চারতলায় দাঁড়িয়ে নতুন একটা স্কেচের জন্য থিম খুঁজছিলাম। এমন সময় ঐ কন্ঠটা। মাটিতে একজন মহিলা তার সামনে দাঁড়ানো সাত আট বছয় বয়সী বাচ্চাটাকে থেমে থেমে শাসাচ্ছে। আমার স্কেচের চিন্তা যে কই পালালো! 'হেই। হুই। এটা করলি কেন। ওটা করলি কেন।' সব কথার মধ্যে একই উচ্চারণের ধরন। এটা স্পষ্ট, মহিলাটা ঠিক করেছেন ভয় দিয়েই আজকে একেবারে বাচ্চাটাকে সিধা করে ছাড়বেন। উনি বুঝতে পারছেন না বাচ্চাটার কেমন ক্ষতি করছেন উনি। এবং উনার কথার সুরে বুঝাই যাচ্ছে উনি নিয়মিতই এটা করেন।
কিছু মানুষ কথা বলার সময় কন্ঠে ধাক্কা দিয়ে কথা বলে সেটা এসে একেবারে বুকে ধাক্কা লাগে। থেমে থেমে সময় নিয়ে হঠাৎ জোরে উচ্চারণ। এটা তারা করে অন্যকে ভয় পাইয়ে বা চমকে দিতে। নীরবতার মধ্যে যেন হঠাৎ একটা পটকা ফাটলে যতটা আঁতকে উঠতে হয় প্রায় সেরকম এটার প্রতিক্রিয়া। আর এমন কন্ঠ সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় শিশুদের উপর। এমনও হয়, যার কন্ঠ নরম-সরম অন্য কারো সামনে মিনমিনিয়ে থাকে তার কন্ঠও শিশুদের সামনে কিরকম শীতল হয়ে যায় অনেকসময়।
শিশুদের মন সাদা কাগজের মত। নরম আর লেখা টুকে নেয়ার জন্য তৈরী। তাই দেখি, কাজ তা যত বড় বা ছোটই হোক করার জন্য শিশুরাই সবার আগেভাগে সোৎসাহে এগিয়ে আসে। ভূবনটাকে শিখে নেয়ার, গ্রহণ করার জন্য উপযোগী এমন বয়স জীবনচক্রে আর দ্বিতীয়টিবার আসে না। আর সেই সময়ে আমরা কি ব্যবহার করি ওদের সাথে? বলি "ওদিকে যেয়োনা, ভুতে ধরবে।" অদেখা বায়বীয় এক জুজুর ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে শেখে তারা। এরকম "এটা করো না, পারবে না। খেলতে যেয়ো না, ব্যাথা পাবে।" "তাড়াতাড়ি ফিরে এসো, নয়ত মার খাবে।" "আড্ডায় যেয়ো না, নষ্ট হয়ে যাবে।" এরকম শত সহস্র ভয় আর নেতিবাচক ধারনায় বেঁধে দিই ওদের শিশুমন, মনের বিকাশ। শিশু বলে আদতে ফুলবাবুটি সাজিয়ে পা থেকে মাথা পর্যন্ত, মাথার ব্রেন পর্যন্ত শিকলে জড়িয়ে রাখি ওদের। নিজেরা যে কুয়োর ব্যাঙের মতো বড় হয়েছি তার শোধ তুলি নিজেদের শিশুগুলোর উপর।
প্রাইমারী আর হাইস্কুল মিলিয়ে চারটা স্কুলে পড়েছি। সবগুলোতেই এমন কিছু শিক্ষাগুরুর দেখা পেয়েছি যারা ক্লাসে ঢুকতেন হাতে একটা বেত নেড়ে। গাছের কঁচি ডাল থেকে শুরু করে বাঘের মত ডোরাকাটা জালিবেত পর্যন্ত কতো কি! তাকালেই মনে হত সপাং সপাং শব্দে বুঝি ওগুলো পিঠে নেমে আসার জন্য ওঁত পেতে আছে। বুঝি ছাত্র পিটানোইবা তাদের কাজ। শিক্ষক তারা, অথচ ভয়ে প্রশ্ন পর্যন্ত করতে পারতাম না। পিছন ফিরে তাঁকিয়ে আজ অনুভব করি কি ত্রাস অতিক্রম করেছি শৈশব আর কৈশরের দিনগুলোতে। এমনকি কলেজেও। আমার কলেজ ছিল ক্যান্টনমেন্ট কলেজ।
জীবনে তো প্রাণবন্ত থাকাটাই ভালো। আর ছোটবেলা হলে তো কথাই নেই। বাচ্চারা ঘুরবে, ফিরবে, নাচবে, গাইবে, আঁকবে, স্পর্শ করবে এভাবেই শিখবে। স্কুলের যতগুলো বাংলা ইংরেজী গল্পের বই আছে প্রায় সবখানেই দেখবেন বাচ্চারা বাইরে ঘুরছে, খেলছে এভাবেই শিখছে- এমন ছবি। মরাদের মত ঘরের ভিতরে পড়ে থাকা তাদের কাজ না। তাদের বয়সটা পৃথিবীটাকে জানার বয়স। সেটা বই থেকেই হোক, ঘর থেকে হোক, আর ঘরের বাইরে থেকেই হোক। আর শুধু বই দিয়ে তো চলে না। অথচ আমরা তা না করে শুধু বই আর ভয়ের রাজ্যে তাদের গুজে দিচ্ছি। পড়াশুনাটাকে বিরক্তিকর আর ভয়ঙ্কর করে তুলছি।
