মাত্র সন্ধ্যা নামছে তখন, মির্জাকে ডাক দিলো হারুন, “কি মির্জা ভাই, আজকে আসবেন নাকি তাসের আসরে?”। মির্জা তখন গ্রামের শেষ মাথায় জঙ্গলের পিছে সূর্যের ডুবে যাওয়া দেখছে। মীরহাটা ঠিক গ্রাম না এখন আর, গ্রামের সবাই নন্দিতাল টাউনে থাকে। সেটা এখান থেকে এক দিনের হাটা পথের দূরত্ব প্রায়। বছরে একটা মৌসুম একটা বিশেষ ধরনের আনারস ফলে মীরহাটায়, অন্য কোথাও এটা পাওয়া যায় না। অনেক আগে যাদের গ্রামে জমি ছিলো, তারা বছরের এই সময়টা মীরহাটা থাকে, আনারস ফলায়, মৌসুম শেষে চলেও যায়। আগে তাও মানুষজন কিছু কিছু থাকতো, ইদানিং কেউই থাকে না তেমন, এই মুহুর্তে যেমন গ্রামে কোন শিশু কিশোর নেই, মহিলা বলতে শুধু আমেনা ও তাঁর মা। এখন বর্ষা, আশে পাশে ঘোরাঘুরি করার উপায় নেই বৃষ্টির উৎপাতে। তাসের আড্ডাটাই মোটামুটি একটু বিনোদন, কিন্তু তারপরেও হারুনের প্রশ্ন শুনে মুখ বাকালো মির্জা। জিজ্ঞাসু চোখে হারুন চেয়ে আছে দেখে মির্জা জবাব দিলো, “আসবো, আর তো কোন কাজ নেই। কিন্তু নিতাইয়ের এই চুরিদারি কিন্তু আর ভাল্লাগে না”। জবাব শুনে হারুন চুপ করে রইলো কিছুক্ষণ, নিতাই মির্জার সমবয়সী, কিন্তু দুইজনের মধ্যে খাতির কম। নিতাই এমনিতে মানুষ খারাপ না, কিন্তু তাসে একটু চুরি করার স্বভাব আছে। মির্জার মেজাজ জানে হারুন, তাই আর কথা না বাড়িয়ে একটু হেসে চলে গেল।
মীরহাটা গ্রামে বাইরের কেউ আসলে একটু অবাকই হবে, গ্রামে গেলে সাধারণত যা দেখা যায়, মাঠে ঘাটে পিচ্চি ছেলেপুলেদের দস্যিপণা বা ক্ষেতে ব্যস্ত কৃষক, তেমনটা নেই মীরহাটায়। গ্রামে কোন স্কুল নেই, দোকানপাটও নেই, নেই বিদ্যুৎ। নন্দিতালে রাবার ফ্যাক্টরিতে কাজ করে গ্রামের বাসিন্দাদের অনেকে, বা আরো দূরে চলে যায়। গ্রামে যারা আনারসের আবাদ করতে আসে, তারা অবশ্য দরকার না হলে অন্য কাজ বিশেষ করে না। কমবেশি সবাই সবাইকে চিনে, জানে কার কি ভালো-মন্দ। তবে গ্রামের সবাই প্রায় একই রকম জীবনযাপন করে, তাই সামাজিক বৈষম্য বলে তেমন কিছু নাই, সবাই সমান। কেউ কারোর থেকে ছোট যেমন না, বড়ও না।
রাতের বেলা ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যেই মির্জা মণ্ডলবাড়ির দরজায় কড়া নাড়ে। মণ্ডলরা দুই পুরুষ আগেই এলাকা ছেড়ে চলে গেছে, কিন্তু বাড়িটা রয়ে গেছে। গ্রামের লোকজন এখন সন্ধ্যার পরে এসে এইখানে জড় হয়, প্রত্যেক দিন কয়েকজন মিলে আপ্যায়ন করে। মুরুব্বীরা এক রুমে বসে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে চলে যায়, পরে অপেক্ষাকৃত তরুণরা বসে তাস খেলে। মাঝেমধ্যে মদের গ্লাস, কখনো হুকা হাতবদল হয় না তা নয়, কিন্তু কম। মির্জা একটু দেরী করে এসেছে, ততক্ষণে সবাই খেলতে বসে গেছে। মির্জা গিয়ে চুপ করে নিতাই, হারুন, রহমত,মজিদদের খেলা দেখতে থাকে। খেলা বেশ জমে উঠেছে,এমন সময় লাগলো গণ্ডগোল। হারুন আর মজিদ প্রায় জিতে আসা দানে হেরে গিয়ে বললো, নিতাই চুরি করেছে। নিতাই জোর গলায় প্রতিবাদ করলো, রহমতও নিতাইয়ের সাফাই গাইলো কিন্তু হারুনরা মানতে রাজী না। মজিদ রেগে গিয়ে বললো, “নিতাই, বেশি কথা বলিস না। হিসাব তোর চাইতে কম না, বেশিই বুঝি। তোর চাইতে দুই ক্লাস বেশি পড়েছি। তাস কয়টা থাকে আর তুই কয়টা খেললি? নির্ঘাত আগের তাস তুলে খেলেছিস। চুরি ধরি না মানে এমন না যে চুরি ধরতে জানি না”। নিতাইও কম যায় না, নিতাইও লাফিয়ে উঠে বললো “চুরি করি নাই তাই লাফাচ্ছো, চুরি করলে তো বুঝবাও না। তোমার দৌড় জানা আছে”। মির্জার মতই দাড়িয়ে দাড়িয়ে খেলা দেখছিল রোকন, হারুন তার দিকে তাকিয়ে বললো “ রোকন ভাই, তুমি তো দেখেছ, নিতাই চুরি করেছে নাকি বল তুমিই”। রোকন অপ্রস্তুত হয়ে গেল, সে ঝামেলা এড়িয়ে চলা মানুষ। সে আমতা আমতা করে কিছু বলবে, তার আগেই মির্জা বলে উঠলো “আমি দেখছি। নিতাই মাঝে ইশকার খেলায় হরতন দিয়ে পরে ইশকার খেলায় ঠিকই ইশকা দিয়েছে”। নিতাই লাফিয়ে উঠে মির্জাকে কিছু বলার আগেই হারুন আর মজিদ মির্জার কথায় সায় জানালো। রহমত আর রোকন চুপ করে বসে পড়লো। নিতাই খালি একবার চোখ তুলে মির্জার দিকে তাকালো, কিছু বলতে মুখ খুলেও বন্ধ করে ফেললো। পরে হারুন আর মজিদের দিকে তাকিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বললো, “আচ্ছা, তোমাদের যদি মনেই হয় আমি চুরি করেছি, আর মির্জার কথাই তোমরা বিশ্বাস করো, আমার কিছু আর বলার নাই। খেলো তোমরা তোমাদের মত”। বলে মির্জার দিকে চোখ গরম করে একবার তাকালো শুধু, কিছু বললো না, চলে গেল। ততক্ষণে বাইরে সবুজ, হাকিম সহ আরো দুই একজন এসে জড় হয়েছে। এরা নিতাইয়ের বন্ধু, একসাথে প্রতি মাসে শিকারে বের হয় এরা আর গ্রামের মধ্যে কোন কুকর্ম হলে তার দায় অবধারিত ভাবে এদের ঘাড়ে পড়বে, কিন্তু এই গ্রামে কখনো কিছু হয় না। নিতাই কথায় পেরে উঠছে না দেখে তারা এগিয়ে আসতে চাচ্ছিলো, কিন্তু নিতাই কিছু না বলে একরকম দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল দেখে তারাও পিছু নিল। মির্জার চেহারা নির্বিকার দেখালেও সে ভিতরে ভিতরে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলো, সমস্যা নিতাই না, নিতাইয়ের বন্ধু হাকিম। হাকিম এমনিতেও মির্জাকে দেখতে পারে না, সারাক্ষণ যেন কেমন কেমন চোখে তাকায়।
নিতাই রাগের মাথায় বেশ জোরেই হাটছিলো; সবুজ, হাকিম আর পলাশ পিছে পিছে হাটছিলো। কি ভাবে মির্জা নিজেকে, অন্যেরা সবাই খারাপ, সে নিজে সাধু! তাস খেলতে বসে চুরি মির্জাও করে, কিন্তু ওরটা কেউ দেখে না। মেজাজ প্রচন্ডই খারাপ হয়েছে নিতাইয়ের। এখন কারোর সাথে কথাও বলতে ইচ্ছা করছে, পাশে থেকে হাকিম, সবুজরা কি বলছে শুনতেও ইচ্ছা করছে না। ওদের একরকম জোর করে ফেরত পাঠিয়ে দিয়ে গ্রামের শেষ মাথার দিকে হাটা দিলো নিতাই। চুপ করে বড়টিলার উপরে বসে বসে দুইটা বিড়ি খেলেই মেজাজ ঠাণ্ডা হবে তার। হাকিম, সবুজরা আর কথা না বাড়িয়ে মণ্ডলবাড়ির দিকে হাটা দিলো, নিতাইয়ের স্বভাব জানা আছে তাদের। গিয়ে দেখলো আবার খেলা শুরু হয়েছে, নিতাইয়ের জায়গায় রোকন বসেছে। মির্জাকে আসে পাশে না দেখে হাকিম জানতে চাইলো মির্জা কই, হারুন অবাক হয়ে ওদের দিকে তাকালো। হাকিম কিছু না বলে তাকিয়ে আছে দেখে হারুন বললো, “মির্জা ভাই তো নিতাই ভাই বের হয়ে যাবার একটু পরেই তোমাদের পিছে পিছে বের হয়ে গেল। আমরা তো ভাবছিলাম নিতাই ভাইয়ের সাথে কথা বলতে গেল বুঝি। তোমাদের সাথে দেখা হয়নি?”। হাকিম আর সবুজ একজন আরেকজনের দিকে তাকালো, পলাশ আর মোস্তাকও। ওরা কেউই মির্জাকে দেখেনি। কোন দিক দিয়ে কোথায় গেল ছেলেটা!
