"মায়াবতী"

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ১৭/০১/২০১৪ - ১০:০৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১.
-"এই যে শুনছেন? "

টিউশানি থেকে ফেরার পথে একমনে চা খাচ্ছিল আবির। হঠাৎ মেয়েকন্ঠ শুনে চমকে উঠল। ফলাফল হিসেবে গরম চা ছিটকে পড়ল শার্টে। রাত দশটায় এরকম একটা অন্ধকার গলিতে মানুষজন থাকে না বললেই চলে। দোকানপাটও সব বন্ধ হয়ে যায় নয়টা-সাড়ে নয়টায়। এসময় একটা মেয়ে কন্ঠ শুনে চমকে উঠাই স্বাভাবিক। কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে ঐ মেয়েকন্ঠধারীর উদ্দেশ্যে তাকালো সে। সাদা আর আকাশী রঙের সালোয়ার কামিজ পড়া এক মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তায় তেমন আলো নেই বলে মুখটা ভালভাবে দেখা যাচ্ছে না।

-- আমাকে বলছেন?

-- হ্যাঁ। আপনার চা খাওয়া শেষ হয়েছে?

-- মানে?

-- মানে আবার কি? আপনার চা খাওয়া এখনো শেষ হয়নি? কতক্ষণ ধরে পেছনে দাঁড়িয়ে আছি। আচ্ছা, তাহলে আমিও আপনার সাথে এক কাপ চা খাই।
"চাচা, আমাকেও এক কাপ চা দিন তো। "

এবার মেয়েটা পেছন থেকে সামনে এসে আবিরের সামনের বেঞ্চটাতে বসল। চায়ের দোকানের লাইটের আলোয় এবার আবির মেয়েটার মুখ দেখতে পেল। উজ্জ্বল শ্যামলা রঙের মায়াবী একটা মুখ, বয়স বিশ কি একুশ হবে। মেয়েটার মুখের মায়াভাব খুব বেশি। একবার দেখলে শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে।

"আমার চায়ে চিনি বেশি দেবেন না চাচা। "
হঠাৎ কথা শুনে আবির বাস্তবে ফিরে এল। সে কিছুই বুঝতে পারছে না। এই মেয়ে ওর পিছনে দাঁড়িয়ে ছিল মানে! কেন দাঁড়িয়ে থাকবে? মেয়েটা কি ওকে চেনে? কিন্তু মেয়েটাকে তো সে আগে কখনো দেখেছে বলে মনে হচ্ছে না।

-- আমি আপনার কথা ঠিক বুঝলাম না। অনেকক্ষণ ধরে আমার পেছনে দাড়িঁয়ে আছেন মানে? কেন?

-- অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি। আপনি আসার আরো আগে থেকে। আপনি এলেন, আমার সামনে বাইকটা রাখলেন, তারপর বসে চা খাচ্ছেন।

-- আপনার সামনে! কোথায়! আমি তো আপনাকে দেখতে পেলাম না।

-- আপনি হয়ত লক্ষ্য করেন নি। তাছাড়া এখানে অনেক অন্ধকার। তাড়াতাড়ি চা খাওয়া শেষ করুন। আমি অনেক গরম চাও তাড়াতাড়ি খেতে পারি। এই দেখুন, আমার চা খাওয়া প্রায় শেষ। আপনি দুকাপ চায়ের দাম দিয়ে আসুন। আমি বাইকের সামনে অপেক্ষা করছি।

-- অপেক্ষা করছেন মানে!

-- আরে, আমি কি এমনি এমনি আপনার পিছনে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম নাকি? আমাকে আপনার বাইক দিয়ে আমার বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসুন। প্রায় ঘন্টাখানেক এই রাস্তায় দাড়িঁয়ে আছি। কোন রিকসা বা ট্যাক্সি পাচ্ছি না।

চায়ের দাম মিটিয়ে দিয়ে আবির মেয়েটার সামনে দাঁড়াল। পুরো ব্যাপারটা তার কাছে অস্পষ্ট। কথা বলে আগে বোঝা দরকার যে আসলে কি হয়েছে।

-- আচ্ছা ঠিক আছে, আমি আপনাকে বাসায় পৌঁছে দেব। তার আগে বলুন আপনি এত রাতে এখানে একা কি করছেন? কোন কাজে এসেছিলেন?

-- সেটা জেনে আপনি কি করবেন? বাসায় পৌঁছে দিতে বাসার ঠিকানা জানা দরকার, সেটা জানতে চাইলে বলব। আমি এখানে কেন এসেছিলাম সেটা আপনার জানার কোন প্রয়োজন দেখছি না। হতে পারে সেটা আমার পারসনাল কিছু।

-- ওকে, বলতে না চাইলে বলবেন না। কিন্তু একটা কথা বলুন, এখনকার অনেক মানুষই অনেক খারাপ মতলব নিয়ে থাকে। আমিও তো সেরকম একজন হতে পারি। আপনি কি করে আমাকে এতটা বিশ্বাস করছেন যে আমি আপনাকে আপনার বাড়িতেই নিয়ে যাব?

-- সেটা না হয় আমি বুঝে নিয়েছি। এখন আপনি বলুন, আপনি কি যাবেন?

আবির আবারও অবাক চোখে তাকালো। মেয়েটা মুচকি মুচকি হাসছে। অদ্ভুত সুন্দর সেই হাসি। হাসিতে মুখের মায়াভাব আরো প্রবল হয়েছে। দেখলে কেমন যেন নেশা ধরে যায়, চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করে না।

