“কোথায় হাঁটতে বেড়িয়েছিলে বাবা?”। সেপ্টেম্বরের এক ছুটির দিনে ভোর সকালের ট্র্যাকিং থেকে বাসায় ফিরে এসে দেখি সোফায় বসে ব্রেকফাস্ট করছে আমার পাঁচ বছরের ছেলে। জবাবে ‘কাম্পোফন্তানা’ বলতেই জিজ্ঞেস করল মারমোত্তা(marmotta) দেখেছি কিনা? উত্তরে ‘না’ জানাতেই অবাক হয়ে বলল “গত সপ্তাহেই না মারমোত্তার ছবি আমাকে দেখালে, আজকে কোথায় গেল ওরা?” দীর্ঘশ্বাস ফেলে জবাব দিলাম “মারমোত্তার দল ঘুমুতে গেছে, সে এক দীর্ঘ ঘুম………… ঘুম ভাঙবে বসন্তে, এখন শুধুই অপেক্ষার পালা”। সন্তানের বিস্মিত চেহারা দেখে শুরু করলাম মারমোত্তার গল্প, হাতের কাছে উইকিপিডিয়া তো আছেই।
ইতালির ভেরোনা জেলার অন্তর্গত কাম্পোফন্তানা(Campofontana) গ্রামে স্থায়ী অধিবাসী তো আছে মোটে শ-খানেক। এপ্রিল মাসেও সচরাচর বরফে ঢেকে থাকে ভূ-পৃষ্ট থেকে ১২০০ মিটার উচ্চতায় এই জনপদের পাহাড়ি ভ্যালিগুলি। অত ভোরে ঘুম ভাঙ্গার তাড়াও নেই এ গ্রামের বাসিন্দাদের, গরু চড়ানোর তৃণভূমির বেশিরভাগই তো আছে বরফে আচ্ছাদিত হয়ে। অথচ কাম্পোফন্তানারই কিছু বিশেষ স্থায়ী অধিবাসীর কিন্তু ঘুম ভাঙ্গার আছে অনেক তাড়া। প্রায় ছয় মাস ধরে অভুক্ত রয়েছে তাঁরা, একটু পেটপুজো না করলে তো বুঝি বাঁচাই হয়ে যায় বিশেষ দায়।
কাম্পোফন্তানা
সেপ্টেম্বর মাসেই ঘরদোর গুছিয়ে দরজার খিল আটকে দিয়ে ভূগর্ভস্থ টানেলের সবচেয়ে প্রশস্থ কামরায় আল্পিয় মারমোত্তা(Alpine Marmot) দলবেঁধে শুরু করে শীতনিদ্রা। শুকনো ঘাস-লতা জমা করতে থাকে সপ্তাখানেক আগে থেকেই। তারপর দিনক্ষণ ঠিকঠাক মিলে গেলেই জমাকৃত শুকনো ঘাস, মাটি আর নিজেদের বিষ্টা মেশানো প্রলেপ দিয়ে সিলগালা করে দেয় প্রবেশদ্বারগুলি। মোটামুটি মানের একটা বিছানাও বানিয়ে ফেলে ঘাস-লতার আচ্ছাদনে। একটি দুটি নয়, কম করে হলেও ছয়টি মাস বেরুনোর উপায় নেই গুহা থেকে। খানাপিনা তো দূরের কথা একটু আরাম করে শ্বাস-প্রশ্বাস নেবারও সুযোগ নেই। বেঁচে থাকতে হলে মৌলিক শারীরিক প্রয়োজনগুলিও করতে হবে মেপেজুকে, মিনিটে তিনটার বেশী নিঃশ্বাস আর হৃদকম্পন ৪-৫টার বেশী হতে দেয়া যাবে না। স্বাভাবিক সময়ে শারীরিক উষ্ণতা থাকে ৩৮ ডিগ্রি আর শীতনিদ্রায় তা নেমে যায় ৫ এর কোঠায়। বিগত ছয় মাসে ভুরিভোজের বদৌলতে শরীরে যতটুকু চর্বি জমাতে পেড়েছে তা তিলে তিলে খরচ করেই কাটিয়ে দিতে হবে শীতনিদ্রাকালিন ছয়টি মাসের অভুক্ত দেহখানি।
ছবি-উইকিপিডিয়া
