ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে জন্ম নেয়া পাকিস্তানের মুখে ঝাঁটা মেরে জন্ম নেয়া বাংলাদেশ আজ স্বাধীনতার চার দশক পরেও ধর্মীয় বিষে নীল। শুধু মুসলমান হয়ে না জন্মাবার কারণে বারবার ভিটেশূন্য হচ্ছে হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ। কখনো ভোটের দোহাই দিয়ে, কখনো বাবরি মসজিদে হামলার দায়ে, কখনো বা স্রেফ ফেসবুকে কোন ছবিতে ট্যাগ হয়ে যাবার অপরাধে বাড়ি-ঘর, উপসানালয় হারিয়ে ফেলছে তারা, কখনো বা সাধের প্রাণটাও বিদায় নিচ্ছে শরীর থেকে।
পরিসংখ্যান বলছে ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে হিন্দু সম্প্রদায়ের অনুপাত। যারা ৪৭ এ চলে যায়নি শিকড়ের মায়ায় তারা হয়তো চলে গেছে পাকিস্তানে দ্বিতীয় সারির নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকার লজ্জা সইতে না পেরে। কেউ চলে গেছে একাত্তরে সব হারিয়ে। এরপর যারা থেকে গিয়েছিল তাদের তো চলে যাওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু স্বাধীনতার কয়েক বছরের মধ্যেই তারা বুঝে গেছে যে তারা সেই দ্বিতীয় সারির নাগরিকই রয়ে গেছে, বাংলাদেশ মুসলমানের দেশ এখানে তাদের মাথা উঁচু করে থাকা সম্ভব না; যারা একাত্তরের অত্যাচার সহ্য করে থেকে গিয়েছিল তারাও স্বাধীন দেশের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে; পিছনে পড়ে থাকছে পোড়া ঘর বাড়ি, পুকুর, গরু বাছুর ও পবিত্র তুলসি গাছ। সব ছেড়ে অন্য দেশে তারা হয়ে গেছে উদ্বাস্তু কিন্তু তাদের মনে হয়েছে এটাই ভাল। দ্বিতীয় সারির নাগরিক হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে কম কিসের?
অথচ আমরা দেশ স্বাধীন করেছিলাম একটা অসাম্প্রদায়িক স্বদেশ পাওয়ার আশায়। অনেকেই পেয়েছে স্বদেশ কিন্তু ওরা পায়নি। তারা একটা দেশ পেয়েছে যা তাদের নিজের নয়; আমরা বুঝিয়ে দিয়েছি এই বাংলা পাকিস্তানের এক নতুন সংস্করণ। এখানে তারাই বেঁচে থাকার যোগ্য যারা পূর্বজন্মের হাজারো পুণ্যিতে জন্ম লাভ করেছে মুসলমান পরিবারে যদিও এরা স্বীকার করেনা জন্মান্তর বাদ।
একাত্তরের ঠিক পর পরেই এদেশে বাঙ্গালিয়ানার প্রাত্যহিক জীবনে এবং সংবিধানে বেশ একটা উত্থান চোখে পড়ে । সাংবিধানিক ভাবে ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু ৭৫ এ বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর দেশটা সব দিক দিয়েই এলমেলো হয়ে যায়। স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র পাঠকারী মুক্তিযোদ্ধা বহু দলীয় গণতন্ত্রের নামে জামাত ইসলামকে বৈধতা দিয়ে দেন। এবং আমরা দেখতে থাকি সামরিক সরকার ও জামাত ইসলাম হাতে হাত ধরে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করতে থাকে। জামাত ইসলাম একাত্তরে যা