গল্পটা যদিও বেশ পুরানো তবুও না বলে আসলে থাকা যাচ্ছে না। সেদিন ১৭ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে বোধহয় নতুন এক মাত্রা যোগ হল। যার পর থেকে ক্রিকেট খেলায় জেতা যেন আমরা ভুলেই গিয়েছি। শুধু জেতা কেন আমরা বোধহয় খেলাও ভুলে গিয়েছি। গল্পটা না হয় একটু আগে থেকেই শুরু করা যাক। বেলা তখন বারোটা বেজে তেতাল্লিশ মিনিট। আমি টেলিভিশনের সামনে বসে চিন্তা করছি খেলাটা মাঠে গিয়ে দেখলে কেমন হয়। আগের রাতে আকাশের অবিরাম কান্নায় খেলার মাঠ প্রায় জলে থৈ থৈ করছে। দেড়টার দিকে মাঠ পরিদর্শন শেষে জানা যাবে বাংলাদেশ বনাম শ্রীলঙ্কার ওয়ান ডে ম্যাচ সিরিজের প্রথম খেলা ঠিক ক’টায় শুরু হবে। মনে হল খেলা শুরু হতে যখন দেরীই হচ্ছে তাহলে মাঠে যাওয়ার একটা চেষ্টা দেয়া যেতে পারে। মাকে ডেকে বললাম,“চল খেলা দেখতে যাব।”
মা জবাব দিলেন, “ টিকিট?”
“মাঠে গেলেই আশা করি পাওয়া যাবে।”
আমার যখন যা মনে হয় তাই করে ফেলি। মা এবং ভাইকে নিয়ে মিরপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। সিএনজি থেকে নেমে টিকিটের খোঁজে এদিক ওদিক করলাম কিছুক্ষণ। টেস্ট সিরিজে বাংলাদেশের অবস্থা তেমন সুবিধার না হওয়ায় খেলা নিয়ে মানুষের উৎসাহ খুব একটা বেশি ছিল না। তাই তিনটা টিকিট জোগাড় করতে তেমন বেগ পেতে হল না। সাউথ গ্যালারিতে এক একটা ১০০ টাকার টিকিট ৩০০ টাকায় কিনলাম। একশ একশ করে দুই ভাই বোন দুটা মাথার ক্যাপও কেনা হল। ম্যাচ দেখার জন্য আমরা মোটামোটি প্রস্তুত বলা যায়। জীবনে প্রথমবার কোন ওয়ান ডে ম্যাচ দেখতে যাচ্ছি তাই আমার মধ্যে চরম উত্তেজনা কাজ করছে। ভিতরে ঢোকার মুখেই কান ফাটানো করোতালির শব্দ শোনা গেল। ঢুকে দেখলাম খেলা আগেই শুরু হয়ে গেছে এবং শ্রীলঙ্কার এক উইকেট পরেও গেছে। ২২ রানে তারা প্রথম উইকেট হারিয়েছে। চিন্তা করলাম বেশি খুশি হয়ে লাভ নেই। এই হাসি মিলিয়ে দিতে বাংলাদেশ তো এক্সপার্ট। আর সাংগাকারা তো আছেই খেলার শুরু থেকে শেষ প্রান্ত পর্যন্ত, সে থাকবেই। তবে সবার সব ভুল ভ্রান্তি ভেঙ্গে দিয়ে বাংলাদেশের দামাল ছেলেরা আমাদের চমকের উপরে চমক দিয়েই গেল। ২১ অভার ৩ বলে শ্রীলঙ্কার মতো বিশ্বজয়ী দলের ৮ উইকেট ফেলে দেয়া কম কথা তো নয়। তখন শ্রীলঙ্কার খাতায় রান মাত্র ৬৭। পাশ থেকে কেউ বলে উঠল, ‘টাকা উসুল হয়ে গেছে। এবার যা দেখব সব বোনাস।’ আমি বরাবরই স্রোতের উল্টো দিকে চলি। এত কিছুর পরেও মন কেন যেন সায় দিচ্ছিল না এই প্রাপ্তি মেনে নিতে। মনের কোন এক কোণে একটা ভয় ছিল। এতটা পেয়ে যাব আশা করে তো আসিনি। আশপাশের সবাই যখন এই খেলা উপভোগ করছে আমি তখন মনে মনে হিসাব কষছি-শ্রীলঙ্কার যদি এই অবস্থা হয় তাহলে বাংলাদেশ তো আরো আগেই অলআউট হয়ে যাবে। এই ফাঁকে পরের জুটিতে হল ৭২ রান। শেষ উইকেট গিয়ে পড়ল ১৮০ রানে।
