মানুষের সকল দৈহিক বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রন করে মূলত ২২ জোড়া জিন। যা বংশানুক্রমিক ভাবে পিতা-মাতা থেকে সন্তানের মাঝে বাহিত হয়। কিন্তু মানুষের মনোজগত, মানুষের বোধ, ভালোলাগা টুকু থাকে সতন্ত্র. এগুলো জিনগত বৈশিষ্ট্য নয়, এগুলো আনিত বৈশিষ্ট্য. যা মানুষ নিজ চেষ্টায় নিজের মাঝে ধারন করে। এই বোধ, ভালোলাগা, আর মনোজগত টুকু সতন্ত্র ভাবে গড়ে তুলতে সাহায্য করে শিক্ষা। কিন্তু এই সতন্ত্র বিষয়গুলোকেও আমরা অপরিবর্তনীয় জিনের মতো করে অপরিবর্তনীয় বংশীয় বৈশিষ্ট্য করে ফেলেছি ব্যাক্তি আর সামাজিক জীবনে। আমাদের মনোজগত তাই অনেকটা হয়ে গেছে পরিবারের মনোজগত, আমাদের বোধ হয়ে ওঠেছে দিনে দিনে পারিবারিক বোধ। এর বাইরে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থাকে মানুষের জীবনে, যার ও হওয়া উচিত ছিলো সতন্ত্র কিন্তু শিঙ্খলায়িত সামাজিক আর রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় সেটিও হয়ে ওঠেছে DNA এর মতো অপরিবর্তনীয়। আর তার নাম হলো ”বিশ্বাস”। সেই বিশ্বাস বেশ কয়েকটি ভাগে বিভক্ত, ধর্মীয় বিশ্বাস, রাজনৈতিক বিশ্বাস, ভালোলাগার বিশ্বাস।
সব বিশ্বাস যে ক্ষতিকর এমন নয়, কিন্তু কিছু কিছু বিশ্বাস অবশ্যই ক্ষতিকর। অন্তত যেগুলোর সাথে দেশ, জাতি, মানবিকতা আর ন্যায়-অন্যায় জড়িত। কিন্তু বংশীয় বিশ্বাসে বিশ্বাসী হয়ে অনেকেই অন্ধের মতো বিশ্বাস করে যায় অনেক কিছু। এই অন্ধ বিশ্বাসের মাঝে রাজনৈতিক বিশ্বাস অন্যতম। আমাদের রাজনৈতিক ভালোলাগার পুরোটাই পারিবারিক। পারিবারিক রাজনৈতিক বিশ্বাসকে মেনে নিলেই যে ভুল তা কিন্তু নয়, কিন্তু ভুল কি সঠিক তা যাচাই করে নেওয়া প্রত্যেক শিক্ষিত মানুষের দায়িত্ব। শিক্ষার মূল কাজ হলো ভুল আর সঠিক কে বাছাই করা, আর বাছাই করে সঠিক টিকে মেনে নেওয়া। উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া কিছুকে বিনা প্রশ্নে মেনে নেওয়া সু-শিক্ষার বৈশিষ্ট্য নয়। আমাদের দেশে বেশি ভাগ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিশ্বাসে দেখা যায় বাবা (পরিবার) যে দলকে সাপোর্ট করে সন্তানও ঠিক সেই দলকে সাপোর্ট করে। হুম এটা ঠিক বিশ্বাস আর ভালোলাগার জগতটা গড়ে দিতে বাবা-মায়ের একটা বড় অবদান থাকে। কারন প্রথম জীবনে পরিবারের ছোট্ট গন্ডিতে আমাদেরকে বড় হতে হয়, আমাদের চেনা-জানার জগতটা ছোট থাকে, তাই আমরা তাদের বিশ্বাস আর ভালোলাগাকে পবিত্র আর অপরিবর্তনীয় জানি। কিন্তু একসময় আমরা পরিবারের ক্ষুদ্র গন্ডিকে পেছনে ফেলে মুক্ত পৃথিবীতে আসি। আস্তে আস্তে নিজের ভিতর বাঁচিয়ে রাখা পারিবারিক বিশ্বাস আর ভালোলাগার সাথে বাস্তবতার দূরত্ব দেখতে পাই, সেই দূরত্ব তৈরি করে দেয় সু-শিক্ষা। আর যে সেই দূরত্বটুকু দেখতে পায়না, অন্ধ বিশ্বাস থেকে সরে আসে না তার জীবনে শিক্ষা শুধু মাত্র একটি কাগজের সার্টিফিকেট।