২.
প্রায় আধা ঘন্টা পথ চলার পর একটা দোতলা বাড়ির সামনে এসে থামল আবির। নিঃসন্দেহে শহরের সবচেয়ে অভিজাত বাড়ির মধ্যে এটা একটা। মেয়েটার কথা অনুযায়ী এটাই ওর বাড়ি। বাড়ির বাইরের বারান্দায় চাদর গায়ে একজন লোক দাড়িঁয়ে ছিলেন। সম্ভবত মেয়েটার বাবা। বাইক থামার কিছুক্ষণ পর উনি বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন। দারোয়ান গেইট খুলে দেয়ার সাথে সাথে মেয়েটা বাইক থেকে নেমে আবার সেই মায়া জড়ানো হাসি দিয়ে ভেতরে চলে গেল। এমনকি যাওয়ার সময় একটা থ্যাংকসও দিয়ে গেল না। "কি অদ্ভুত মেয়ে রে বাবা! " মনে মনে বলল আবির। তারপর বাইকে স্টার্ট দিতেই দারোয়ান এসে বলল, "স্যার আপনাকে ভেতরে যাইতে কইছেন"।
হঠাৎ আবিরের ভয় ভয় লাগল। একসাথে দুজনকে বাইকে আসতে দেখে ভদ্রলোক কি ভেবেছেন কে জানে! "না জানি আজকে কি আছে কপালে। কেন যে মেয়েটাকে নিয়ে আসলো.... "- ভাবতে ভাবতে বাড়ির ভেতরে ঢুকল সে।

গেইটের ভিতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল দুটো গাড়ি। একটা কালো, আরেকটা সাদা। একটা ব্যাপার আবিরের খুব অবাক লাগলো। এধরনের ধনী পরিবারের গাড়ি থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অস্বাভাবিক হল দুটো গাড়ি থাকতে ওই মেয়ে একা একা গাড়ি ছাড়া এতদূরে কেন গেছিল! আর কোন কারণে যদি গাড়ি ছাড়া গিয়েও থাকে, ফেরার সময় রিকসা বা ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা না করে বাসায় ফোন করে দিলেই তো হত গাড়ি পাঠিয়ে দেয়ার জন্য। এসব ভাবতে ভাবতে মূল বাড়ির দরজার সামনে এসে দাড়াঁল আবির। দরজা খোলা। সরাসরি ভিতরে চলে যাওয়া ঠিক হবে কিনা চিন্তা করছিল সে। তখনই গম্ভীর কিন্তু মিষ্টি পুরুষ কন্ঠস্বর শুনতে পেল, "ভেতরে এস"।

৩.
আবির ড্রইংরুমের সোফায় বসে আছে। তার সামনে বসে আছেন বারান্দায় দাড়িঁয়ে থাকা সেই ভদ্রলোক। আগে গায়ে চাদর দেয়া ছিল, এখন খুলে ফেলেছেন। মাথায় কাঁচাপাকা চুল, পাঞ্জাবি পড়া। দেখলেই বোঝা যায় উনিই মেয়েটার বাবা। চেহারায় অনেক মিল। মেয়ের মত উনার মুখেও মায়াবী ভাব আছে। তবে উনার বয়স ষাটের কাছাকাছি হবে।

-- তোমার নাম কি বাবা?

-- জ্বি, আবির। আবির রহমান।

-- তুমি নিশ্চই মিমির বন্ধু নও?

প্রশ্ন শুনে খানিকটা ঘাবড়ে গেল আবির। ভদ্রলোকের আচরনে আর মিষ্টি কন্ঠস্বরে ভয় অনেকটা কেটে গিয়েছিল। মিমি নিশ্চই ওই মেয়েটার নাম। কিন্তু বন্ধু নও বলতে উনি কি বোঝালেন? প্রেমিক? নাকি অপরিচিত?

-- না, মানে.....

-- আমি যতদূর জানি মিমির এখন কোন বন্ধু নেই। গত এক বছর ধরে ও কারো সাথে মেশে না। এমনকি পুরনো বন্ধুদের সাথেও কোন যোগাযোগ রাখে না। আমার মনে হয় তুমি ওকে রাস্তায় এত রাতে একা দেখে বাসায় নিয়ে এসেছ। আমি কি ঠিক বলছি?

-- আসলে আঙ্কেল, ও নিজেই আমাকে বলেছে বাসায় নিয়ে আসার জন্য। তখন আমি....

-- স্ট্রেঞ্জ!! মিমি তোমাকে নিজে বলেছে বাসায় নিয়ে আসার জন্য!

-- জ্বি

-- গত একবছর মিমি আমি ছাড়া আর কারোর সাথে কথা বলে নি। এমনকি ওর পুরনো বন্ধুদের সাথেও দেখা করতে চায় না। আজকে তোমার মত অপরিচিত একজন ছেলের সাথে কেন কথা বলল বল তো?

-- আমি আসলে কিছু বুঝতে পারছি না আঙ্কেল। ও কারো সাথে কথা বলে না কেন?

-- বলব। আমার মনে হয় তোমাকে কোন কারণে মিমির পছন্দ হয়েছে। তুমিই এখন আমার ভরসা। তোমাকে সব বলব। প্লিজ তুমি আমার মেয়েটাকে আগের মত করে দাও। তেমন কিছু করতে হবে না। শুধু মিমির সাথে ভাল বন্ধুত্ব তৈরি কর, ওর সাথে কথা বল, বাইরে ঘুরতে যাও। এর বেশি কিছু করতে বলব না। আমার মেয়েটা দিনে দিনে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে। একটু দেখ না বাবা ওকে বের করে আনতে পার কিনা.... আমি তোমার কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকব। হয়ত তোমার খুব অবাক লাগছে আমার কথা শুনে। হয়ত ভাবছ অপরিচিত একটা জায়গায় এসে কোন বিপদে পড়তে যাচ্ছ। কিন্তু বিশ্বাস কর, নিজেকে খুব অসহায় লাগে আমার। বাবা হয়ে নিজের মেয়েকে চোখের সামনে এভাবে শেষ হয়ে যেতে দেখার চেয়ে কষ্টের বোধ হয় আর কিছু নেই। তোমার কাছে আমি হাত জোড় করছি বাবা। আমাকে ফিরিয়ে দিও না...

-- এভাবে কেন বলছেন আঙ্কেল! আমি যদি কিছু করতে পারি তবে অবশ্যই করব। কিন্তু ও এমন কিভাবে হল?