পরদিন সকালে সবুজ নিতাইকে ডাকতে গেল, নিতাইয়ের মাথা ঠাণ্ডা না হলে বড় সাধুর আখড়ায় যাবে ওকে নিয়ে। মীরহাটা গ্রামটা দুই দিকে পাহাড় দিয়ে ঘেরা, দক্ষিণপাড়া পার হয়ে বড় টিলার পাশে দিয়ে খাদ। বাকি দিক হচ্ছে রাস্তা শহরে যাবার। ডান দিকের খাড়া পাহাড় বেয়ে উপরে উঠলে বড় সাধুর আখড়া। যথেষ্ট দুর্গম পথ, সবাই যেতে পারে না। কিন্তু ডাকাডাকি করার পরেও যখন নিতাই বের হল না, একটু অবাক হয়ে জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে সবুজ দেখলো নিতাইয়ের ঘরে কেউ নেই। চিন্তিত মুখে বের হয়ে দেখলো হাকিম আসছে, হাকিমকে এই কথা জানানো হলে হাকিমও একটু বিরক্ত হল। নিতাই এর কাজ কারবারের ঠিক নাই, কি না কি করেছে কে জানে। পলাশকে কে ডেকে নিয়ে বড়টিলার দিকে যেত থাকলো ওরা, পথে জসীমদের বাড়ি পড়ে। রাতে নিতাইকে দেখেছে জানতে চাইলো সবুজ, জসীম বিরক্ত হয়ে বললো, “নিতাইয়ের খোজ রাখা ছাড়াও অন্য কাজ আছে আমার”। জসীম সবুজকে ভিতরে ভিতরে একটু অপছন্দ করে, যদিও উপর থেকে দেখে বোঝার উপায় নাই। একই সাথে মৌসুম আসলে জমি চাষে, দেখা হলে খোজখবর নেয়, কিন্তু মুখের “কি সবুজ, ভালো আছো নাকি?” মুখেও থাকে, এর ভিতরে আর যায় না। সবুজও জসীমকে দেখতে পারে না তেমন। দেখাতে চায় সে জসীমের থেকে ভালো, কর্মঠ। কিন্তু দেখানোর মাধ্যমটাই শুধু পাচ্ছে না। কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ হাটা দিলো সবাই, বড়টিলা পৌছে জোরে জোরে দুইবার নিতাইকে ডাকলো পলাশ। কোন জবাব এলো না। হাকিম ততক্ষণে বড়টিলা বেয়ে উঠতে শুরু করলো, টিলা খুব বেশি উচু না, কিন্তু ওই পাশে মোটামুটি খাদ। আসলে এটা টিলা না, পাহাড়ের একটা অংশ। ওইখানেও না পেয়ে চিন্তিত মুখে নেমে আসলো হাকিম। আস্তে আস্তে বেলা বাড়লো যখন, গ্রামের মানুষজনকে জিজ্ঞেস করা হলে কেউই নিতাইয়ের খবর দিতে পারলো না। মির্জাকে জিজ্ঞেস করা হলে মির্জা জানালো সে সোজা বাসা চলে এসেছে, নিতাইয়ের সাথে তার কথা হয়নি। সন্ধ্যার সময়ও যখন নিতাইয়ের খবর পাওয়া গেল না, হাকিম একটু বিচলিত হয়ে পড়লো। নন্দীতালের দিকে যাবে ভাবলো, কিন্তু রাত হয়ে আসছিলো আর বৃষ্টি শুরু হল মুষলধারে। ওইদিন রাতে মণ্ডলবাড়ির আড্ডা জমলো না। নিতাইয়ের কাজে এক দুইজন মুরুব্বী বেশ ক্ষুদ্ধ, এইভাবে না বলে কয়ে গায়েব হয়ে যাওয়াতে। ওইদিন সবার মধ্যে কেমন জানি একটু অস্বস্তি। পাহাড়ের ভেতর ছোট্ট মীরহাটা গ্রাম, যেইখানে সবাই সবার কথা জানে, কে কখন কোথায় যায় কেউ না কেউ জানে, ওইখানে নিতাইয়ের এইভাবে গায়েব হয়ে যাওয়াটা একটু অস্বাভাবিকই।
পরের দিন বৃষ্টির মধ্যেই গ্রামের আশে পাশে নিতাইকে খোজা হল, হাকিম বৃষ্টির মধ্যেই পাহাড় বেয়ে উঠে বড় সাধুর আখড়ায় গিয়ে নিতাইয়ের খোজ করলো। নিতাইয়ের কথা কেউ বলতে পারলো না। সন্ধ্যার সময়ও যখন নিতাইয়ের খোজ পাওয়া গেল না, এবার সবাই একটু চিন্তিত হয়ে পড়লো। পরদিন সকালে রহমত আর মোস্তাক গেল নন্দীতালের দিকে। অন্যরা কেউ গ্রামের উত্তর মাথায় জঙ্গলে আর হাকিম, সবুজ ওরা বড় টিলার ওই পাড়ে দেখতে পাকদণ্ডী বেয়ে নিচে নামলো। এইখানেই দুপুরের দিকে নিতাইয়ের লাশ পাওয়া গেল। মাথাটা থেতলে গিয়েছে, খুব সম্ভবত টিলা থেকে পিছলে পড়ে গিয়ে পাহাড়ে ঢালে কিছুর সাথে বাড়ি খেয়ে। ঢালের মধ্যে শেয়াল বা অন্য প্রাণী আসে না তেমন, কিন্তু লাশ পিপড়া ঘিরে ফেলেছে, পরনের লাল জামাটা না থাকলে খুজেও পাওয়া যেত না। লাশ একটু ফুলে উঠেছে, গন্ধ ছড়াচ্ছে। দড়ি এনে বেঁধে লাশ উপরে তোলা হল, গ্রামের অল্প যে কয়জন মানুষ ছিলো সবাই ছুটে আসলো। মুরুব্বীরা নিজেদের মধ্যে কিছুক্ষণ কথা বলে লাশটা কোন রকমে গোসল দিয়ে কবর দিয়ে দিল কারণ বৃষ্টির জন্য রাস্তা বন্ধ, নন্দীতালে যেতে গিয়ে রহমত আর মোস্তাক ফিরে এসেছে। আর এইখানে থানা পুলিশ করার কিছু নেই, বুঝাই যাচ্ছে পা পিছলে টিলা থেকে পড়ে গিয়েছিল নিতাই, বৃষ্টির মধ্যে রাতের বেলা খামোখা কেন যে ছেলেটা টিলায় চড়তে গেল।
মির্জা গুম হয়ে তার ঘরে বসে আছে, গত দুই দিন ধরেই সে দেখতে পাচ্ছে যে হাকিম তার দিকে কিভাবে যেন তাকায়। গতকাল রাত্রে যখন গ্রামের উত্তর কোণায় নিতাইকে কবর দিয়ে ফেরত আসছিলো সবাই, হাকিমের চোখের হিংস্র দৃষ্টিটা মির্জার মনে গেথে গিয়েছিলো। আর কেউ খেয়াল না করলেও, মির্জা খেয়াল করেছে কারণ হাকিম তার দিকেই ওই হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। হাকিমের ওই চোখের ভাষা পড়তে একটুও কষ্ট পেতে হয়নি মির্জার, হাকিমকে সে চিনে। মির্জা বুঝে ফেলেছে নিতাইয়ের মরার জন্য তাকে দায়ী ভাবছে হাকিম, নিতাইকে কবর দিতেও সে আপত্তি তুলেছিল। কিন্তু শহরে যাওয়া সম্ভব না এখন, থানা-পুলিশ করতে করতে লাশ রাখা যাবে না, তাই তার আপত্তি টেকেনি। মির্জা একটু ভয় পেয়েছে, বাড়ি ফেরার পরে সারাক্ষণ তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো হাকিমের চিন্তা। হাকিম কি কিছু করবে? কিছু বলবে ওকে? অন্যদের বোঝানোর চেষ্টা করবে? যতই চিন্তা করতে থাকলো, মির্জার মাথায় ততই