সাম্প্রদায়িকতা, নাকি শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিহিংসা?

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ১১/০১/২০১৪ - ৪:১৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মাহফুজ খান
ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার সাথে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে খুব ছোটবেলা, প্রাইমারী স্কুলে। ৫/৬ বছর বয়সেই শিখে যাই কোন পিঁপড়া হিন্দুদেরকে কাটে আর কোনটা মুসলমানদের। এরপর থেকে কালো পিঁপড়া মারতাম না কিন্তু লাল পিঁপড়া দেখলেই প্রবল বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়তাম, কারণ ওটা কামড়ায় আর ওটা হিন্দু পিঁপড়া।

আমি তখন তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ি। আমাদের বাড়িতে একজন স্বর্ণকার আসতেন, আমরা উনাকে অমল বাবু নামে জানতাম। অমল বাবুকে কখনও অন্য ধর্মের মানুষ মনে হতো না। উনি আমাদের বাড়িতে চা, পানি, নাস্তা সবি গ্রহণ করতেন। একবার এক বিশেষ কারণে আমি, আমার মা আর দাদির সাথে উনাদের বাড়িতে যাই। আমাদেরকে চা বিস্কুট দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। সবাই বিস্কুট খেলেও আমার দাদি চা মুখেও তুললেন না। ফেরার পথে জিজ্ঞাসা করতেই উনি জবাব দিলেন যে তার ঘেন্না লাগছিল হিন্দু বাড়ির চা খেতে। আমারা মাকেও দেখলাম তাতে সায় দিতে, যদিও চক্ষুলজ্জার কারণে উনি সেই চা পান করেছিলেন।

আমাদের গ্রামে প্রতি বছর বৈশাখ মাস জুড়ে মেলা হয়। বাড়ির পাশেই সেই মেলায় যাওয়ার রাস্তা আর রাস্তার পাশেই আমাদের মসজিদ। আমি তখন ষষ্ঠ/সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি। মসজিদখানা নতুন, নিয়মিত সেখানে নামাজ পড়ি। তখন মসজিদের কাজের জন্য বৈশাখী মেলার সময় রাস্তার পাশে বসে সাহায্য উঠানো হতো। ছুটির দিনগুলোতে আমিও মাইকে বসে মসজিদের কাজের জন্য সাহায্য চাইতাম। মাঝে মাঝেই দেখেছি কিছু হিন্দু মানুষ মেলায় যাওয়ার বা ফেরার পথে দুই-চার টাকা ফেলে যেত সাহায্য হিসেবে। আমাদের ইমাম সাহেব সেই টাকাগুলোকে টেবিলের উপর তুলতে দিতেন না। সেটা আমরা আলাদা করে রাখতাম, আর দিন শেষে সেই টাকা দিয়ে বাদাম কিনে খেতাম। বিধর্মীদের টাকা নাকি আল্লার ঘরের কাজে লাগানো উচিৎ না!

ততদিনে হিন্দুরা যে মালাউন সেটা জেনে গেছি। খেলার মাঠে তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে আমার মুসলমান বন্ধুটি হিন্দু বন্ধুটিকে বলেছিল- মালাউনের বাচ্চা তুই চুপ থাক। কিন্তু মালাউন শব্দের অর্থ কি, সেটা আজো বোধগম্য নয়। যাইহোক মালাউন ছাড়াও যে হিন্দুদের আরও নাম আছে সেটা জেনেছিলাম বছর খানেক পর, অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময়। আমি অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় চট্টগ্রাম আমার বড় চাচার কাছে থাকতাম। আমাদের পাশের বাসায় এক হিন্দু পরিবার ছিল, সবাই দেখতাম আড়ালে তাদের ডান্ডি বলতো। কেন বলত, ডান্ডি নামের উৎস কি আজো জানিনা, জানার আর আগ্রহও নেই।