-- বলছি।

৪.
"আমার বয়স তখন ২২। বাবা-মার অমতে গিয়ে মিমির মাকে বিয়ে করি। আমাদের আলাদা একটা সংসার হয়। ছোট সংসার। সেখানে সুখের কোন অভাব ছিল না। শুধু একটাই কমতি ছিল, সন্তান। অনেক চেষ্টা করেছিলাম, কোন লাভ হয়নি। ডাক্তারও কিছু বলতে পারছিল না। আমাদের কারোর কোন সমস্যাও ছিল না। শেষ পর্যন্ত এটাকে নিয়তি ভেবে মেনে নিয়েছিলাম।

এর প্রায় ১৩ বছর পর হঠাৎ মিমির আগমন। বুঝতেই পারছ তখন আমাদের কি মানসিক অবস্থা। মনে হচ্ছিল যেন পৃথিবীর সব সুখ আমাদের এই ছোট্ট পরিবারে চলে এসেছে। কিন্তু সেই সুখ কপালে সইল না। মিমির যখন ২ বছর বয়স, তখন ওর মা হঠাৎ রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়। আমার তখন কি অবস্থা তা বলে বোঝাতে পারব না। একদিকে ওর মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না। অন্যদিকে মিমি অনেক ছোট। ওর দেখাশোনা করার কেউ নেই। শেষপর্যন্ত কলিগদের পরামর্শে আরেকটা বিয়ে করলাম। রেহানা, মিমির ছোটমা।

রেহানা আসার পর আস্তে আস্তে সবকিছু আগের মত হয়ে উঠতে লাগল। যদিও মিমির মায়ের অভাব আমি সবসময় ফিল করতাম, কিন্তু রেহানার ভালবাসায় আর দায়িত্বশীলতায় আমাদের সংসার আবার পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। রেহানা কখনো মিমির সৎ মার মত ছিল না। মিমিকে সে খুব আদর করত, আগলে রাখত। মিমিও ছোটমাকে ছাড়া কিছু বুঝত না। আস্তে আস্তে মিমি বড় হয়। আমার ব্যবসারও অনেক উন্নতি হতে থাকে। সবকিছু ভালই চলছিল।

বছরখানেক আগে এক সকালে ঘুম থেকে উঠে লক্ষ্য করলাম রেহানা ঘুম থেকে উঠে নি। রেহানা আর মিমি একসাথে ঘুমাতো, আর আমি পাশের ঘরে ঘুমাতাম। রেহানার খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস ছিল। ইনসমোনিয়া থাকা সত্ত্বেও ও সবার আগে ঘুম থেকে উঠত। ওইদিন ওঠে নি দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম। পরে আবার ভাবলাম হয়ত শরীর খারাপ, এজন্য ঘুমাচ্ছে। আমি আর ডাকতে যাই নি। যখন প্রায় সাড়ে নয়টা বাজে, তখন একটু ভয় ভয় লাগল। রেহানার শরীর বেশি খারাপ করল কিনা দেখার জন্য দরজায় ধাক্কা দিলাম। দরজা খোলাই ছিল। ভেতরে ঢুকে দেখি মিমি চুপচাপ বিছানায় বসে আছে। বললাম - "কিরে, এভাবে বসে আছিস কেন? ছোটমাকে ডাক দিস নি? ছোটমার কি শরীর খারাপ?" ও কোন সাড়া দিল না। নড়ল না পর্যন্ত। এরপর আমি রেহানাকে ডাকলাম। অনেক ডাকার পরও ও ঘুম থেকে উঠল না। হঠাৎ মিমি বলল, "ছোটমাকে ডেকো না বাবা। ছোটমা আর নেই।" আমি অবাক হয়ে দাড়িঁয়ে ছিলাম। কথা বলতে পারছিলাম না।

ওইদিন মিমি একফোঁটা চোখের জল ফেলে নি। পাথরের মত বসে ছিল শুধু। পরে জানতে পারি রেহানা আত্মহত্যা করেছিল। ইনসমোনিয়া ছিল বলে ওর ড্রয়ারে সবসময় স্লিপিংপিল থাকত। রাতে দুধ খেয়ে শোয়ার অভ্যাস ছিল। সেই দুধের সাথে স্লিপিং পিল মিশিয়ে.....

রেহানা কেন সুইসাইড করেছিল সেটা এখনো আমার কাছে রহস্য। আমার জানামতে ওর তেমন কোন সমস্যা ছিল না যে কারণে তাকে সুইসাইড করতে হবে। রেহানা মারা যাওয়ার পর থেকে মিমি কেমন যেন হয়ে যায়। কারো সাথে কথা বলে না। মাঝে মাঝে আমার সাথে একটু আধটু কথা বলে, তাও প্রয়োজনে। রেহানা ছিল তার প্রাণ। তার এই অপমৃত্যু মিমি একদম মানতে পারে নি। অনেক চেষ্টা করেও ওকে একটু কাঁদাতে পারি নি। সবকষ্ট বুকে চেপে বসে আছে। সারাদিন ঘরে বসে থাকে। কিছুদিন ধরে বিকালে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। কোথায় যায় বলে যায় না। গাড়িও নিয়ে যায় না। জিজ্ঞেস করেছিলাম কোথায় যায়। বলল কোথাও যায় না, শুধু হাঁটে। সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরে আসে। যতক্ষণ ও বাসায় না ফেরে ততক্ষণ আমি বারান্দায় দাড়িঁয়ে থাকি। আর কিছু করার সাহস হয় না। ভয় হয় যদি আবার হিতে বিপরীত হয়। আজকে ফিরছিল না বলে ভয় লাগছিল। এত রাত ও কখনো করে না। বাসায় ঢোকার সময় ওকে দেখে অনেক ফ্রেশ লাগছিল। আমাকে দেখে একটু হাসলোও। অনেকদিন ওর এমন মুখ দেখিনি।"

মিমির বাবা কাঁদছেন। আবির কি বলবে বুঝতে পারছে না। এই মানুষটা না জানি কত চোখের জল ফেলেছেন নীরবে। অসহায়ত্ব বোধয় একেই বলে।

৫.
প্রায় আধা ঘন্টা ধরে আবির মিমির বাসার সামনে দাড়িঁয়ে আছে। বিকালে মিমির বের হওয়ার কথা। আবির বাসা থেকে একটু দূরে এমনভাবে দাড়িঁয়েছে যেন মিমি বের হয়ে তাকে দেখতে না পায়। তাদের দেখা হওয়াটা যেন কাকতালীয় মনে হয়।