করেছিল তাতে জনগণের কাছে পৌঁছানো তাদের দ্বারা সম্ভব ছিল না তাই তারা বেছে নেয় একটা চরম হাতিয়ার –ধর্ম এবং ধর্মের দোহায় দিয়ে তারা পৌঁছে যায় প্রতিটা গ্রামে। তারা দখল করে নেয় দেশের সব মসজিদ মাদ্রাসা এবং বাস্তবায়ন করতে থাকে তাদের পরিকল্পনা। শত শত বছর ধরে একসাথে বাস করা একই সংস্কৃতি লালন করা মানুষের মাঝে তারা সৃষ্টি করে সুক্ষ পার্থক্য। তারা হাজার হাজার মানুষকে বুঝাতে সক্ষম হয় এতোদিনে পালন করে আসা লোকাচার আসলে হিন্দুদের। মানুষ আবিষ্কার করে ঘরে ধুপ-সাঁঝ বাতি দেয়া, আলতা-টিপ পরা মুসলমানিত্বের খেলাপ।
কিন্তু জামাতের দ্বারা সংবিধানের কোনকিছু পরিবর্তন করা সম্ভব ছিল না যা সম্ভব ছিল সামরিক সরকারের পক্ষে। এবং এখানে এসে আমরা দেখতে পাই জামাত ও সামরিক সরকার উভয়েই একই সমস্যার সম্মুখীন এবং তা হচ্ছে জনগণের মাঝে গ্রহণ যোগ্যতার অভাব। এবং জামাতের মতই সামরিক সরকারও ধর্মকেই তার বর্ম হিসেবে ব্যাবহার করে। আমরা দেখতে পাই জামাত যেমন সুকৌশলে এদেশের সংস্কৃতির মুসলমানি দেয়া শুরু করেছে তেমনি সামরিক সরকার সাংবিধানিক ভাবে এদেশের মুসলমানি দেয়া শুরু করে। মুসলমানি দেয়ার প্রথম যাত্রা শুরু করেন স্বাধীনতার প্রেসিডেন্ট জিয়া। তিনি তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে দেখতে পান সংবিধান বড়ই নাস্তিক। সংবিধানের এই নাস্তিকতা তাকে ব্যাথিত করে; তিনি সংবিধানকে ধর্মীয় পরিচয় দিয়ে দেন। সংবিধান পেয়ে যায় তার পরিচয়, তার মাথায় জ্বলজ্বল করতে থাকে বিসমিল্লাহ এবং আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস। ’৪৭ এর দেশ ভাগের সময় যেমন মানুষ ঘুম থেকে উঠে দেখেছিল তারা যেখানে শুয়ে আছে তা তাদের দেশ না তেমনি সংবিধানের এই খৎনা দেয়ায় অন্য ধর্মাবলম্বিরা আবিষ্কার করে তাদের অস্তিত্বের সংকট। দেশের সংবিধান পড়তে হলে তাদের ধর্ম ভুলে গিয়ে তাদের আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা রেখে আল্লাহর নামে শুরু করতে হবে। স্বাধীনতার পর তারা সমাধিকারের যে স্বপ্ন বুনেছিল তা বালির বাঁধের মত ভেঙে যায়, তারা জেনে যায় এই দেশে তারা সংখ্যালঘু, সমাধিকার তো দূরের কথা বেঁচে থাকায় কঠিন হয়ে যাবে তাদের জন্য। দেশীয় প্রচার যন্ত্রে ইসলাম প্রচার হতে থাকে; এ যেন ইসলামের রেনেসাঁ। তিনি সফল ছিলেন তার লক্ষ্যে। লাখে লাখে মানুষ তাকে বাহবা দেয়; তিনি ইসলামের উপর প্রেম দেখিয়ে দলও বানিয়ে ফেলেন।