আল্পিয় মারমোত্তা থাকে সমুদ্রপৃষ্ট থেকে অনেক উঁচু পাহাড়-পর্বতে। সাধারণত হাজার মিটারের নিচে এরা বসবাস করেনা, আবার ৩০০০ মিটার ছাড়িয়ে গেলে এদের আর দেখা যায় না। কাঠবিড়ালি গোছের হলেও মারমোত্তা গেছো প্রাণী নয়। মাটিতে জন্মানো ঘাস, লতাগুল্মই এদের প্রধান খাদ্য। গ্রীষ্মকালে তৃণভূমিতে লাফিয়ে বেড়ানো পতঙ্গ আর ঘাসফড়িং হাতের কাছে পেলে তাও পেটে চলে যায় অনায়াসে। আসলে গ্রীষ্মকাল মানেই পেটপুজো আর সন্তান জন্মদানের মৌসুম। হাতে সময়ও তো বড্ড কম, বড়জোর ছয়মাস। এই সল্প সময়ে যার শরীরে যত বেশী চর্বি জমবে পরের বছরের বসন্ত দেখার সম্ভাবনাও তাঁর বেশী থাকবে।
বসন্তকালেই পুরুষ মারমোত্তার ভালবাসতে মন চায়, ছয় মাস গর্তের ভিতর ঝিম মেরে বসে থাকতে থাকতে অনেক সময় নষ্ট হয়েছে! একটি দলের সবগুলি সাবালক(দুই বছর) পুরুষ সদস্য পালাবেঁধে রতিক্রিয়া চালায় গ্রুপের সর্দারনীর সাথে। মাসখানেক গর্ভাবস্থা পেরুলেই তিন থেকে সাতটি বাচ্চা জন্মায় গর্তের প্রকোষ্ঠতে। ৪২ দিন পর্যন্ত মায়ের বুকের দুধ খেয়ে বেড়িয়ে পড়ে গর্তের বাইরে। সময় যে হাতে অনেক কম, বড়দের সাথেই নেমে যায় ভূরিভোজনের রেসে, জমাতে হবে চর্বির আস্তর।
কপাল ভাল থাকলে অবাধ প্রকৃতিতে একটি আল্পিয় মারমোত্তা সর্বচ্চো ১৮ বৎসর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারবে। এত উঁচু পাহাড়ে প্রাণসংহারী দুশমন খুব বেশী নেই। চিল-বাজ পাখি আর নেকড়ের থেকে বড় বিপদ তো সেই তোমার আমার মত দ্বিপদী মানুষ। ইউরোপের কিছু কিছু দেশে মারমোত্তা শিকার এখনও একপ্রকার আইনসম্মত ক্রিয়া প্রতিযোগিতা। ‘মারমোত্তার চর্বি নাকি বাতের মহৌষধ’ এই প্রাচীন মিথের জন্য কুসংস্কারাচ্ছন্ন কিছু মানুষ হত্যা করে বেড়ায় নিরীহ এই প্রাণীকে। অস্ট্রিয়ার কোন কোন পাহাড়ি জনপদে নাকি মারমোত্তার দাঁত দিয়ে তথাকথিত শিকারি পুরুষেরা কোমরের বেল্টের কারুকাজ করতেও দ্বিধান্বিত হয়না। ইঁদুরের মতই এর দন্ত বিকাশের কোন সীমা নেই, আজীবন বাড়তে থাকে। অবশ্য প্রায় সারাদিনই চর্বনে ব্যাতিব্যাস্ত থাকে বলে যতটুকু বাড়ে ততটুক ক্ষয় হয়ে যায় প্রকৃতির নিয়মেই। গর্ত খোঁড়ার সময় যদি পাথর টুকরো সামনে পড়ে তবে থাবার নখের সাথে দাঁতদুটিও সমানভাবে কাজে লাগিয়ে দেয় তা সরাতে।
কাম্পোফন্তানা বেশ কয়েকবারই ট্র্যাকিংয়ে গিয়েছি গ্রীষ্মের শেষদিকে। মারমোত্তার দেখাও মিলেছে সৌভাগ্যক্রমে একবার, ক্যামেরা তাক করতে না করতেই হাওয়া। দিনটাও ছিল চমৎকার, শরতের সেই মিষ্টি রোদে একটু আয়েশ করে পাথরের উপর বসে ঝিমুতে পছন্দ করে এরা। চর্বির ভারে শরীরটাও হয়েছে ভারিক্কী, একটু হেলেদুলে অলস দিনগুলি কাটিয়ে দিচ্ছে ছুটির আমেজে। আমার অভিজ্ঞ ট্র্যাকিং সঙ্গী জানাল মারমোত্তা দেখার জন্য সেপ্টেম্বর মাসই আদর্শ সময়। আর কিছুদিন পরেই তো মন না চাইলেও ঢুকতে হবে গর্তে, দীর্ঘ শীতনিদ্রার পূর্বে ভরপেট প্রাণীগুলি চলনে-বলনে এখন হয়ে যায় একটু আয়েশি। বিপদ দেখলে সতর্ক থাকে, কিন্তু হুট করে গর্তের ভিতর পালিয়ে যায়না।