ভুতের ভয়, বাঘের ভয়, মাকড়শার ভয়, শারিরীক শাস্তির ভয় আর না। ওগুলো সাময়িক কাজ দেয় হয়ত। কিন্তু কাজের আড়ালে ক্ষতি করে বেশি। তাছাড়া ভয় দেখানোর চেয়ে বুঝিয়ে বলাটাই বেশি কার্যকর- এবং সেটাই দীর্ঘমেয়াদী ও বাস্তবসম্মত। ছোট শিশুদেরকে পিটিয়ে হুমকি ধামকি দিয়ে মানুষ বানানোর ধারনা বা ভয় দেখিয়ে পড়াশুনা করানোর রীতি এগুলোর ব্যাপারে আরো বেশি সচেতনতা গড়ে তোলা দরকার। আমি তো বলবো সম্ভব হলে আইন করে নিষিদ্ধ করা দরকার, কারণ এটা আসলেই গুরুত্বপূর্ণ। নয়ত অনেক ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে আমাদের, আমাদের ভবিষ্যতের। এমন নয় যে বাচ্চাদেরকে সত্যি ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললে তারা বুঝে না। তারা আমাদের ধারনার চেয়ে ভালোই বুঝে সাধারণত। তারা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নভাবে চিন্তা করতে পারে। তারা যে অনেক পরিষ্কার মাথায় চিন্তা করতে সক্ষম তা আমি আমার দুই বছরের ভাগনিটাকে খেয়াল করে দেখেছি। ওই গল্প আরেকদিন।
কাল বিকেলে ঝড়ো বাতাসের মধ্যে বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। একটা ছেঁড়া পলিথিন বাতাসে উড়তে উড়তে একতলা দু'তলা হয়ে চারতলার উপর, তারও উপর ভেসে গেল। জড় একটা পলিথিনও কখনো কখনো ভাসতে জানে। আর আমরা সে ইচ্ছাটি পর্যন্ত করতে ভয় পাই। দরজায় ছিটিকিনি মেরে জগত থেকে আলাদা করে রাখি। সেটাইতো স্বাভাবিক, ভয় চিড়িয়াখানার যোগ্য চিড়িয়া হয়ে বড় হয়ে উঠেছিযে আমরা। আমরা গর্বিত বাঙ্গালিরা।
-জানুয়ারী ২৯, ২০১৩।
(অনেকদিন থেকে সচলে সচল হবো ইচ্ছে। এদিকে আমার প্রায়ই পুরো লেখা সমাপ্ত করা হয়না। আবার পারফেকশনিজমের আশায় পোস্টও করা হয়না। আজ তাই পারফেকশনিজমের ভুত ঘাড় থেকে ঝেড়ে ডায়েরীর পাতা থেকে টুকে সামান্য উনিশবিশ করে লেখাটা একরকম দাঁড় করিয়ে ফেললাম। তারপর আর বেশি সংযোজন বিয়োজন না করে পোস্ট করে দিলাম সচলে।)
মন্তব্য
লেখকঃ
আমিনুল করিম মাসুম,
স্থপতি।
লেখার বক্তব্যের সাথে সহমত। কিন্তু লেখার মাঝে যত্নের অভাব মনে হলো, একি বাক্যে সর্বনামের বার বার ব্যবহার হয়েছে। যেমন এই বাক্যগুলোতে “ উনি বুঝতে পারছেন না বাচ্চাটার কেমন ক্ষতি করছেন উনি। এবং উনার কথার সুরে বুঝাই যাচ্ছে উনি নিয়মিতই এটা করেন” । বারবার একি সর্বনাম ব্যবহার করলে পড়তে ক্লান্তিকর অনুভূতির জন্ম দেয় ! আশা করি পরের লেখাগুলোতে এইদিক টা খেয়াল রাখবেন।
আর শেষ লাইনে গর্বিত বাঙালি কথাটা আসলো কোন উদ্দেশ্যে?
মাসুদ সজীব
শিশুদের ব্যাপারে যা বলতে চেয়েছেন সেভাবে সহমত।
না লিখলে বুঝবেন কিভাবে পরিপক্কতা আসছে? তাই আপনার নিজেরও উচিৎ ভয়/আলস্য ভেঙ্গে লিখে যাওয়া।
সচলায়তনে স্বাগতম।
লিখতে থাকুন - জলে না নামিলে কেহ শেখেনা সাঁতার। আপনার লেখার ধরন ভালো, যেটা আরো লিখলে এবং ফিডব্যাকগুলো কাজে লাগালে দ্রুত উন্নতি হবে। আর পড়ুন, প্রচুর পড়ুন।
আপনার বিষয় নির্বাচন ভালো লেগেছে। পছন্দের বিষয় নিয়ে লিখে যান। লেখা শেষ করে এক/দুইদিনের একটা গ্যাপ দিয়ে একবার পড়ে নেবেন, দেখবেন অনেক ইম্প্রুভমেন্ট স্কোপ খুঁজে পাওয়া যাবে।
সচল থাকুন, সচল রাখুন।
____________________________
নতুন মন্তব্য করুন