এই ধারণা বদ্ধমূল হতে থাকলো যে হাকিম কিছু না কিছু একটা করবেই। হয়তো তার ক্ষতি করতে চাইবে, নয়তো কূকথা ছড়াবে। সারাদিন এই চিন্তাই করতে থাকলো সে, সন্ধ্যায় চিন্তিত মুখে মণ্ডলবাড়ি গেল, ওইখানেও গুমোট আবহাওয়া। কেউ তেমন একটা কথা বলছে না, তবে হাকিম নেই। রাস্তাঘাট এর কি অবস্থা জানতে খোজ নিয়ে মির্জা জানতে পারলো যে রাস্তা এখনো বন্ধ হয়ে আছে, পাহাড় ধ্বসে গিয়ে রাস্তার একটা অংশ ঢাকা পড়ে আছে, যেতে হলে ওটা পার হতে হবে, যেটা এই বৃষ্টির মধ্যে করা প্রায় দুঃসাধ্য। চিন্তিত মুখে বাসায় ফিরছিলো মির্জা, মীরহাটা গ্রামে মানুষ কম থাকলেও বাসাবাড়ি বেশ দূরে দূরে। এক পাড়া থেকে আরেক পাড়া একটু দূরেই বলা যায়। পাহাড়ের উপর এমন জায়গা বেছেই তাদের আদিপুরুষ এইখানে গ্রামের পত্তন করেছিল। নিজের পাড়ার কাছাকাছি চলে এসেছে মির্জা, এমন সময় রাস্তার পাশের বটগাছ থেকে একজন মির্জাকে ডাকলো। ডাক শুনে থামতে থামতেই গলার মালিককে চিনতে পারলো মির্জা, ওটা হাকিম দাঁড়িয়ে আছে। শরীরটা একটু শিরশির করে উঠলো মির্জার, হাকিমের বাসা এই পাড়ায় না, উত্তরপাড়ায়। সে এইখানে কি করছে? চিন্তা করার বেশি সময় পেল না, হাকিম এগিয়ে আসতে আসতে তার ডান হাতের কাছে কি যেন চাদের আলোয় ঝিলিক দিয়ে উঠলো। মির্জার মাথার ভিতরে যেন কেউ একজন চিৎকার দিয়ে বললো, “ওইটা ছুরি! হাকিম আমাকে মারতে চায়, এইজন্যেই কি এই সময়ে সে এই জায়গায় ওঁত পেতেছিলো?”। মির্জার মধ্যে হঠাৎ যেন একটা বুনো ক্রোধ জেগে উঠলো, কোন পূর্বলক্ষণ ছাড়াই সে হাকিমের উপর ঝাপিয়ে পড়লো। হাকিম এরজন্যে প্রস্তুত ছিলো না, হঠাৎ মির্জা তার উপর ঝাপিয়ে পড়ায় সে সরে পড়ার সময়ও পেল না, মির্জার ধাক্কায় মাটিতে পড়ে গেল। চিৎকার করে মির্জাকে থামতে বলার চেষ্টা করলো সে, কিন্তু মির্জার হাটু তার গলার উপরে পড়ায় সে আওয়াজ করতে পারলো না। আত্মরক্ষার জন্যে সে মির্জাকে ঠেলে সরানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু তার আগেই মির্জার হাত একটা মোটামুটি বড় পাথরে পড়েছে। মুহুর্তের মধ্যে কিছু চিন্তা না করেই মির্জা পাথরটা তুলে হাকিমের মাথায় বাড়ি মারলো। হাকিমের গলা দিয়ে আর্তচিৎকার বের হতে হতেও হলো না, মির্জা তখনো হাকিমের গলায় হাটু দিয়ে ভর দিয়ে রেখেছে। এইদিকে ছিলকে ওঠা আঠালো একটু তরল মির্জার মুখে লাগতে সে তার অবশিষ্ট কাণ্ডজ্ঞানও হারালো, পাথরটা দিয়ে সে বার বার হাকিমের মাথায় আঘাত করতে থাকলো। যতক্ষণে তার হুশ হলো, হাকিমের দেহ নিথর হয়ে এসেছে। চাদের আলোয় নিজের হাতে-মুখে লেগে থাকা রক্ত দেখে প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেল মির্জা, আর তার মাথায় ঢুকলো যে সে কি করে ফেলেছে।
হাকিমের মৃতদেহের থেকে লাফিয়ে দূরে সরে গেল মির্জা। তার বারবার মনে হচ্ছিল বাসায় দৌড়ে পালিয়ে যেতে, এবং কিছু না বুঝে সে তাই করলো। কিছুদূর আসার পরে তার খেয়াল হলো যে সে এখনো রক্তমাখা পাথরটা হাতেই নিয়ে ঘুরছে, পাথরটা এক দিকে ছুড়ে ফেলে সে বাসায় দৌড় দিলো। পথে হারুনদের বাসা, হারুনদের ডাকতে গিয়েও সে কি মনে করে থেমে গেল। মির্জার মাথা আস্তে আস্তে ঠাণ্ডা হয়ে আসলো, অন্ধকার রাতে কেউ ঘটনাটা দেখেনি, আওয়াজও হয়নি কোন। তার দিকে আঙুল তোলার কেউ নেই, তার কি দরকার কিছু করার। দোষ হাকিমের, সে তাকে মারতে এসেছিল। সে তো কেবল নিজেকে বাচানোর চেষ্টা করছিলো। তার তো কোন দোষ নেই, মনে হল মির্জার; সব দোষ হাকিমের। হাকিম তার দিকে কেমন কেমন করে তাকাচ্ছিলো বারবার, তারপরে এতো রাতে ওর জন্যে ওঁত পেতেছিলো, নিশ্চয়ই হাকিমের কোন কুমতলব ছিলো। সে তো কেবল নিজের জীবন বাচানোর চেষ্টা করেছে, তার কেন দোষ হবে, এই ভেবে নিজেকে শান্ত করলো মির্জা। তারপরে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করলো, রাতে যে মির্জা বাইরে আছে এখনো, কেউ জানে না। তার বাবা অনেক আগেই বাসায় চলে গিয়েছে, সেও মণ্ডলবাড়ি থেকে বের হয়েছে বেশিক্ষণ হয়নি। এখন দেরী না করে বাসায় চলে গেলেই ভালো, এই ভেবে একেবারে নিঃশব্দে হারুনের বাসা থেকে সরে গেল মির্জা। কোন আওয়াজ না করে নিজের বাসার পিছনে চলে এল সে, এইখানে একটা গামলা রাখা ছিলো, সারা দিন বৃষ্টির পানি এতে জমা হয়েছে। খুব সাবধানে, আওয়াজ না করে হাত মুখ থেকে রক্ত ধুয়ে নিলো মির্জা। ভাগ্যের কি সহায়, তার পরনে কালো জামা কাপড় ছিলো, রক্ত লাগলেও পরিষ্কার বোঝা যাবে না। যতটা সম্ভব কাপড়টা ধুয়ে নিলো মির্জা অন্ধকারেই। তার বাবা ঘুমিয়ে পড়েছে, তারপরেও কোন শব্দ করলো না মির্জা। গামলার পানিটা বাড়ির পাশে জংলা জায়গায় ফেলে দিলো মির্জা, অনেকক্ষণ ধরিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে। যা রক্ত আছে তাও সকাল নাগাদ ধুয়ে যাবে। চুপচাপ বাড়ির মধ্যে ঢুকে শুয়ে পড়লো মির্জা, পরপর দ্বিতীয় রাত নির্ঘুম কাটলো তার।