কিছু খটকা তৈরি হয়েছে। মিমি বের না হওয়া পর্যন্ত সেগুলো নিয়ে ভাবা যাক। মিমির বাবার কথা অনুযায়ী মিমি গত একবছর ধরে কারো সাথে কথা বলে নি শুধু ওর বাবা ছাড়া। কিন্তু কালকে রাতে রাস্তায় ওকে বাসায় পৌঁছে দিতে বলল, এবং যথেষ্ট স্বাভাবিক ব্যবহার করল। শুধু স্বাভাবিক বললে ভুল হবে, বেশ মিশুক ব্যবহার করল। এর কারণ কি হতে পারে? আবিরকে ভাল লাগার ফলে এমনটা করেছে এটা মানা যায় না। তাছাড়া ভাল লাগার মত সিচুয়েশনও তৈরি হয়নি। আবিরকে দেখার সাথে সাথেই মিমি নরমাল ব্যবহার করেছে। তাহলে?

তাহলে কি কাল এমন কিছু হয়েছে যাতে মিমির ভেতরে থাকা চাপা কষ্টটা কমে গেছে? এজন্য সে আগের মত স্বাভাবিক ব্যবহার করছে? তাই যদি হয় তাহলে কি হয়েছে?

-- কি ব্যাপার মিষ্টার আবির রহমান? কি ভাবছেন এখানে দাড়িঁয়ে দাড়িঁয়ে? আমার ব্যাপারে ভাবছিলেন?

আবির চমকে উঠে পিছনে তাকালো। মিমি দাড়িঁয়ে আছে। সাদা সালোয়ার-কামিজ পড়া, একটু সাজগোজও করেছে আজকে। কপালে ছোট একটা পাথরের টিপ। সাথে সেই নেশা ধরা হাসি। মনে হচ্ছে যেন স্বর্গের কোন অপ্সরী দাড়িঁয়ে আছে।

-- আপনি....!

-- হ্যাঁ, আমি। আমার জন্যই অপেক্ষা করছেন, আবার আমাকে দেখেই অবাক হচ্ছেন?

-- না, আসলে...

-- আমি জানি। মিথ্যা কথা বলতে হবে না।

-- আপনি আমার নাম জানলেন কি করে?

-- কালকে যখন বাবাকে বলছিলেন তখন শুনেছি।

-- তার মানে আপনি কালকে সবকিছু শুনেছেন?

-- না, সব শুনিনি। আপনার নাম পর্যন্ত শুনেছি। বাকিটা অনুমান করেছি। আমার ধারনা বাবা কালকে আপনাকে আমার সম্পর্কে অনেককিছু বলেছে। হয়ত আমার উপর নজর রাখতেও বলেছে।

-- আপনার অনুমান শক্তি অনেক ভাল। তবে তিনি আমাকে আপনার উপর নজর রাখতে বলেন নি।

-- হুম, আমার অনুমান সহজে ভুল হয় না। এটা আমার একটা এক্সট্রা পাওয়ারও বলতে পারেন। আর বাবা আপনাকে নজর রাখতে না বললেও আমার সাথে মিশতে অবশ্যই বলেছে। আমার অনুমানশক্তি তাই বলে।

-- আপনার অনুমানশক্তি হয়ত বেশ ভাল। কিন্তু এখন যে কথাগুলো বললেন সেগুলো অনুমান করে নয়, বুদ্ধি দিয়ে। আপনি বেশ বুদ্ধিমতী।

-- হুম। আপনিও কম বুদ্ধিমান নন। চলুন, সামনে যাই। আজকে আমি প্রচুর ঘুরব। অনেক রাতে বাড়ি ফিরব। যা যা করতে ইচ্ছা হয় সব করব আজ। আপনার নিশ্চই আমার সাথে ঘুরতে আপত্তি নেই, বরং আপনার জন্য ভালই হবে। যা করতে চেয়েছিলেন তার সুযোগ আমিই করে দিলাম। আপনার কাছে নিশ্চই বাবার কার্ড আছে। বাবাকে ফোন করে জানিয়ে দিন আমার বাড়ি ফিরতে অনেক দেরি হবে।

৬.
আবির একঘন্টা যাবত রিকসায় বসে আছে। সাথে মিমি। তারা কোথায় যাচ্ছে তাও জানে না। মিমি রিকসাওয়ালাকে বলেছে যেদিকে খুশি যেতে। আবিরের আজকে মিমির বাসার সামনে দাঁড়ানোর উদ্দেশ্যে ছিল মিমির সাথে কথা বলা, পারলে ওকে কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাওয়া, ওর সাথে কথা বলে ওর ভেতরের কষ্টটা কমানোর চেষ্টা করা। কিন্তু আবিরকে কিছুই করতে হচ্ছে না। মিমি একাই একনাগাড়ে কথা বলে যাচ্ছে। আগে আপনি করে কথা বলছিল, এখন তুমি করে বলছে। বেশিরভাগ কথাই ছোটমাকে নিয়ে। ছোটমাকে সে কতটা ভালবাসত তা তার কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছে। ছোটবেলা থেকে শুরু করে যত মজার ঘটনা ঘটেছে সব একের পর এক বলে যাচ্ছে। হাসির কিছু বললে নিজেই হাসছে। মনে হচ্ছে এক বছরে না বলা সব কথা আজকে বলে উশুল করে নেবে। আবির কিছুই বলছে না। শুধু মুগ্ধ হয়ে মিমির দিকে তাকিয়ে আছে। যখনই মিমি হাসছে তখনই তার বুকের ভেতর কেমন যেন করছে, মনে হচ্ছে কেউ যেন তার বুকে ছুরি ঢুকিয়ে দিচ্ছে। আবির স্পষ্ট বুঝতে পারছে সে ভয়ংকর ভাবে এই মায়াবী মেয়েটার প্রেমে পড়ে যাচ্ছে। এর থেকে মুক্তির কোন উপায় নেই।

৭.
রাত প্রায় একটা বাজে। আবির মিমিকে ওর বাসায় দিয়ে যেতে এসেছে। মিমি গেইট দিয়ে ঢুকতে গিয়েও আবার ফিরে এসে আবিরের সামনে দাড়াঁল।

-- আই অ্যাম সরি আবির।

-- সরি!! ফর হোয়াট?

