'এক বাকশো বিজ্ঞান'

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ১৮/০১/২০১৪ - ৫:০৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সেই ছোট্টবেলা থেকেই শুনে আসছি যে দেশে 'সাইন্সের স্টুডেন্ট' এর সংখ্যা নাকি বাড়ছেই! কারণ 'সাইন্সে' পড়লে সব সাবজেক্টেই সুইচ করা যায়, তাই অনেক চাকরিও পাওয়া যায়!! কী আনন্দ!!! কিন্তু আনন্দটা বিষাদে পরিণত হল বড় হয়ে যখন জানতে পারলাম সংখ্যায় কিছুটা বাড়লেও বিজ্ঞানপড়ুয়াদের অনুপাত দিনদিন আসলে কমে যাচ্ছে। এরকম একটা বাস্তবতাতেই দু'হাজার বারোতে কাজ শুরু করে 'শিক্ষা দেশের জন্য'।

শিক্ষা ব্যবস্থার সব কিছু নিয়েই আমাদের মহা উৎসাহ থাকলেও ইঞ্জিনিয়ারিং এর শিক্ষার্থী হওয়ায় শুরুটা করলাম আমরা বিজ্ঞান দিয়েই। আর আমাদের পথচলার একদম শুরুতেই আমরা বুঝতে পারলাম যে আমাদের বাচ্চাদের হাতেকলমে বিজ্ঞান শেখানোর জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার একটা টুলবক্সের, যেখানে বিজ্ঞানের এক্সপেরিমেন্টগুলো পারফর্ম করার মতো যন্ত্রপাতি থাকবে এবং অতি অবশ্যই টুলবক্সটা তৈরি হতে হবে একদম সহজলভ্য জিনিসপত্র দিয়ে। সহজলভ্য জিনিসপত্র দিয়ে টুলবক্স বানানোর উদ্দেশ্য ছিল যেন বাচ্চারা আমাদের দেখানো এক্সপেরিমেন্টের ডেমোগুলো দেখে নিজেরাই বুঝতে পারে যে বিজ্ঞান শুধু ধবধবে অ্যাপ্রনে জড়িয়ে ঝক্কিঝামেলার ল্যাবের ব্যাপার নয়। বরং তারা যেন বুঝতে পারে যে একেবারে হাতের কাছেই, মায়ের রান্না ঘরে, বোনের সেলাই বাক্সে বা ভাইয়ের টেবিলের ড্রয়ারেই এমন হাজারটা উপকরণ থাকে যেগুলো দিয়ে চাইলেই হাজারটা পরীক্ষা করে ফেলা যায়! বইয়ের পড়ার পাশাপাশি তাই চারপাশের রিসোর্স নিয়ে বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের আগ্রহী করে তোলাটাও আমাদের এই টুলবক্স বানানোর একটা বেসিক উদ্দেশ্য ছিল।