পরের দিন খুব সকালেই রোকনের চিৎকারে মধ্যপাড়ার মানুষের ঘুম ভেঙে গেল, ছুটে এসে হাকিমের থেতলানো মাথা দেখে দ্বিতীয়বারের মত শিউরে উঠলো মীরহাটা গ্রামের মানুষজন। নিতাইয়ের মত এটা দুর্ঘটনা না, এটা পরিষ্কার খুন। এবং খুনি তাদেরই কেউ। নিতাইয়ের দুর্ঘটনাও অনেকের কাছে আর “দুর্ঘটনা” মনে হল না তখন। এইবার থানা পুলিশ ডাকতেই হবে। অনেকক্ষণ কথাবার্তার পরে জুলহাস এবং শরীফ নামের দুই লোককে পাঠানো হল নন্দীতাল গিয়ে পুলিশে খবর দিতে। জুলহাস আর শরীফ পাহাড় বাওয়ার কাজে মীরহাটার সেরা। এরা না পারলে কেউ নন্দীতাল যেতে পারবে না।
সারা গ্রামের মানুষ জড় হয়েছিল মধ্যপাড়ায়। সবার মাথায় একই চিন্তা, কে খুনি হতে পারে? গ্রামের সবাই সবাইকে কমবেশি জানে, তাই কেউ নিশ্চিত হয়ে কারোর দিকে আঙুল তুলতে পারছে না। কিন্তু সবাই ভাবছে, আমি ছাড়া সবাই খুনী হতে পারে। রহমত কথা বলতে বলতে আশে পাশে তাকাচ্ছিল, সবুজের চোখ খুজছিল মির্জাকে। এরমধ্যে গ্রামের সবচেয়ে বয়স্ক লোক রতন মোল্লা আস্তে করে একবার বললো, “হয়তো বাইরের কেউ এসে কাজটা করেছে। বড় সাধুর আস্তানা থেকেও তো কেউ আসতে পারে”। রতন মোল্লার কথাটা কেউ উড়িয়ে দিলো না। কিন্তু তারপরেও সবাই চোরা চোখে একজন আরেকজনের দিকে খেয়াল করতে থাকলো। এক অজানা আতংক হঠাৎ যেন গ্রামটাকে গ্রাস করে নিয়েছে। রহমতের মাথায় আসলো, নিতাইয়ের সাথে খেলা নিয়ে প্রায়ই গণ্ডগোল হত হারুনের। সে কাল মণ্ডলবাড়ি যায়নি, হাকিমও যায়নি। হারুন এমনিতে হাসিখুশি ভাব দেখালেও নিতাইয়ের উপর শোধ নিতে সেই নিতাই কে ঠেলে ফেলে দেয়নি তো পরে রাতে একসময়? পরে হাকিম টের পেয়ে যায় দেখে হাকিমকেও মেরে ফেলেনি তো? হারুনকে চোরা চোখে এদিক ওদিক তাকাতে দেখে সন্দেহ গাড় হল রহমতের। হারুনের মাথায় তখন অন্য চিন্তা, সে জানে যে মোস্তাকের কাছে টাকা পায় নিতাই। মোস্তাক বন্ধু মানুষ দেখে টাকার কথা তেমন তোলে না, কিন্তু ভিতরে ভিতরে কি কিছু হচ্ছিল? হয়তো হাকিম সেটা জানে, তাই হাকিমকেও মরতে হল। মোস্তাককে পছন্দ না হারুনের। তার মনে হল এই গ্রামে এমন কেউ করতে পারলে মোস্তাকই পারে। সবুজ তখন চুপ করে হাকিমের কাপড়ে মোড়ানে লাশের পাশে বসে আছে। তার মাথা ভালো মত কাজ করছে না, উদ্ভ্রান্তের মত চারপাশে তাকাচ্ছে সে। এর মধ্যে তার চোখ আটকে গেল তার প্রতিবেশি আমেনার দিকে। মেয়েটা কেমন হাসি হাসি মুখ করে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। সবুজ জানে হাকিম আমেনাকে পছন্দ করতো, কিন্তু আমেনা পছন্দ করে আবার রহমতের প্রতিবেশি রতন মোল্লার ছেলে কাওসার মোল্লাকে। কাওসার মোল্লা একেবারে চুপচাপ ছেলে, কারোর সাথে মেশে না। কিন্তু ওকে দেখলে কেন জানি সাপের কথা মনে হয় সবুজের। কাওসারের নির্বিকার চেহারার দিকে পলকহীন ভাবে তাকিয়ে রইলো সবুজ। যেন চোখ দিয়ে কাওসারের মাথার ভিতরে ঢুকে দেখতে চায় ওইখানে একটা খুনি বসে বসে মিটিমিটি হাসছে কিনা।
সবার থেকে একটু দূরে দাড়িয়ে আছে মির্জা, পাশে তার বাবা। কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করছে মির্জা যেন তার বাবা তার বুকের ধড়াস ধড়াস আওয়াজ শুনতে না পায়। কারোর দিকে তাকাতে পারছে না মির্জা। যার দিকেই তাকায়, তারই চাউনি দেখে মির্জার মনে হয় যে সে তার গোপন সত্যটা বুঝে ফেলেছে। সবার চেহারায় একটা নীরব তিরষ্কার দেখতে পাচ্ছে মির্জা। যেন সবাই ওকে বুঝিয়ে দিচ্ছে যে ওরা সবাই জানে কাজটা মির্জাই করেছে, খালি পুলিশ আসতে যা দেরী। সবুজের নিষ্পলক চাউনি, রহমতের তীর্যক দৃষ্টি, লোকমানের চোখ বড় বড় করে তাকানো সবই তার কাছে ইঙ্গিতপূর্ণ মনে হয়। তার কাছে অবাক লেগেছে, লাশের সাথে কোন ছুরি, ভোজালি বা এমন কিছু পাওয়া যায়নি। সে কি তাহলে ভুল দেখছিল রাতে? পাশে দাঁড়ানো বাবার কথায় সম্বিৎ ফিরে পেল মির্জা। “কি বললে?” জানতে চাইলো মির্জা। “ তৈয়বদের কাজ”, দূরে দাঁড়ানো তৈয়ব আলী আর আর তার ছেলে আতর আলীর দিকে ইশারা করলো মির্জার বাবা। “ওদের চাষের জমিটা নিতাই আর হাকিমের মাঝামাঝি। নিতাই একলাই থাকে আর হাকিমের বাপের সাথে তৈয়ব আলীর অনেক আগে একবার লেগেছিল। তখন তোদের জন্ম হয়েছে মাত্র। তৈয়ব খুব হারামি লোক। একমাত্র ওই পারে এই গ্রামে এইসব করতে”। মুখ বাকাল মির্জার বাবা। মির্জা যদি মাথা ঠাণ্ডা করে খেয়াল করতো, সে দেখতো যে সবাই যাকে সে সবচেয়ে অপছন্দ করে, তাকেই সম্ভাব্য খুনির তালিকায় প্রথমে রাখছে। একজন একজন করে সবাই চলে যেতে থাকলো। সবাই নিজেদের মধ্যে মাথা নিচু করে কথা বলতে বলতে যাচ্ছে। সবাই নিজেদের নিজেদের চিন্তা নিয়ে ব্যস্ত, তাই কেউ জিনিষটা খেয়াল করলো না, আরেকটু মাথা ঠাণ্ডা থাকলে মির্জা খেয়াল করতে পারতো। গ্রামের প্রত্যেকটা মানুষের চোখে এখন সন্দেহ। একই পরিবেশ, একই রকম জীবন যাপন এবং একই লক্ষ্যের ছকে বন্দী গ্রামের মানুষগুলি এতোদিন যাদেরকে খুব ভালো করে চিনতো, তাদের যেন আজ নতুন করে চিনছে। অবিশ্বাসের বীজ সবার মধ্যে দানা বাধছে। ভয়ের মত সংক্রামক জিনিষ কমই আছে, আর মানুষ সবচেয়ে বেশি ভয় পায় অজানাকে। অজানা শঙ্কাটা দাবানলের মধ্যে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে, এবং আস্তে আস্তে উন্মোচিত হচ্ছে মীরহাটা গ্রামের আপাত বন্ধুবর মানুষগুলোর এক অচেনা রূপ। সবার তাকানো, চলাফেরা, কথার ভঙ্গীর আলাদা তাৎপর্য ধরা দিচ্ছে সবার কাছে।