তখন কলেজে পড়ি, গ্রাম থেকে দুরে জেলা সদরে কলেজ হোস্টেলে থাকি। মাঝে মাঝে যখন ছুটি ছাটায় বাড়িতে যেতাম তখন বন্ধুরা মিলে অনেক মজা করতাম। সবচেয়ে মজার ছিল রাতের বেলা সবাই মিলে ডাব চুরি করে খাওয়া। কার গাছের ডাব খাওয়া যায়, এমন প্রস্তাবে সবার প্রথমেই আসত ঠাকুর বাড়ির নাম। কেন আসত সেটা তখন ঠিকমত না বুঝলেও এখন বুঝি। কারণ সেখানে ডাব খেতে গিয়ে ধরা খেলেও খুব একটা সমস্যা হবে না। হিন্দু মানুষ, বড়জোর দুই চারটা বকা-ঝকা দিয়ে ছেড়ে দিবে। ডাব যে শুধু হিন্দু বাড়ির খেয়েছি এমন নয়, বরং হিন্দু মুসলিম উভয়ের গাছের ডাবই সমান সুস্বাদু ছিল। কিন্তু অবাক হতাম, যখন দেখতাম কোনও মুসলমান বাড়ির ডাব চুরির সময় আমার বন্ধু জগদীশ কোনও না কোনও অজুহাতে সটকে পড়ত। কেন পড়ত সেটা ব্যাখ্যা করার প্রয়োজনীয়তা আছে বলে মনে করি না।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় একবার আমার এক হিন্দু বন্ধুর সাথে নীলক্ষেত খেতে গিয়েছিলাম। আমি গরুর তেহারি অর্ডার করলাম আর বন্ধুটি ইলিশ মাছ ভাত। আমার খাওয়া শেষ, হাত না ধুয়ে ওর খাওয়া শেষ হওয়ার অপেক্ষায় আছি। হঠাৎ ইলিশ মাছের লোভ সামলাতে না পেরে, কোনও রকম চিন্তা ভাবনা ছাড়াই ওর পাতে হাত দিয়ে এক টুকরো মাছ ভেঙ্গে নিয়ে নিজের মুখে তুলে দিই। সাথে সাথে আমার বন্ধুটি আমাকে হতভম্ব করে দিয়ে খাওয়া বন্ধ করে হাত ধুয়ে ফেলে। ওর মুখে বিরক্তিটা স্পষ্ট। ততক্ষণে আমি আমার ভুল বুঝতে পেরে বিব্রতভাবে দুঃখ প্রকাশ করে বন্ধুটির কাছে ক্ষমা চাইলাম। সে বোধহয় আমার অনিচ্ছাকৃত ভুলটা বুঝতে পেরেছিল, যাইহোক এটা নিয়ে আমরা আর কখনও কথা বলিনি।

হতে পারে, উপরের প্রতিটি ঘটনাই শুধু মাত্র আমার জীবনে ঘটে যাওয়া বিচ্ছিন্ন ঘটনা। অথবা আমরা সবাই শৈশব, কৈশোরে এমন ঘটনার মধ্য দিয়েই বড় হয়েছি। যাই হোক, উপরের প্রতিটি ঘটনাই আমার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে যে হিন্দুরা আলাদা মানুষ, ওরা দুর্বল, ওরা তুচ্ছ। আমি ঠিক জানিনা, তবে অনুমান করতে পারি যে একজন হিন্দু শিশুও আমাদের প্রতি বিরূপ মনোভাব নিয়েই বেড়ে উঠে। এই যে মানুষে মানুষে ধর্মীয় সংস্কৃতি ভিত্তিক ভেদাভেদ সেটা প্রাগৈতিহাসিক। আজ যখন কথায় কথায় হিন্দুদের, বৌদ্ধদের নির্যাতন করা হয় তখন আমরা এটাকে শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বলে আমাদের সেই প্রাগৈতিহাসিক সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তিকে আড়াল করতে চাই। ফেসবুকের এক মিথ্যা, তুচ্ছ ঘটনার উপর ভিত্তি করে রামুতে যখন আওয়ামীলীগ, বিএনপি, জামাত সব মুসলমান মিলেমিশে একাকার হয়ে হাজার বছরের পুরনো বৌদ্ধ মন্দির পুড়ায়, তখনও আমরা বলি ওরা ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার শিকার নয়, বরং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার। ঠিক কবে, আরও কত শতাব্দী পেরুলে, আরও কত শিক্ষিত হলে আমরা কোনও সমস্যার শুধু ডালপালা না ছিঁড়ে বরং গোঁড়াটাকে চিহ্নিত করে সেটা কেটে দিতে পারব। আমার মতে, রাজনীতি এখানে শুধুমাত্র প্রভাবক হিসেবে কাজ করে, কিন্তু প্রতিটি ঘটনার গোড়াতেই থাকে সেই প্রাগৈতিহাসিক ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা। ঠিক যেমন আলোর স্পর্শে কিছু কিছু রাসায়নিক বিক্রিয়া আপনি আপনি ঘটে।


