গল্পটা মিস মন খারাপ

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

ভালো লেগেছে!

-অপ্রকৃতিস্থ

অতিথি লেখক এর ছবি

পাঁচ মিনিটের আক্ষেপটা থেকেই গেল!! মন খারাপ

-নিহাদ

রু  এর ছবি

ভালো লাগলো।

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

পাঁচ মিনিটের গল্প। ব্লগের জন্য আকারে আরামদায়ক। দ্রুত পড়ে ফেলা গেল।
রুপ>রূপ চোখে লাগে।
কিছু ইংরেজী শব্দ এবং শেষের লাইনটা বাংলা হলে কেমন হতো ভাবছি।

আপনার লেখা আরো গল্প পড়তে চাই।

গান্ধর্বী এর ছবি

ভাল লাগল আপনার লেখা। আরো লিখুন। পাঁচ মিনিটের দোহাই দিয়ে গল্প যেন অসমাপ্ত না থাকে!
নতুন বছর মাস্তিপূর্ন না হয়ে আনন্দময় হয়ে উঠুক! চোখ টিপি

------------------------------------------

'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

পরের বাস এসে গেল? এত তাড়াতাড়ি? দুত্তোরি! নিকুচি করি নিয়মানুবর্তিতা আর সময়ানুবর্তিতার!

নাঈম অঙ্কন এর ছবি

আপনাদের সবার কমেন্ট পড়ে অনেক উৎসাহ পেলাম। ধন্যবাদ সবাইকে হাসি

এক লহমা এর ছবি

ভালো লাগল তবে বানান নিয়ে আরো যত্ন নিলে এবং যতটা সম্ভব বাংলায় লিখলে আরো ভাল লাগবে।
পরের লেখার অপেক্ষায় থাকলাম।
গান্ধর্বী-র মত আমিও বলি "নতুন বছর মাস্তিপূর্ন না হয়ে আনন্দময় হয়ে উঠুক!" হাসি

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

ভালো

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।