সবাই চলে গেলেও সবুজ বসে আছে। মির্জা কি মনে করে এগিয়ে গেল, সবুজকে লাশটা চটে মুড়িয়ে সরিয়ে রাখার জন্য সাহায্য করলো। আসার পথে কথাচ্ছলে মির্জা জানতে চাইলো, “সবুজ, তোর মনে হয় কাজটা কে করেছে?”।“তুই নিজেও তো হতে পারিস”, অন্য সময় হলে বলতো সবুজ, কিন্তু এখন তার মাথা কাজ করছে না। দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করলো মির্জা, বেশ শান্ত ভাব বজায় রেখেছে সে, কিন্তু ভিতরে ভিতরে ঘামছে। ভাবছে কি দরকার ছিলো এতো সাহস দেখানোর। “কাওসার....কি জানি কে, মাথায় কিছু আসছে না”, উত্তর দিলো সবুজ। কথাটা মাটিতে পড়তে দিলো না মির্জা, দায়টা কাল্পনিকভাবে হলেও সে অন্যের উপর চাপাতে উদগ্রীব এখন। “হ্যা হ্যা, এই ছেলেটাকে আমার কোনদিন পছন্দ হয়নি। কেমন যেন, আর কিরকম করে তাকায় মানুষের দিকে। আর আমেনার কাহিনী তো আছেই”, বেশ উৎসাহ নিয়ে বললো মির্জা। অন্যসময় হলে এই কথাটা তেমন গুরুত্ব রাখতো না, কিন্তু সবুজ তখন নিজের মধ্যে ছিলো না। নিজের চিন্তাটা অন্যের ভাষায় শুনে তার চিন্তাটা আরেকটু পোক্ত হল কেবল।
দূপুর গড়িয়ে বিকেল হল। জুলহাস আর শরীফের কোন খবর নেই। হাকিমের লাশটা আপাতত মণ্ডলবাড়িতে চটে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে, লাশের উপর একটু লবণ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে যেন পচন একটু দেরীতে ধরে। মণ্ডলবাড়িতে কোন কারণে আজকে সন্ধ্যায় মনে হয় না কেউ যাবে, লাশের সাথে এক ঘরে কেউ থাকতে চায় না অনেকেই, সবুজ আর পলাশ ঠিক করেছিল তারা বন্ধুর লাশ পাহারা দিবে। সবুজ ঘরের দাওয়ায় বসে অপেক্ষা করছিলো, তখন সবুজের চোখ গেল পাশের বাসায় কাওসার মোল্লার দিকে। হেসে হেসে আমেনার সাথে কথা বলছে সে। এতো বেলা হয়েছে, তাও এই বাড়িতে কি করে বেশরম ছেলেটা। একটু ধমক দিতে এগিয়ে যায় সে, তখন শুনতে পায় কাওসার আমেনাকে বলছে, “....আর কোন বাধা নেই”। কথাটা শুনে জায়গাতেই জমে গেল সবুজ, কাওসার আর আমেনা কথা বলতে বলতে ভিতরে চলে গেল। সবুজের মাথার মধ্যে শুধু ঘুরপাক খেতে লাগলো কাওসারের কথাটুকু, “....আর কোন বাধা নেই। ....আর কোন বাধা নেই”। কিসের বাধার কথা বলছিলো কাওসার? হাকিম?! তাহলে কি তার চিন্তাই ঠিক ছিলো, আমেনাকে পাওয়ার মধ্যে হাকিম যেন বাধা হয়ে দাড়াতে না পারে, এইজন্যে কাওসারই হাকিমকে মেরে ফেলেছে? হঠাৎ করে যেন চিন্তার সুতো ছিড়ে গেল সবুজের। আমেনাদের বাসা থেকে কাওসার বের হচ্ছে। কাওসারের পিঠে একটা বন্দুক ঝোলানো। মাঝেমধ্যে গ্রামে বাঘডাশ আসে, আর অবসরে আরো দূরের গ্রামের খুমি উপজাতিদের সাথে মিলে শিকার করতে বের যাওয়া, এই কারণে গ্রামের প্রায় বাড়িতেই একটা বন্দুক থাকে, বেশিভাগই যুদ্ধের সময় পাক বাহিনীর ফেলে যাওয়া অস্ত্র থেকে যোগাড় করা। কিন্তু কাওসার কোনদিন শিকারেও যায় না, আর এই সময় গ্রামে বাঘডাশ আসে না। তাহলে কাওসারের ঘাড়ে বন্দুক কেন? চিন্তার মধ্যেই কোন সময় ঘরে ঢুকে নিজের বন্দুকটা হাতে নিয়ে বের হয়ে গিয়েছে, সবুজ নিজেও টের পায় না। একটা ঘোরের মধ্যে সবুজ দেখতে পায় কাওসার মোল্লা কি যেন বলতে বলতে তার বাড়ির আঙিনায় ঢুকছে, ঢুকতে ঢুকতে কাধ থেকে বন্দুকটা হাতে নিলো কাওসার, সাথে সাথে নিজের বন্দুক তুলে তাকে গুলি করলো সবুজ।
নিজের বাড়িতে বসেছিল জসীম, মা ঘরের ভিতরে, কাজে ব্যস্ত। বাবার সাথে কথা বলছিল জসীম, এমন সময় গুলির শব্দ শুনতে পায় জসীম। নিস্তব্ধ মীরহাটা গ্রামকে যেন ভয়ংকর একটা ঝাকুনি দিয়ে গেল গুলির আওয়াজ। গুলির আওয়াজের প্রতিধ্বনি হয় চারপাশের পাহাড়ে। পরিধ্বনি মিলিয়ে যাবার আগেই মেয়েকন্ঠের চিল-চিৎকার শোনা গেল, “কাওসার, ওমাগো....কাওসার”। চিৎকার কানে যেতেই জসীম দৌড়ে গিয়ে তার বাবার গাদা বন্দুকটা নিয়ে দৌড়ে বের হল।তার পাশে দিয়ে পাশের বাড়ির আইয়ুবও বের হয়েছে, আইয়ুব শরীফের ভাই। আওয়াজ এসেছে আমেনাদের বাড়ির দিক থেকে, ওইদিকেই দৌড়ে যাচ্ছিল তারা; কিন্তু জসীমের চোখে পড়লো সবুজদের বাড়ির দরজা থেকে সবুজ বের হচ্ছে, হাতে সবুজের দোনলা বন্দুক। জসীমকে বন্দুক হাতে দৌড়ে আসতে দেখেই কিনা, তার দিকে বন্দুক তাক করে গুলি চালিয়ে বসলো সবুজ। হয়তো ঠিক ধাতস্থ হয়ে উঠেনি বা হাত কেপে গিয়েছিলো, গুলিটা জসীমের গায়ে না লেগে লাগে আইয়ুবের গায়ে। সাথে সাথে মাটিতে ঢলে পড়লো আইয়ুব। সবুজকে বন্দুকে গুলি ভরার কোন সুযোগ না দিয়েই গুলি চালাল জসীম। সবুজ মাটিতে ঢলে পড়লো।
