একবার এক বাঙ্গালী ভদ্রলোক এর সাথে পরিচয় হয়। উনি ফ্যামিলি নিয়ে ক্যামেরুন থাকেন। ওখানে ব্যবসা করেন, মাঝে মাঝে বাংলাদেশে আসেন। অনেক গল্প হওয়ার পর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে ব্যাপারটা নোটিশ করেছিলাম তা হল ক্যামেরুনে প্রচুর এইডস রোগী আছে, আর দিন দিন এই রোগের হার বেড়েই চলছে। বিশেষ করে তরুন প্রজন্ম এই রোগে সব চেয়ে বেশি আক্রান্ত। কেন জানি মাথার ভিতর কথাটা ঢুকে গিয়েছিল। বাসায় এসে ছোট বোনের সাথে শেয়ার করার সময় আম্মা হয়ত শুনে ফেলেছিলেন, আর তখনি তাঁর কড়া নির্দেশ, যেখানেই যাও সমস্যা নাই, কিন্তু ক্যামেরুন যেতে পারবা না। বলা যায় না, কোথা থেকে কি হয়! সাপ্রাইজিংলি এর কয়েক সপ্তাহ পর ক্যমেরুন যাওয়ার ডাক পড়ল। যে যাই বলুক আমি এক্সসাইটেড! রজার মিলার দেশ বলে কথা! তাছাড়া এক সাথে অনেক এইডস রোগী দেখতে পাবো, এটা ভেবেই মনে মনে এক অজানা অনুভূতি কাজ করছিল! রাতে খাওয়ার সময় বাসায় জানালাম যে আমাকে ক্যামেরুন যেতে হবে। শোনামাত্র আম্মা শকড্! অনেক করে বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে আমাকে যেতেই হবে। অতঃপর এই বলে দফা-রফা হল যে ক্যামেরুন যেয়ে কারো সাথে হ্যান্ডশেক করা যাবে না। আম্মাকে কি করে বোঝাই যে হ্যান্ডশেক করলে এইডস সংক্রমিত হয় না!
মধ্য আফ্রিকার একটি দেশ হল ক্যামেরুন। ভূতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের কারনে ক্যামেরুন কে বলা হয় ‘আফ্রিকার ক্ষুদ্র প্রতিরূপ’। এখানে সমুদ্র, পাহাড়, মরুভূমি, রেইনফরেস্ট, সাভানা সবই আছে। দেশটি একসময় ফ্রেঞ্চ কলোনি ছিল, তাই বেশীরভাগ ক্যামেরুনিয়ান ফ্রেঞ্চ ভাষায় কথা বলে। দুই কোটি মানুষের এই দেশে দুইশোর বেশি জাতি বাস করে। আর একারনে জাতিগত প্রচুর পার্থক্য আছে এখানে।
যেহেতু ক্যামেরুনের কোন অ্যাম্ব্যাসি কিংবা কনসুলেট বাংলাদেশে নাই, তাই যেতে হবে ‘ভিসা অন অ্যারাইভাল’ নিয়ে। মানে ক্যামেরুনের এয়ারপোর্ট দোয়ালা পৌঁছালে ভিসা পাওয়া যাবে। ঢাকা-দুবাই-আদ্দিস আবাবা-দোয়ালা এক লম্বা রুট! প্রথম ধাক্কাটা খেলাম ঢাকা এয়ারপোর্ট-এ। ইমিগ্রেশন অফিসার অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করার পর সন্তুষ্ট হতে না পেরে তার বসের কাছে নিয়ে গেল। বস হলেন এক ভদ্রমহিলা, বেশ গুড বিহেভড – এমনটা সাধারণত আমাদের দেশের ইমিগ্রেশনে দেখা যায় না। অনেক কিছু জিজ্ঞেস করলেন- কোথায় যাবো, কেন যাবো, কোথায় থাকবো, কবে ফিরবো, রিটার্ন টিকেট আছে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি। আমিও খুব চেষ্টা করলাম স্মার্টলি ব্যাপারটা হ্যান্ডেল করার। কি মনে করে যেন ক্যামেরুন ইমিগ্রেশনের একটা অফিসিয়াল ডকুমেন্ট কপি করে ওনার কাছে রেখে দিলেন ভদ্রমহিলা। অবশেষে মুক্তি পেলাম! এমিরেটস এর উড়োজাহাজ এ চড়ে