মূল সড়ক থেকে ৩ কিলোমিটার পায়ে হেঁটেই পৌঁছে যাওয়া যায় সিতারা(sitara) গ্রামে। জঙ্গলের মাঝ দিয়ে এগিয়ে চলা চমৎকার পিচঢালা রাস্তা। লেপ্টে থাকা ঝরা পাতায় আচ্ছাদিত পথ দেখলেই বোঝা যায় গাড়ি বেশী যাওয়া-আসা করেনা এখানে। প্রথমবার রৌদ্রকোজ্জল এক সকালে পায়ে হেঁটে গিয়েছিলাম সিতারা গ্রামে অনেকটা কৌতূহলবশত। (দিক নির্দেশনামূলক কোন তীরচিহ্ন দেখলেই আমার কৌতূহল জেগে উঠে) গোটা পাঁচেক ছিমছাম বাড়ি আর গোলাঘর দেখে আশেপাশে একটু উঁকিঝুঁকি মেরে দেখি পাখির কিচিরমিচির আর বিড়ালের মিয়াঁও ছাড়া অন্য কোন সাড়াশব্দ নেই। সবজি বাগানে দেখি হুলুস্থুল অবস্থা, সবকিছু সাজানো-গোছানো। সেই বাগানে প্রথম দেখা মিলে দাদীমার। সুপ্রভাত জানাতেই শুরু করল বকরবকর। জিজ্ঞেস করলাম এই গ্রামে কয়টি ঘর আছে। উত্তর মিলল “বাবাজী, ঘর তো আছে অনেকগুলি কিন্তু মানুষ আছে শুধু দুটি”। বৃদ্ধার ছেলে সাতসকালে কাজে চলে যায় দূরের শহরে আর ফিরে সন্ধ্যাবেলা। আক্ষেপ করে জানালো দক্ষিণ ইতালির সাগরতীরে জন্ম তাঁর, ভালোবাসার টানে উত্তর ইতালির এই পাহাড়ে থিতু হয়েছিল একদিন। স্বামী গত হবার পর থেকে সমুদ্রই দেখা হয়নি আর, তাও পেরিয়ে গেছে দুই দশক। একে একে সবাই চলে গেছে সিতারা গ্রাম ছেড়ে, শেষ নিঃশ্বাস ফেলার অপেক্ষায় স্বামীর ভিটে আঁকড়ে পড়ে আছে দাদীমা। মন খারাপ করে আবার জিজ্ঞেস করলাম তা আপনার সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী কারা? হাত দিয়ে ইশারা করে দেখাল ঐ একটু দূরে আছে আরেকটি গ্রাম। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া খাড়া পাথুরে রাস্তা পেরিয়ে আরও ৩ কিলোমিটার এগিয়ে দেখি সেই গ্রামেও একই হাল। দুটি মাত্র প্রাণী শেকড়ের টানে বসবাস করছে এখনও।
পাপালিনি(papalini)গ্রামটি তো পরিত্যাক্তই হয়ে গেছে কয়েক দশক আগে। ভূতুড়ে আবহ আর লতাগুল্মে ছেয়ে যাচ্ছে বাড়িঘর। ১৭৯৬ সালে তৈরি পাথরে গড়া কলপাড়ে এখনও সুমিষ্ট পানি পড়ছে বিরামহীন। স্বর্ণালী অতীতে এখানেও ছিল গোলাঘর, শিশুদের খেলার জন্য উঠানে ছিল হস্তনির্মিত কাঠের চরকি আর দোলনা। প্রতিবছর ১লা মে পাপালিনি পদবিধারী বংশধরেরা পিকনিক করতে আসে দলবলে। চিমনি দিয়ে ফের বেরুয় লাকড়ি পোড়ানো ধোঁয়ার কুন্ডুলি।