বেশ একটু দূরে থাকতেই গুলির শব্দ শুনতে পায় পলাশ। অবাক হয়ে দাড়িয়ে যায় সে, গুলির আওয়াজের পরপরই নারীকন্ঠের চিৎকারে পলাশের হুশ হয়, আওয়াজ সবুজের বাসা থেকে এসেছে। সাথে সাথে দৌড় দেয় পলাশ। সবুজের বাসায় কাছাকাছি পৌছাতে পৌছাতে পরপর দুইটা গুলির শব্দ আসে, দৌড়ের গতি বাড়িয়ে দেয় পলাশ। সবুজের বাসার কাছে পৌছে দেখে জসীম কার যেন দেহের সামনে বসে আছে। একটু দূরে আরেকটা আর সবুজের বাসার ভিতরে আরেকটা দেহ পড়ে আছে। কেউ নড়ছে না, আর জসীমের সামনে পড়ে থাকা দেহটা সবুজের। সবুজকে চেনামাত্র থমকে দাঁড়ায় পলাশ। আস্তে আস্তে হেটে সবুজের সামনে গিয়ে বসে পড়ে, তাকিয়েই বুঝতে পারে সবুজ আর নেই। জসীম ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে, আশেপাশে থেকে মানুষজন এগিয়ে আসছে, জসীম এগিয়ে যেয়ে আমেনার মায়ের সাথে কথা বলতে চায়। কিন্তু এরমধ্যেই পলাশ উঠে দাঁড়ায়, চোখের সামনে বন্ধুর মৃতদেহ দেখে এবং জসীমের হাতে বন্দুক দেখে নিজের মত করে দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে নেয় সে। কাওসারের মৃতদেহ দেখে আমেনা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে, আমেনার মা হতবিম্বের মত তাকিয়ে আছে। এরমধ্যেই পলাশ সবুজের বন্দুকটা তুলে সজোরে ঘুরিয়ে জসীমের মাথায় বসিয়ে দেয়। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়ে আমেনার মায়ের মুখে লাগে, ৫ মিনিটের ব্যবধানে দ্বিতীয়বারের মত দক্ষিণপাড়া প্রকম্পিত হয় এক নারীর তীব্র চিৎকারে।
দক্ষিণপাড়া থেকে ভেসে আসা গুলির আওয়াজ পাহাড়ের আনাচে কানাচে প্রকম্পিত হয়ে মধ্যপাড়াতেও এসে পড়ে। প্রথম গুলির আওয়াজ কানে আসার পরে সবাই অবাক হয়ে দাড়িয়ে যায়, কান পেতে শোনার একটু পরেই আরো দুইটি গুলির আওয়াজ যখন ভেসে আসে, সবাই বুঝে যাচ্ছে কিছু একটা ঘটতে চলেছে। অন্য যে কোন সাধারণ দিন হলে গ্রামের মানুষজন সাথে সাথে ছুটে যেত দেখতে যে কি হচ্ছে, কিন্তু আজকের দিনটি কোন সাধারণ দিন নয়। গত তিন দিনে এই গ্রামের দুই যুবক রহস্যজনকভাবে মারা গেছে, এবং গ্রামের সবাই একজন আরেকজনকে সন্দেহ করছে। এমন অবস্থায় গুলির আওয়াজ ভেসে আসায় মধ্যপাড়া আর উত্তরপাড়ার লোকজনের বীনার টানাতারের মত স্নায়ুতে যেন ধ্বংস রাগীনির কম্পন উঠে । সবাই আস্তে আস্তে যার যার ঘর থেকে বের হয়, কিন্তু কেউ নিরস্ত্র না। মির্জার হাতে তার বাবার বন্দুক, হারুনের হাতে দা, উত্তরপাড়া থেকে সতর্ক পায়ে রহমত আর মজিদকে হেটে আসতে দেখা যায়, তাদের হাতেও বন্দুক। বন্দুকগুলো বেশিভাগই সাবেকি আমলের, একবার কাজ হয় তো পরের বার হয় না, কিন্তু পাহাড়ঘেরা মীরহাটা গ্রামে এই মুহুর্তে লুকানোর জায়গা বলতে নেই, আর অল্প দূরত্বে এই বন্দুকও অনেক কার্যকর, সবাই তা জানে। আস্তে আস্তে লোকজন জড় হলে সবাই কোন কথা না বলে দ্রুত পায়ে দক্ষিণপাড়ার দিকে রওনা হয়, সবার পিছনে মির্জা। তার মাথা কাজ করছে না, সে যতই বোঝার চেষ্টা করে ততই তার মাথা গুলিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু একবার রক্তের দেখা সে পেয়েছে, সুতরাং দ্রুত মাথা ঠাণ্ডা রেখে সে চিন্তা করে কিভাবে এই নতুন পরিস্থিতিটা সে নিজের অপরাধ ঢাকার জন্য ব্যবহার করতে পারে।
দক্ষিনপাড়ায় ঢুকে সবুজদের বাড়ির কাছে এসে সবাই থমকে দাঁড়ায়। সামনে পড়ে থাকা লাশগুলোর দিকে একবার, মাটিতে লুটিয়ে থাকা আমেনা আর পাশে নিথর বসে থাকা আমেনার মার দিকে একবার আর চেহারায় রক্তের ছাপ আর হাতে একটা বন্দুক নিয়ে দাড়িয়ে থাকা পলাশের দিকে একবার করে তাকায়। পলাশ পাগলের মত কাওসারের পাশ থেকে তুলে নেওয়া বন্দুক এদিক ওদিক নাড়ছে আর উদ্ভ্রান্তের মত চারদিকে তাকাচ্ছে। কেউ সাহস করে তার দিকে এগোতে যাচ্ছে না। এমন সময় মোস্তাক, তৈয়ব আলী আর তার ছেলেকে এগিয়ে আসতে দেখে মির্জার বাবা জানতে চাইলো কি হয়েছে। সবাই একটু ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাড়িয়ে আছে পলাশের ভয়ে। পলাশ থেকে থেকে ভাঙা গলায় বলছে, “কেউ সামনে আসবি না, জান রাখবো না একেবারে। কেউ আসবি না”। তৈয়ব আলী যেই মাত্র বলতে শুরু করবে যে কি হয়েছে কিন্তু তার আগেই তার ছেলে আতর আলী পলাশের দিকে এগিয়ে গেল আর আঙুল তুলে বললো, “এটা আমাদের বন্দুক না?” বলে পলাশের দিকে এগিয়ে গেল। পলাশের উত্তেজিত মাথা আর সহ্য করতে পারলো না, সে বন্দুক তুলে আতরকে সোজা মাথায় গুলি করলো।
গুলি খেয়ে আতর ঢলে পড়তে না পড়তেই এক সাথে বেশ কয়েকটা ঘটনা ঘটলো। অনেকক্ষণ ধরে যেই চাপের মধ্যে মানুষগুলো ছিলো, তার একসাথে বিস্ফোরণ ঘটলো। আতরকে গুলি খেতে দেখে আতরের বাবা তৈয়ব আলী চিৎকার দিয়ে পলাশের দিকে এগিয়ে গেল,রক্ত দেখে মির্জার মাথায় কি হলো, সে হঠাৎ করে সামনে এসে অশরীরী স্বরে বলে উঠলো, ‘এইগুলি সব তৈয়ব আলীর কাজ। নইলে পলাশের কাছে ওদের বন্দুক কিভাবে আসে? পলাশ পাগল হয়ে গিয়েছে, আর পাগলের হাতে বন্দুক তুলে দিয়েছে তৈয়ব”। বলতে না বলতেই মির্জা বন্দুক তুলে খুব কাছে থেকে তৈয়ব আলীকে গুলি করে। এদিকে বন্ধু আতরকে চোখের সামনে গুলি খেতে দেখে হারুন মাথা ঠিক রাখতে পারে না আর। পলাশের দিকে দা হাতে ঝাপিয়ে পড়ে সে, যতক্ষনে মোস্তাক তাকে থামাতে এগিয়ে আসে ততক্ষণে পলাশের কাছে পৌছে গেছে সে। মোস্তাক কিছু করতে পারার আগেই হারুনের দায়ের কোপ বসে যায় পলাশের গলায়। আরো একবার ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটে দক্ষিণপাড়ায়, কিন্তু এইবার কোন চিৎকার শোনা যায় না। ঘাড় ঘুরিয়ে সবার আগে মোস্তাকের