৪৩ অভারে এই গন্তব্যে পৌঁছান খুব কঠিন কিছু না। তবে নিজের দেশের খেলা বলে কথা। দুশ্চিন্তাটাই আগে মাথায় আসে। রানের খাতা না খুলেই যখন আনামুল বিদায় নিল তখন দুশ্চিন্তাটা বড় বেশি অমূলক মনে হল না। এর পর প্রতি বলেই মনে হল এই বুঝি গেল। কিন্তু দ্বিতীয় জুটি আমাদের উপহার দিল ৭৯ রান। এরপর মুশফিক আর শামসুর রহমানের মিলিত প্রচেষ্টায় এল ৩৫ রান। ১১৪ রানে ৩ উইকেট এবং ওভার ১৯। ম্যাচ জেতার জন্য আর কী চাই। সবাই তখন ধরেই নিয়েছে এই খেলা এখন আমাদের হাতে। তবে বলা হয়ে থাকে ক্রিকেট হচ্ছে সবচেয়ে অনিশ্চিত খেলা – ম্যাচ একজনের কোর্ট থেকে অন্য দলের কোর্টে যেতে সময় লাগে না। এ কথার সত্যতা আমরা আবারও প্রমাণ করলাম। শামসুর রহমানের পেছন পেছন অনেকটা বিনা রান হাতে নিয়েই হাঁটা দিল সাকিব, নাসির এবং মাহমুদুল্লাহ। আশার ভেলা তখন মাঝ দরিয়ায় ডুবি ডুবি করছে। কোন কাজ অপূর্ণ রাখা ঠিক না। তাই ভেলা পুরোপুরি ডুবাতে সাহায্য করল সোহাগ গাজি। এ অবস্থায় আমাদের বুঝতে আর বাকি থাকল না যে এই ম্যাচ জেতা অসম্ভব। খেলা শেষ পর্যন্ত দেখার মত মনোবল ধরে রাখতে পারলাম না। দুঃখের ভার মন ঠিকমত বহন করতে পারল না। আগে থেকেই একটা আন্দাজ ছিল হয়ত জিতব না। তবুও বাংলাদেশ আশাজাগানীয়া। আশা দেখিয়ে নিরাশার ধারালো অস্ত্র প্রচন্ড বেগে হৃদয়ে আড়পার করার কায়দাটা বেশ ভালই জানা আছে তাদের। এবারও এর ব্যতিক্রম হল না।
৭ উইকেট চলে যাবার পর আমরা বেরিয়ে এলাম। সিএনজিতে বসে কেউ কোন কথা বলতে পারলাম না। বলার কী-ই বা ছিল। এই খেলা হারার জন্য কোন কারণ দর্শানো আসলে যথেষ্ট হবে না। তবে নাম না জানা একটা খারাপ লাগা ছিল সেদিন – যা বোঝানো একটু কঠিন। এরপর হারার ক্ষেত্রে আমরা ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছি। বলা যায় একরকম অভ্যাস হয়ে গেছে খেলায় হেরে বাড়ি ফেরা।
এবার আশা যাক আজকের খেলার কথায়। মনের অবস্থা এতটাই বেহাল যে আজকের খেলার বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া আমার জন্য শাস্তিতুল্য। তাই শুধু মনের কথাই বলি। ভীরু মনের কোঠায় ভয় একটা ছিল। হয়ত জানতাম আজকে আফগানিস্তানের সাথেও হার বরণ করতে হবে। বলা যায় মন অনেকটাই প্রস্তুত ছিল এ হার মেনে নিতে। কিন্তু খেলা শেষে যে এভাবে আপাদমস্তক নাড়া খাব তা চিন্তা করা হয়নি। ছোটবেলায় খেলায় হারলে কান্না করতাম। তবে শেষ কবে খেলার জন্য কেঁদেছি আজ আর মনে পড়ে না। কিন্তু খুব আশ্চর্যভাবে লক্ষ্য করলাম আজকে আমার কান্না পাচ্ছে। মন ভেঙে গেছে। এতটা আঘাত খুব কাছের মানুষ ছাড়া আর কেউ দিতে পারে না। হ্যাঁ, আমার দেশ; দেশের খেলোয়াড় – সবাই, সব কিছু আমার এতটাই প্রিয়। তাই বারবার আশা করি জিতব আর বারেবারেই খালি হাতে; না, আসলে নিরাশা ভরা হাতে ফিরে আসি।
-সানজানা শাহনাওয়াজ
মন্তব্য
আফগান ইনিংসের ৩৫ ওভারের পর থেকে ওরা আর আফগানিস্তান ছিল না, যেন হয়ে উঠেছিল অস্ট্রেলিয়া। বাংলাদেশের চেয়ে অনেক ভাল খেলেই ওরা ম্যাচটা জিতেছে।
অস্বীকার করব না। তবে নিজের দেশকে হারতে দেখলে কষ্ট হয়।
সানজানা
পাকিস্তানকে হারালে ১০০ খুনও মাফ।
পাকিস্তানকে নাস্তানাবুদ করতে পারলে আমি গত কয়দিনের সব ভুলে যেতে রাজি আছি।
--ইমরান ওয়াহিদ
এটা এখন ফরজ হয়ে গেছে।
এইডা সবসময়ই ফরজ শিমুল ভাই।
সুবোধ অবোধ
ঠিক ঠিক!!!
