নীচু হয়ে মাছের পেট টেপাটেপি করছেন জীবনবাবু। কানকো লাল না ফ্যাকাশে সব দেখে নিচ্ছেন। দেখে টেখে পছন্দ হলে এবার শুরু হবে দরকষাকষি। তারপর আবার ছোট দু একটা মাছ ফাউ নেবার বায়না। জীবনবাবুকে তাই মাছওয়ালারা কেউ ভালবেসে চায়না। তারা অবশ্য আমাকেও চায়না। দরদাম কম করে, পচা ধচা সব গছানো যায় এমন খরিদ্দারকেই তো বিক্রেতারা ভালবাসে। আর ক্রেতারা ভালবাসে সেই দোকানীকে যে কেনা দামে মাল বেচে তাড়াতাড়ি ফকির হবে সেই মহৎপ্রাণ কে।
ভালবাসার আছে নিজস্ব ব্যকরণ। প্রথম চ্যাপ্টার সৌন্দর্য্য, দ্বিতীয় চ্যাপ্টার উপযোগিতা, তৃতীয় চ্যাপ্টার সহিষ্ণুতা, চতুর্থ চ্যাপ্টার আত্মসমর্পণ আর উপসংহারে পুর্ণাংগ মরণ। কে কার জন্য মরতে রাজী এই মশলার উপর নির্মিত হবে ভালবাসার স্থিতি। মাছওয়ালা আর জীবন বাবুর মধ্যে ভালবাসা সম্ভবই নয়। হলে তা হবে ব্যকরণ বহির্ভূত। মাছওয়ালারা চোটায় টাকা নিয়ে মাল তোলে। সুদের হার টেন পার্সেন্ট। অত চড়া সুদে টাকা ধার করে সেই টাকা উড়িয়ে প্রেম করার রেকর্ড খুব একটা চোখে পড়েনা। তবে ভালবাসায় আবার লিংগ মাহাত্ম্য আছে। বিপরীত লিংগের ক্ষেত্রে কোন সাধারণ হিসাব মিল খাবেনা। এতো মাছওয়ালা নয় মাছওয়ালী। স্বামী অকাতরে চুল্লু খেয়ে অকালে দেহ রাখার পর তার কচি বউ খাবে কি। এই বাজারে তাকে তো কেউ বসিয়ে খাওয়াবে না। তা স্বামীর বন্ধুরা লাইন ঘাট দেখিয়ে ওকে পুরোন ব্যবসাতেই বসিয়ে দিয়েছে। বসিয়ে খাল কেটে কুমীর ডেকে এনেছে। একে কম বয়েস তায় রঙ গড়ন চোখে পড়ার মত। আর যায় কোথা! যা আনে তাই সবার আগে বিক্রি হয়ে যায়। আর পয়সার নেশা এমন নেশা একবার যদি ধরে যায় তো অন্য সব নেশা তার পায়ের কাছে গড়াগড়ি খায়। যেমন এখন নয়নের কাছে জীবন খাচ্ছে।
লোকটার ভূষিমালের মহাজনি ব্যবসা। সুখের উপর শতরঞ্চি তার উপর চেয়ার বেঞ্চি। তিন তিনটে জোয়ান ছেলে। তারা সব পারে আর বাজার করতে পারেনা? কিন্তু মাছটি জীবন বাবুর নিজের হাতে কেনা চাই নাহলে নয়নমনির সংগে মোলাকাত হবে কি করে? মাছের পয়সা আনতে হবে বাবুর দোকানে গিয়ে সন্ধ্যের পরে। সন্ধ্যে বেলায় ভিড় থাকে বলে বাবু খ্যাঁচ খ্যাঁচ করে। বলে, একটু পরে আসতে পারিস না? সন্ধ্যের পর ওর বড় ছেলে আর দোকানে থাকেনা। ঐ সময় গেলে জীবন বাবু নয়নমনির সুখ দুঃখের একটু খোঁজ খবর করে। তিনবার চারবার ধরে রেজগি মানে খুচরো গুনে পয়সা মিট করে।