ধর্মীয় বিশ্বাস ও ক্ষতিকর যখন সেটি অন্ধ আর নীতিহীন হয়। যেমন অনেক বাঙালি নির্লজ্জের মতো হিটলারকে সাপোর্ট করে, তার গুনগান গায়। অথচ তারা ঠিক জানে না এই নরপশু ৬০ লক্ষ নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে। না নিহত রা ঠিক নিরীহ ছিলো না এইসব বাঙালির চোখে, তারা নাকি মুসলমানের শত্রু ছিলো, ৬০ লক্ষ ইহুদিকে হত্যা করেও ভুল বিশ্বাসে বেড়ে ওঠা কিছু বাঙালির কাছে হিটলার একজন মহানায়ক। হিটলারকে সাপোর্ট করার পেছনে ছোটবলো থেকে চাপিয়ে দেওয়া পারিবারিক অন্ধ ধর্মীয় বিশ্বাস পুরোটাই দায়ী। হিটলারকে সাপোর্ট কিংবা ঘৃনা করা মানবিকতার সাথে জড়িত, ন্যায়বোধের সাথে সম্পর্কিত। সেখানে সাম্প্রদায়িক বিশ্বাস আসবে না, সেখানে দেশ-কাল আর মানচিত্র আসবেনা। হিটলারকে সাপোর্ট করা যতটা অন্যায় তারচেয়ে লক্ষ কোটি গুন অন্যায় পাপিস্থান নামক নষ্ট ভূ-খন্ডটিকে সাপোর্ট করা।
যারা আমার দেশের ৩০ লক্ষ মা-বোনকে হত্যা করলো, আমাদের উপর ইতিহাসরে বর্বরতম অত্যাচার করলো তাদের কে আমরা কিভাবে সাপোর্ট করি? কিভাবে তাদের পতাকা নিজের মুখে আঁকি? কিভাবে ব্যানারে লেখি আফ্রিদি প্লিজ ম্যারি মি? পাপিস্থান তো আমার অস্তিত্বের সাথে বেঈমানী করেছে, আমার মাকে অপমান করেছে, লাঞ্চিত করেছে, হত্যা করেছে আমার পূর্ব পুরুষদের। পাপিস্থানকে সাপোর্ট করা মানে কি আমার মায়ের সাথে বেঈমানি করা নয়, আমার ভাইয়ের রক্তের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করা নয়? যাদের সাথে যুদ্ধ করে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে আমারা স্বাধীনতা পেয়েছি, যাদের বিরুদ্ধে এক সাগর রক্ত দিয়ে আমরা আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছি তাকে আপনি ইসলামের দোহাই দিয়ে সাপোর্ট করছেন? মুসলামানি তত্ত্ব দিয়ে তাদের সাপোর্ট করছেন? পারিবারিক ভালোলাগার থেকে সাপোর্ট করছেন? কোথায় ছিলো ৫২ আর ৭১ এ এই তত্ত্ব? তারা তো গুলি চালানোর সময় মুসলমান খুঁজেনি। তাহলে আপনি কি করে তাদের সাপোর্ট করছেন? কিসের ভিত্তিতে? খেলার সাথে রাজনীতি মিশাবেন না এই তত্ত্ব দিয়ে? সেটাও অচল, এটি রাজনীতি নয়, এটি নিজের অস্তিত্বের প্রশ্ন, দেশপ্রেমের প্রশ্ন, পূর্বপুরুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের প্রশ্ন। এটিকে আপনি কোন অজুহাত দিয়ে পাশ কাটিয়ে যেতে পারবেন না। এই বঙ্গে জন্মে, এই বাংলার বীর সন্তানদের রক্তে ভেজা বাংলায় দাঁড়িয়ে যদি আপনি পাপিস্থান সাপোর্ট করেন তবে আপনাকে বেঈমান বলতে আমার বুক কাঁপবেনা। আপনার জন্যে এক গাল থুথু আর একবুক ঘৃনা ছাড়া দেওয়ার মতো আর কিছুই থাকবে না। সেই ঘৃণা প্রকাশের আগে আপনাকে একটা গল্প বলি..
