লোহিত সাগরের তীরে দেশটি, তাই এর নাম ‘লোহিত ভূমি’। হ্যা, ‘ইরিত্রিয়া’ শব্দটিকে বাংলায় অনুবাদ করলে এই অর্থ-ই বোঝায়। সুদান, ইথিওপিয়া, জিবুতি আর লোহিত সাগর দিয়ে বেষ্টিত দেশটি। এর বিশাল এক অংশ জুড়ে সমুদ্র থাকাতে সেই প্রাচীনকাল থেকে এই পথ দিয়ে এখানে উপনিবেশ গেঁড়েছে আরব, মিশরিয়, ইংরেজ আর রোমান শাসকরা। তখন অবশ্য এটি কোন স্বাধীন দেশ ছিল না, ইথিপিয়ার একটা অংশ হিসেবে ছিল। ত্রিশ বছর ধরে যুদ্ধ চলে ইথিওপিয়া সরকার আর ইরিত্রিয়ার স্বাধীনতাকামী মানুষদের সাথে। অবশেষে ১৯৯১ সালে স্বাধীনতা লাভ করে দেশটি।
ইরিত্রিয়ার রাজধানী আসমারাকে বলা হয় Piccola Roma যার অর্থ হল ‘ছোট্ট রোম’। ১৯১৩ আর ১৯১৫ সালে ভয়াবহ দুটি ভূমিকম্প হয় এখানে, ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় আসমারা। সেইসময় এখানে ছিল রোম সাম্রাজ্যের আধিপত্য। ভূমিকম্পের পর রোমানরা পুরো আসমারাকে আবার নতুনভাবে গড়ে তোলে যেটার রিফ্লেকশন আমি নিজেই ওখানে দেখেছি।
আফ্রিকান দেশগুলোতে এতো জাতিগত বৈচিত্র্য যে নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয় না। ইরিত্রিয়াতেও তাই দেখেছি। পুরো জাতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীতে বিভক্ত। প্রচুর অনুর্বর ভূমি, খুব-ই কম হাইরাইজ বিল্ডিং যা হাতে গোনা যায়। একটা মাত্র ইউনিভারসিটি তাও আবার পলিটিকাল কারনে ওই সময় বন্ধ ছিল। আরো আছে............ আপনি ইছছা করলেই ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারবেন না, ইছছা করলেই মোবাইল এর সিম তুলতে পারবেন না। ওদের প্রেসিডেন্ট মিস্টার ইসাইয়াস আফেওয়ারকি-র একনায়কতন্ত্র এমনভাবেই দেশটাকে গ্রাস করে রেখেছে যে প্রিন্ট আর ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার স্বাধীনতা বলে কোন কিছু নাই। একটামাত্র জাতীয় দৈনিক পত্রিকা যেখানে শুধু সরকার এর গুণগান আর একটাই টিভি চ্যানেল যেখানে বেশীরভাগ সময় প্রেসিডেন্ট এর ভাষণ দেখায়। কিন্তু মানুষগুলো বেশ ভালো। খুব সহজ-স্বাভাবিক ব্যবহার। যেহেতু আমার প্রথম আফ্রিকা ভ্রমন, বেশ এক্সসাইটমেন্ট কাজ করছিল নিজের ভিতরে। ওখানে গিয়ে আরো এক্সসাইটটেড হই ওদের হেয়ারস্টাইল দেখে (কারন চুল নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করা আমার অনেক পূরনো শখ)। বেশিরভাগ মেয়েরাই খুব ছোট ছোট বেনি করে আর এই বেনির গাঁথুনি এতোই সুক্ষ যে মাথার তালুর অনেকটাই দৃশ্যমান। অনেকে আবার বেনির আশ-পাশটা শেভ করে ফেলে যাতে তাদের আরো আকর্ষণীয় দেখায়। কেউ কেউ আবার চুলের শেপটা এমন করে যে দেখলে মনে হবে এটা কোন মাথা না, যেন একটা কালো কামরাঙ্গা জাতীয় ফল! মনে মনে পুরো ডিসাইড করে ফেললাম যে ওদের মত একটা কার্লি টাইপ লুক নিয়ে বাংলাদেশে ফিরব! যাই হোক পরে কোন এক কারনে ইচ্ছাটা পূরণ করতে পারি নাই, মনে আক্ষেপটা রয়ে গেছে এখনো!
