আদুভাই নামের আমাদের পাড়ায় এক বড়ভাই ছিলো। মানুষ ভালো কিন্তু জগতের কোন কাজই ভালো মত পারতো না সে। সোজা কথায় আমড়া কাঠের ঢেকি আর কী। আমাকে সাথে নিয়ে সারাদিন গোপালের মিষ্টির দোকানে বসে থাকতো আর একটু পর পর জোর করে আমাকে মিষ্টি খাওয়াতো। আমার কপ্ কপ্ করে মিষ্টি খাওয়া দেখলে নাকি উনার মন ভালো হয়ে যেত। তখনও আমার হাফ্-প্যান্ট পড়ার বয়স। আদুভাই বিরাট অকর্মণ্য মানুষ। স্বাভাবিকভাবেই পরিবার থেকে শুরু করে বন্ধুসমাজ পর্যন্ত সবখানেই ব্যাপকভাবে অবহেলিত ছিলো সে। হঠাত একদিন কী মনে করে জানি পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধবের কাছে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার সাধ জাগলো। যেমনি ইচ্ছা, তেমনি কাজ। সে করলো কী, তার সমস্ত পরিচিতজনকে মিছেমিছি জানিয়ে দিলো যে লটারিতে সে দশ কোটি টাকা জিতেছে। তার এই কথা শুনে তো পরিবার পরিজন সহ সবার একেবারে চক্ষু চরক্ গাছ। “এক কোটি না, দুই কোটি না, আমাদের ‘আদু’ সরাসরি দশ কোটি টাকার মালিক?” সবার কাছে রাতারাতি তার খাতির বেড়ে এভারেস্টের চুড়া স্পর্শ করলো। আজ এই ফুপুর বাসায় দাওয়াত তো কাল সেই মামীর বাসায় দাওয়াত। প্রতিটা বাসায় দাওয়াতে আদুভাই এক প্যাকেট মিষ্টি, মুখ ভর্তি হাঁসি আর আমাকে সাথে নিয়ে যান। সব বাড়িতে একই ঘটনা ঘটে। দাওয়াতের শুরুতে সবাই এমন একটা ভাব করে যেন আদুভাইকে এমনি এমনিই দাওয়াত করা হয়েছে, লটারি-ফটারি কোন ব্যাপারই না। দাওয়াতের শেষের দিকে এসে ফুপা অথবা মামার খুক্ খুক্ করে কাশী শুরু হয়। কিছুক্ষণ কেশে উনারা জিগ্যেস করেন যে এতগুলো টাকা দিয়ে আদুভাই কি করবে। আদুভাই বিনয়ী হয়ে উত্তর দেয় যে, ব্যাবসা-ট্যাবসা কিছু একটা করার ইচ্ছা আছে। ব্যাবসার বিষয়ে খালু বা মামা তার সাথে নিজেদের অভিগ্যতা শেয়ার করলে সে খুবই কৃতার্থ হয়। তাঁর এই কথা শুনে খালু/মামা সহ সবার কাছে তাঁর আদর দ্বিগুণ বেড়ে যায়। এরপরের কিছুক্ষণ নিজেদের অভিজ্ঞতার ছাপ রেখে জ্ঞানী কথাবার্তা বলেন ফুপা-মামারা। তারপর দ্বিতীয় দফায় উনাদের কাশী শুরু হয়। উনাদের কাশী থামার আগেই উনাদের প্রশ্নটা বুঝে ফেলেন আদুভাই। নিজে থেকেই উত্তর দিয়ে দেন তিনি, - "আগে কিছুদিন দেশটা ঘুরে দেখতে চাই। মাস তিনেক পর ব্যবসা শুরু করবো বলে ভাবছি।"
আদরে আদরে মাস খানেক ভালোই কেটে যায়। এর মধ্যে আবার উপরি পাওনা হিসেবে জুটেছেন পাশের বাড়ির রুপা আপা। রুপা আপা এখন আদুভাইকে ছাড়া কিছুই বোঝেন না। অথচ এই রুপা আপাই ছাঁদের থেকে তাঁর দিকে ফ্যাল্ ফ্যাল্ করে তাকিয়ে থাকার অপরাধে আদু ভাই কে ‘ধরাম’ করে বন্-চটকানা মেরেছিলেন। সেই চটকানায় আদুভাইয়ের ডান কানটা আংশিক ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছিলো। লটারি জেতার খবর ছড়ানোর পর আদু-ভাই আর রুপা আপার প্রেমটা যখন জমে গেলো, তখন অবশ্য রুপা আপা জানিয়েছেন যে সেই চটকানাটা নাকি আদরের চটকানা ছিলো। আদু ভাইয়ের সেই ফ্যাল্ফ্যালে চোখের দৃষ্টি নাকি রুপা আপার বুকে বরাবরই বারতি হৃৎস্পন্দনের জন্ম দিতো। যাই হোক, প্রেম যখন তুঙ্গে তখন একদিন আদু ভাই রুপা আপাকে জিগ্যেস করলেন, “আচ্ছা, তুমি কি আমাকে ভালবাসো, নাকি আমার টাকাকে।” আদুভাইয়ের প্রশ্ন শুনে রুপা আপা মনে ভীষণ চোট পেলেন। এটা কোন কথা হলো! ভালবাসার মাঝে টাকা আসলো কোথা থেকে! ভালবাসা তো ভালবাসাই। মানুষের জন্মের আগেই তাঁর জোড়া নির্ধারিত হয়ে যায়। আদুভাই হলেন রুপা আপা’র পূর্ব নির্ধারিত জোড়া। আদুভাই বিল্ গেটস্ হলেও রুপা আপা উনাকে ভালবাসতেন, আবার কানা ফকির হলেও রুপা আপা উনাকেই ভালবাসতেন। শুধুমাত্র ভালোবাসাটা তখন রাজ-প্রাসাদের বদলে রাস্তার পাশে পড়ে থাকা খালি পাইপের ভেতর হতো, এই যা পার্থক্য। মনে সত্যিকার ভালোবাসা থাকলে পাইপের ভেতরের সংসার নাকি রাজ-প্রাসাদের সংসারের চেয়েও বেশি উত্তেজনাময়।