সময় টা ৭১ এর এপ্র্রিল মাস, প্রচন্ড গরমের রাতে খাওয়া শেষ করে আপনি, আপনার মা-বাবা ভাইবোন সবাই যার যার মতো ঘুমের আয়োজন করছেন। এমন সময় শুনলেন বাহিরে প্রচন্ড গোলাগুলি, ভয় পেয়ে সবাই এক রুমে জড়ো হলেন, এর মিনিট ৫ পর আপনাদের দরজায় কারা যেন কড়া নাড়ছে। আপনি বুঝে গেছেন কারা এসে গেছে মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে। আপনি তাকালেন আপনার মায়ের মুখের দিকে, রক্তশূন্য অসহায় মায়ের মুখ দেখে আপনি কি তখন আবেগহীন থাকতে পেরিছিলেন? আপনার ছোট ভাইটি মাকে জড়িয়ে আছে, ভয়ে সে তাকাতে পারছে না। অথচ ওই বয়সে তো ওর মৃত্যু ভয় কি সেটাতো জানার কথা ছিলো না, আপনা ১২ বছর বয়সী বোনটির চোখেও দেখলেন অজনা আতংক আর মৃত্যু ভয়। বাবা ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে বড় নড়বড়ে দরজাটির পানে। তারপর দরজা ভেঙ্গে ঘরে ঢুকলো সাচ্চা মুসলমান পাকিস্থানি হানাদার রা। লাইনে দাঁড় করালো আপনাদের সবাইকে, চোখ আর হাতটুকু বেঁধে দিলো সবার। সেই সময়টা কি আপনার কাছে অনন্ত মনে হয়নি? আপনি কি তখন শেষবারের মতো মমতাময়ী মায়ের বুকটি চিন্তা করতে চেয়েছিলেন, বাবার প্রচন্ড সাহসী মুখটাকে কি আপনার মনে হয়নি তখন পরাজিত সৈনিকের মতো? শেষবারের মতো কি আদুরে ছোট ভাইটিকে একবার কোলে নিতে ইচ্ছে হয়নি আপনার? সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া বোনটিকে যারা নেকড়ের মতো খুঁটিয়ে রক্তাত্ত করলো আপনার সামনে, আপনি কি সেই বোনটির কাছে একবার ক্ষমা চাইবেন ভাবেন নি..? এমন অসংখ্য ভাবনার জাল বুনার আগেই শুনতে পেলেন বুলেটের শব্দ, লুটিয়ে পড়লেন মা-লুটিয়ে পড়লেন বাবা, একে একে লুটিয়ে পড়লো আদরের ছোট ভাই আর জন্মেই মানুষ সম্পর্কে ভুল ধারনা নিয়ে কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া বোনটি। গুলি আপনাকেও করেছিলো কিন্তু সেটি বুকে না বিদ্ধ হয়ে বাহুতে স্থান নিলো, আপনিও ভাবলেন এই বুঝি মৃত্যুর যন্ত্রনা শুরু, ভাবলেন মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বুঝি বেঁচে গেলেন এই অসহ্য নরক থেকে। আপনি চোখ বুজে ফেললেন। কিন্তু অনন্ত সময়ের পর আবিষ্কার করলেন, আপনি দুর্ভাগ্যক্রমে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে পারেননি। আপনি বেঁচে গেলেন আর এখনো বেঁচে আছেন.. মুক্তিযুদ্ধর ৪৩ বছর পর সেই আপনি কি পারবেন মুসলমান তত্ত্ব দিয়ে পাকিস্থানকে সাপোর্ট করতে? আপনি কি বলবেন তখন খেলার সাথে রাজনীতি মিশাবেন না? আপনি কি মেনে নিতে পারবেন আপনার সন্তানের পাকিস্থান সাপোর্ট করা কে? জানি পারবেন না, এমন পরিস্থিতির মাঝে দিয়ে যাওয়া কোন মানুষি কোনদিনও তা পারবেন না। পাকিস্থানকে সাপোর্ট করতে গেলেই আপনার অসহায় মায়ের মুখটি ভেসে ওঠবে, অবাক বিস্ময়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়া ছোট ভাইটির কথা মনে পড়বে, রক্তাত্ত বোনটির কথা মনে পড়ে আপনাকে আবারো বেঁচে থাকার জন্যে অপরাধী করে যাবে...!