নয়নমনিও কিছু ধোয়া তুলসীপাতা নয়। তার আগেও একবার বিয়ে হয়েছিল। সে বর ছিল কুঁড়ে আর সন্দেবাতিক গ্রস্ত। তাকে ছেড়ে গনেশ মাছওয়ালার সংগে ঘর ছেড়েছিল। এখন সেই গণেশ আবার গেল চলে। এই পুরোন কথা কেউ কেউ জানে। যারা জানে তাদের দু একজন নয়নের সংগে অকারণে খাতির বাড়াতে চায়। সে আবার বাঁজা কিনা। ঝামেলা ঝক্কি কম। তদুপরি বাজারে তার মাছের ব্যবসা এখন এক নাম্বার পজিসনে আছে। তার উপর লোকের নজর থাকা স্বাভাবিক।
সরস্বতী পূজোর চাঁদা, আর বাজার থেকে একটু মাছ কেনা দুটো কাজ একসঙ্গে করব বলে বেরিয়েছিলুম। জীবন বাবুর পেছনে আরো কয়েকজনের সঙ্গে আমিও লাইনে আছি। মাছ দেখার পর এবার নয়নমনিকেও একটু ভালকরে দেখে নিচ্ছেন জীবন বাবু। মাছ পাল্লায় তোলা, তার গায়ের যত হড়কানি একটু মুছে টুছে দেওয়া, খসে যাওয়া আঁচল আবার কাঁধে তুলে দেওয়া প্রভৃতি কর্মে ব্যস্ত নয়নমনিকে সবাই দেখছে, আর ধৈর্য্য সহকারেই দেখছে। মনে তো হয়না কারও কোন তাড়া আছে। অবশেষে মাছ নিয়ে জীবন বাবু চললেন। কিন্তু মন কি অত সহজে যেতে চায়! চার পা গিয়ে আবার ফিরলেন, হ্যাঁরে নয়ন, কিছু ফেলে টেলে গেলুম নাকি? নয়ন বড় বড় চোখ মেলে নাকের নথ দুলিয়ে এক মুখ হেসে বলে, তুমি ফেলে যাবে! সে কি কখনও হয়েছে!
বড় বড় ক্রেতাদের প্রতিষ্ঠাকে ডজ করে অবশেষে আমিও আড়াইশ গ্রাম ওজনের চারাপোনা একটা সংগ্রহ করে জীবন বাবুর দোকানের দিকে রওনা হলুম। ছেলেদের সর্বদা পাওয়া যায়না। এলুম যখন কয়েকটা দোকানের চাঁদা একাই তুলে নিয়ে যাই।
ডানপাশে সরকার, বামে বড়পুত্র আর মধ্যে জীবন বাবু এই তিন সেনাপতি উচ্চাসনে সামনে কাঠের বাক্স নিয়ে বসে এই বিচিত্র বিক্রয় যুদ্ধ পরিচালনা করেন। নীচে পাঁচ সাতজন সেপাই বাকি কাজকর্মের সংগে সর্বাধিনায়ক জীবন বাবুর হুকুম তামিল করে। বেলা এগারটার কাছাকাছি সময় হলেও ভিড় এখনও রয়েছে। কাঠের বাক্সের কাছাকাছি অগ্রসর হবার পর জীবন বাবু আমাকে দেখতে পাবার ভান করেন। আসলে উনি বাজার থেকেই আমাকে নজরে রেখেছেন।
তোমার কি ব্যাপার মানব?
আজ্ঞে আমি ঐ সরস্বতী পূজোর---
সরস্বতী? আমাদের তো ভাই লক্ষীর সাধনা।
না, মানে আপনাদের ভরসায় তো পুজো।
কত? বলতে বলতে একটা ২০ টাকার ময়লা দেখে নোট উনি ডান হাতে তৈরি রেখেছেন দেখলাম।
আপনার কাছে ১০০টাকা আশা করি।
কি? দুড়ুম করে সশব্দে উনি বাক্সের ডালা বন্ধ করে যুদ্ধংদেহি মূর্তি ধারণ করলেন। সরকার মশায় তাই দেখে মিটি মি্টি হাসতে লাগলেন।
পারলাম না। তুমি এখন এসো। কটা সরস্বতী পুজো হয়, কতগুলো চাঁদা আমায় দিতে হয় সেটা কি জানো? পুজো, পুজো, পুজো, শেষ হয়ে গেলাম আমি। ২০ টাকার এক পয়সা বেশী আমি দেবো না, দিতে পারবো না।
আপনার মত ধনী যদি একথা বলে তাহলে পুজো আর হয় কি করে?