-- সেটা তুমি এখন বুঝবে না আবির। তবে তোমার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। তোমার জন্য আমি আজকের দিনটা যেভাবে কাটাতে চেয়েছিলাম, তার চেয়েও অনেক ভালভাবে কাটিয়েছি। মন খুলে কথা বলেছি তোমার সাথে। তোমাকে আমার ভীষন পছন্দ হয়েছে। তুমি খুব ভাল একটা ছেলে। তা না হলে সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা মেয়ের জন্য এতটা করতে না। কিন্তু কি জানো, ভালদেরই বেশি কষ্ট পেতে হয়, বিপদে পড়তে হয়। তুমিও কষ্ট পাবে আবির, খুব শীঘ্রই। তোমার সামনে বিপদ আসছে। কষ্টটা তোমাকে সহ্য করতে হবে। দুদিনের মোহকে আঁকড়ে ধরো না। মোহ থেকে যত তাড়াতাড়ি বের হতে পারবে, তত তাড়াতাড়ি কষ্ট থেকেও মুক্তি পাবে।

এইটুকু বলেই মিমি ভেতরে চলে গেল। আবির তখনো কথাগুলোর অর্থ ভেবে চলেছে। কিসের কষ্ট আসবে তার সামনে? কিসের বিপদ?

৮.
অনেক রাতে মেসে ফিরে ঘুমাচ্ছিল আবির। মোবাইলের শব্দে ঘুম ভাঙল। আননোন নাম্বার। ঘুম চোখে রিসিভ করল সে।

-- হ্যালো..

-- আবির, এখনই একবার আমার বাসায় চলে আস প্লিজ।

আবিরের বুঝতে কোন অসুবিধা হল না এটা মিমি। মিমির কন্ঠে এমন কিছু ছিল যে কারণে আবিরের ঘুম একবারে কেটে গেল। কিন্তু মিমি আবিরের মোবাইল নাম্বার কিভাবে পেল? হঠাৎ মনে হল কাল বিকালে আবির মিমির বাবাকে কল করেছিল, সেখান থেকে হয়ত নিয়েছে। কেন এখনই মিমির বাসায় যেতে বলছে তা আর জিজ্ঞেস করল না সে। শুধু বলল - "একটু অপেক্ষা কর, এখনই আসছি। "

মুখ ধুয়ে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিল আবির। কেন জানি তার ভয় ভয় লাগছে। মিমির কন্ঠস্বর এমন গম্ভীর ছিল কেন? কাল রাতে বলা মিমির কথাগুলোর সাথে আজকের হঠাৎ বাসায় যেতে বলার কি কোন সম্পর্ক আছে?

৯.
আবিরকে দেখেই দারোয়ান গেইট খুলে দিল। ভিতরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিংবেল চাপার প্রায় সাথে সাথে একটা মেয়ে এসে দরজা খুলে দিল। মেয়েটা বোধহয় আশেপাশেই ছিল। হয়ত ওকে বলা আছে। আবির ঢুকতেই মেয়েটা বলল - "আফামণি আপনারে উনার ঘরে নিয়া যাইতে বলছেন। আহেন আমার সাথে.. "। আবিরকে মিমির ঘরের দরজার সামনে দিয়ে মেয়েটা চলে গেল। ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেল। মিমির ঘরের জানালার পর্দা দেয়া। একারণে ঘরে বেশি আলো নেই। বিছানায় মিমি বসে আছে, ওর চোখ-মুখ ফোলা। দেখেই বোঝা যাচ্ছে প্রচুর কান্নাকাটি করেছে। হয়ত সারারাত কেঁদেছে। এখনও চোখের কোণে জল। মিমিকে এভাবে দেখে আবির তেমন চমকালো না। সে আগেই বুঝেছিল এরকম একটা দৃশ্য দেখতে পাবে।

-- এসেছ? বসো। তোমাকে আমার কিছু কথা বলার আছে আবির। কাউকে বলি নি। কিন্তু তোমাকে আজকে বলব। এ যন্ত্রণা আমি আর সহ্য করতে পারছি না।

-- কি বলবে বল, আমি শুনব। তুমি বল।

-- তোমার সাথে কালকে অনেক কথা বলেছি। সব শুনে কি মনে হয়েছে তোমার?

-- তোমার অধিকাংশ কথা তোমার ছোটমাকে নিয়ে ছিল। সেই থেকে বুঝেছি তুমি তোমার ছোটমাকে ভীষন ভালবাসতে। তাছাড়া তোমার বাবাও এই কথাই বলেছেন।

-- হুম, প্রচন্ডরকম ভালবাসতাম আমি আমার ছোটমাকে। এখনো বাসি। নিজের মাকেও হয়ত এতটা ভালবাসতাম না আমি। বাবা নিশ্চই তোমাকে এটাও বলেছে ছোটমা ঘুমের ওষুধ খেয়ে সুইসাইড করেছে?

-- হ্যাঁ।

-- সবাই এটাই জানে। সত্যিটা কেউ জানে না। সত্যিটা হল ছোটমা সুইসাইড করেনি। আমি ছোটমাকে খুন করেছি। আমি ছোটমার দুধের সাথে অনেকগুলো স্লিপিং পিল মিশিয়ে দিয়েছিলাম।

-- কি বলছ তুমি এসব মিমি? কেন আজেবাজে বকছ?

-- আমি আজেবাজে বকছি না আবির। সত্যিটা স্বীকার করছি। আমি নিজের হাতে খুন করেছি ছোটমাকে, আমি। আমি খুন করেছি আবির, আমি। আই অ্যাম দ্যা কিলার...

-- কিন্তু কেন মিমি? যাকে এত ভালবাস, তাকে..... কেন?

