শৈশব আর কৈশোরের প্রতি সব মানুষের থাকে অপার দূর্বলতা, থাকে অজস্র স্মৃতি। জীবনের সেই শ্রেষ্ঠ সময়টাকে নিয়ে ভাবতে যেমন ভালোলাগায় পূর্ণ হয় বুক তেমন দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয় যাপিত জীবন। সেই ভালোলাগার স্মৃতিচারনের চেষ্টা থেকে লেখতে বসলাম অগোছালো হাতে হারিয়ে ফেলা ছেলেবেলার কথামালা। লেখার পূর্বে মনে হয় হৃদয়ের সব কথা লেখতে বসলেই এক নিমিষেই লেখে ফেলতে পারবো কিন্তু বাস্তবে লেখতে বসলে ভাষাহীন হয়ে যায় মস্তিষ্ক! তারপরও গাইতে গাইতে গায়েনের মতো পড়তে পড়তে লেখক হয়ে যাওয়ার দশা থেকে লেখে ফেলা।
কনেকেনে শীত, কুয়াশার দীর্ঘ প্রাচীর সব কিছুই আছে আগের মতো, শরীরকে ঠিকি ছুঁয়ে যায় এই শীতলতা, ভিজিয়ে যায় কুয়াশা. কিন্তু আজ আমি নেই সেই শীতের রস, গন্ধ, আর নতুন পিঠার উৎসবে. অথচ একটা সময় ছিলো ভোরে দাদার সাথে যেতাম গাছ থেকে রস নামাতে, ২০-২২টা খেজুরের গাছ ছিলো আমাদের, সেই গাছ থেকে রস নামিয়ে দেখা যেত পাতিলে পাতিলে ভরে গেছে রস, রসের গন্ধে ভরে উঠতো পাকের ঘর. তারপর পিঠা দিয়ে সেই রস খাওয়া, যার স্বাদ আর গন্ধ এখনো স্মৃতির পাতায় সতেজ হয়ে আছে. খুব ভোরে আসত মোলা ওয়ালা, টাকা দিয়ে কখনো এই মৌসুমী খাবারটি কেনা হতো না, ধান কাটার পর জমিতে পড়া থাকা ধান সংগ্রহে করে জমিয়ে রাখা অল্প কিছু ধান কিংবা গোলা ( যেখানে অনেক ধান একসাথে জমা রাখা হয়) থেকে নেওয়া ধান দিয়েই মোলা কিনতাম. আমাদের গ্রামের বাড়ীতে গাছের পরিমান বেশি ছিলো তাই সূর্যর আলো পৌছাতে পৌছতে দুপুর গড়িয়ে আসত প্রায়, বাড়ির দক্ষিনে উচু কিছু ভিটা ছিলো যেখানে রোদ আসত সবার আগে. আমরা সবাই রোদ পোহাতে যেতাম সেখানে, শুয়ে থাকতাম বিছিয়ে দেওয়া লেপ আর কম্বলের গায়ে সকাল থেকে.