মন্তব্য

নরাধম এর ছবি

খুবই বাস্তবধর্মী লেখা। চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

স্বীকার করতে আমাদের লজ্জা বা দ্বিধা হয়, কিন্তু সত্যটা হচ্ছে এই যে, আমাদের সামাজিক শিক্ষার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বীজ খুব ভালোভাবে পোঁতা আছে। জীবনের আর দশটা পাঠের মতো সাম্প্রদায়িকতা, নারীকে হেয় করা, দরিদ্র বা অশিক্ষিত বা শ্রমজীবি মানুষকে তাচ্ছিল্য করার শিক্ষা আমরা খুব ছোটবেলা থেকে পেয়ে যাই। সাম্প্রদায়িকতার শিক্ষাসম্বলিত অসংখ্য প্রচলিত ছড়া ও নিক্‌ আছে যেগুলো শুধু অশ্লীলই না চরম অরুচিকর। এগুলো কোন পাঠ্য বা অপাঠ্য পুস্তকে লেখা থাকে না। কিন্তু কেমন করে যেন এগুলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সুচারুভাবে চলে আসে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অতিথি লেখক এর ছবি

আফসোস হয়, যখন দেখি এক দল মানুষ এই ব্যাপারগুলোকে অত্যন্ত সুচতুরতার সাথে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে।

অতিথি লেখক এর ছবি

সহজ সত্যগুলি সহজভাবে বলেছেন। বেশিরভাগ পরিবারেই ব্যপারটা এরকম, কিন্তু এটা কেউ কখনো বলবেনা। খুবই হিপোক্রিট জাতি আমরা।

ওয়াইফাই ক্যানসার

অতিথি লেখক এর ছবি

আমাদেরকে ছোট বেলা থেকেই কিছু সাম্প্রদায়িক শিক্ষা দিয়ে দেয়া হয় আমাদের মনের অগোচরে সেগুলোকে আমরা লালন করি অনেক বছর ধরে। আমি জানি না ভারতে হিন্দুদের কিংবা অন্য ধর্মের ক্ষেত্রেও সেই একি রকম ভাবে সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়িয়ে দেয়া হয় নাকি? তাছাড়া আমার মনে হয় শ্রেনীভিত্তিক একটা দুর্বলতা চোখে পড়ার মত। যত বার দেখা যায় হিন্দু দের উপর আক্রমন হচ্ছে ততবার সেটা গরিব হিন্দুদের উপর এ বেশি হয়। পাকিস্তান বা পুর্ববর্তি আমলে যেটা অবস্থাপন্ন হিন্দুদের উপর দেখা যেত। যেটার মূল কারন ছিল সম্পদের অধিগ্রহন । এখন গরিব হিন্দুদের সম্পত্তি দখলের হীন মানসিকতা অথবা শুধুমাত্র গরিব তার উপর হিন্দু মারলে কোন ক্ষতি নেই , প্রতিবাদ করার কেউ নাই এই জঘন্য ব্যাপারটিও কাজ করে। কারন এরকম খুব একটা পাওয়া যাবে না যে ধনী অবস্থাপন্ন প্রতিষ্ঠিত হিন্দুদের উপর এরকম হামলা হয়েছে। তবে এটা সত্য হিন্দুদের উপর হামলা করার কারন শুধুমাত্র ধর্ম ভিত্তিক নয়।
গবেষক

মন মাঝি এর ছবি

এটাকে শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বলে আমাদের সেই প্রাগৈতিহাসিক সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তিকে আড়াল করতে চাই।

এটা প্রাগৈতিহাসিক ঠিকই, তবে "শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিহিংসা" বললে যেমন ভুল হবে, তেমনি শুধুমাত্র "সাম্প্রদায়িক (ধর্মীয় অর্থে) মনোবৃত্তি" বললেও মনে হয় ভুল হবে। আমার মনে হয় এই "সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তি"-র মূলে রয়েছে অজানা-অচেনার প্রতি মানুষের মর্মমূলে প্রোথিত এক প্রাগৈতিহাসিক, প্রাক-সভ্যতা, এমনকি হয়তো প্রাক-মানবিক ভীতি। Fear of unknown । এই ফিয়ার অফ আন্‌নোনের অনেক চেহারা - তার মধ্যে একটা চেহারা সাম্প্রদায়িকতা। এর আরও অনেক রূপ আছে অবশ্য।

