একটি আত্মহত্যা এবং আমরা তিনজন / মনোবর

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ১১/০২/২০১৪ - ৭:০৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মৃত্যুটা ঠেকান গেল না। দুপূর দুটো নাগাদ খবর পাওয়া গেল যোগমায়া মারা গেছে। আগের সন্ধ্যায় নিজেই যখন কেরোসিন গায়ে ঢেলে ও আগুন ধরায় তখন খবর পেয়ে আমরা ওদের বাড়ী গিয়ে দেখি একটা সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার ঘটে গেছে। ফর্সা এবং মোটাসোটা চেহারার যোগমায়ার শরীর দিয়ে মাংসপোড়া গন্ধ বের হচ্ছিল। ঐ অবস্থায় যত দ্রুত সম্ভব ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

এখন এই মধ্যরাতে শ্মশানের কাছে এক বন্ধ দোকানের বারান্দায় ধুলোর ওপর খবরের কাগজ বিছিয়ে আমরা যে তিনজন শুয়ে আছি সকলেই যোগমায়ার অতি পরিচিত ছিলাম। আমাদের মধ্যে ছিল যার সঙ্গে সম্প্রতি যোগমায়ার একটা ভাব ভালবাসার ব্যাপার চলছিল সেই সুহাস ও। আমার মনে একটা খটমট লাগছিল। সুহাসের বক্তব্য ওর আত্মহত্যা করবার মত কিছুই ঘটে নি। ও মাঝে মাঝে যেভাবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছিল তার মধ্যে একটা লোক দেখান ব্যাপার আছে বলে আমার সন্দেহ হচ্ছিল। নিজের মন কে আমি বিশ্লেষণ করে দেখছিলাম যে আমার কোন অপছন্দের কারণেই আমি সুহাস কে দায়ী করতে চাইছি কি না।

অপছন্দের কারণ ছিল। আমাদের মধ্যে তৃতীয় জন ছিল ভাল গায়ক। মাত্র কিছুদিন হল ও ফাংশনে গান করে কিছু কিছু অর্থ পাচ্ছিল। আমাদের তিনজনের মধ্যে গায়ক স্বপন প্রায় প্রতিদিনই সন্ধ্যার পর যোগোর ঘরে ঢুকে কিছুক্ষন হলেও ওর সঙ্গে সময় কাটাত। যোগোর একমাত্র মামা বিহারের কোন এক পোষ্ট অফিসের পোষ্ট মাষ্টার ছিল।যোগোর পাশের ঘরে থাকত ওর এক অবিবাহিতা মাসি যার স্বভাবের দোষ ছিল। বর্তমানে এই দু-জনই রাস্তার পাশের এক একতলা বাড়ীর পাশাপাশি দুটো ঘরে বাস করত। ওর মামা বছরে দু-বার আসত। মৃত্যুর আগের রাতে ওর মামা ওর ঘরেই ছিল। ঐ লোকটা অদ্ভূত বাতিকগ্রস্ত টাইপের ছিল। কিন্তু সে যাই হোক আমার অপছন্দের কারণ ছিল সুহাস ভালো না বেসেও যোগোর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়েছিল।

ঐ শালা, কিছু একটা ঘটিয়েছে! এই বলে সুহাস ঊঠে বসলে আমিও অবাক হয়ে উঠে বসলাম।
সুহাস ফিস ফিস করে বলল, ও আমার কাছে দু তিনবার বলেছে যে মামা এলে ও টেনশনে থাকে। মামার কাছে ওকে নাকি এখনও শিশু বলে মনে হয় এবং সে ওর পেটে কাতুকুতু দেয় আর হা হা করে হাসে। ভাবতে পারিস অতবড় মেয়ের পেটে কাতুকুতু দেওয়ার মানে কি!

অথচ আমি খুব ভাল করে জানি সুহাস যোগমায়াকে ভালবাসত না যদিও যোগমায়া সুহাসকে পাগলের মত ভালবাসত। সুহাস নিজেই আমার কাছে কয়েকবার একথা বলেছে যে ও আসলে ভালবাসে মধুমিতাকে যে একজন এম বি বি এস ডাক্তারের মেয়ে এবং যথেষ্ট সুন্দরী। মেয়েটি ওকে পাত্তা না দেবার কারণে ও যোগকে রাজী করিয়েছিল ওর লেখা চিঠি তার কাছে পৌঁছে দেবার জন্য। কেননা মধুমিতা আর যোগমায়া ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ছিল। তারপর সেই আশ্চর্য্য ব্যাপার টা ঘটে। অবশ্য এটা আমি সুহাসের মুখেই শুনেছি।