আমার শৈশবটা ছিলো তাই প্রকৃতির সাথে মিলেমিশে, জলের আদরে, কুয়াশার চাদরে, রোদের খরতাপে আর বাউন্ডুলে. নিজেদের এত খেজুরের রস থাকার পরও সমবয়সীরা মিলে রস চুরি করে সিন্নি (আধুনিক ভাষায় যাকে পায়েস বলে) রান্না করতাম. কিংবা কারো খোয়াড় থেকে হাস/মুরগী চুরি করে পিকনিক করতাম রাতের আধাঁরে. রাজশাহীতে কাটানো শৈশবে, যখন তখন লাফিয়ে পড়তাম বাসার পাশ দিয়ে বয়ে চলা ছোট্ট নদীতে. নদীর ওইপারটা তে ছিলো সারি সারি করে দাঁড়ানো মাইলের পর মাইল পানের বর, কতদিন কেটেছে সেই পানের বরে লুকোচুরি খেলে, কতবার হারিয়ে গেছি সেখানে. কোন কোন দিন হাত চালিত নৌকা নিয়ে চলে গেছি কত অচেনা বাঁকে. গ্রামের বাড়িতে বর্ষায় জমিতে জমে থাকা পানি সেঁচতাম মাছের আশায়, মাছ ধরার নেশায় কত দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে আমাদের কালো জলের শীতল পুকুর টিতে! একবার জাল টেনে মাছ ধরতে গিয়ে গুইসাপ আটকা পড়েছে জালে আর বড় মাছ পড়েছে জালে এই ভাবনায় পানির নিচে জালে হাত দিয়ে ছোট ভাই তুলে এনে দেখে হাতে ইয়া বড় গুইসাপ! আমাদের বাড়ির পেছনের পুকুরে ছিলো অসংখ্য মাছ. একবার আমি আর ছোট ভাই পানিতে ভাসমান ছোটমাছ ধরার জন্যে গামছা টানছিলাম, হঠাৎ সেই গামছায় ৩-৪ কেজি ওজনের একটা কাতলা জড়িয়ে গেল. গামছা দিয়ে এতবড় কাতলা মাছ ধরার বিশ্বরেকর্ড বোধহয় আরো কারো নেই পৃথিবীতে
বিকেলের বিচিত্র সব খেলা ( মারবেল, ঝিক,লাটিম, কাবাড়ি, ঘুড়ি ওড়ানো প্রভৃতি) শেষ করে কখনো কখনো যেতাম আমাদের গ্রামের বাজারে, গরম গরম হালুয়া কিংবা পাতলা ডাল দিয়ে দাম্বা রুটি ( আধুনিক ভাষায় নাল রুটি) খাওয়ার জন্যে দাদার পেছন পেছন লেগে থাকতাম, দাদার ও খুব প্রিয় ছিল এই রুটি. তাই প্রায় প্রতিদিন খাওয়া হত এটি. টেলিভিশন দেখার জন্যে কখনো কখনো অনেক রাত পর্যন্ত বাজারে থাকতাম, হোটেলগুলোতে খাওয়ার (চা-গুলগুলা কিংবা পরোটা) বিনিময়ে টিভি দেখা যেত. বেশিভাগ সময় খেলার কিংবা নাটকের মাঝপথে বিদুৎ চলে যেত, আর এই সুযোগে খাওয়ার বিল না দিয়ে কতদিন যে ফাঁকি দিয়ে চলে এসেছি তার কোন ইয়াত্তা নেই! বাড়ি ফেরাপ পথে একটা বড় কবরস্থান ছিলো আর ছোটবেলার সব ভয়ের কেন্দ্রবিন্দু ছিলো সেই কবরস্থান. কতজন কতকিছু দেখেছে সেই কবরস্থানে এই গল্প শুনতে শুনতে বড় হয়েছি. তাই কবরস্থানের সামনে দিয়ে যেতে গলাশুকিয়ে কাঠ হয়ে যেত, দিনের বেলায়ও চোখ বন্ধ করে পার হতাম কবরস্থানটি. আর রাত হলে তো কথা নেই উচ্চ কন্ঠে সুরা-কালাম পড়ে একজন আরেকজনকে জড়িয়ে পার হতাম ছেলেবেলার ফুলসিরাত..!