গ্লাস, প্লাস্টিকের ঢাকনা, বেলুন, আলপিনের মতো জিনিস দিয়ে আমরা কাজ শুরু করি। কিছুদিনের মধ্যেই দাঁড়িয়ে যায় বিজ্ঞানের ১০-১২টা বিষয় বোঝানোর মতো সেটআপ। কাজ করতে করতে খোঁজ পাই ফ্রিডম ফাউন্ডেশানের একটা কীটবক্সের, সেখান থেকে শিখি বর্ণচাকতি, দৃষ্টিবিভ্রমসহ আরো ৮-৯টা সেটআপ বানাতে। ধীরে ধীরে আমাদের কাজ চলতে থাকে। বুড়োদের দলে যোগ দেয় একঝাঁক নতুন মুখ, 'শিক্ষা দেশের জন্য'র প্রাণ 'শিক্ষাসেবী'রা! সবার সম্মিলিত শ্রমে একে একে ক্লাস সিক্স, সেভেন, এইট, নাইন-টেনের বই থেকে খুঁজে বের করা হয় এক্সপেরিমেন্টের লিস্টি, তৈরি হয় সেগুলোর সহজলভ্য, টেকসই সেটআপ। ঢাকা ভার্সিটি আর মেডিকেলের শিক্ষার্থীরা যোগ দিলে আমাদের ইনভেন্টরিতে যুক্ত হতে শুরু করে কেমিস্ট্রি আর বায়োলজির বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষার সেটআপ, তৈরি হয় অনেকগুলো ডিসপ্লে বোর্ড। পথচলার দ্বিতীয় বছরে এসে পূর্ণতা পেতে থাকে আমাদের টুলবক্স। যুক্ত হয় গণিত আর ইলেক্ট্রনিক্স এর বিভিন্ন সেটআপও। এমনকি আমাদের ছেলেমেয়েরা বানিয়ে ফেলে জাতীয় স্মৃতিসৌধের মডেলও! স্বাধীনতা দিবসে বুয়েট আঙিনায় স্থান করে নেয় স্মৃতিসৌধের ৭১ ইঞ্চি মডেল। একটা দুইটা করে দেশের ১০টারও বেশি জেলা ঘুরে আসে আমাদের বিজ্ঞানের বাকশো।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে আমরা জানিয়েছিলাম যে আমাদের আমাদের বিজ্ঞানের বাকশো '১০০ এক্সপেরিমেন্ট' এর মাইলফলক স্পর্শ করেছে। এরপরে বিজ্ঞানের বাকশোতে যুক্ত হয়েছে আরো আরো সেটআপ, এখনও কাজ এগিয়ে চলছে পুরোদমে, ইনভেন্টরি বেড়েছে কয়েকগুণ। দুই বছর ধরে অসংখ্য ছেলেমেয়ের একটু একটু করে গড়ে তোলা 'এক বাকশো বিজ্ঞান' প্রজেক্টটা কয়েকদিনের মধ্যেই আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পন্ন হয়ে যাবে। ব্যবহারের ম্যানুয়াল তৈরির কাজও প্রায় শেষ। এখন চলছে শেষ মুহূর্তের ঘষামাজার কাজ। আশা করছি ক্লাস সিক্স থেকে ক্লাস নাইন-টেনের বিজ্ঞান বইয়ের যেকোনো এক্সপেরিমেন্টই পারফর্ম করা যাবে এই বাকশের যন্ত্রপাতি দিয়ে। সবমিলিয়ে তাই একটা খুশি-খুশি আর বেকার-বেকার অনুভূতি একইসাথে কাজ করছে আমাদের মধ্যে!

আমাদের প্রথম স্বপ্নটা ছিল আমাদের বাচ্চাদের জন্য হাতেকলমে বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য একটা সমাধান বের করা। 'এক বাকশো বিজ্ঞান' এর মধ্য দিয়ে আমরা সেটার পথে এক ধাপ এগিয়ে গেলাম। এবার আমাদের স্বপ্ন দেশের প্রতিটি প্রান্তে বাচ্চাদের হাতে এই টুলবক্স পৌঁছে দেয়া। একইসাথে আমাদের প্রচেষ্টা পুরো প্রজেক্টটাকে বাণিজ্যিকীকরণের হাত থেকে মুক্ত রেখে সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া। আমরা প্রচণ্ড আশাবাদী যে সবার সহযোগিতায়, সবার অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের এই স্বপ্নটাও পূরণ করতে পারব।

আমাদের 'এক বাকশো বিজ্ঞান' এর সুবাদে একটা বাচ্চাও যদি উপকৃত হয়, খুঁজে পায় বিজ্ঞানের অপার আনন্দের জগত, তাহলে আমাদের শ্রম সার্থকতা পাবে, আমরাও খুঁজে পাব আরো সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা।

দিনশেষে তাই কথা একটাই -
পরিবর্তন আসবেই! হাসি


মন্তব্য

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

'শিক্ষা দেশের জন্য' কি একটি এনজিও? এ বিষয়ে আরো তথ্য কোথায় পাওয়া যাবে?

তানভীর আরাফাত ধ্রুব এর ছবি

'শিক্ষা দেশের জন্য' একটা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। আমরা ভার্সিটিপড়ুয়া ক'জন ছেলেমেয়ে এটা চালাই। আমাদের একটা ওয়েবসাইট আছে, সেখানে আরেকটু ডিটেল জানতে পারবেন।

www.eshikkha.org

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

আরও ডিটেইলস জানতে পারলে ভাল লাগত।

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

তানভীর আরাফাত ধ্রুব এর ছবি

ভাইয়া, আমাদের সাইটে আরো কিছু তথ্য পাবেন। ঘুরে আসতে পারেন www.eshikkha.org

(আপনি কি শান্ত ভাইয়া?)

