; যখন আমি ছোট ছিলাম, তখন সব কিছু সহজ লাগত। পাশের বাসায় যাওয়া মানে ছিল দুধভাত। আমাদের মাঝে অন্যরকম এক সৌহার্দের সম্পর্ক ছিল। বিকেলের আড্ডা থেকে শুরু করে কারও বাসায় মেহমান আসলে আমাদের উপস্থিতি, আমারা যেন সবাই আপন মানুষ ছিলাম। শুধু আমাদের পাশের বাসা নয়, আমাদের পাশের বাড়ি এবং তার সবগুলো পরিবার ছিল আমাদের চেনা জানা। আপন মানুষ। একবার আমাদের পাশের বাড়িতে তিন তলায়, এক ছোট্ট শিশু ঘরের ভেতর থেকে দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে দেয়। সেই বাসায় তখন আর কেউ ছিল না! কেন ছিল না তা আমার জানা নেই। বাবুটি ছিটকিনি আটকেছিল নিজের অজান্তে ঠিকই কিন্তু খুলতে আর পারছিল না। দরজার পাশে বসে কেবল কাঁদছিল। এমন সময় আমার পাশের বাসার এক মামাকে নিয়ে, পাশের বাড়ির সেই তিনতলার ঘটনাস্থলে যাই। মামা দরজা ভেঙ্গে বাবুকে বের করে নিয়ে আসেন। সবাই আমাকে জিগ্যেস করছিল, উনি কে? আমার সরল উত্তর ছিল, 'আমার আপন মামা।' ব্যাপারটা হয়ত সবার মাঝে নিজের গুরত্ত বোঝানর জন্য হয়েছিল। কিন্তু এমন সরলভাবে কাউকে আপন করে নেয়া আসলেই বড় ব্যাপার!
আন্তরিকতার আরেকটি বড় মাধ্যম ছিল 'হোম পিকনিক।' প্রতি বাসা থেকে চাল, ডাল, ডিম, তেল সংগ্রহ করা হত। তারপর কোন এক বাসার আপু বা আনটি তা রান্না করতেন। এর মাঝে নানা রকম 'গেম' খেলা হত যেমনঃ 'নেতা বলেছে' অথবা 'চোর খোজা।' সবশেষে সবাই একসাথে বসে খাওয়া দাওয়া। অসম্ভব সুন্দর একটি মানবিকতা।
আর পাশের বাসা'র মানুষ কি জিনিষ! তা টের পাওয়া যেত নিজের বাসার কেউ অসুস্থ হয়ে গেলে। আমার বাবা যেদিন প্রথমবার স্ট্রোক করলেন, তখন আমি এতই ছোট যে তাকে শোয়া থেকে বসাতে পাড়ছিলাম না। আমাদের পাশের বাসায় যে আঙ্কেল ছিল তিনি কোলে তুলে বাবাকে ৪তলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামিয়ে এনে গাড়িতে তুলে দেন। এরকম কোন কাজের কি কোন তুলনা হয়?
কিন্তু আমাদের এখনকার ঢাকাকেন্দ্রিক যে সংস্কৃতি তাতে এই বিষয়গুলো আর খুঁজে পাওয়া যায় না। আমরা নতুন বাসায় উঠেছি ২০০৫ সালে, কিন্তু আমি এখন পর্যন্ত আমার পাশের বাসার মানুষটিকে চিনিনা! এর মাঝে আমার পাশের বাসার মানুষগুলো বদলেছে অনেকবার কিন্তু কারও সাথেই কেন যেন চেনা জানা হয়ে ওঠে না। আমার বাবা বলতেন, 'এক জনের বাসায় গরু জবাই দিলেও আরেকজন আর টের পাবে না!' সত্যিই তাই। আমি জানি না আমার বাড়িতে কে মারা গিয়েছে! শুধু কান্নার রোল উঠলে মাঝে মাঝে খবর পাই অথবা নিচে গেলে দেখতে পাই খাটিয়াতে রাখা মৃত মানুষ। আমি জানিনা, এই ব্যাপারটা শুধু আমাদের ৯৬টা পরিবারের এই পাশাপাশি তিনটা বাড়িতেই কিনা তবে আমার মনে হয় এই রকম 'দেখেও না চেনা অথবা কি লাভ এত্ত খাতির করে' টাইপের সংস্কৃতি আমাদের শহরে মহামারি আকারে আছে। আমাদের উচিত পাশাপাশি থাকা মানুষগুলোর সাথে সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তোলা। কারন বিপদে আপদে এই পাশের বাসার মানুষটিই হতে পারেন আমাদের প্রথম আশ্রয়স্থল। আমাদের সবার এগিয়ে আসতে হবে, কারন এক হাতে তো আর তালি বাজে না!