আমার ধারণা প্রাগৈতিহাসিক কালে মানুষ তার অনগ্রসর জ্ঞানের কারনে নানা ভাবেই ভীষণ দুর্বল ছিল। অন্ধকারকে সে ভীষণ ভয় পেত (এখনও পায়!)। অন্ধকারের গর্ভে ওৎ পেতে থাকা অজানাকে ভয় পেত। তা সে শিকারী হিংস্র প্রাণী হোক, শত্রু গোষ্ঠীর মানুষ হোক, বা অন্যকিছু। অন্ধকারে ওৎ পেতে থাকা সম্ভাব্য কিন্তু অজানা ভীতিকর বস্তুর ভয় থেকেই আমার ধারণা ভূত-প্রেতের জন্ম। অজানা বাস্তব থেকে অবাস্তবের। ঝড়-ঝঞ্ঝা-বজ্র-বিদ্যুৎ-ভূমিকম্প-দাবানল-হিংস্র প্রাণী সহ বহু ক্ষতিকর জিনিষকেই সে ভয় পেত, কারন এগুলি থেকে সবসময় আত্নরক্ষার উপায় বা এর কারন সম্পর্কে তার কোন জ্ঞান ছিল না। তাই এইসব জিনিষ যে ভয়ের জিনিষ, ভয়ঙ্কর বা ক্ষতিকর জিনিষ, পরবর্তীকালে তার প্রথম দিককার ধর্মগুলিতে সে তা নিজের সীমিত জ্ঞানবুদ্ধি অনুযায়ী নিজের মত করে ব্যাখ্যা করেছে এগুলেকে রুদ্র দেবতা বা ভয়ঙ্কর দানব হিসেবে চিত্রিত করে। আবারও অজানা বাস্তব থেকে অবাস্তবের জন্ম। প্রায় একই ধরণের ভয় ছিল ভিন্‌ গোত্রের বা জাতের মানুষ সম্পর্কেও। এদের সাথে বোধহয় তার নানারকম স্বার্থের সংঘাত দেখা দিত - টেরিটোরি, শিকার, বিভিন্ন ধরণের প্রাকৃতিক ও মানবিক রিসোর্স নিয়ে দ্বন্দ্ব বা দ্বন্দ্বের সম্ভাবনা থাকত। কিন্তু পরস্পরের উদ্দেশ্য বা অভিপ্রায় সম্পর্কে জানাশোনার মনে হয় ভাল সুযোগ বা সক্ষমতা ছিল না। এমনকি পারস্পরিক সমরূপতা সম্পর্কেও মনে হয় উপলব্ধির অভাব ছিল। ফলে ছিল না দ্বন্দ্ব নিরসনের সক্ষমতা। এর একমাত্র ফল - পারস্পরিক ডেমোনাইজেশন। আবারও অজানা বাস্তব থেকে অবাস্তবের জন্ম। তবে এই শেষ ক্ষেত্রে শক্তির নৈকট্যের কারনে সহিংসতার সুযোগ সৃষ্টি হল।

এই অজানাকে-ভীতিই মনে হয় সাম্প্রদায়িকতার মূল, বা অন্যতম মূল উৎস। ধর্ম কেবল এই জানা-অজানার সীমানাটা ধর্মকে কেন্দ্র করে পূনর্নির্ধারণ করেছে। সুতরাং, সাম্প্রদায়িকতার বিষ দূর করতে হলে গোড়া থেকে এই অজানাকে-ভীতিটাই দূর করতে হবে এবং আরও গুরুত্বপূর্ণ হল অজানাকে-ভীতি দূর করার প্রক্রিয়াটাকেই মানসিকভাবে আত্নস্থ করে ফেলতে হবে।