ছয় ঘন্টা পর দুবাই পৌঁছলাম। চার ঘন্টার ট্রানজিট ছিল ওখানে। দুবাই এয়ারপোর্টে একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম, ওদের কাছে বাংলাদেশি পাসপোর্ট বহন করা সব মানুষই যেন সন্দেহজনক। এখানেও অনেক জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে হল! ভালো খারাপ মিলিয়ে ঘন্টা দুয়েক পর ওরা ছাড়পত্র দিল! দুবাই থেকে ইথিওপিয়ার আদ্দিস আবাবা যেতে প্রায় সাড়ে ছয় ঘন্টা লাগলো। আদ্দিস এয়ারপোর্টে আড়াইঘন্টা ওয়েট করার পড় চেপে বসলাম ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজে। গন্তব্য ক্যামেরুনের দোয়ালা। ছোটবেলা থেকে বই পড়ার অভ্যাস থাকার কারনে আর বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের সদস্য হওয়ার সুবাদে প্রচুর আজে-বাজে, ভালো-খারাপ বিভিন্ন টাইপের বই পড়েছি। সেই রকম কোন একটা বইয়ে পড়েছিলাম আফ্রিকার এক উপজাতি সম্প্রদায়ের কথা যাদের গায়ের গন্ধে বনের পশু-পাখিরাও নাকি পালায়। এত বছর পর বুঝলাম গায়ের গন্ধ কি জিনিস! উড়োজাহাজে ওঠার পরই এক আদিম উছ্রিঙ্খল বোঁটকা গন্ধ নাকে এসে লাগল, মনে হচ্ছিল নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে বোধহয় মরেই যাবো! আমার ঠিক পাশেই এক আফ্রিকান তরুনী বসেছিল। মেয়েটার বয়স কম, কিন্তু অবিশ্বাস্য রকমের স্থুল। আহা নিজেকে যে কত স্লিম লাগছিল, বার বার মনে হচ্ছিল ইশ আমি কত সুন্দর! ওই সময়টা ‘নারসিসাস’ হয়ে গিয়েছিলাম আর কি! তবে সাতটা ঘন্টা ওই মেয়ে আমাকে যে পেইন দিয়েছে তা বলার মত না। পুরোটা সময় আমার গায়ের উপর ঢুলছিল, আর সেই রকম সুবাস ছড়িয়ে দিচ্ছিল আমার নাকে! উড়োজাহাজ জুড়ে চলছিল অ্যালকোহলের মহা উৎসব! ফ্রি পেয়ে আর যেন কেউ ছাড়তে চাইছিল না! যাই হোক, তখনো জানতাম না এর চেয়েও ভয়ঙ্কর কিছু ওয়েট করছে!
ক্যামেরুন পৌঁছলাম। দোয়ালা ইমিগ্রেশন অফিসার প্রথমেই সব কাগজপত্র, পাসপোর্ট নিয়ে নিল। মিনিট দশেক পর জানা্লো এখনি ক্যামেরুন ছাড়তে হবে, কাগজপত্র সব অবৈধ! কিছুই বুঝতে পারছিলাম না, আসলে কি ঘটতে যাচ্ছে! একেই বোধয় বলে ‘মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়া’! এমনকি কথা বলারও কোন সু্যোগ দিচ্ছিল না। এর মধ্যেও যা বুঝতে পারলাম তাহলো কাগজপত্র সব ইস্যু করা হয়েছে জুন মাসে, কিন্তু জুলাই মা্সের এক তারিখ থেকে ক্যামেরুনের ইমিগ্রেশন আইনের কিছুটা চেঞ্জ হয়েছে, যদিও ক্যামেরুন গভর্নমেন্ট প্রপারলি সারকুলেট করে নাই এটা। আত্নপক্ষ সমর্থনের কোন সুযোগই দিল না! এটা যে ওদের সরকারের ব্যর্থতা তা কিভাবে বুঝাবো এদের কে! কেন জানি মনে হচ্ছিল কিছু ডলার দিলে কি কাজ হবে! এর মাঝে আর একজন অফিসার আমার ব্যাগ থেকে বেশ কিছু স্যূভেনির (যেটা আমি বাংলাদেশ থেকে নিয়ে গিয়েছিলাম) জোর করে নিয়ে গেল। এরপর যা ঘটল তা কল্পনার