যোগমায়া একদিন ঝরঝর কর কাঁদতে কাঁদতে বলে যে ওর পক্ষে মধুমিতাকে চিঠি দেওয়া সম্ভব নয় কারণ ও সুহাস কে ভালবাসে। তারপর কান্নার মধ্যে একটু দম নিয়ে বলে যে তাছাড়া মধুমিতা চিঠি নিতেও চায়না। এই বিবৃতির পর সুহাস যোগোমায়ার গুষ্টির তুষ্টি করে জানায় যে অবশ্যই মধুমিতা ওকে ভালবাসে আর এ সব হচ্ছে ঐ চরিত্রহীনা যোগোর বানানো গল্প।

যোগো অসম্ভব সৎ ছিল। ওর প্রথম এবং শেষ প্রেম ছিল সুহাস। মধুমিতার উপেক্ষা সুহাসের অহং কে ক্ষুব্ধ করে আর ও সব দায়টা যোগোর উপর চাপিয়ে দেয়। সুহাস সুপুরুষ। কিন্তু এটা প্রেমের কোন নিশ্চিত শর্ত নয় সেটা ওকে কখনও বোঝান যায় নি। এই স্বপন হারামীটা আবার মন গোবজা। সুহাসের সামনে ও মরে গেলেও কিছু বলবে না অথচ কয়েকবার ও বলেছে সুহাস শুধু শুধু যোগোকে নষ্ট করছে কেন যখন এটা নিশ্চিত যে ও যোগোকে বিয়ে করবে না। আমি তার উত্তরে বলি সুহাসের সঙ্গে যোগোর সম্পর্ক জানা সত্বেও ও নিজে কেন রোজ যোগোর সঙ্গে গল্প মারতে ঢোকে। স্বপন অবাক হয়ে বলে যোগোর মত তেজস্বী মেয়ের সঙ্গে ফাজলামি করা সম্ভবই না।

এটা আমিও জানতাম। যোগোর মত স্পষ্টবাদী এবং সাহসী মেয়ের এই পরিণাম মেনে নেওয়া খুব কষ্টকর।
শ্মশান থেকে হরিধ্বনি ভেসে আসে। যোগোর মামা এমন পাগলের মত আচরণ করছিল যে তাকে শ্মশানে আসতে দেওয়া হয়নি। পাড়ার অভিজ্ঞরা সবাই এসেছে।

আমরা দুজন কিন্তু সারাক্ষনই যোগোর কথা ভাবছি আর এইশালা ধুলোয় শুয়ে ঘুমোচ্ছে এই বলে আমি স্বপনের পিঠে খোঁচা মারি আর অমনি স্বপন বলে, আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না যে যোগো মারা গেছে।
অথচ বিমল বলল ও নিজেই ডাক্তারের কাছে বলেছে যে ও আত্মহত্যার জন্য গায়ে আগুন দিয়েছে এবং এর জন্য অন্য কেউ দায়ী নয়।
ঠিক তাই। বলে স্বপন উঠে বসে আর বলে, যোগোর মুখে আমি সুহাসের প্রশংসা কখনও শুনিনি কিন্তু তোর প্রশংসা সর্বদা করত। কেন? বলে অন্ধকারেও ও আমার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকায়। আমার বিরক্ত লাগে কারণ এটা ও সুহাসের সামনে আজ বলছে কিন্তু আগে কখনও আমায় বলে নি।

কি বলে প্রশংসা করত? সুহাস জিজ্ঞাসা করে।
বলত যে আমি বা সুহাস মানবের কাছে কিছুই না। আর একটা অদ্ভূত কথাও বলেছিল।
কি? সুহাসের স্বর টা খুব কর্কশ শোনায়।
বলেছিল যে ও যদি কাউকে সত্যিকারের পছন্দ করে সেটা হল মানব। বলে স্বপন মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে।
আমার কেমন সন্দেহ হয় যে স্বপনের মতলব বোধহয় ভাল নয়। কেননা এইসব কথা ও আগে কখনও বলেনি। আর সুহাস আমাকে বেশ কয়েকবার বলেছে যে যোগো ওর হাতের একটা খেলনা মাত্র ও যেভাবে খুশী যখন খুশী ঐ খেলনা ও ব্যবহার করতে পারে।
তাহলে মানব, এই আত্মহত্যার গোপন কোন কারণ কি তোর জানা আছে? স্বপন বেশ ধারাল গলায় কৈফিয়ৎ চায়।
হ্যাঁ, আমি গম্ভীর ভাবে বলি।
কি? দুজনেই সমস্বরে জানতে চায়।
ওর জরায়ুতে চারটে ভ্রূণ ছিল। সব পাশাপাশি সাজান ছিল। একটা গায়ক ভ্রূণ,একটা সুপুরুষ ভ্রূণ,একটা পোষ্ট মাষ্টার ভ্রূণ আর একটা মানব ভ্রূণ।

এই সময় খুব উচ্চস্বরে কেউ বিকৃত নেশা জড়ান গলায় চীৎকার করে বলে, বল্ল ও হরি! আর বহুকন্ঠ সমস্বরে বলে ওঠে, হরিবোল হরি!
শুধু আমরা কিছু বলিনা। সতর্ক হিংস্র হায়েনার মত আমরা পরস্পরকে তাক করে জ্বলজ্বলে চোখে লড়াইয়ের মুহূর্তের অপেক্ষায় বসে থাকি।


মন্তব্য

আয়নামতি এর ছবি

উত্তম জাঝা!
শিরোনামের সাথে নিজের নিকটা না দিয়ে লেখার শেষে দিন বরং হাসি
আরো লেখুন মনোবর। শুভেচ্ছা।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ আয়নামতি। এবার নিকটা নীচেই দেব। গল্প বিষয়ে কোন আলোচনা করলেন না কেন?