পারিবারিক ভালোলাগা থেকে কিংবা রাজনৈতিক ভুল শিক্ষা থেকে আপনি পাকিস্থানকে সাপোর্ট করছেন হয়তো, করার আগে অন্তত একবার এই গল্পের বেঁচে যাওয়া মানুষটির জায়গায় নিজেকে দাঁড় করান, চোখ বন্ধ করে একবার নিজের পরিবারকে নিয়ে যান সেই দৃশ্য কল্পে... আমি জানি এরপর কোন তত্ত্ব দিয়েই আপনি পাকিস্থান সাপোর্ট করা কে বৈধতা দিবেন না। পাপিস্থান তখন আপনার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে ঘৃণ্য শব্দ মনে হবে.. ! আসুন পাপিস্থানকে ঘৃণা করি, পরবর্তী প্রজন্মকে ৫২ থেকে শুরু করে ৭১ এর সত্য ইতিহাস টুকু জানাই। দেখবেন এরপর তারাই পাপিস্থানের পতাকা মুখে নয়, এক গাল থুথু আর এক বুক ঘৃণা নিয়ে খেলা দেখতে যাবে রফিক-সালাম-বরকত-হামিদুর-মতিউর-রুমি সহ নাম না জানা অসংখ্য বাংলা মায়ের সন্তানদের রক্তে পাওয়া প্রিয় বাংলাদেশের মাটিতে.. !
মন্তব্য
কিছুর সাথেই কিছু মিশানোর চিন্তা করি না।
যারা শত্রু মনে করে আমার পূর্বপুরুষের উপর গুলি চালিয়েছে, তান্ডব চলিয়েছে পুরো বাংলাদেশে-
তারা আমাদের বন্ধু না। এখানেই দাঁড়ি।
তবে যারা পাকিস্তান সমর্থন করতে করতে অন্ধই হয়েছে, তাদের আর কিছুউ বলার নেই।
ধন্যবাদ আপনাকে, মাসুদ সজীব। ষষ্ঠ অনুচ্ছেদটা পড়ে শিউরে উঠেছিলাম।
শুভেচ্ছা
সবাই যদি শি উরে উঠতো তাহলে তো নিজ দেশে পাপিস্থানি পতাকা হাতে কাউকে দেখার কষ্টটা সহ্য করতে হতো না ।
তবু আশা করি সেই সংখ্যাটা কমে আসবে দিনে দিনে, আমাদের সবাইকে আরো বেশি সচেতন হতে হবে।
মাসুদ সজীব
এদেরকে আসলে ইতিহাসের ভুলটুকু শিখানো হয়েছে, ব্রেইনওয়াশ করা হয়েছে।
মাসুদ সজীব
"পারিবারিক ভালোলাগা" বা "অন্ধ বংশীয় বিশ্বাস" বলতে আপনি যা বুঝাচ্ছেন তা আসলে স্রেফ বা সাধারণ কোন "ভালোলাগার" বিষয় না, এমনকি আসলে মনে হয় এটা "বিশ্বাস"-এর ব্যাপারও না! এটা স্রেফ ব্রেইনওয়াশিং - যা ভিন্ন একটা ফেনোমেনা। আর এই ফেনোমেনাকে সাধারণ বা সাময়িক যুক্তি-বুদ্ধি-তর্ক-বিতর্ক দিয়ে এত সহজে দূর করা যাবে বলে মনে হয় না, কারন এটা আবেগ ও চেতনার অনেক গভীর স্তরে প্রোথিত হয়ে যায়। আর শিশুদের ক্ষেত্রে ব্রেইনওয়াশিং আরও ভয়ঙ্কর ব্যাপার, কারন তাদের কোন ক্রিটিকাল মানসিক প্রতিরক্ষা থাকে না।