বাড়ীর একেবারে পেছনে জঙ্গল হয়ে থাকা অংশের একপ্রান্তে ছিলো আমাদের গ্রামের সবচেয়ে বড় তেতুল গাছটি. তেতুল গাছ নিয়ে গ্রাম্য জীবনে ভূত জিনের কাহীনি থাকবেনা এমন সাধারনত হয়না. যথারীতি আমাদের গাছটি নিয়েও ছিলো. একবার আমার বাড়ীর এক কাকা নাকি গাছে উঠে তেতুল পাড়ছিল, তো হঠাৎ দেখে তার উপরের ঢালে সাদা কাপড় পরা একজন বসে বসে তেতুল খাচ্ছে, কংকাল সাদৃশ্য সেই দয়াময়ী ভূত নাকি কাকাকে একটা পাকা তেতুল খাওয়ার জন্যে দিলো আর কাকা কিছুক্ষন পর নিজেকে আবিষ্কার করলো গাছের নিচে. হাত পা দুটোই ভেঙ্গেছে সেই ভূতের সাক্ষাত পেয়ে. তারপর অমাদের বাড়ীর কেউ উঠতো না ওই গাছে, গাছে উঠবে এমন লোকের অভাবে তেতুল মাটিতে পড়তো ঝরে ঝরে. আমিই বোধহয় প্রথম সেই প্রথা ভেঙ্গে দিয়েছিলাম, একদিন ফুপাতো ভাইকে গাছ তলায় রেখে উঠে গিয়েছিলাম ভূতের আবাস্থলে. গাছটিতে উঠলে আমাদের পুরো গ্রামটিকে দেখা যেত, ছোটবেলার সবচেয়ে উঁচু গাছটিতে উঠে পুরো গ্রামকে দেখার আনন্দে তারপর টানা কয়েকদিন উঠেছি গাছটিতে. কিন্তু আমি গাছে উঠেছি এই ক্ষতিপূরণ দিতে হলো প্রিয় গাছটিকে. বাবা ছুটিতে বাড়ি এসে যখন শুনলো আমি উঠেছি সেই গাছে তখনি গাছের সব ডালপালা কেটে গাছটিকে তালগাছ আকৃতি করে দিল. আর সেই সন্ধ্যাটা আমার বিষন্নতার চাদরে ঢেকে গেল, এরপর যতবার সেই গাছের তলায় গিয়েছি নিজেকে অপরাধী মনে হয়েছে, একসময় অপরাধের বোঝা ভারি মনে হতে লাগলো তাই যেতাম না সেই পথে গাছটির সাথে দেখা হয়ে যাবে বলে. সেই ছেলেবেলার প্রথম অপরাধবোধের কারনে দশ বারো বছর আমি যাইনি সেই প্রিয় তেতুল গাছের কাছে..!
ছোটবেলার সেই ফুলসিরাত এখনো আগের মতোই আছে, কিন্তু ভয় জাগায় না কোন মনে. সেই তেতুল গাছ আজো দাড়িঁয়ে আছে মাথা তুলে কিন্তু সে এখন আর বিষন্ন করেনা আমাকে. কারন এখন আমি কোমলমতি ছেলেবেলাকে ইতিহাসের পাতায় ফেলে এসেছি বহুকাল আগে. ছেলেবেলার সেই স্বর্ণালী দিন গুলো আজ তাই ঝাপসা হয়ে যাওয়া সুদুরতম অতীত আমার জীবনে. মাঝে মাঝে নিজেরি বিশ্বাস হয় না এমন একটা জীবন আমি কাটিয়েছিলাম, এমন প্রকৃতির কোলে স্মৃতিময় একটা জীবন আমি পেয়েছিলাম. আজ এই শহুরে এক নিয়মের জীবনে নিজেকে বন্দী করে চোখ বন্ধ করে মাঝে ফিরে যাই শৈশবে আর কৈশোরে. ছেলেবেলা এখন একটি নীরব দীর্ঘশ্বাসের নাম, ছেলেবেলা এখন স্মৃতির পাতায় সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্রসম ভালোলাগা বেদনার নাম।
মাসুদ সজীব
মন্তব্য
আহ! খেজুরের রসের কথা মনে করিয়ে দিলেন। ইস! একটু যদি পেতাম এই মুহূর্তে!
বলেন কি? তেঁতুল গাছ আপনার প্রিয়? সত্যি বলুন তো আপনি মানুষ, না ভূত?
আর, এই তেঁতুল কি ফল তেঁতুল? নাকি অন্য 'তেঁতুল'?
শুভেচ্ছা
[মেঘলা মানুষ]
এখনো মানুষ হতে পারি নাই, তাই চরম দার বই ”লাইনে আসুন” পড়ে মানুষ হওয়ার লাইনে আসার চেষ্টায় আছি
আর তেঁতুল নিয়ে সব বলা যাবে না থাকনা কিছু গুপুন ।
মাসুদ সজীব
আপনি নিজে গাছের থেকে রস নামাতেন! সে তো রীতিমত গাছি ব্যাপার!