পাগলাটে এক বুড়োকে চিনি, শহুরে ওল্ড হোমের বিলাসিতা ছেড়ে ফিরে এসেছে আবার তাঁর বাপ-দাদার ভিটেয়। প্রতিমাসে পয়সা কিন্তু দিচ্ছে ওল্ড হোমের একাউণ্টে, হোম সার্ভিসে ঠিক মধ্যাহ্নে এসে যাচ্ছে খাবার কিন্তু থাকবে সে নিজের বাড়িতে। বর্তমানে মেচেনেরো(mecenero)গ্রামটিতে সেই বুড়ো বাদে আছে আর মাত্র পাঁচটি মানুষ। অথচ গ্রামটিকে বাঁচাতে কি করেনি এই পাগলা বুড়ো...... বরফ পড়লে মূল সড়ক পর্যন্ত ২ কিলোমিটার রাস্তা নিজেই পরিষ্কার করে দিত গ্রামের সবার জন্য। মেচেনেরো গ্রামে বসবাস করেই তুষারপাত সত্ত্বেও সবাই কাজে যেতে পারবে আর বাচ্চারা স্কুল কামাই দিবেনা এটা ভেবেই সে আনন্দ পেত। তারপরও নানা অজুহাতে একে একে চলে যাচ্ছে পরিবারগুলি। নিজের ছেলেটাও হয়ে বসেছে ঘরজামাই, নাতিপুতি নিয়ে সংসার বেঁধেছে শহরে।
আমার বন্ধুবর লুইজির গল্প সচলে করেছিলাম একবার। চিত্রশিল্পী এই মানুষটিও ঘুরে বেড়ায় প্রত্যন্ত পাহাড়ি গুচ্ছগ্রামগুলিতে। স্বল্পভাষী লুইজি রংতুলিতে এঁকে যায় এই নির্বাসিত জনপদের আনন্দ-বেদনার কাব্য। বুড়োরা আমাকে যে অতীতের গল্প শুনিয়ে যায় তাঁর সাথে মিল খুঁজে পাই পেইন্টার বাবুর ক্যানভাসে।
মুচি, কাঠুরে, গোয়ালা আর সাধারণ গ্রাম্য কৃষকের মত হারিয়ে যাওয়া পেশাজীবী এই বৃদ্ধরা যখন আর এই ধরণীতে থাকবেনা তাঁদের বংশধরেরা নামের পেছনে পদবি হিসেবে হয়ত আরও কয়েক প্রজন্ম বয়ে নিয়ে যাবে ইতিহাসের পাতা। আজও অনেকের বংশনাম(পদবি) দেখে অনুমান করা যায় তাঁর পূর্বপুরুষ কি পেশায় নিয়োজিত ছিল, কোথা থেকে এসেছে তাঁদের আদিপুরুষ। একবার এক বহুজাতিক টুরিস্ট গ্রুপের সাথে সুদূর দক্ষিণ আমেরিকার এক ছোট্ট শহর ভ্রমণকালে এক ব্রাজিলিয়ান বৃদ্ধের সাথে আলাপচারিতায় চমৎকার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। ভদ্রলোকের পেল্লিজ্জারি(pellizzari, চর্মকার) পদবি দেখে যখন বললাম আমি ইতালির যেখানে থাকি সেখানেও এই পদবির মানুষ আছে উনি জবাবে বললেন “আমি তোমার শহরে গিয়েছি আমার পূর্বপুরুষের খোঁজে। আদিপুরুষের জন্মভূমি কোরতেজানি(cortesani) গ্রামেও গিয়েছি। গির্জা বা মিউনিসিপালিটির রেজিস্ট্রি খাতা খুলে দেখি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের কিছু নেই, নাৎসিরা সব পুড়িয়ে ফেলেছে” । ইতালি ফিরে এসেই ট্র্যাকিং করতে করতে গিয়েছি সেই কোরতেজানি গ্রামে। ৮টি পরিবার এখনও আছে সেখানে, জানিনা থাকবে আর কতদিন।
‘La terra è santa’ (পবিত্র আমার এই মাটি) এই বিশ্বাসকে চিরন্তন ভেবেই শতশত বছর ধরে পাহাড়ি জনপদের মানুষেরা সফলতার সাথে তিলে তিলে গড়ে তুলেছে সভ্যতার বিভিন্ন ধাপ। শিল্পায়নের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ প্রভাবে বিলুপ্তির করাল গ্রাসে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে এই গুচ্ছগ্রামগুলির ক্ষুদ্রশিল্প আর শতবছর ধরে যাপিত জীবনধারা। স্বচক্ষে দেখেছি থেমে যেতে পাহাড়ি জলস্রোতে চালিত ময়দা পিষানোর শেষ কলটি(grinding mill)। শুনেছি একটা সময় এমন কল ছিল ২০টি। গত সপ্তাহে বাড়ির পাশের মাংসের দোকানে গিয়ে দেখি কসাই পরিবার তাঁদের শত বছরের ব্যাবসা গুটিয়ে ফেলেছে চুপিচুপি। আকালের এই দিনে একটু পয়সা বাঁচাবে বলে সবাই যাচ্ছে সুপারমার্কেটে।