চেয়েও বেশী! মিনিট খানেকের মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করলাম ফিরতি ফ্লাইটে! হাতে শুধু একটা বোর্ডিং পাস! কোন পাসপোর্ট, ডকুমেন্ট কিছু নাই সাথে। ফ্লাইট আটেন্ডেডকে পাসপোর্টের কথা জিজ্ঞেস করতে বললো উড়োজাহাজ থেকে নেমে দেয়া হবে! সিট পেলাম ওয়াশরুমের পাশে! আবার সেইম জার্নি, জাস্ট ভাইস ভারসা! আদ্দিস এয়ারপোর্টে পৌঁছানোর পর পাসপোর্ট চাইলাম, এবার বললো নেক্সট ডেস্টিনেশনে দেয়া হবে। প্রায় তের-চোদ্দ ঘন্টা আদ্দিস এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করলাম। পোর্টের বেঞ্চিতে বসে সারারাত শীতের ঠান্ডা বাতাসে কাঁপতে কাঁপতে কাটালাম। বিদেশ-বিভুইয়ে উদ্ভ্রান্তের মত ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছি, সাথে নাই পাসপোর্ট! এরপর দুবাই পৌঁছানোর পর পাসপোর্ট পেলাম হাতে। আহ সে কি অনুভূতি! মনে হচ্ছিল এর নামই বোধয় ‘সোনার হরিণ’! এমিরেটস এর উড়োজাহাজ এ চড়ে রওনা দিলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে! কাহিনী এখানেই শেষ নয়! ঢাকা এয়ারপোর্টে নেমে আবিষ্কার করলাম ‘লাগেজ ইস মিসিং’! অতঃপর লাগেজ ছাড়াই গাড়িতে উঠলাম!
রজার মিলার দেশটা দেখা হল না! টানা চারদিন উড়োজাহাজে চড়ে জার্নি করে প্রচন্ড ক্লান্ত, অসুস্থ আর বিধস্ত এক মানুষ আমি! তবুও যেন আর তর সইছিল না, কখন যে বাসায় যাবো আর আম্মার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়বো!
[সামশাদ]
মন্তব্য
ভয়ানক অভিজ্ঞার মাঝ দিয়ে গেছেন দেখছি । কিন্তু অনেক কিছুই অস্পষ্ট থেকে গেল, কি ভিসায় গেলেন, কেনই বা ফিরিয়ে দিলো, পরে আর গিয়েছেন কিনা?
লেখায় ইংরেজি শব্দের ব্যবহার একটু বেশি ছিলো যা চোখে লেগেছে, বাংলা যেখানে ব্যবহার করা যায় সেখানে ইংরেজি ব্যবহারের কোন দরকার দেখছি না। তবে লেখাটা পড়ে ভালোলেগেছে, আপনার বর্ণনা করার দক্ষতা বেশ ভালো, লেখা চলুক। শুভেচ্ছা ও
মাসুদ সজীব
ছবি এমন ঝাপ্সা কেনো ?
বেশ কষ্টকর অভিজ্ঞতা । তবু বিমান ভ্রমন ত হল !!
Mohammad Anwar
পুরো লেখাটার মধ্যে আপনার মনের সংকীর্ণতা ফুটে উঠেছে. একসাথে অনেক এইডস রুগী দেখা যাবার সাথে অজানা অনুভুতি , আফ্রিকানদের গায়ের গন্ধে জন্তু জানোয়ার পালিয়ে যায়, স্থুল মহিলার পাশে নিজেকে শুকনো লাগা, আফ্রিকান মহিলার পাশে নিজেকে সুন্দর লাগা এই সবের মাঝে প্রকট রেসিজম দেখা যাচ্ছে. আফ্রিকার মানুষদের নিয়ে আপনার যে মনোভাব, সেখানে ওই মহাদেশের একটি দেশ যে আপনাকে ঢুকতে দেইনি, ভালই করেছে.
পোয়েটিক জাস্টিস .
খুবই ভয়াবহ অভিজ্ঞতা!
এখানে আমি কিন্তু কোন রেসিজম দেখতে পাচ্ছি না ভাই। একটা মানুষ যখন এমন একটা সময়ের মধ্যে যায় তখন মাথা ঠিক রাখাই কঠিন! উনি কিন্তু এখানে সেই সময়টাকেই তুলে ধরেছেন।
আরো লিখবেন আশা করি।
[উড়ন্ত প্রজাপতি]
নতুন মন্তব্য করুন