-- অনেকদিন আগে যখন ছোটমার গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম, তখন হঠাৎ লক্ষ্য করি গ্রামের মানুষজন ছোটমাকে একটু ভয়ের চোখে দেখে। কি কারণে তা জানি না। সেখানে একটা মেয়ের সাথে আমার বেশ ভাল সম্পর্ক হয়েছিল। তাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে সে বারবার এড়িয়ে যায়। আমি পরে আর ওকে কিছু জিজ্ঞেস করিনি।

যেদিন আমরা চলে আসব সেদিন ও আমাকে ডেকে নিয়ে যায়। তখন ও যা বলে তা শোনার জন্য আমি একদম তৈরি ছিলাম না। সে বলে যে ছোটমার বয়স যখন আরো অনেক কম, তখন তিনি তার ৫ বছর বয়সের আপন ছোট ভাইকে খুন করেন।

বাসায় চলে আসার পর কথাটা আমি মাথা থেকে বের করে দেই। ভাবি হয়ত কোনভাবে ছোটমার ছোট ভাই মারা যায়, আর গ্রামের মানুষ ছোটমাকে মিথ্যে সন্দেহ করে। একজন বোন কেন তার ৫ বছর বয়সী ছোট ভাইকে মারতে যাবে?

এরপর অনেকদিন চলে যায়। আমাদের সংসার ভালই চলছিল। ছোটমা আমাকে খুব আদর করত। বাবার প্রতিও অনেক কেয়ারফুল ছিল। একদিন বিকালে আমি বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাব বলে বের হচ্ছি। রান্নাঘরের সামনে দিয়ে যাচ্ছি, তখন দেখি ছোটমা একটা ওষুধের স্ট্রিপ হাতে নিয়ে চায়ের কাপে একের পর এক ট্যাবলেট দিয়ে যাচ্ছে। তখনই মনে হল, এই সময়ে বাবা চা খায়। আমার সারা শরীর ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু কিছু করি নি। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়েছি।

ওইদিন ধাক্কা লাগার অভিনয় করে চায়ের কাপ ফেলে দেয়ায় বাবা বেঁচে গিয়েছিল। সেদিন রাতে আমি ঘুমাতে পারিনি। বারবার মাথায় একটা কথাই ঘুরছিল। কোনভাবেই বুঝতে পারছিলাম না যে ছোটমা আমাদের সবাইকে এত যত্নে রাখে, বাবার এত খেয়াল রাখে, বাবাকে এত ভালবাসে, সেই ছোটমা কেন বাবাকে মারতে চাইবে?

অনেক ভাবার পর একটাই উত্তর পেয়েছি। সাইকোপ্যাথি। ছোটমা একজন সাইকোপ্যাথ। ছোটমা বাবাকে ভীষণ ভালবাসতো। আমার বাবা যে ছোটমাকে পছন্দ করতেন না, তেমনটা নয়। বাবাও ছোটমাকে পছন্দ করতেন। কিন্তু বাবার মন জুড়ে ছিল আমার মা। মূলত বাবা ছোটমাকে বিয়ে করে শুধুমাত্র আমার জন্য। প্রায়ই কথায় কথায় বাবা আমার মার কথা বলে ফেলে। মার অভাব যে ছোটমা পূরণ করতে পারে নি তা ছোটমা ভালভাবেই বুঝতে পেরেছিল। ছোটমার মনে আমার মার প্রতি প্রচন্ড হিংসা সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু যে মানুষটা পৃথিবীতে নেই, তাকে হিংসা করলেও অন্যকিছু করার কোন উপায় নেই। তাই ছোটমা সেই রাগটা বাবার উপর ঢালতে চেয়েছিল। যদিও কখনো ছোটমার কোন আচরনে কেউ কিছু বুঝতে পারে নি। ছোটমার আচরনে কোন খুঁত ছিল না।

ছোটমার ছোট ভাইকে খুন করার হিসাবটাও একইভাবে মিলানো যায়। সম্ভবত ছোটমা তার ভাইকে হিংসা করত। সেজন্যই....

আমার অনুমানশক্তি খুব ভাল। এমনিতেও আমি বুঝে গিয়েছিলাম ছোটমার মনে যখন একবার বাবাকে খুন করার চিন্তা এসেছে, তখন সেটা করেই ছাড়বে। বাবাকে সব বললে বাবা আমাকে বিশ্বাস করতো না। কেননা ছোটমা এমন কিছু করতে পারে তা কেউ ধারনাও করতে পারবে না।

বাবাকে বাচাঁনোর জন্য এ ছাড়া আমার অন্য কোন উপায় ছিল না। সেদিন রাতে ছোটমা যখন ঘরে দুধ রেখে অন্য ঘরে যায় তখনই আমি ড্রয়ার থেকে স্লিপিং পিলগুলো বের করে দুধের সাথে মিশিয়ে দেই। আমার চোখের সামনে ছোটমা ছটফট করতে করতে মারা যায়। যাকে আমি আমার নিজের থেকেও বেশি ভালবেসেছিলাম, যাকে আমি আমার মায়ের আসনে বসিয়েছিলাম, তাকেই নিজের হাতে মেরে ফেলেছি আমি।

সেদিনের সেই যন্ত্রণা তিলে তিলে আমাকে শেষ করে দিচ্ছিল। কোনভাবেই মুক্তি পাচ্ছিলাম না। সারাক্ষণ চোখের সামনে ছোটমার যন্ত্রণাময় মুখটা ভেসে উঠে। সবসময়ই শুনতে পাই - " আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে রে মিমি, সহ্য করতে পারছি না। তোর বাবাকে একটু ডেকে দিবি? " সেদিন বাবাকে ডেকে দেইনি আমি। শেষে বুঝতে পারলাম, এইভাবে আমি বেঁচে থাকতে পারব না। যেদিন তোমার সাথে রাতে দেখা হয়, সেদিনই বিকালে আমি সবকিছুর সমাধান খুঁজে পেয়েছিলাম আবির। ইচ্ছা ছিল একটা দিন নিজের মত করে কাটিয়ে নেব। তারপরই মুক্তি। তোমার কারণে কালকের দিনটা নিজের মত করে কাটাতে পেরেছি। আজকের সকাল আমার জীবনের শেষ সকাল।

-- কি বলছ তুমি মিমি? কি করেছ তুমি?