একটা সুনির্দিষ্ট বা জোরালো পারিবারিক মতাদর্শীয় বা দৃষ্টিভঙ্গিগত বাতাবরণে জন্ম ও বড় হওয়া একটা কাদামাটির মত শিশুমনে ঐ পরিবারের মতাদর্শ / দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি প্রায় চিরস্থায়ীভাবে ছাপ ফেলে যায় - প্রায় খোদাই করে বা ডাইস দিয়ে ছাপ মেরে দেয়ার মতই। এরপরও সে প্রায় ১৫-১৮ বছর ঐ পরিবারের ঐ আবহেই থাকে। এই জিনিষ কোন ভালোলাগার জিনিষ না বা নিজে থেকে করা বিশ্বাসেরও জিনিষ না। আমার মতে এটা আসলে মানসিক হাসপাতালে ভায়োলেন্ট বা সুইসাইডাল রোগীদের যেমন 'স্ট্রেইটজ্যাকেট' নামের একটা জিনিষ পরানো হয়, সেরকমই একটা মানসিক স্ট্রেইটজ্যাকেট । পার্থক্য হল শুধু - এই (মানসিকটা) স্ট্রেইটজ্যাকেট খালি চোখে দেখা যায় না, আর যে পরে আছে সে বুঝতেই পারে না যে সে এইটা পরে আছে। বুঝতে পারলে তো বেরিয়েই আসত। হাসপাতালের মানসিক রোগী স্ট্রেইটজ্যাকেটে কষ্ট পায়, এর থেকে মুক্ত হতে ছটফট করে কিন্তু মুক্ত হতে পারে না - কিন্তু সুস্থ ও মানসিক স্ট্রেইটজ্যাকেট পরিহিতরা উলটো এতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করে, এর মধ্যেই আবদ্ধ থেকে চলতে সুবিধা বোধ করে - মুক্ত হওয়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও। তবে সবচেয়ে বড় কথা হল, এই মানসিক স্ট্রেইটজ্যাকেটের কারনে তারা অন্যদের সাথে বা ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির সাথে এম্প্যাথাইজ করতে, ভিন্নমত বা যুক্তি পুরোপুরি হৃদয়ঙ্গম করতে যথেষ্ট সক্ষম হয়না। যেমন কিনা হাসপাতালের স্ট্রেইটজ্যাকেট-পরিহিত রোগীরা হাত বাড়িয়ে অন্যকে স্পর্শ করতে পারে না। শিশুবয়স থেকে পারিবারিক ব্রেইনওয়াশিং মানুষকে এমনটাই পঙ্গু করে ফেলতে পারে চিন্তার দিক থেকে! সুতরাং বুঝতেই পারছেন, "চোরে যেমন ধর্মের কাহিনি শোনে না", এনাদেরও তেমনি যুক্তি-বিচার-বিবেক-অনুভূতি দিয়ে অনেক সময়ই সঠিক পথে আনা বা টলানো সম্ভব হয় না। অন্যরকম যে নেই তা হয়তো না, তবে কাদের সংখ্যা বেশি আমি নিশ্চিত না।
লাভ নাই! আমি এটা নিজেই দেখেছি ঠিক এরকম লোকের ক্ষেত্রেই। বহুক্ষেত্রেই এসব আর্গুমেন্ট কাজ করে না। যেসব ক্ষেত্রে কাজ করে সেসব ক্ষেত্রেও প্রায় সময় উপ্রে-উপ্রে ভাসা-ভাসা ভাবে, অর্থাৎ মুখরক্ষা ও চক্ষুলজ্জার কারনে মৌখিক সায় দেয়া পর্যন্তই - অন্তরের গভীরে বা আবেগের স্তরে করে না। পাকিস্তানী আর্মির হাতে শহীদ পিতার সন্তানকে