এখন এই অজানাকে-ভীতির সাথে যখন herd-mentality এবং herd-behaviour (বাংলা জানি না, ব্যাখ্যার জন্য উইকিলিঙ্ক দুটি দ্রষ্টব্য - দুটোই দেখে নিলে ভাল হয়) যুক্ত হয় তখন সেটা 'সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তি'-র রূপ নেয় পুরোপুরি। বিভিন্ন সময় ব্যাপক সহিংসতারও জন্ম দেয়। তবে সুসংগঠিত, দীর্ঘস্থায়ী সাম্প্রদায়িক বিবাদ বা অনেকসময় স্বল্পস্থায়ী পরিকল্পিত সহিংসতারও সৃষ্টি হয় বোধহয়, যখন অজানাকে-ভীতি আর herd-mentality-র সাথে স্বার্থের সঙ্ঘাত বা কোন বিশেষ শ্রেণীর স্বার্থান্বেষিতা / ক্ষমতালিপ্সা যুক্ত হয়ে সেটাকে সহিংসতার পথে ঠেলে দিয়ে নিজের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে চায়। যেমন এখন বাংলাদেশে হচ্ছে। এই স্বার্থান্বেষীতাকেই আমরা 'রাজনৈতিক' বলছি এখন। তবে এই 'রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িক সহিংসতা'-ই সাম্প্রদায়িক সহিংসতার একমাত্র রূপ না।

আমার তাই মনে হয়, শুধুমাত্র আইন-কানুন করে বা তার কঠোরতম প্রয়োগ করেও এই সমস্যার দীর্ঘস্থায়ী বা দীর্ঘমেয়াদী সমাধান করা যাবে না। তাৎক্ষণিক সমাধান হয়তো হবে, এবং সেটাও অপরিহার্য, কিন্তু শুধু এভাবে সমাধান করার চেষ্টা করলে সহিংসতা তাৎক্ষণিক ভাবে স্তিমিত বা নিবারিত হলেও সমাজের ভিতরে ভিতরে থেকেই যাবে তুষের আগুনের মত। এবং বারবারই মাথাচাড়া দিয়ে আত্নপ্রকাশ করবে। সেজন্যে, অর্থাৎ দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের জন্য দরকার এর পিছনে অজানাকে-ভীতি আর herd-behaviour-এর মত raw বা মৌলিক কারনগুলির মোকাবেলা করা। সেটা কিভাবে করা যাবে? আমার মতে এজন্যে দরকার শিশু বয়স থেকেই একটা গুনগতভাবে উচ্চমানের মানবীকৃত, বহুসাংস্কৃতিক, বহুত্ববাদী, বিশ্বমুখী, গণতান্ত্রিক, এবং স্বাধীণ ও যুক্তিশীল চিন্তায় সক্ষমতা নির্মানে সহায়তাকারী শিক্ষাক্রম ও পদ্ধতির পরিপূর্ণ প্রসার। যে শিক্ষা শিক্ষার্থীদের মন, মনন ও আবেগের গভীরে মানবিকতা ও বাস্তবতা সম্পর্কে একটা জোরালো শেয়ার্‌ড বোধের জন্ম দিবে। জন্ম দিবে একটা শেয়ার্‌ড যুক্তিবোধের। যে শিক্ষা শুধু তার বৌদ্ধিক স্তরেই নয়, আবেগে বা অবচেতনেও প্রবেশ করবে। শুধু বৈষয়িক বা বেসিক 'স্কিল' ওরিয়েন্টেড শিক্ষা হলে চলবে না।

অসম্ভব, অবাস্তব, আকাশকুসুম কল্পনা মনে হচ্ছে। কিন্তু আর কোন বিকল্পও মাথায় আসছে না। শুধু সাম্প্রদায়িক সহিংসতাই তো নয়, আরও বহুধরণের সহিংসতা আর চরম অসহনশীলতায় ছেয়ে গেছে সবকিছু - মানুষ, রাজনীতি, দেশ। অন্তহীণ ভাবে কেবল বাড়তেই থাকবে মনে হচ্ছে!
---------------------------------------------------------------------------

বারো হাত কাঁকুড়ের তের হাত বিচির মত, মূল পোস্টের চেয়েও বড় মন্তব্য দিয়ে ফেললাম মনে হয়। আশা করি কেউ মাইন্ড খাবেন না! হাসি

****************************************

অনিকেত এর ছবি

মন-মাঝি-র বক্তব্যের সাথে একমত---

অনিকেত এর ছবি

অনেকগুলো স্ন্যাপশটের মত দৃশ্যাবলী চোখের সামনে দিয়ে গেল--
এইসব দৃশ্যাবলী অধিকাংশই চেনা--কিছু দৃশ্যে দর্শকের ভূমিকায় আমি নিজেও ছিলাম--অসহায় নিস্পৃহতায় দেখেছি আমার হিন্দু বন্ধুর চোখের ত্রাস--আমার হাজার স্তোকবাক্যেও সে ভয় দূর হয় নি---