লেখা খুব ভাল লাগল।
আরো এরকম লেখার অপেক্ষায় থাকলাম, মাসুদ-ভাই!
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
পড়ার জন্যে অসংখ্য । শুভেচ্ছা
মাসুদ সজীব
দুরন্ত কৈশরে গাছে চড়ার যে কি আনন্দ তা বোধ হয় বলে বোঝানো যাবে না। আমাদের মাঝ থেকে সেই আনন্দ হারিয়ে যাচ্ছে চিরতরে।
হুম আসলেই বোঝানো যাবে না
মাসুদ সজীব
লেখার পূর্বে মনে হয় হৃদয়ের সব কথা লেখতে বসলেই এক নিমিষেই লেখে ফেলতে পারবো কিন্তু বাস্তবে লেখতে বসলে ভাষাহীন হয়ে যায় মস্তিষ্ক!
পানিতে ভাসমান ছোটমাছ ধরার জন্যে
হাত চালিত নৌকা
-- উপমা, লেখার ভঙ্গি বড্ড ক্লিশে। ছোটবেলার সেই ফুলসিরাত নয়, শব্দটা পুলসিরাত। পানের ক্ষেতকে বর নয়, বরজ বলে জানি। আঞ্চলিক বিশেষত্বের কারণে ইচ্ছে করেই ওভাবে লিখলে অবশ্য আলাদা কথা।
কনেকেনে >কনকনে শীত, তেতুল গাছ আজো দাড়িঁয়ে আছে > তেঁতুল গাছ আজো দাঁড়িয়ে আছে-- এরকম টাইপোও আছে বেশ।
কঠোর মন্তব্যের জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। কিন্তু নীড়পাতার নিয়মিত মন্তব্যকারী হিসেবে লেখায় আরো যত্নবান হবেন, এমনটাই আসলে আশা করেছিলাম।
সচল থাকুন, সচল রাখুন।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
ধন্যবাদ ভুলগুলো ধরিয়ে দেওয়ার জন্যে। অফিসে বসে লেখা, লেখা শেষ করতে করতে ঘড়িতে দেখি ৫ টা, তাই আর প্রিভিউ দেখার সুযোগ পাইনি তেমন। আশা করি পরের লেখাগুলোতে অবশ্যই যত্নবান হবো। শুভেচ্ছা
মাসুদ সজীব
আপনার শৈশব রাজশাহীতে কেটেছে নাকি?
লেখা চলুক।
__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---
হুম
বাগমারা, তানোর, মোহনপুর, দূর্গাপূর আর রাজশাহী সদর সব মিলিয়ে ৬-৭ বছর। সেটাই আমার জীবনের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সময়। মন্তব্যের জন্যে
মাসুদ সজীব
মোলা জিনিষটা কী? এই নামটা অপরিচিত ঠেকলো তাই কৌতুহল হচ্ছে জানার।
তিথীর কথামত লাইনে আসুন লেখালেখি চলুক। শুভকামনা।
মোলা গুড় আর মুড়ি দিয়ে তৈরি হয়। অন্য অঞ্চলে মোয়া বলে খুব সম্ভব, নোয়াখালী অঞ্চলে মোলা নামে চেনে সবাই। আর লাইনে এখনো যেতে পারি নাই, কারন চরম’দার লাইনে আসুন এখনো হাতে আসে নাই।
মাসুদ সজীব
মনোবর।
মাসুদ সজীব
ভাল লাগল আপনার স্মৃতিচারণ। অনেকটা আপনার বর্ণনা মতই চমৎকার এক শৈশব আমার কেটেছে খোদ ঢাকা শহরেই।
এটাই কি আপনার প্রথম ব্লগপোষ্ট? পোষ্টে অনেক টাইপো থাকলেও আশা করি পরের লেখায় তা কাটিয়ে উঠবেন।
শুভকামনা রইল।
……জিপসি
মাসুদ সজীব
নতুন মন্তব্য করুন