শরতের রোদে বসে আছে মারমোত্তা
গর্ত
সদা-সতর্ক যে থাকে সেতো আমি আগেই বুঝেছি মারমোত্তার শিস(হুইসেল) শুনে। তাও আবার নানা ধরনের, কোনটা হ্রস্ব কোনটা আবার প্রলম্বিত। জানতে পারলাম প্রহরী মারমোত্তা ছোট হুইসেল দেয় যখন বিপদ আসে আকাশ থেকে, হতে পারে ঈগল পাখি। লম্বা হুইসেল মারে যখন আসে কোন নেকড়ে বা আদমসন্তান। হুইসেলের গভীরতা শুনেই দলের বাকিরা বুঝে যায় কতটা দূরে আছে সেই আসন্ন বিপদ।
প্রহরী মারমোত্তা ছবি-ইন্টারনেট
La marmotta sentinella fischia.mp3
মারমোত্তার শিস
মারমোত্তার দেখা না মিললেও কতবার একাকী ট্র্যাকিংয়ে গিয়ে একমনে হেসেছি সেই শিস শুনে, ভাবটা এমন “বাবাজী ভেবনা তুমি রয়েছ একা, আমরাও আছি তোমার সাথে”। ১৬০০ মিটার উঁচুতে তো আর কাঠঠোকরা পাখি দিবেনা আমায় সঙ্গ, বরফগলা ক্ষীণ স্রোতধারার কলকল শব্দ আর তৃণভূমির হিমেল হাওয়ার পরশে মনটা যখনি হয় উদাসী, মারমোত্তা হুইসেল বাজিয়ে জানিয়ে দেয় ‘অ্যাটেনশন, দূরে থাক বাবাজী’!
মজার একটা তথ্য পেলাম ইন্টারনেটে। আগে ভাবতাম আমার নিকট প্রতিবেশী এই আল্পিয় মারমোত্তা আর সেই সুদূর উত্তর আমেরিকার প্রেইরি ডগ(Prairie dog) প্রায় একই ধরণের প্রাণী। এখন শুনি ওদের নাকি শীতনিদ্রার অভ্যাস নেই, পোষও নাকি মানানো যায়। হবে হয়ত, আমি এখন দিন গুনছি কবে বসন্ত ছুঁয়ে যাবে কাম্পোফন্তানার পাহাড়ি ভ্যালিগুলিতে। কবে আবার গর্ত থেকে উঁকি দিবে একটি মারমোত্তা, অভুক্ত শরীরে রয়ে যাওয়া তিল পরিমাণ শক্তি দিয়ে একটি হুইসেল দিয়ে জানিয়ে দিবে সবাইকে ‘হে-হে ভাইয়েরা আমার…… এসেছে বসন্ত……… ঘুমন্ত শরীর-মনটাকে জেগে তোলার এসেছে প্রহর………’
………জিপসি
মন্তব্য
চমৎকার!
ধন্যবাদ। দেখি এবছর যদি মারমোত্তার ভাল কিছু ছবি তুলতে পারি তবে হয়ত আরেক কিস্তি লিখে ফেলব(বড়দের জন্য)
………জিপসি
লেখা আর ছবি -দুটোই ভাল লেগেছে, জিপসি!
.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল
এটা অনেকটা আমার ছেলেকে বলা ‘ঘুমপাড়ানিয়া’ গল্প। আপনারও ভাল লেগেছে জেনে খুশি হলাম
………জিপসি
দারুন।
__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---
ধন্যবাদ আপনাকে। আমার বাচ্চা ছেলেকে গল্পটা অনেকবারই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলেছি, আমার তো প্রায় মুখস্ত হয়ে গেছে! বাংলায় অনুবাদ করে গুছিয়ে লিখতে অবশ্য বেশ কষ্ট হয়েছে।
………জিপসি
সুনদর ছবিসহ লেখাটি । ভাল লাগল ।
..........জিপসি
ভাল লাগল।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
ধন্যবাদ
......জিপসি
চমৎকার।
____________________________
শুভেচ্ছা জানবেন, প্রফেসর সাহেব!
.........জিপসি
নতুন মন্তব্য করুন