চেহারা দেখতে পায় হারুন। মোস্তাককে আগে থেকেই অপছন্দ করে সে, আর এখন সে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য। এমন অবস্থায় চোখের সামনে মোস্তাককে দেখেই তার মনে হয় মোস্তাক তাকে আক্রমণ করতে আসছে। “তুইও ওদের সাথে” বলতে বলতে মোস্তাকের মাথা বরাবর কোপ বসিয়ে দেয় হারুন। করোটির সাথে দায়ের সংস্পর্শে “ঘ্যাস” করে একটা অপার্থিব শব্দ হয়। কোন কথা না বলেই মোস্তাক মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এই দিকে মির্জার এমন আচমকা এগিয়ে গিয়ে গুলি চালানোয় হতবাক হয়ে পড়ে পিছে দাড়িয়ে থাকা রহমত, মজিদ আর রোকন। অন্য পাশ দিয়ে হারুনকে এগিয়ে গিয়ে কোপ মারতে দেখে তারা সহ্য করতে পারে না। দৌড় দেয় উল্টো দিকে, তাদের হাতেও যে অস্ত্র আছে তা তাদের খেয়াল হয় না এই ভয়াবহ দৃশ্য দেখার পরে। মির্জা পিছনে পায়ের আওয়াজ পেয়ে ঘুরে দাড়িয়ে দেখে রহমতরা দৌড়ে পালাচ্ছে। কোন কিছু না ভেবেই রহমতদের পিছে দৌড় দেয় সে “ধর, ধর। পালাতে দিস না এদের” বলতে বলতে। আওয়াজ পেয়ে হারুনও ঘুরে তাকায়, তার চোখে আদিম অনুভূতি, যেই অনুভূতি শিকারকে পালাতে দেখলে শিকারীর চোখে দেখা যায়।
বয়স হয়েছে দেখে রতন মোল্লা, রহমতের বাবা এরা মধ্যপাড়াতেই বসেছিল। ওইদিকে আবার গুলির আওয়াজ আর শোরগোল শুনে তারা এগিয়ে দেখতে চাইলেন যে কি হচ্ছে। তারা দেখতে পেলেন রোকন, রহমত,মজিদ তাদের দিকে দৌড়ে আসছে, ওদের চোখে ভয় আর অবিশ্বাসের এক অদ্ভুত মিশেল। পিছনে দা হাতে হারুন আর বন্দুক হাতে মির্জা তেড়ে আসছে। হঠাৎ মির্জা দৌড়ে মাঝেই চিৎকার দিয়ে উঠলো, “রতন চাচা, ওরা কাওসারকে মেরে পালাচ্ছে”। যতক্ষনে রতন মোল্লার মাথা মির্জার কথাটা পুরোপুরি বুঝতে পারলো, তার আগেই তার শরীর প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে ফেলেছে। রতন মোল্লা রোকনকে আটকাতে গেল, রহমতের বাবা যে মজিদের রাস্তা আটকে দাড়িয়ে আছেন তা তিনি খেয়াল হয়নি, তিনি বুঝতে চেষ্টা করলেন আসলে কি ঘটছে। মজিদের মধ্যে ততক্ষণে প্রাণের ভয় চলে এসেছে, কোন চিন্তা না করেই সে সোজা রহমতের বাবাকে দা দিয়ে কোপ দিয়ে সরিয়ে দিলো। সবার পিছে ছিলো রহমত, সে এতক্ষণ মজিদের জন্য তার বাবাকে দেখতে পারছিল না ঠিকমত, কিন্তু মজিদের হাত যে কোপ দিতে উঠেছে সেটা সে ভালো মত দেখতে পেল। এক মুহুর্তের জন্য রহমতের মনে হল যে সময় থেমে যাচ্ছে, সে খুব পরিষ্কার ভাবে দেখতে পেল মজিদ দা দিয়ে তার বাবার গলার পাশে কোপ দিলো এমন ভাবে যে দায়ের ধাক্কাতেই রহমতের বৃদ্ধ বাবা পাচ হাত দূরে ছিটকে পড়লেন। গ্রামের অন্যতম ভালো শিকারি রহমত, তার মধ্যে সাথে সাথে প্রতিক্রিয়া দেখা গেল। কোপ দিতে যেই সময়টুকু লাগালো মজিদ, এর মধ্যেই রহমত দৌড় থামিয়ে অভ্যাসবসে বন্দুক তুলে নলটা প্রায় মজিদের মাথায় ঠেকিয়ে গুলি করলো। এদিকে রতন মোল্লার সাথে ধাক্কা খেয়ে রোকন ছিটকে পড়লো। সে উঠে দাঁড়ানোর আগেই মির্জা চলে এল। মাত্র গত রাতেই সে এই কাজ করেছে, দৃশ্যটা এখনো টাটকা, সে দৌড়ে এসে বন্দুক তুলে রোকনের মাথায় বসিয়ে দিলো। ভারী বন্দুকের বাটের বাড়িতে রোকনের মাথা দেবে গেল। এদিকে তার পাশে রহমত মজিদকে গুলি মেরে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। পাশে যে মির্জা রোকনকে বন্দুকের বাট দিয়ে পিটাচ্ছে সেদিকে তার খেয়াল নেই। তার সব খেয়াল কেড়ে নিয়েছে রক্তমাখা দা হাতে ছুটে আসতে থাকা হারুন। দুপুরে হারুনের ব্যাপারে করা সন্দেহগুলি তার মধ্যে আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো কিনা, নাকি তখনো ঘোরের মধ্যে ছিলো কে জানে, অভ্যস্ত হাতে বন্দুকে গুলি ভরে সে হারুনের দিকে বন্দুক তাক করে গুলি করলো। হারুন মাত্র কয়েক গজ সামনে থেকে বুকে গুলি খেয়ে হুড়মুড় করে মাটিতে পড়ে গেল। মির্জা ততক্ষণে রোকনের মাথা থেতলে দিয়েছে। মির্জার মধ্যে তখন রক্তের নেশা আর নিজের অপরাধ লুকানোর চিন্তা একসাথে কাজ করছে। এই নারকীয় তান্ডবের মধ্যেও সে হঠাৎ করে বুঝে গেল, এইখানে যে খুনাখুনি হয়েছে, তার সাক্ষী এখন বেচে আছে মাত্র পাঁচজন। রহমত, রতন মোল্লা, আমেনা, আমেনার মা আর তার নিজের বাবা। চিন্তাটা মাথায় আসতে যা দেরী, সাথে সাথেই মির্জা রতন মোল্লার মাথায় রক্তে ভেজা বন্দুকের বাট দিয়ে বাড়ি দিয়ে বসলো। রতন মোল্লা বৃদ্ধ মানুষ, এক বাড়িতেই শেষ হয়ে গেল। পাশে রহমতকেও তখন রক্তের নেশায় পেয়ে বসেছে যেন, মজিদকে গুলি করেছে দেখেছে মির্জা। তারপরে আরো দুইটা গুলির আওয়াজ হয়েছে, কিন্তু মির্জার মধ্যে তা আলাদা কোন অনুভূতি সৃষ্টি করলো যেন। এ যেন খুবই সাধারণ ব্যাপার। সামনে পড়ে থাকা দুইটা বিকৃত মরদেহ যেন নিত্যনৈমিত্ত্যিক দৃশ্য। মির্জা বসা থেকে উঠার মাঝে বন্দুকের নল দিয়ে রহমতের গলার নিচে প্রচন্ড জোরে খোচা দিলো। বেকায়দা খোচা খেয়ে রহমত ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে গেল, আর পড়তে না পড়তেই মির্জা তার উপর চড়ে বসলো। কিভাবে হাত চললো মির্জা টের পেল না, মুখে এক দিনের মধ্যে দ্বিতীয়বার ছিটকে আসা রক্তের স্রোতে তার কোন ভাবাবেগ হলো না। মির্জার তখন শুধু মাথার মধ্যে কাজ করছে, “কোন সাক্ষী রাখা যাবে না....কারোর বেচে থাকা চলবে না.....কেউ যেন না জানে”।