না হয় না হোক! এত পুজো হবার দরকার কি? অ্যাঁ? পিতার উত্তেজনা সত্বেও বড়ছেলে দেখলাম নির্বিকার ভাবে নাক খুঁটছে। গর্ব করার মত ছেলে একখানা।
সে আপনি যখন দেবেন না আমি না হয় চলেই যাই। কিন্তু সন্ধ্যেবেলা ছেলেরা এসে ঝামেলা জুড়লে আবার আমায় দোষ দেবেন না।
দিলুম এবার পাশুপত অস্ত্র ছেড়ে। দেখি শালা পপাত হয় কি না! ছেলে এবার আমাকে লক্ষ্য করতে লাগল। যুবক ছেলে হুমকির কথা শুনে একটু গরম খেলেও খেতে পারে। কিন্তু না ব্যাটা আলুভাতে আবার নাকে হাত বুলোচ্ছে। এবার ঘটনা একটু ব্যাখ্যা করা দরকার। তিনখানা বাসের মালিক আর বাজারের একনম্বর ব্যবসায়ী আমার হুমকি কে গ্রাহ্য করবেন কেন? কারন তার গোপন দুর্বলতার খবর বাইরে ফাঁস করছে ঐ পাশে বসা সরকার যে আবার ঘটনা চক্রে আমার এক মামা; যদিও আপন নয়। ১০০টাকা নয়, সারা বছরে দেড় দু হাজার টাকা চাঁদা আমায় এখান থেকে সংগ্রহ করতে হয়। এটা পারি বলে চ্যাংড়া ছেলেগুলো আমায় কিছু সম্মান দেয়। ওরা আমার গল্পের ইনফর্মার। আমায় তো আমার কাজ করতে হবে না কি!
সন্ধ্যেবেলা? বলে চোখ কুঁচকে আমায় ভাল করে লক্ষ্য করলেন জীবন বাবু। সরকার মামা আমার দিকে চেয়ে নীরবে হাসছে। ভালোবাসার ব্যকরণ আছে। সে সব নিয়মনীতির উর্ধ্বে। শুধু নিরিবিলিতেই সেই গুল্ম বৃক্ষ হতে পারে। ঘোষ পাড়ায় দু কাটা জমির উপর দু কামরা ঘর হবে নয়নমনির। ব্যাবসা শেষে মৎসগন্ধ নির্মূল করে নথ দোলাতে দোলাতে তাগাদা সেরে সবচেয়ে বড় মাছটার দাম নিতে এখানে যদি নয়নমনি না আসে ঘরটা কি হাওয়ায় হয়ে যাবে? ভালবাসার কাছে বয়সই বা কি, ব্যবসাই বা কি আর দুর্জনের সমালোচনাই বা কি! আর ১০০টাকা! ছিঃ! ছিঃ! ছিঃ!
সশব্দে বাক্স আবার খোলে। চিচিং ফাঁক! ১০০টাকার নোট সাবধানে পকেটস্থ করে, মীরজাফর মামার সংগে নীরব দৃষ্টি বিনিময় সেরে, ভালবাসার প্রতি পুর্ণ আস্থা নিয়ে এবার আমি বেরিয়ে পড়ি চারাপোনার পরিণতি সন্ধানে।
মনোবর
মন্তব্য
তৃতীয় গল্পটি দিলামঃ জীবন নয়ন ও চারাপোনার গল্প। লিখেছেন মনোবর অংশটা নীচে দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু পরে আর সরান যাচ্ছে না।
ভাই আপনি সচলে নতুন লিখছেন তাই হয়ত জানেন না, এখানে কোন লেখকের একসাথে দুইটি লিখা প্রথম পাতায় থাকেনা, নীতিমালা পড়ে দেখার অনুরোধ রাখলাম। নীতিমালার ৮ নাম্বার পয়েন্ট পড়লেই বুঝতে পারবেন।
আপনার সর্ব্বনাশী গল্পটি এখনও প্রথম পাতায় শোভা পাচ্ছে কিন্তু।
প্রথম লেখাটি প্রথম পাতা থেকে সরে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন, তারপর নতুন পোস্ট দিন।
ধন্যবাদ এবং শুভকামনা।
__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---
ও দিদি, উনি তো অতিথি। উনি কি আর সরাসরি পোস্ট দিতে পারেন? মডুরা তুলে দিলে উনি আর না করবেন কিভাবে?