-- কিচ্ছু করিনি। ছোটমার সাথে যেমন করেছিলাম, নিজের সাথেও তাই করেছি। আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে আবির, মাথার ভেতরে কেমন যেন করছে। আমি চলে যাওয়ার পর বাবা খুব কষ্ট পাবে। তুমি বাবাকে সব বলে দিও প্লিজ। আর বলো আমি বাবাকে খুব ভালবাসি, খুব, ছোটমার থেকেও বেশি। তুমিও ভাল থেকো। কাল তোমার চোখে আমার প্রতি যে টান আমি দেখেছি, তা মুছে ফেলো।

মিমি বিছানায় শুয়ে পড়েছে, ওর মুখে কষ্টের একটা সূক্ষ্ম ছাপ। আবির মিমির পাশে বসে আছে। সে নড়তে পারছে না। মনে হচ্ছে কেউ তাকে বিছানার সাথে বেঁধে ফেলেছে। হঠাৎ সে উঠে দাঁড়ালো। তাকে এখনই কিছু করতে হবে, না হলে অনেক বেশি দেরি হয়ে যাবে। এখনই কিছু করতে হবে....

১০.
হাসপাতালে মিমির বাবার পাশে আবির বসে আছে। কেউ কোন কথা বলছে না। হঠাৎ মিমির বাবা আবিরকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলেন।

-- কেন এমন করলো বলত মেয়েটা। কাল কত হাসিখুশি ছিল, সেই আগের মত। আমাকে সাথে নিয়ে বসে দুপুরে খেল। আমাকে ভাত বেড়ে খাওয়ালো। রাতে বাসায় ফিরে কিছুক্ষণ আমার পাশে শুয়েছিল। বললাম, - "আজকে আমার সাথে ঘুমিয়ে যা।" কিছু বলল না। হঠাৎ উঠে নিজের ঘরে চলে গেল। ভেবেছিলাম আমার মেয়েটাকে আমি ফিরে পেয়েছি। সব আবার এলোমেলো হয়ে গেল। কেন করলো বলত...?

-- আঙ্কেল, আপনাকে কিছু কথা বলার ছিল। মিমি.....

"এক্সকিউজ মি, পেশেন্ট এখন ভাল আছেন। ওয়াশ করে সব বের করা গেছে। এখন উনি বিপদমুক্ত। আপনারা চাইলে ভেতরে যেতে পারেন, উনি অবশ্য এখন ঘুমাচ্ছেন। "

আবিরের বুক থেকে যেন একটা বিশাল পাথর নেমে গেল। মিমির বাবা এখনো কাঁদছেন। আবির কিছু বলল না। কেঁদে যদি উনার মনটা একটু হালকা হয়। হঠাৎ উনি বললেন, "যাও বাবা, ভেতরে যাও। মিমির ঘুম ভাঙলে আমাকে ডাক দিও। "

১১.
আবির মিমির বেডের সামনে বসে আছে। মিমি ঘুমাচ্ছে। হাসপাতালের অল্প আলোয় ওকে অনেক বেশি মায়াবী লাগছে। সেই মায়াভরা মুখ থেকে চোখ ফেরানো যাচ্ছে না। আবির সেই চেষ্টাও করছে না। সে ঠিক করেছে যতক্ষণ মিমি না জাগবে ততক্ষণ সে মিমির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকবে, আর মনে মনে বলবে - "মায়াবতী, তোমায় অনেক বেশি ভালবাসি"।

( সমাপ্ত )

-- মৃ


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

সচলায়তনে এটি আমার প্রথম লেখা। সকলের মূল্যবান
মতামত আশা করছি। হাসি

মৃ

অতিথি লেখক এর ছবি

নাটুকে...তবে ভালো লাগল।

আমার মনে হয় প্রথমটা আরও বেশি জমতে পারত। যে মেয়ে বেশি কথা বলে না সে চায়ের দোকানির সাথে চিনি নিয়ে কথা বলবে এ জায়গায় কেমন কেমন লেগেছে। ভেতরের মিমি বাইরে বেড়িয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কথা বলছে লেখক এটি আরো ভালভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন।

কাহিনী চমৎকার, সচলায়তনের প্রথম লেখা হিসেবে লেখককে শুভেচ্ছা।

পরবর্তী লেখার অপেক্ষায় রইলাম।

রাসিক রেজা নাহিয়েন

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

মিসির আলী ও তার স্রষ্টার প্রবল ছাপ থাকলেও লেখা ভাল লেগেছে... এমন সহজ ভাষায় সবাই লিখতে পারেনা ... আরও লিখুন... শুভেচ্ছা হাসি

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

হুমায়ুনের প্রভাব পুরোটা ফুটে এসেছে, তাই ক্লান্তিকর লেগেছে মাঝখানে এসে। এই প্রভাব থেকে সরে আসতে হলে পড়ায় বৈচিত্র‌্যতা আনতে হবে। আবিরের সাথে মিমির হুট করে কেন কথা বলতে ইচ্ছে হল? কেন তার জন্যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেছিলো? আবির কে পূর্বে না চিনে থাকলে তার জন্যে অপেক্ষা কিভাবে করে? একটা কোটিপতির মেয়ে হুট করে কাউকে চেনে না জানে না তার সাথে প্রথম দিনেই এত সহজ স্বাভাবিক থাকবে কথায়, আচরনে সেটা বাস্তবতার সাথে যায় না।

প্রথম লেখায় শুভেচ্ছা, সহজ করে গল্প বলার ক্ষমতা আপনার ভালোই আছে। আশা করবো এমন সহজ নাটকীয় গল্প থেকে বেরিয়ে আসবেন আর আমরা আপনার থেকে উৎকৃষ্ট গল্প পাবো। শুভেচ্ছা আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

মাসুদ সজীব

সাফিনাজ আরজু এর ছবি

বেশ নাটুকে, তবে ভালই লাগল। হাসি
উপরে দুইজন ইতিমধ্যে বলেছেন লিখায় হুমায়ূন আহমেদের ছাপের কথা তাই আমি আর কিছু বললাম না। কারো লিখা ভাল লাগলে তার কিছুটা ছাপ লেখায় আসতেই পারে, সেটি দোষের কিছু নয় তবে খেয়াল রাখা উচিত তাতে যেন নিজস্বতা না হারিয়ে যায়।
আশা করি পরের লিখায় আরও সুন্দর কোন গল্প পাব। ভাল থাকবেন।