জিয়ার হাত ধরে এরশাদ এসে তার কাজকে আরও অনেক দূর এগিয়ে নেয়। সে দেখতে পায় সংবিধানে করার কিছুই নেই তাই সে দেশেরই খৎনা দিয়ে দেয়। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করে সে প্রকাশ করে ইসলামের উপর তার আস্থা। অন্যধর্মের মানুষ আবার বুঝতে পারে তারা এদেশে থাকার যোগ্য নয়। সে যে শুধু রাষ্ট্রের পরিচয় বদলে দেয় তাই নয়, মানুষের মাঝে খুব ছোট বেলা থেকে ধর্মীয় বিভাজন দাঁড় করিয়ে দেয় পাঠ্যপুস্তকে ধর্মশিক্ষা চালু করে। মুসলমান ছাত্ররা ইসলাম শিক্ষা পড়বে; অন্যেরা তাদের নিজ নিজ ধর্ম পড়বে। ব্যাপারটা শুনতে ভাল লাগলেও এর ফল ভয়াবহ। একই সাথে খেলা করা ছেলেমেয়ে কিছু বুঝার আগেই বুঝে যায় তারা এক না। তারা ভিন্ন গোত্রের মানুষ। এবং কিছুদিন যেতে না যেতেই হিন্দু শব্দটিই গালি হিসেবে ব্যাবহৃত হতে শুরু করে। ধর্ম কি বুঝাত আগেই এই সমস্ত ছেলেমেয়ে তাদের বন্ধুদের ধর্মের ভিত্তিতে আলাদা করে ঘৃণা করতে শুরু করে দেয়। জামাত ইসলামের উত্থান ও সামরিক সরকারের ধর্মীয় পৃষ্ঠপোশকতায় বেড়ে ওঠা ঘৃণা আগুনে রূপ নিতে খুব বেশি সময় লাগে না। আর তাই নব্বইয়ের অক্টোবরে বাংলাদেশের আকাশ বাতাশ প্রকম্পিত হয় ‘একটা দুইটা হিন্দু ধর, ধরে ধরে জবাই কর’ বাক্যে। গুড়িয়ে যায় ঢাকেশ্বরী মন্দির, শিব মন্দির, জয়কালী মন্দির। দেবালয় যখন গুঁড়িয়ে যায় তখন দেবতার সেবকের বাড়িঘর অক্ষত থাকে কি করে? তাই জ্বলে যায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘর বাড়ি, ব্যবস্যা প্রতিষ্ঠান সব কিছুই। দাঙ্গার নতুন সংজ্ঞা দাঁড়িয়ে গেল দেশে। তখন থেকে একপক্ষের উপর অন্য পক্ষের চরম অত্যাচারকে দাঙ্গা বলা হতে লাগল।
এরশাদের পতনের পর গণতন্ত্র ফিরে আসে কিন্তু হিন্দু সম্প্রদায়ের অধিকার ফিরে আসে না। কি সংবিধান কি দেশ, সবই মুসলমানই থেকে যায়। গণতন্ত্র আসার বছর খানেকপর আবার নেমে আসে তাদের উপর আল্লাহর বান্দাদের দেয়া গজব। কোনদিন অযোধ্যায় দূরে থাক ভারতে না যাওয়া মানুষ আবিষ্কার করে অযোধ্যার বাবরি মসজিদের ভেঙ্গে পড়ার সাথে সাথে তাদের বাড়িঘর, মন্দির, দেবতা লুটিয়ে পড়ছে মাটিতে। তাদের দোকান লুট হয়ে যাচ্ছে, লুট হয়ে যাচ্ছে তাদের যুবতি মেয়েরা। তারা অসহায়ের মত শুধু দেখছে তাদের উপর নেমে আসা অত্যাচার। এই গণতন্ত্রের যুগে এসে তারা আবিষ্কার করে নতুন এক বিপদ। তাদের একটা দলের নাম ট্যাগ হয়ে যাওয়ার বিপদ। তারা দেখতে পায় নির্বাচন আসলেই তাদের জ্বালা বাড়ে। একদল ধরে নেয় তারা তাদের ভোট দেবেই আর একদল ভাবে কোনদিনই তারা তাদের কে ভোট দেবে না। তাই, নির্বাচন আসলে ভোট কেন্দ্রে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে শুরু হয় তাদের সঙ্কট। এ যেন শাখের করাত। গেলেও বিপদ না গেলেও বিপদ। আর তাই সাধের গণতন্ত্রের কারণে ২০০১ একে তারা বাধ্য হয় গণতন্ত্রের ফল ভোগ করতে। জামাত ইসলামের খিলজিরা তাদের বড় ভাইদের সাথে নিয়ে মেতে ওঠে ধ্বংস যজ্ঞে। ১৫ বছরের পূর্নিমার সাথে বাংলাদেশ আবার গণধর্ষিত হয়।