আহ্, রুপা আপার কথা শুনে আদু ভাইয়ের বুক থেকে পাষাণভার নেমে গেলো। তিনি রুপা আপাকে সব সত্যি খুলে বললেন। রুপা আপু কে জানিয়ে দিলেন যে তিনি আসলে কোন লটারি যেতেননি। উনার কথা শুনে রুপা আপু কিছুক্ষণ পাথরের মূর্তির মতন চুপ করে বসে রইলেন। নড়েনও না, চড়েনও না। আদুভাই তো টেনশনে পড়ে গেলেন। হার্ট অ্যাটাক্ করে রুপা আপু মারা গেলো না তো আবার! ব্যাপারটা চেক্ করতে গিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে আদুভাই “রুপা, রুপা” বলতে বলতে যেই না আপুর হাত স্পর্শ করেছেন, ওমনি কত্থেকে জানি আদু ভাইয়ের উপর আবারও সেই চটাশ শব্দের পাঁচ-টন ওজনের বন্-চটকানা বর্ষিত হলো। ভাগ্য ভালো যে আদর করে রুপা আপা এবারও উনাকে একই গালে চটকানা মারেন নাই। নাহলে এইবার আমার আদু ভাইয়ের কানটা যেতো নিশ্চিত। চড় খাওয়ার পরপরই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন যে “মনটা খুবই খারাপ হয়েছে। চল, কপ্ কপ্ করে তোর মিষ্টি খাওয়া দেখি”। আজব মানুষ।
এরপর ফুপা আর খালু সমাজে আদুভাইয়ের কী গতি হয়েছিলো সেটা অবশ্য আমার জানা নাই। কারণ সেদিন সন্ধ্যায় গোপালের মিষ্টির দোকানেই উনার সাথে আমার শেষ দেখা হয়েছে। শৈশবের হিরো, শৈশবেই হারিয়ে গিয়েছে। আস্তে আস্তে হাফ্-প্যান্ট ছেড়ে আমি ফুল-প্যান্ট পড়ার অভ্যেস করেছি।
লিখেছেন;
নাঈম অঙ্কন
মন্তব্য
নাহ। আদু ভাইয়ের খবর নেয়া উচিত ছিলো। তাহলে অন্তত কপ কপ করে মিষ্টি খাওয়ার ঋণটা শোধ হতো। ওনার কানের উপর দিয়ে তো আরো চাপ গেছে মনে হয়।
মজা লাগলো গল্পটা। চমৎকার ঝরঝরে ভাষা। যদিও মূল সুরটা পরিচিত এবং গতানুগতিক, কিন্তু হাস্যরসের যথেষ্ট সমাগম আছে।
তবে বানানের দিকে একটু নজর দেয়া উচিৎ - পড়া > পরা, হাঁসি > হাসি, বারতি > বাড়তি, চরক্ গাছ > চড়ক গাছ, কত্থেকে > কোত্থেকে। লেখার পরে কিছু সময় গ্যাপ দিয়ে একবার পড়ে নেবেন, তাহলে বোধহয় "এই স্লিপ অব কী বোর্ড" আর হবে না।
আদুভাইকে নিয়ে কি কোন সিরিজ লেখার পরিকল্পনা আছে? না থাকলে ক্যাটেগরিতে আদু রাখার প্রয়োজন দেখছি না। আর "আমার" ক্যাটেগরিতে দেখছি আরো কয়েকজনের লেখা আছে, এই ক্যাটেগরীর কারণ বুঝলাম না। আপনার লেখাগুলোকে "নাঈম অঙ্কন" ক্যাটেগরি করে রাখতে পারেন। অবশ্য এটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত অভিমত, একটা ফিডব্যাক হিসেবে জানিয়ে রাখলাম আরকি।
আপনার আমার পতাকা, আমার অহঙ্কার পড়ে বড় প্রত্যাশা তৈরী হয়েছিল, এই লেখাটা সেই প্রত্যাশার পালে আরো বাতাস লাগালো কিন্তু! বেশী করে লিখতে থাকুন, আপনার কাছ থেকে আসা বিভিন্ন স্বাদের আরো গল্প পড়তে চাই।
____________________________
সুবিধা বাদীর একটা ভালো উদাহরণ।
বিনোদন ছিল, তবুও গল্পটা কিছুটা প্রেডিক্টেবল হয়ে যাওয়ার কারণে কিছুটা হতাশ হয়েছি। অন্যরকম একটা সমাপ্তি আশা করছিলাম। যাই হোক, লেখা ভাল। আশা করি আমার ব্যক্তিগত অভিমত আপনি সহনশীলতার সাথেই নেবেন। ধন্যবাদ।
নতুন মন্তব্য করুন