এইবার খাওয়াদাওয়া নিয়ে কিছু বলি............ আমি হচ্ছি এমন এক ‘ভেতো বাঙালি’ যার প্রিয় খাবার হল ডাল-ভাত-আলু ভর্তা। আর আমি হচ্ছি সেই লেভেলের ‘ভেতো বাঙালি’ যে কিনা যত বড় রেস্টুরেন্টে-ই খেয়ে আসুক না কেন বাসায় ফিরে একটুখানি হলেও মায়ের হাতের রান্না করা খাবার খাবে। তো প্রথম দিন Hotel Asmara Palace-এ বুফে খেলাম, অতো খারাপ লাগল না (মানে খারাপ লাগতে দিলাম না আর কি)। কিন্তু পরের দিন গেলাম বাইরের একটা রেস্টুরেন্টে। মেন্যু দেখে কিছুই বুঝি না, কোনটা ভাল কোনটা মন্দ কোন আইডিয়াই নিতে পারছিলাম না......... তাই ‘ভেতো বাঙালি’ হিসেবে চিরাচরিত বৈশিষ্ঠ্য বজায় রাখলাম! রাইস টাইপের একটা মেন্যু দেখে অর্ডার দিয়ে দিলাম। বেশ কিছুক্ষন পর আমার টেবিলে এলো বড় এক প্লেট ভর্তি ইয়া লম্বা লম্বা চালের একগাদা ভাত, সাথে নাম না জানা মাছের বিশাল বড় কুচকুচে কালো দুইটা পিস, অলিভ অয়েলের কৌটা (মনে হয় ডালের সাবস্টিটিউট!), সস জাতীয় কাচা কাচা একটা থকথকে পদার্থ ......... আমার গলা দিয়ে যেন আর নামছিল না............ লবন আর মশলাবিহীন পদার্থ!!! সেই মুহূর্তে আমার ছোট বোন শান-এর কথা খুব মনে পড়ছিল......... শান নিশ্চয় এখন আম্মার হাতের মজার মজার খাবার খাচ্ছে!!! বেশীরভাগ দিন এভাবেই গেছে। এর মাঝে একদিন গেলাম একটা পিজা রেস্টুরেন্টে। উমমমম... মনে হল নাহ লাইফ ইজ নট অলওয়েজ ব্যাড। পিজার সেই টেস্ট এখনো মুখে লেগে আছে (খুব যে মজা ছিল তা না, কিন্তু সেটা ছিল খরার পর এক পশলা বৃষ্টির মত)। একটা মজার ব্যাপার কি জানেন...... আপনি যে খাবার-ই অর্ডার দেন না কেন, এত্ত দেরি করে ওরা সার্ভ করে যে অনেক সময় এমন হয়েছে যে ভুলেই গেছি আসলে কি জানি অর্ডার দিয়েছিলাম!!!
ওদের জাতীয় খাবার নিয়ে কিছু না বললেই না। মুরগী/বিফ/ভেড়ার মাংস দিয়ে নন-স্পাইসি ‘সেবি’ নামক একধরনের ঝোল রান্না করে যেটা ওরা ঈস্ট আর গম দিয়ে তৈরী রুটি ‘ইঞ্জেরা’ দিয়ে খায়, সাথে থাকে ‘হিলবেট’ নামক ডাল ভর্তা। এই খাবারটা নাকি Horn of Africa-র অন্যান্য দেশের-ও মেইন ফুড। সত্যি কথা বলতে কি...... আমার কাছে একটু-ও ভালো লাগে নাই। মাঝে মাঝে নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হয় যে আমি বাংলাদেশে জন্ম নিয়েছি, নইলে এত্ত মজার বাঙ্গালী খাবার আমি কই পেতাম!
বিশ-বাইশ বছর হল দেশটা পুরোপুরি স্বাধীন কিন্তু সেই অর্থে কোন উন্নতি করতে পারে নাই, শুধুমাত্র ওদের গভঃমেন্টের কারনে। ধরেন কোন ইরিত্রিয়ান একটা ল্যান্ড পারচেস করল বাট সেই ল্যান্ডের মালিক হবে গভঃমেন্ট! দেশটির সবকিছুর মালিক হল ওদের সরকার! ইন্টারনেট ইউজ করতে হলে আপনাকে যেতে হবে কোন ফাইভ স্টার হোটেলের বিজনেস সেন্টারে। বিদেশিরা কোন মনুমেন্ট বা বিল্ডিং এর ফটো তুলতে পারবেন না। আমি একদিন ওদের এক মহিলা ভিক্ষুক দেখে খুব খুশি হলাম (আফ্রিকান ভিক্ষুক বলে কথা!), একটা ছবি তোলার পর হঠাত এক লোক এসে আমাকে ধমক দিয়ে বলল “No, no….you can not take photo of this lady. Please don’t do it here”.