এক লহমা এর ছবি

এ গল্প আমাদের চেনা-জানা গল্প'র কাঠামোয় ধরে না। এবং এ গল্প অবশ্যই একটি সূচনা মাত্র। আমার অশেষ সৌভাগ্য এ গল্পটির উপর প্রথম মন্তব্যটি আমি লিখতে পারলাম। গল্পটি পড়ে আমার প্রিয় একটি কবিতা সারাদিন ধরে মনে পড়েছে। বাড়ি এসে কবিতাটি না পড়ে ইস্তক এ গল্পে মন্তব্য করতে মন চায়নি। শক্তি চট্টোপাধ্যায়-এর "একা গেলো"। জানি না, এই কবিতা আপনার পড়া আছে কি না। জানি না এ গল্পে সেই কবিতার কোন রূপায়ণ ইচ্ছায়িত হয়েছিল কি না। অনুরোধ রইল, কবিতাটি পড়া না থাকলে পড়ে নেওয়ার জন্য। এই কবিতার শেষ পংক্তিগুলি দিয়েই এ মন্তব্য শেষ করি।

"বলেছিলো, কথা দাও, তোমরা দাঁড়াবে
সমুদ্রের তীরে এসে, সারিবদ্ধভাবে।
জানো, একা কোনো কিছু আমার লাগে না
ভালো।
সুতরাং, একা চলে গেলো
বসন্তের কূটকচাল
লাগাতে পারবে না ভালো, এই ভেবে, একা চলে গেলো
বলেও গেলো না।
বড় বেশি বাঁচতে চেয়েছিলো ব'লে
    চলে যেতে হলো।
    যেতে এ ভাবেই হয়
    চাও বা না-চাও
    একা গেলো, দোসর নিল না।"

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

না, ঐ কবিতাটি পড়া ছিল না। আপনার সু চিন্তিত মন্তব্য প্রশংসনীয়, হ্যাঁ, কাঠামো আলাদা। তবে নিছক গল্প নয়, বাস্তবে এমনই হয়েছিল। মৃত্যুটা খুব বেদনাদায়ক ছিল এবং রহস্যময় যার মীমাংসা করা যায় নি।

গান্ধর্বী এর ছবি

অন্য ধাঁচের গল্প। ভাল লাগল।
সচলের সাথেই থাকুন।

------------------------------------------

'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার গল্পটা আর চরিত্রগুলোর বর্ণনা সমরেশ বসুর একদম একই রকম একটা গল্পের কথা স্মরণ করিয়ে দিল। গল্পটার নাম ভুলে গেছি। লিখতে থাকুন।

রাজীব মাহমুদ।

অতিথি লেখক এর ছবি

সমরেশ বসুর একদম একই রকম একটি গল্প আছে বলে আমি তো জানিনা! এই গল্পের বিষয়বস্তু নিছক কাল্পনিক নয়। কোন এক জায়গায় ঠিক এই ঘটনাটি ঘটেছিল। তবু যদি থেকেই থাকে তবে সেই গল্পটির নাম কি আপনি একটু অনুসন্ধান করে বলবেন?

মনোবর।

অতিথি লেখক এর ছবি

হয়ত তাই যে আর একটু বাড়ালে বোঝার পক্ষে পাঠকের সুবিধা হত। আসলে কাজের ফাঁকে ফাঁকে চটজলদি লিখতে হয়। খুব ভালোকরে চিন্তা ভাবনা করে তো লেখা হয়না তাই হয়ত কিছু অসম্পূর্ণতা থেকেই যায়।

মনোবর।

অতিথি লেখক এর ছবি

হ্যাঁ, সচলের সঙ্গে থাকতে ভালই লাগবে। আপনার ভাল লাগার জন্য আমারও খুব ভাল লাগছে। আন্তরিক ধন্যবাদ!

মনোবর।

সাফিনাজ আরজু এর ছবি

আপনার অন্যসব গল্পের চেয়ে এই গল্পের ধাঁচটি আলাদা।
বেশ ভাল লাগল। চলুক চলুক
আরও আসুক এমন সব গল্প। হাসি

__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---

অতিথি লেখক এর ছবি

রহস্যময়, ভাললেগেছে, আরেকটু স্পষ্ট ও বাড়ালে পাঠকের সুবিধে হত, শেষ অংশে ।

অতঃপর মরিচিকা মামুন

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।