কোরতেজানি গ্রামে এখনও আছে এমন পরিবার যারা প্রতিদিনের পাস্তা ঘরেই বানায়, পোষা মুরগির ডিম আর হাতে বানানো রুটিতে হয়ে যায় সকালের নাস্তা। শুয়োরের পালের হৃষ্টপুষ্ট একটি বেছে রাখে বড়দিনের উৎসবের জন্য। ক্ষেতের আঙ্গুর দিয়ে নিজেদের যেটুকু প্রয়োজন সেটুকু ওয়াইন ঘরে বসেই বানিয়ে ফেলে। তারপরও বেঁচে থাকার বাকি প্রয়োজনীয়তা মেটাতে করতে হয় চাকরি তাই জীবিকা নির্বাহের খাতিরে প্রতিদিন যেতে হয় শহরে। ভেড়ার পাল এখনও আছে কিন্তু তাঁর লোমে গরম পরিধান বুননের মানুষ আর নেই। হয়ত আর বেশীদিন বাকি নেই যেদিন মেচেনেরো গ্রামের সেই খ্যাপাটে বুড়োর মত আর কেউ বলবে না “নয়টি গরুর দুধ বেচে আর নিজের ক্ষেতের ফসল ফলিয়ে আমি দুটি সন্তানকে মানুষ করেছি। সবাই চলে গেছে যাক, আমি আমার ভিটেয় থাকব আমৃত্যু” ।
………জিপসি
মন্তব্য
৫ তারা।
"সবাই চলে যাচ্ছে শহরে একটু আরাম আয়েশে জীবনটা কাটাবে বলে। ঘড়িবাঁধা পেশায় উপার্জনটাও বেশী।" সারা পৃথিবীর কত গ্রাম-জুড়ে যে এই ছবি!
আপনি এবারে যে পেইন্টিং-এর ছবিগুলি দিয়েছেন সেগুলিও লুইজি-র-ই আঁকা, তাই না? খুব সুন্দর। আপনার তোলা ফটোগুলিও ভাল লাগল।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
আমি ড্রয়িং এর খাতায় কোনদিন পাশ মার্ক তুলতে পারিনি ……… পেইন্টিং সব লুইজির আঁকা।
শতবর্ষী কসাইয়ের দোকানটা বন্ধ দেখে মনটা খুব খারাপ হয়েছিল।(বেচারাকে দোষ দিয়ে লাভ কি? আমি নিজেও তো পয়সা বাঁচাতে গিয়েছি সুপারমার্কেটে।) বেদনাসিক্ত হৃদয় নিয়েই লিখেছি দুটি কথা, ছবি জুড়ে দিয়েছি পাহাড়ি গুচ্ছগ্রাম ব্যাপারটা বোঝার সুবিধার্থে।
………জিপসি
অসাধারণ!
.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল
ধন্যবাদ, আশা করি কিছুটা হাহাকার আপনিও শুনতে পেরেছেন।
………জিপসি
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
খালি তালি বাজালে চলবে?
………জিপসি
আইচ্ছা যান, পরের পোস্টে কান্দা আসুক আর নাই আসুক কান্দনের ইমো দিমুনে (মাটি থাবড়ায়া হাসনের লাহান মাটি থাবড়ায়া কান্দনেরও একটা ইমো দরকার)
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
পরের পোষ্ট তো দেখি বেশ ভেবে-চিন্তে লিখতে হবে দেখছি
………জিপসি
লুইজির আঁকা দেখে লাজবাব অবস্হা রে ভাই! তারে
আচ্ছা গুচ্ছগ্রামের মানুষেরা অসুস্হ হলে চিকিৎসার জন্য কোথায় যান?