মাহফুজ বস, তোমার লেখাটা আমাদের সামাজিক সমস্যার মর্মমূলে থাকা একটা বিষয় নিয়ে আলোকপাত করেছে---সমস্যাটার যে অবধারিত সমাধান আমাদের জানা--সেই সমাধানে যাবার পথ বোধকরি আমাদের কারোরি জানা নেই----

অনেক ধন্যবাদ লেখাটার জন্য--
শুভেচ্ছা নিরন্তর--

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক

আমাদের পরিবারি আমাদেরকে সাম্প্রদায়িক চিন্তা লালন করতে শিখায়। কম বেশী সব মসুলমান পরিবারে শিশুরা হিন্দুদের ঘৃণা করতে শিখার মধ্য দিয়ে বড় হয়। তাই সবার আগে পারিবারিক দৃষ্টিভঙ্গিটা পরিবর্তন দরকার, আর এই পরিবর্তন খুব সহসা আসবে না। মন খারাপ

মাসুদ সজীব

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

আর সকল কিছুর মত অসাম্প্রদায়িকতার শুরুটাও কি পরিবারে হতে পারে না? আমার পাড়াতে, আমি যেখানে বেড়ে উঠেছি, সেখানে সাম্প্রদায়িকতার কোন বিষবাষ্প দেখেছি বলে মনে পড়ে না। বড় হয়ে তাই অন‌্যদের অনেক সাম্প্রদায়িক চিন্তাভাবনা আমাকে হতবিহবল করে দিত! একবার এক গ্রামে বেড়াতে গিয়ে সেখানের এক ছেলের কাছে পিঁপড়ার হিন্দুত্ব, মুসলমানিত্বের তত্ব শুনে আমরা হাসতে হাসতেই শেষ হয়ে গেছিলাম। পরে অনেকদিন ওটা ছিল আমাদের হাস্যরসের বড় উৎস! কিন্তু ওটা আসলে অনেক জায়গারই নির্মম বাস্তবতা!

ছোট পরিসরে হলেও আমরা যে যেখানে আছি সেখান থেকেই পরবর্তী প্রজন্মকে অসাম্প্রদায়িক হয়ে বেড়ে উঠতে শেখাই না !

____________________________

অতিথি লেখক এর ছবি

এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বরং মানুষ হিসেবে আমাদের হীনমন্যতার পরিচায়ক ঘটনাবলি।
যতটুকু জানি দুনিয়ার প্রতিটি ধর্মই মানুষে মানুষে বিভেদ অপছন্দ করে। আর ইসলাম ধর্ম সর্বদাই অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার নির্দেশ দিয়েছে। এরপরেও মুসলিমদের এমন বৈষম্যমূলক আচরণের পেছনের কারণ হতে পারে, মুসলিমদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হবার প্রতি অনীহা। পরিশেষে বলব, মানুষে মানুষে এই হানাহানি সত্যিই হতাশাজনক।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

সমস্যাগুলোর শুরু পরিবার থেকেই বলে বুঝি। কিন্তু পারিবারিক কুইনিনের মহামারী সারাবে- কে? কবে? কিভাবে? উত্তর জানিনা বলে কখনও কখনও বড্ড হতাশ হতে ইচ্ছে করে। খালি হাতে স্বপ্ন মোড়ানো আশা দিয়ে কি হবে? মন খারাপ

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

মন মাঝি এর ছবি

কিন্তু পারিবারিক কুইনিনের মহামারী সারাবে- কে? কবে? কিভাবে?

একদম খাঁটি কথা। পরিবারেই অসাম্প্রদায়িকতা আর মানবিকতার শিক্ষা শুরু হওয়া দরকার। এই শিক্ষাই সবচেয়ে স্থায়ী হয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে - 'পরিবারকে' শিখাবে কে? কুইনিন জ্বর সারাইবে বটে, কিন্তু কুইনিন হইতে ভেজাল সারাইবে কে? ভেজাল কুইনিনে তো সন্তানের সাম্প্রদায়িকতা নামক জ্বর সারিবে না!