পর্যন্ত দেখেছি বিম্পিপন্থী মামাদের আশ্রয়ে মানুষ হয়ে কট্টর ৭১-বিরোধী ও পাকিপন্থী হয়ে যেতে। কোন যুক্তিফুক্তি, এমনকি তার জন্মদাতার হত্যাকারী কারা - সেই যুক্তি পর্যন্ত তার মর্মকুহরে প্রবেশ করে না। এর তো আর আপনার গল্পের মানুষের জায়গায় নিজেকে "কল্পনা" করার দরকার ছিল না, তার ক্ষেত্রে আসলেই এটা ঘটেছে। ব্রেইনওয়াশিং-এর এমনই শক্তি। এমনই শক্তি যে আপন জন্মদাতার হত্যাকারীদের প্রতি ঘৃণা ভুলিয়ে দিতে পারে, তাদেরই বরং উলটে ভালোবাসতে শিখাতে পারে - ঐ হত্যাকারীদের যারা সঠিক বিচার করছে তাদের বদলে। শুধু তাই না, যারা ঐ হত্যাকারীদের বিচার চায় বা করছে - তাদেরকেই উলটো ঘৃণা করতে শেখাতে পারে। এমনই শক্তি এর যে, এতকিছুর পরেও ব্রেইনওয়াশিং-এর শিকার ঐ মানুষ আসলেই নিজের ভ্রান্তি বুঝতে পারে বলে মনে হয় না। উলটে বড় হয়ে বিয়ে করে একটা পাকিস্তানিকেই! হ্যাঁ, এর সবটাই আমার দেখা ঐ মানুষটির ক্ষেত্রে ঘটেছে। এমন আরও অনেক আছে। আর কিছুটা কম মাত্রায় তো বেশুমার। (এদের সংশোধনযোগ্যতা আর সংশোধন-পদ্ধতিটা আসলে নির্ভর করবে পারিবারিক পর্যায়ে ব্রেইনওয়াশিং কতটা জোরালো বা হাল্কা ছিল তার উপর)।
এজন্যে তাই, যতই আপত্তিকর মনে হোক - আমি পারিবারিক ব্রেইনওয়াশিং-এর শিকার ও মানসিকভাবে স্ট্রেইটজ্যাকেটেড মানুষকে পুরোপুরি হয়তো দায়ী হয়তো করব না। কারন এর জন্যে সম্পূর্ণ দায়ী এরা না, দায়ী এদের পরিবার। তারাই শিশুবয়সে এর মনে ও ব্যক্তিত্বে ঐ মানসিক স্ট্রেইটজ্যাকেটটা পরিয়ে দিয়েছে - এরা নিজে থেকে পরেনি। এরা তাই খানিকটা ভিক্টিমও বটে। ভিক্টিম এবং রোগী। ব্রেইনওয়াশিং রোগের রোগী। তবে এজন্যে এটা যে ছেড়ে দিতে হবে তাও না। তবে বিচ্ছিন্ন যুক্তিতর্কে খুব বেশি যে কাজ হয় বা হচ্ছে বলেও মনে হয় না। এজন্যে আসলে দরকার ভিন্ন ধরণের প্রয়াস। অন্য ধরণের চিকিৎসা।
****************************************
-খুবই খাঁটি কথা।
সহমত, পরিবারের দায়ভার টাই সবচেয়ে বেশি। তবে পাপিস্থান সাপোর্টের পেছনে আরো একটি অন্যতম কারন মনে হয় ৭৫ পরবর্তী প্রচন্ড ভারত বিদ্বেষী প্রচারণা আর ইতিহাস বিকৃতি। সেই প্রচারনার পালে এখনো সু-বাতাস বইছে, প্রথম আলুর মতো পত্রিকা সেখানে এখন অগ্রণী সৈনিকের ভূমিকা পালন করছে।