__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---

আয়নামতি এর ছবি

সচলে স্বাগতম। নিশ্চয়ই আপনার লিখাটা সচল মডুদের ভালো লেগেছে তাই ছাড়া হয়েছে হাসি
প্রথম লেখার জন্য অভিনন্দন! পাপীমনে ব্যাপক প্রশ্ন আছে মৃন্ময়ী(এত মিষ্টি কেন আপনার নামটা!),
আচ্ছা মিমি যদি মায়াবতী না হতো, যদি সে হাসলে কেবলি তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে না করতো আবিরের, তবে
কী তখনো সে রাইড দিতো তাকে? পৃথিবীর সব্বাই তো আর মায়াবতী, চৌম্বুক হাসির ধারক বাহক হয় না।
এমনসব হতচ্ছাড়িদেরও নিয়েও লিখুন!

আমার চোখের সামনে ছোটমা ছটফট করতে করতে মারা যায়।

পাপী এবং কৌতুহলি মন জান্তে চায়,
ঘুমের ওষুধ খেয়ে তো লাকুম দ্বিনুকুম অবস্হা হবার কথা ছটফটের অবকাশ থাকে কী??
মন খুলে লিখুন আরো মৃন্ময়ী। শুভকামনা।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

পৃথিবীর সব্বাই তো আর মায়াবতী, চৌম্বুক হাসির ধারক বাহক হয় না।
এমনসব হতচ্ছাড়িদেরও নিয়েও লিখুন!

চলুক চলুক চলুক

ঘুমের ওষুধ খেয়ে তো লাকুম দ্বিনুকুম অবস্হা হবার কথা ছটফটের অবকাশ থাকে কী??

ক্যান মতি'দি? জীবনে ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখে ছটফট করেন নাই? বেশি হাই ডোজের ঘুমের ওষুধ খাইলে এমনই হয়, বিশ্বাস না হইলে খায়া দেখেন খাইছে

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

আয়নামতি এর ছবি

@ সাক্ষ্যি সত্যানন্দ , হেই মিয়া দুঃখস্বপ্ন দেখে ছটফট করা আর অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ খেয়ে সেরাম করা এক হলো নাকি? হ এত্ত খায় না। বেপারটা আসলেই হয় কিনা সেটা নিয়েই তো আমার কৌতুহল। তাই নিজে খাইলে তো সেটা বুঝতেই পারবো না। তারচে' এককাজ করুন আপনি খান আর কিরাম ছটফট করেন তাহা আম্রা পর্যবেক্ষণ করে কৌতুহল মিটাই দেঁতো হাসি খাইছে

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

তারচে' লন এক কাম করি... ৯০ বচ্ছর তো বাচুম না... গোলাম্রে কোনভাবে খাওয়ায় দেই শয়তানী হাসি তারপর দুইজনই দেখি... ছটফট করলে তো হইলই... যদি না করে তাইলে নাহয় ডাক্তররে ডাইকা পাকস্থলী ওয়াশ করায় দিমুনে... ব্যাটা হাসপাতালে থাকবিই যখন হাসপাতালের মত করেই থাক... তোর আরামের আমি গোলামাজম মারি রেগে টং

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

গড়াগড়ি দিয়া হাসি গড়াগড়ি দিয়া হাসি মিজান, পিষে ফ্যালো মিজান, পিষে ফ্যালো

মাসুদ সজীব

আয়নামতি এর ছবি

এত স্বার্থপর হইলে তো হবে না ভাই, গোলামের ছটফটানি ছাগুবাদে বাকি বাংলাদেশের মানুষের উপভোগের
ব্যাপার। কাজেই নিজের নিজের চিন্তা বাদ দিয়ে লাইনে আসুন। স্বার্থহীন ভাবনায় মন দিন দেঁতো হাসি

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

আইডিয়া যেহেতু আমার আর আপনার, লন পেটেন্ট কইরা ফালাই... তাপ্পর শুভদিনের টিকেট বেচুম্নে... ফিফটি-ফিফটি শেয়ার দেঁতো হাসি

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

আয়নামতি এর ছবি

জলদি করেন পেটেন্ট। দিনকাল ভালু না কিন্তু! আমার হিস্যায় একটুও কম পড়লে একটাও কিল মাটিতে পড়বে না কথাটা মাথায় রাখতে ভুলে যাবেন না পিলিইজ দেঁতো হাসি

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

মাটিতে পড়বে কোন দুঃখে? আমি আছিনা? মাটির উপরে গোলামরে বিছাই দিমুনি। শয়তানী হাসি

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

সবার ফিডব্যাক মাথায় রেখে আরও লিখুন।

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

শাব্দিক এর ছবি

সচলে স্বাগতম।
সবার মত আমার কাছেও হুমায়ুন আহমেদ ছাপটা বেশি লেগেছে, যে অংশগুলো একটু অবাস্তব মনে হয়েছে, আয়নামতি আপু আর মাসুদ সজীব মন্তব্যে বলে ফেলেছেন আগেই।
কিন্তু আপনার লেখায় একটা টান আছে, পড়তে বেশ ভাল লাগছিল। একটু ভিন্নতা আনলে অনেক ভাল লেখা পাব আপনার কাছ থেকে আশা করি। লিখতে থাকুন জোরেসোরে।

---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।

এক লহমা এর ছবি

সচলে স্বাগতম। আপনার ধৈর্য্য আছে। হাসি

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

পড়লাম আপনার মায়াবতীর গল্প।

গল্পের ক্যারাক্টার গুলোর একশন বেশি লেগেছে অর্থাৎ মিমির সাথে আবিরের পরিচয় হওয়া, তার সাথে ঘুরতে যাওয়া, দ্রুতই অতীত চারণ সব কিছুই দ্রুত ঘটেছে এমন মনে হয়েছে আমার।

যাই হোক লেখালেখির চর্চা অব্যাহত থাকুক আপনার। শুভকামনা ।

====
অপর্ণা মম্ময়

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।