ডিজিটাল বাংলাও সংখ্যালঘু অত্যাচারে বেশ সরেস। এখানে কখনো কারো নামে ছবি ট্যাগ করে কিংবা চাঁদে রাজাকারের ছবি বসিয়ে ধর্মানুভুতিকে উত্থিত করে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে সংখ্যালঘু শেষ করা হয়। আমরা দেখতে পাচ্ছি, অনবরত ঘটে চলেছে এই অত্যাচার। কিন্তু কখনোই কোনদিন ধর্মীয় উন্মাদনায় উত্তেজিত হয়ে করা কোন অপরাধের শাস্তি হয়নি। একটা রাষ্ট্রে যখন বারবার একই অপরাধ সংঘটিত হয় এবং রাষ্ট্রযন্ত্র নীরবে মেনে নেয়, তাকে রাষ্ট্রীয় অপরাধ ছাড়া আর কিছুই মনে করা যায়না। আর রাষ্ট্র কর্তৃক চলা অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে , এদেশের হাজারো মানুষ রাষ্ট্রের উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে পাড়ি দিচ্ছে অজানার উদ্দেশ্যে। তাদের কষ্ট হয়, লজ্জা লাগে কিন্তু কিছুই করার থাকেনা, চলে যাওয়া ছাড়া।
জাহিদ হায়দার
মন্তব্য
লেখাটা পড়ে একধরনের আত্মগ্লানি বোধ করছি। মনে হচ্ছে এই একবিংশ শতাব্দী তে এসেও আমরা কি অসহায়! যেসব মানুষ ধর্মের এই বলিদানের অংশ হতে চান না তাদেরকেও এই অপবাদ আর গ্লানি নিয়ে থাকতে হয়। লজ্জায় কষ্টে ঘৃনায় দগ্ধ হতে হয়। আত্মদহনে পুড়ে মরতে হয়।
গবেষক
এটা সত্যি খুবই গ্লানিকর। এতদিন ধরে এতো অত্যাচার হয়ে আসছে কিন্তু তাঁর প্রতিবাদ তেমন জোরালো হয়নি। আবার দেখুন বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে বিতর্কিত বই দুটো লেখা হয়েছে এই সাম্প্রদায়িকতাকে ভিত্তি করেই। তসলিমা নাসরিনের 'লজ্জা' এবং হুমায়ুন আজাদের 'পাকসার জমিন সাদ বাদ' কিন্তু বাহবা পায়নি বরং বই দুটো লিখে প্রতিবাদের মুখে একজন দেশান্তরি হতে বাধ্য হয়েছে আর আরেকজন তো ভয়ংকর শারীরিক নির্যাতনের শিকার। এতে প্রমাণ হয় আমরা খুব করে চাই, এই অপরাধ চলতে থাকুক। ভোট হারাবার ভয়ে তাই সরকার কোনদিন বিচার করেনি। যেদিন সবাই শাহবাগের আন্দোলনের মত জোড় হতে পারবে সেইদিন হয়তো সরকার এই বিচার করতে বাধ্য হবে। সেই দিনের অপেক্ষায়।
জাহিদ হায়দার
এবং সে ভাইরাস আজ এই দুই গোষ্ঠীর বাইরেও বিশাল এক জনগোষ্ঠীকে সংক্রামিত করে চলেছে
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
এমনকি আমি এটাও জানতাম না যে 'কেউ বলে ফাল্গুন, কেউ বলে পলাশের মাস' এই গানটাও জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায় এর। এত দারুন কথা আর এত দারুন সুর। অসম্ভব সুন্দর একটা গান। এত ভালো লাগে আমার। তাকে আসলেই আমরা উপযুক্ত সম্মান দেখাতে পারিনি।তার গান 'বধুয়া আমার চোখে জল' এটা গেয়ে শ্রীকান্ত আচার্য বিখ্যাত হয়ে গেলেন। অথচ জটিলেশ্বর এর নাম শুনেন নি এরকমটাও হয়েছে এবং হচ্ছে । স্বীকার করতে লজ্জা নেই আমি নিজেও তার নাম জেনেছি খুব বেশি দিন হয়নি। এতটাই জনপ্রিয়তা বিমুখ একজন মানুষ আজকের যুগে খুব দুর্লভ।
গবেষক
জামায়াতে ইসলামি বড়ই বাঞ্চত।
ইউক্লিড
নতুন মন্তব্য করুন