তবে একটা কথা না বললেই না, লোকজন ট্র্যাফিক সিগনাল মানার ব্যাপারে মারাত্তক ওবেডিয়েন্ট। কোন জ্যাম নাই রোডে। বেশ নিট অ্যান্ড ক্লিন রোডগুলো। জাতি হিসেবেও অনেক মিশুক । ওরা আমার সালওয়ার-কামিজ, আমার সিলকি চুল, এমনকি আমার কপালের টিপ টা পর্যন্ত অনেক পছন্দ করেছে! আমি এখনো ওদের সঙ্গ মিস করি।
(ওহহো একটা কথা শেয়ার করতে ভুলে গেছি...... কখনো ইরিত্রিয়া গেলে স্থানীয় পেয়ারার জুস খেতে ভুলবেন না প্লিজ। অসম্ভব সুস্বাদু একটা খাবার!)
মন্তব্য
খুব ভাল লাগল। খুব মজা পেয়েছি পড়ে। আর ইরিত্রিয়াকেও জানা হল। আগে শুধু দেশটির নামই জানতাম।
সেবি, ইঞ্জেরা, হিলবেট চেখে দেখতে ইচ্ছে করছে। সেবির ঝোল বানায় কি করে?
আরো আকর্ষণীয়? ভয় পাইছি!
এই জায়গায় আপনার সাথে মিল আছে আমার। আমারও এমন হয়। আর এজন্যই কখনো দূরদেশে যাওয়ার কথা ভাবতেও পারি না।
আর, হ্যা, এত্ত সুন্দর একটি লেখা লিখে নাম না দিলে চলে? লেখালেখি চলুক!
.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল
Thanks
আপু, আপনি শেষ পর্যন্ত সচলে লেখা দিয়েছেন দেখে খুশী হলাম। লেখার নিচে নিজের নাম বা একটা নিক দিয়ে দিয়েন। নাহলে অতিথি লেখকদের লেখার মধ্য থেকে আপনাকে আলাদা করা যাবে না। লিখতে থাকুন।
Thanks Kamol for encouraging me
আরো কিছু ছবি দিলে ভালো হতো। এরকম লেখা আরো আসুক।
ভালো লাগলো।
আফ্রিকার দেশগুলোর সাথে আমরা একরকম আত্মীয় বোধ করি সবসময়। আমাদের মাঝে 'আন্ডারডগ' টাইপের একটা সেন্টিমেন্ট কাজ করে। আবার, আফ্রিকার দেশগুলোর সবচেয়ে বড় সমস্যা হল তাদের নিজেদের সরকারগুলো, তারাই (অনেক সময় বাইরের সাদা চামড়ার লোকদের সাথে যোগসাজসে) দেশগুলোকে সামনে এগিয়ে যেতে দিচ্ছে না।
অনেক ভালো লাগলো ইরত্রিয়া সম্পর্কে জেনে।
শুভেচ্ছা
[মেঘলা মানুষ]
লেখিকার নাম তো জানা গেল না। আর এত যে চমৎকার বর্ননা দিলেন ওদের কবরী বিন্যাসের, তার ছবি কই?
তিন নাম্বার ছবিটা দেখে মনে হল খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ ভাজা।
পড়তে বেশ লাগছিল,লেখাটা আরেকটু বড় হলে আরও ভাল লাগত।
আরও লিখুন প্লিজ।
__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---
বাহ, যামুই যামু
facebook
নতুন একটা দেশ সম্পর্কে জানলাম
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
আমি যেখানে থাকি সেখানে বেশ কয়েকজন ইরিত্রিয়ান আছে । এরা বেশ মিশুক এবং ভালো মানুষ । আপনার লেখা পড়ে মনে হচ্ছে ইরিত্রিয়া না গেলেই নয়।
Mohammad Anwar
ভালো লাগলো প্রায় অজানা একটা দেশের কথা পড়ে। তবে আরো বেশী তথ্য থাকলে ভালো হতো - লিখুন না ইরিত্রিয়া নিয়ে আরো দু এক পর্ব। আপনার লেখার ঢংটাও পছন্দ হয়েছে। কিন্তু লেখার মাঝে ইংরেজী শব্দের ব্যবহার একটু বেশী মনে হয়েছে - আরেকটু চেষ্টা করলেই উপযুক্ত বাংলা শব্দ দিয়ে প্রতিস্থাপিত করে দেয়া যেত।
ছবি কয়েকটা বেশী হলে ভালো লাগতো। ঠিক মন ভরলো না এই কয়টা ছবি দেখে। অবশ্য অল্প ছবিটা "বিদেশিরা কোন মনুমেন্ট বা বিল্ডিং এর ফটো তুলতে পারবেন না" এটার ফলাফলও হতে পারে।
আরো লিখুন।
____________________________
তোর এই লেখাটা আসলেই অনেক ভাল হয়েছে দোস্তো। অনেক সুন্দর করে সবকিছু বর্ণনা করতে পারিস।
ফাহিমা দিলশাদ
নতুন মন্তব্য করুন