আসলে এই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র ভূমিকা রাখার কোন বিকল্প নাই। সাম্প্রদায়িকতা, অসহনশীলতা, বৈষম্যমূলক আচরণ ইত্যাদি সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা, রাষ্ট্রিক, পাব্লিক, প্রাইভেট - সবধরণের প্রতিষ্ঠানে নিষিদ্ধ, নিরুৎসাহিত, ডিস্‌ইন্সেন্টিভাইজ, দমন ও লজ্জার বিষয় করে তুলতে হবে। বাইরের দুনিয়াতে সাম্প্রদায়িকতা কঠিন শাস্তি ও শরমের বিষয় হয়ে গেলে কেবল তখনই 'পরিবার' সেটা শিখবে। নচেৎ হাজার নীতিকথার খুৎবা শুনিয়েও পরিবারের ভিতরে তার নিজস্ব প্রাইভেসিতে কি ঘটে সেটা জানা বা বন্ধ করা যাবে না। উপরন্তু এর সাথে যোগ করতে হবে শিক্ষাব্যবস্থার মানবীকিকরণ ও অসাম্প্রদায়িকিকরণ - উপ্রে যেমন বলেছি।

এটা হল 'কিভাবে' করা যেতে পারে তার উত্তর। কিন্তু কে করবে, কবে করবে - এসবের উত্তর আনফর্চুনেটলি আপনার মত আমিও জানি না। এটা অনেকটা ডিম আগে না মুরগী আগের মত হয়ে যাচ্ছে। শেষমেশ সবকিছুই মনে হয় রাজনীতিতে এসে ঠেকে।

****************************************

তানিম এহসান এর ছবি

উত্তর কিন্তু জানা, একটু খুঁজে দেখুন, চিন্তা করুন, উত্তর আমাদের জানা। কিন্তু উত্তরগুলো বাস্তবে প্রয়োগ হতে দেখি না বলেই হতাশ হতে ইচ্ছে করে। ব্যাপার না, হতাশ হওয়ার ইচ্ছা-ও হতে নেই।

তানিম এহসান এর ছবি

দুর্বলের উপর কথা, ভাষা কিংবা শারীরিক শক্তি দিয়ে নিজেকে সবল প্রমাণের চেষ্টা করাটা মানুষের জন্মগত অপরাধ। সাধারণভাবে, হীনমন্যতায় ভোগা মানুষগুলো’র ভেতর আমি সাম্প্রদায়িকতা সবচাইতে বেশি দেখেছি। সামাজিক-সাংস্কৃতিক মনস্তত্ব বুঝি না, বোঝা যায়-ও না কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার চর্চা এতটাই গভীরে অকারণে প্রোথিত যে বাংলাদেশে’র বহু মানুষ ভারত’কে দুই চক্ষে দেখতে পারে না কিন্তু হিন্দি মুভি’র পাইরেটেড কপি না দেখলে তার ঘুম আসে না, পোশাক হতে হয় শাহরুখ খান কিংবা ক্যাটরিনা’র মত, হিন্দি গান ছাড়া তার ঘুম ভাঙে না। বাঙালী’র ভণ্ডামি তার আরও সব জাগ্রত স্বত্বাকে ছাড়িয়ে যায় বহুদূর। যেই কারণে কেউ কেবলমাত্র একটা লুঙ্গি গায়ে জড়িয়ে, আবার কেউ কাফনের সাদা কাপড় পড়ে-ও এখানে বুদ্ধিজীবী হতে পারে কিন্তু তাদের’কে বেশ্যা বলে গালি দিলে চারিদিকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষতার কান্নাকাটি শুরু হয়ে যায়।

অতিথি লেখক এর ছবি

জন্ম থেকে কেউ ই সাম্প্রদায়িক মন নিয়ে জন্মায় না, পরিবেশ-পরিস্থিতি-সমাজ আমাদের কে শেখায় সাম্প্রদায়িক হতে। যতদিন না আমরা আমাদের সমাজ এবং নিজেদের মন-মানসিকতার পরিবর্তন না আনতে পারব ততদিন এই বিষফোঁড়া আমাদের বয়ে বেড়াতে হবে। লেখা ভালো লেগেছে ...

শব্দচোর

আয়নামতি এর ছবি

পারিবারিকভাবে এসবের চর্চা একদমই ছিল না। প্রথম মালাউন শব্দটা শুনি স্কুলের টিচারের মুখে!
তবে দেশে থাকতে এইসব অশ্লীল শব্দ যতবার শুনেছি, তারচে অনেক বেশি শুনি এই বিদেশে বসে মন খারাপ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।