(ইমরান ওয়াহিদ)
ইমরান ওয়াহিদ,
অতিথি হিসেবে উনি সিম্পলি একটু অপেক্ষা করতে পারেন। অন্যান্যদের পোস্টের কারণে নিজের লেখাটা নীড়পাতা থেকে সরে গেলে পরবর্তী পোস্টটা দেবেন আর কী।
মনোবর,
আপনার ট্যাগিং এর ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না। গল্প, যুবা-- ঠিক আছে। বাকিগুলো?
যাই হোক, সচলে স্বাগতম।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
না, জানা ছিলনা। এবার থেকে অপেক্ষা করব। নিয়মটা জানাবার জন্য ধন্যবাদ ভাই।
গল্পের থিমটা ভালো, কিন্তু গল্পটা সেভাবে টেনে রাখতে পারলো না। আপনার সর্ব্বনাশীর লেখার ধরণ অনেক বেশী টান টান ছিল। এই গল্পে বাক্যগুলোকে অযথা লম্বা করা হয়েছে মনে হলো। কিছু কিছু জায়গায় বাক্য গঠনে সতর্কতা জরুরী। যেমন "ক্রেতারা ভালবাসে সেই দোকানীকে যে কেনা দামে মাল বেচে তাড়াতাড়ি ফকির হবে সেই মহৎপ্রাণ কে" এখানে সেই দোকানী আর সেই মহৎপ্রাণ ডাবল হয়ে গেছে।
আর ক্যাটেগরী দেবার সময়ে সতর্ক থাকুন। "ব্যবসাই বা কি আর দুর্জনের সমালোচনাই বা কি! আর ১০০টাকা! ছিঃ! ছিঃ! ছিঃ!" অথবা "ভালবাসার কাছে বয়সই বা কি" এই ধরণের ক্যাটেগরী দেবার দরকার দেখি না। ক্যাটেগরী দেবেন যেটা সহজে গল্প সম্পর্কে ধারণা দেবে। চাইলে ক্যাটেগরীতে "মনোবর" ব্যবহার করতে পারেন, এতে করে যখন পরে হাচল হবেন তখন আপনার লেখাগুলো খুঁজে বের করা সহজ হবে।
সচলে লিখতে হলে আর জিজ্ঞাস্য পাতাদুটো দেখে নিন, অনেক কিছু সহজ হয়ে যাবে।
আরো লিখতে থাকুন। ধন্যবাদ।
____________________________
লেখার ধরনটা ভালই লাগলো, তবে গল্পটি অতিশয় অপরিনত।
প্রফেসর হিজিবিজবিজ ক্যাটিগরির বিষয়ে যে পরামর্শ দিয়েছেন সেটাই করব মানে মনোবর বলে চিহ্নিত করব। কিন্তু ডাবল হয়ে গেছে বলে যে ব্যাপারটি আপনি উল্লেখ করেছেন ওটা বুঝতে পারিনি ওরকম হলে তো ব্যকরণগত ভুল হবার কথা নয়।
পরামর্শ দেবার জন্য ধন্যবাদ!
মনোবর।
তিথিডোর যা বলেছেন সেটা করা যেতে পারে।
ধন্যবাদ!
মনোবর
আবদুল্লাহ এ এম বলেছেন গল্পটি অতিশয় অপরিণত- এটা একটু বিশদে বললে বোঝবার পক্ষে সুবিধা হত।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ!
মনোবর।
নতুন মন্তব্য করুন