কতক্ষণ ওই রক্তভেজা কাদামাটির উপর বসে ছিলো মির্জা তার খেয়াল নাই। খেয়াল হলো যখন তখন চারদিকে অন্ধকার হয়ে এসেছে, কোনমতে উঠে দাড়িয়ে টলতে টলতে ফেরত গেল সে। হাতে তখনো বন্দুকটা ধরা। যদিও তার কাছে গুলি নেই, অবচেতন ভাবে সে এটা নিয়েই ঘুরছে। আমেনাদের বাসার কাছে গিয়ে সে কাউকে দেখতে পেল না। বাইরে একটা হারিকেন জ্বলছে। দরজা আটকানো। মির্জা কোন কথা বললো না, হাত বাড়িয়ে হারিকেনটা নিলো, কোনার খোলা জানালা দিয়ে হারিকেনটা ঘরের ভিতরে ছুড়ে মারলো। হারিকেনের কেরোসিনে আগুন ধরে গেল মুহূর্তেই। ঘরের ভিতরে মা-মেয়ের চিৎকার মির্জার মনে কোন কম্পন তুললো না। চেহারা আগের মতই নির্বিকার করে লাথি দিয়ে দরজা খুলে মা-মেয়ে দুইজনকেই বাড়ি মেরে অজ্ঞান করে ফেললো। আগুন নেভানোর কেউ আর রইলো না ঘরে। তারপরেও কি মনে করে ফিরে গিয়ে মা-মেয়ে দুইজনকেই ক্রমাগত বন্দুকের বাট দিয়ে বাড়ি দিতে থাকলো। কেমন যেন একটা মাদকতাময় অনুভূতি। একই কাজ বারবার করার মধ্যেও কেমন জানি অন্যরকম আনন্দ। ঘরের মধ্যে আগুনের আঁচ বেড়ে যাওয়ার পরেই মির্জা ঘর থেকে বের হল। বের হয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘুরলো সে। তারপরে আশেপাশে পড়ে থাকা লাশগুলিকে ক্রমাগত বন্দুকের বাট দিয়ে পিটিয়ে যেতে থাকলো, তার চোখের মধ্যে কোন অনুভূতি নেই আর।
জুলহাস আর শরীফ পুলিশ নিয়ে ফিরলো দুই দিন পরে। অনেক কষ্ট করতে হয়েছে তাদের পুলিশকে বোঝাতে। আসতে গিয়ে জান-প্রাণের ভয় বাদ দিতে হয়েছে। গ্রামে ঢোকার সময় যখন আশে পাশে শুধু কয়েকটা কাকের আওয়াজ ছাড়া আর কোন আওয়াজ পাওয়া গেল না, সবাই একটু অবাক হল। মাত্র দুপুর গড়িয়ে বিকেল হচ্ছে। কোথায় সবাই? খুজতে খুজতে মধ্যপাড়ায় এসে সবার শরীর শিউরে উঠলো সামনের দৃশ্য দেখে। মাটিতে পাচটা লাশ পড়ে আছে, প্রত্যেকের মাথা ভাঙা, ভাঙা বললে কম হবে, দেখে মনে হচ্ছে কেউ অসম্ভব আক্রোশে তাদের মাথাটা পিটীয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে চেয়েছিলো। কাউকে এমন ভয়ংকর ভাবে নির্যাতন করা হয়েছে যে চেহারা বলেও আর কিছু নেই। শরীফ এই দৃশ্য দেখে আর সহ্য করতে পারলো না। মুখ চেপে ধরে এক পাশে যেয়ে বমি করে দিলো। পুলিশ আর জুলহাস ততক্ষণে বসে নেই, তারা সামনে এগোচ্ছে। খুব সতর্ক তারা। একটু সামনে গিয়ে আরো একটা লাশ পাওয়া গেল, একই রকম ভাবে মাথা ভাঙা। জুলহাস শনাক্ত করলো, মির্জার বাবা। সাদা চোখে মনে হবে তাকেও পিটিয়ে মেরেছে, কিন্তু পরে ময়নাতদন্তে বোঝা যাবে উনি মারা গিয়েছেন রহমতের ছোড়া তৃতীয় গুলিতে। আরেকটু সামনে এগিয়ে দক্ষিণপাড়া পৌছানোর পর পুলিশ এক অবর্ণনীয় দৃশ্য দেখতে পেল। প্রায় কাছাকাছি জায়গায় অনেকগুলো লাশ পড়ে আছে, সবকয়টা লাশের আগের মত মাথা ভাঙা। আশে পাশে কয়েকটা বন্দুকও পড়ে থাকতে দেখলো পুলিশ। একজন মাত্র লোক পাওয়া গেল যার মাথা অক্ষত। কাছে গিয়ে দেখা গেল সে জীবিত, এবং জ্ঞানও আছে। জুলহাস তাকে মির্জা বলে শনাক্ত করলো। কি হয়েছে জানতে চাওয়া হলে মির্জা কেবল একটা কথাই বারবার বিড়বিড় করে বলতে লাগলো, “ এখন কেউ জানে না....কেউ জানে না....কেউ জানে না....”। এবং কেউ জানলোও না, সমস্ত ঘটনার একমাত্র সাক্ষী যে,মির্জা; সে তাঁর বাকি জীবনে ওই একটা বাক্যই আউড়ে গেছে বারবার।
আলভী মাহমুদ
ডিসক্লেইমারঃ একটা কল্পিত ম্যাসাকারের রেফারেন্সটা সত্য হলে কেমন হত চিন্তা করতে যেয়ে এটা লেখা। আমি মূলত আমার চিন্তা কতটা সুশৃঙ্খল ভাবে দেখাতে পারি তাই যাচাই করছি। আপনাদের মতামত পেলে খুশি হব। কল্পিত ম্যাসাকারটি ১৯৫৮ জোয়েইফেলস্টাড নামে পরিচিত (বানান নিয়ে নিশ্চিত নই)
মন্তব্য
কি যে বলা হলো গল্পে কিছুই বুঝলাম না। গল্পের ভাষা প্রবন্ধ-কলাম লেখার মত মনে হলো। চরিত্রগুলো বর্ণনাই থেকে গেলো, জীবন্ত হলো না। নিতাইকে কেন কবর দেয়া হলো বুঝা গেলো না! আমি খুব হতাশ হলাম। সচলের মত লেখা মনে হলো না।
ইউক্লিড
চমৎকার জমে উঠেছিলো গল্পটা - শুরুটাতে বেশ দারুন একটা টান টান আবহ সৃষ্টি হয়েছিল। বেশ জমাটি একটা গল্পের আভাস পাচ্ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করে গল্পটা অন্যদিকে মোড় নেয়াতে পুরো ব্যপারটাই কেঁচে গেলো! তারপর থেকে আর ভালো লাগলো না গল্পটা।
আর নিতাইকে কবর দেয়া হলো কেন, দাহ করার কথা না?
____________________________
চুরিচামারি জানতাম, চুরিদারি শব্দটা আগে শুনি নি।
১ম মন্তব্যের সাথে একমত, কিছুটা প্রবন্ধঘেষা লিখেছে।
লেখা চলুক।
রাসিক রেজা নাহিয়েন
বড় বেশী রক্তস্রোত অথচ মোটিভ সেভাবে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারেনি। বহু চরিত্র কিন্তু তাদের জীবন্ত মনে হয়নি। বর্ণনার স্টাইল আরও ভাল হতে পারত। তবে লেখকের যখন এতটা ধৈর্য্য আছে, সেগুলি পরবর্তী কালে গড়ে উঠবে এই আশা করছি।
অতিথি লেখকঃ মনোবর
নতুন মন্তব্য করুন