আগের দিনের স্মৃতিচারন করলে আমার মনে বারে বারে একই গান বাজতে থাকে, 'আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম আমরা, আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম!'
::ভিজ্যুয়ালাইজার::
মন্তব্য
"...'আমার আপন মামা।'..." এইভাবেই বড় হয়েছিলাম আমরাও। এখন সে সব আছে শুধুই স্বপ্নের রাজ্যে।
নিজেদের জীবন থেকে পাশের বাসার মানুষটির অস্তিত্বের হারিয়ে যাওয়াকে গুরুত্ব না দেওয়ার সংস্কৃতি - নাগরিক জীবনের এক মর্মান্তিক অভিশাপ।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
ধন্যবাদ জনাব। আসলে মানুষের জীবন এখন যন্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে। চাইলেও হয়ত আগের অবস্থায় ফেরা সম্ভব না। কি জানি, হয়ত বা আমরা চাই ও না!
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
খুব হাঁসফাস লাগে ঢাকায়!
____________________________
আমার ভাল লাগে, কাজ কর্ম সবই তো এইখানে। কিন্তু মানুষদেরকে কেমন যেন স্বার্থপর মনে হয় ইদানিং।
::ভিজ্যুয়ালাইজার::
সময় বদলেছে, এখন আর এসবের 'চল' নেই।
আমার নিজের একটা থিয়রি আছে:
মানুষ যখন নিজেকে কম স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে তখন সে সমাজের সাথে মেশে বেশি, তার প্রতিবেশির দরকার হয়, পরামর্শের দরকার হয়। যখন মানুষের প্রাচুর্য আসে, তখন সমানুপাতিক হারে মানুষ প্রতিবেশি আর সমাজকে অবজ্ঞা করা শুরু করে। তখন আর প্রতিবেশির সাথে মিশতে ইচ্ছে হয় না, বরং প্রতিবেশির চেয়ে 'লেটেস্ট' মডেলের গাড়ি কেনার দিকেই মনোযোগ চলে আসে।
শুভেচ্ছা
[মেঘলা মানুষ]
বেশ যৌক্তিক ভাবনা। কিন্তু কেউ কি আসলেই কখনও চাহিদা মুক্ত হয়? আরেকটা বিষয় সাধারনত শহরে প্রায় সমকক্ষ আয়ের লোকেরা এক ই বাড়ি তে থাকে। মানে ধরুন যে বাড়ি'র বাসা ভাড়া ৫০০০ তার ভাড়াটিয়া গন মোটামুটি এক ধাঁচের। আবার যে বাসার ভাড়া ৪০০০০ তার ভাড়াটিয়াদের ধাঁচ আবার প্রায় কাছাকাছি। আন্তরিকতা বিষয়টা আসলে ভার্চুয়াল হয়ে গেছে।
::ভিজ্যুয়ালাইজার::
চাহিদা মুক্ত হয় না, কিন্তু আমি নিজেই অনেক কিছু করে ফেলতে পারি (টাকার মায়া না করে)-এই মানসিকতাটাই মানুষকে এককী করে ফেলছে। যারা ৫,০০০ টাকা ভাড়া দেন, তারা বাসার হলুদ কম পড়লে প্রতিবেশির থেকে ধার নিতে পারেন, যারা ৪০,০০০ টাকা ভাড়া দেন, তারা এটা করতেই পারবেন না।
যারা ৫,০০০ টাকা ভাড়া দেন, তারা পাশের বাসায় নক করে বলতে পারেন, "ভাবী, আমরা নতুন এসেছি এখানে, আমার ছেলেটা আপনার ছেলেটার সাথে খেলতে চায়"
যারা ৪০,০০০ টাকা ভাড়া দেন, তারা ছেলের হাতে ট্যাবলেট, স্মার্টফোন তুলে দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেন।
আমার আর কাউকে লাগবে না-এই ধরণের ভাবনাই মানুষকে দেয়ালবন্দী করে ফেলছে।
শুভেচ্ছা
[মেঘলা মানুষ]
মফস্বলে থাকতাম। মনে পড়ে ছোট বোনটার নিউমোনিয়া হলে মা ওকে নিয়ে হসপিটালে থেকেছিল কয়েকদিন। আমি তখন স্কুলে পড়ি, পুরো বিল্ডিং এর একেক বাসায় একেকদিন থাকতাম, খাওয়া দাওয়া করতাম, বেশ স্বাধীন কটা দিন কাটিয়েছিলাম!
আর এখন আমরা পাশের বাসার মানুষকে দেখলে খুব কেজো ভঙ্গিতে পাশ কাটিয়ে চলে যাই!
ভাল্লাগেনা এই ঢাকা।
------------------------------------------
'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)
চমৎকার লিখেছেন
::ভিজ্যুয়ালাইজার::
নতুন মন্তব্য করুন