সেই শহরে ছুটতে হয় নাকি আশেপাশে ডাক্তার বৈদ্যি আছে? চিন্তাই হচ্ছে কিন্তু দাদীমায়ের জন্য!
আপনার বর্ণনা বেশ লাগে। নতুন কোন কোন মুভি দেখলেন?
আমি এক মাসেই তিনবার গিয়েছি দাদীমাকে দেখতে, একবারও তাঁর ছেলেকে পাইনি। ঠিক করেছি সিতারা গ্রামে আবার যাব তুষারপাতের পর।
এইসব বিরান এলাকায় ধারে কাছে ডাক্তার নেই, অবশ্য ইমারজেন্সি ফোন দিলেই অতিসত্বর এ্যাম্বুলেন্স এসে পরে।
মুভি নিয়ে সিরিজটা আবার শুরু করতে হবে, সব মুভি নিয়ে তো আর ব্লগ লিখা যায়না। একটু ভিন্ন ধারার এবং অনালোচিত ফিল্ম নিয়ে লিখব বলেই সিরিজটা শুরু করেছিলাম।
………জিপসি
তুষারপাত কমে গেলে আবার যাবেন জেনে ভালো লাগলো ভাই। আমাদের শুভেচ্ছা দাদীমা'র জন্য।
হেই আপনি 'দ্যা হান্ট' দেখছেন নাকি? 'এম্পায়ার অফ সিলভার'? 'আণ্ডার দ্যা বোম্ব'?
দেখে থাকলে এগুলো নিয়ে রিভিউ লিখেন। প্রশ্ন কমন পড়ার মত আনন্দ নিয়ে পড়বো তা'হলে
শুভকামনা থাকলো।
আপনি নিজেই কেন রিভিউ লিখছেন না ? আপনার রিভিউ পড়ার অপেক্ষায় রইলাম।
__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---
আপনি ঠিক বলেছেন। আমরা দুজনেই একসাথে অপেক্ষায় রইলাম। আমি বরং ‘একটি লেবু বাগানের’ লড়াই নিয়ে নির্মিত চলচিত্র নিয়ে দুলাইন লেখার চেষ্টা করি।(আসিতেছে শীঘ্রই)
………জিপসি
খুব ভাল লাগল।
__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---
ধন্যবাদ
………জিপসি
নামগুলি ডাইরিতে টুকে রাখলাম, সময় করে দেখে নিব। সবচেয়ে ভাল হয় যদি আপনি একটা রিভিউ লিখে ফেলেন আমাদের জন্য। আমিও আরজু আপার মত অপেক্ষায় রইলাম।
………জিপসি
দুঃখ জাগানিয়া লেখা। আমার ঘরের পাশের গাছে বাসা বেঁধেছিল এক শালিক দম্পতি। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হওয়ার পর সারাদিন ধরে কিছুক্ষন পর পর মুখে করে এটা সেটা খাবার নিয়ে আসে ছানাদের জন্য। ছানাগুলো গোগ্রাসে খেয়ে খেয়ে বড় হয়, আর শালিক দুটির অবয়বে যেন স্পষ্ট ফুটে ওঠে তৃপ্তির অনুভূতি। আমি মুগ্ধচিত্তে অনিমেষ তাকিয়ে দেখি প্রকৃতির অপূর্ব ছলনা। আরো বড় হয়ে ছানাগুলো উড়ে যায় অন্য কোন খানে, মা বাবাও হয়ে যায় মুক্ত বিহঙ্গ। ভালবাসার বাসাটি শুধু রয়ে যায় আরো কিছুদিন, তারপর রোদে ঝড়ে বৃষ্টিতে ধীরে ধীরে ক্ষয়ে নিঃশেষ হয়ে যায়। মায়া ও মমতায় রচিত অপূর্ব সেই পীঠস্থানের আর চিহ্ণমাত্র থাকে না।
চমৎকার মন্তব্বের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। পৃথিবী নামের আমাদের এই গ্রহটা আসলেই বড্ড মায়াময়।
………জিপসি
………জিপসি
____________________________
ধন্যবাদ, প্রফেসর সাহেব
………জিপসি
লেখা পড়ে ভাল লেগেছে।শুভ কামনা রইল।( KAMRUL222)
আপনাকে ধন্যবাদ
......জিপসি
নতুন মন্তব্য করুন