শক্তি আছে, সামর্থ আছে... শুধু মনোবলটাই দরকার... পাকিস্তানরে হারাতে পারলে সব মাফ করে দিমু
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
জেতার আশা কেন দুরাশা হবে?!!
কিছুদিন আগের কথা চিন্তা করে দেখুন, কালে ক্ষনে একটা দুিটা ম্যাচ জিতে গেলে সবাই নাচানাচি করত। যারা হারত তাদের খারাপ দিন গেছে বলত। আর এখন? বাংলাদেশ হারলে আমরা বলছি যে আজ বাংলাদেশের খারাপ দিন ছিল। আমাদের মধ্যে বাংলাদেশ দলের প্রতি এই আস্থা তো এই ছেলেগুলোই তৈরি করেছে,নাকি?
একটু ভাল করে চিন্তা করে দেখুন, দল এখন একটা খারাপ সময়ই পার করছে। ইঞ্জুরির কারণে তামিম নেই, যদিও সে অনেকটাই অফ ফর্মে ছিল, তবুও সে পরীক্ষিত। সাকিব মাঠের বাইরে। মাশরাফী ইঞ্জুরিতে। মিডল এবং লেইট অর্ডারের দুই প্রধাণ ভরসা নাসির এবং মাহমুদুল্লাহ বাজে সমইয়ের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে। একটা ব্যালান্সড দলের মূল ৫ জন প্লেয়ারের যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে সাময়িক ভাবে এই সমস্যা হবেই।
আর গতকালের খেলায় মুশফিকের ভুল আউট টা অনেক বড় একটা টার্নিং পয়েন্ট ছিল। সাথে আব্দুর রাজ্জাকের নাবালকের মত আউট হয়ে যাওয়া!!
দুঃসময়ে পাশে থাকাটা খুউব জরুরী। আসুন, হতাশ না হয়ে বরং এই ছেলেগুলোকে সাহস দেই। আশা করি খুব শিঘ্রই দুঃসময় কেটে যাবে।
সুবোধ অবোধ
লেখার আগে ঠিক এ কথা গুলোই আমার মাথায় ছিল। এখন আমরা জিতব বলেই মাঠে নামি। আগে ভাল খেলে হারার আশা করতাম। দিন তো অবশ্যই বদলাইছে। আর অর্ধেক টিম নিয়ে খেলছি - সেটা তো আছেই। আমার অভিযোগ ছিল শ্রীলংকার সাথে প্রথম ম্যাচটা নিয়ে। এই খেলা হারার কোন কারণ থাকতে পারে না। আবেগ আসলে কারণ মানতে চায় না। তবে আশা আছে বলেই এখনো খেলা দেখতে ব্ল্যাক এ টিকিট কেটে মাঠে যাই।
-সানজানা
বাংলাদেশের খেলা দেখতে গেলে এখন থেকে পেয়ারা গাছের চিকন ডালা সাথে নিয়ে যাবেন। হুমুন্দির নাতিরা খেলতে নামার সময় এই ডালা দেখায়ে দিবেন। হুদাহুদি আউট হবি, বাইড়াইয়া পাছা ফ্যাতাফ্যাতা কইরালামু। ফিল্ডিং-এ তেড়িবেড়ি করবি, বাইড়াইয়া হোতায়ালামু। এরপর দেখেন, না জিত্যা যাবে কই! দেশের ষোল কোটি মানুষের আবেগ নিয়া হাদুমপাদুম, ফাইজলামি নাকি!
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
নতুন মন্তব্য করুন