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

হুম আমি একজন শান্ত বটে!

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

শাব্দিক এর ছবি

অসাধারণ প্রয়াস। চলুক
এরকোন ওয়েবসাইট আছে কি? কর্ম পদ্ধতিটা আরো বিস্তারিত জানতে পারলে ভাল লাগত।

---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।

এক লহমা এর ছবি

চলুক হাততালি
৫ তারা এই চমৎকার কাজের জন্য। আরো ৫ তারা এই চমৎকার খবর এত সুন্দর ভাবে জানানোর জন্য। তারার ঘরে ৫-এর বেশী জায়গা নেই। তাই এখানেই বলে যাই।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

আমরা কিভাবে যুক্ত হতে পারি?

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

আয়নামতি এর ছবি

প্রশংসাযোগ্য একটা উদ্যোগের জন্য সাধুবাদ। আচ্ছা 'শিক্ষা দেশের জন্য' এই উদ্যোগে প্রতিবন্ধী বিশেষ করে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী
শিক্ষার্থীদের নিয়ে কিছু করার কথা ভাবছে কী? ওদের জন্যেও কিছু জায়গা হোক বাকশোর বিজ্ঞানে। শুভকামনা।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

সাফিনাজ আরজু এর ছবি

প্রথমেই আপনাকে অভিবাদন এবং সাধুবাদ জানাই, দারুন একটা কাজ করেছেন আপনারা।
সত্যি বলতে কি বিজ্ঞান আসলে কত মজার এবং এটি ঠিকমত কাজে লাগালে যে করা সম্ভব আমরা যারা বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পাশ করেছি তারাও জানিনা। চাকুরী পাবার জন্য বিজ্ঞান নিয়ে অনেকেই পড়ে কিন্তু বিজ্ঞান ভালবেসে, জানার আগ্রহ নিয়ে, নতুন আবিস্কারের নেশায় খুব আমাদের দেশে খুব কম মানুষই বিজ্ঞান পড়ে।

আগে আমার ধারনা ছিল পি, এইচ, ডি করে তারাই যারা গবেষণা করতে ভালবাসে, কিন্তু এখন আমি জানি মানুষ অর্থ উপার্জনের একটি পন্থা হিসাবেও পি, এইচ, ডি করে থাকে।

বিজ্ঞানের প্রতি সত্যিকারের ভালবাসা তৈরির এই উদ্যোগটি আসলেই প্রশংসনীয়। আমি নিজে বিজ্ঞান ভালবেসেছি যখন বিজ্ঞান নিয়ে নিজে অনুভব করেছি। আরও ছড়িয়ে যাক আপনাদের এই উদ্যোগ। যদি কোনভাবে আমরাও পাশে থাকতে পারি জানাবেন প্লিজ। ভাল হয় আপনাদের কোন ওয়েব সাইট থাকলে তাতে আপনাদের কাজ এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে মানুষ সহজেই জানতে পারবে।

ভাল থাকবেন। আমিও আশাবাদী পরিবর্তন আসবেই! আমাদের হাত ধরে। হাসি

__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক

আপনাদের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই, ছড়িয়ে পড়ুক সেই প্রচেষ্টার ফল শহর থেকে গ্রামে সবার মাঝে। আপনারা কি কি উপকরন তৈরি করেছেন, সেগুলোর ছবি দিলে ভালোলাগত দেখতে। আশা করি এটা নিয়ে আরো লেখবেন এবং ছবি কিংভা কোন ভিড়িও ক্লিপস দেবেন। শুভেচ্ছা জানবেন আর হ্যাঁ পরিবর্তন আসবেই, আমরাই তার সূচনা করে যাবো।

মাসুদ সজীব

Saiful এর ছবি

দয়া করে আপনার সাথে যোগাযোগের উপায় বলবেন কী? আমাকে ই-মেইল করুন :

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।