আমার একজন কলিগ আছে, বাংলাদেশের খেলার দিনও সে পাপিস্থান সাপোর্ট করে। বাংলাদেশের সাথে খেলার পর তাকে পাকিস্থানিদের বর্বতার উদাহারন হিসাবে বাংলাদেশের গনহত্যা বইটি থেকে কিছু অংশ পড়তে দেই এবং অফিসে তার একটি নতুন নাম দেই এবং সবাই সেই নামে সম্মতি দেয়। তার নামের পাশে বিহারি যুক্ত করেছি, কিছুক্ষন পর সে সবাইকে ডেকে ক্ষমা চায়। বলে সে আর পাকিস্থান সাপোর্ট করবে না। আমি জানি ইহা ক্ষনিকের সমাধান, উপযুক্ত আলো বাতাস পেলে তার ভিতর আবারও পাকিস্থান প্রেম জেগে ওঠবে। তাই গোড়া থেকে পাপিস্থান প্রেম সরাতে না পারলে হঠাৎ করে এমন ডাল পালা কেটে দিলে পাপিস্থান ভূত কখনো যাবে না।
মাসুদ সজীব
"তবে পাপিস্থান সাপোর্টের পেছনে আরো একটি অন্যতম কারন মনে হয় ৭৫ পরবর্তী প্রচন্ড ভারত বিদ্বেষী প্রচারণা আর ইতিহাস বিকৃতি।" '৯৯ পর্যন্ত এই যুক্তি আমি মানতে রাজী আছি, কারণ আমার নিজের পরিবারেই এটা ছিল, কিন্তু '৯৯-এর পর থেকে ভারত বিদ্বেষ, মুসলমান ভাই - এই সব যুক্তি আর ধোপে টিকে না, কারণ আমার নিজের দেশই তখন নিয়মিত খেলা শুরু করেছে। তাই বলে '৯৯-এর আগে পাকি সাপোর্ট আমি ডিফেন্ড করি না, কারণ কোন অবস্থাতেই এই ব্যাপারটা গ্রহণযোগ্য না, আমি নিজেই এই দলের একজন ছিলাম, এবং এর জন্য আমি লজ্জিত - এটা বলতে আমার কোন দ্বিধা নেই।
'৯৯ এর পরেও যারা পাকি সাপোর্টার, তাদের ব্যাপারে আমি আগেও বলেছি, এবং এখনও বলছি, এরা কেউ কোন ভুল বোঝাবুঝি বা শিক্ষার অভাব থেকে পাকি সাপোর্টার না, এরা সব জেনে-বুঝেই পাকি সাপোর্টার, কারণ এদের অন্তরেই পারিবারিকভাবে পাকি ভালবাসা বিদ্যমান। ব্লগে ছাগু দেখলেই যে গদাম ট্রিটমেন্ট চালু আছে, ব্লগের বাইরেও একই ট্রিটমেন্টের ব্যাবস্থা ছাড়া আর পথ দেখি না।
মফিজ
পাপিস্থান সাপোর্ট কেন করে এর পেছনে আসলে অনেকগুলো মোটা দাগের কারন রয়েছে বলে আমি মনে করি। পরিবার, মিথ্যে ইতিহাস, পাপিস্থান মনা শক্তির উত্থান, অন্ধ ধর্ম বিশ্বাস, ভারত বিদ্বেষ প্রভৃতি। ৭১ এ রাজাকার বাদে সবাই যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলো বিষয়টা এমন না। আমার গ্রামের বাড়ির সবাই বিম্পি জামাত করে, এমনকি আমার দাদা ছিলো জামাতের ভোটার। সেই পরিবেশে বড় হয়ে আমিও একসময় পাপিস্থানকে সাপোর্ট করতাম। কিন্তু যখন মুক্ত পৃথিবীতে এলাম তখন আমার উপর চাপিয়ে দেওয়া ভুল বিশ্বাসকে ছুড়ে ফেলেছি। আর সেই ভুলটা কে ধরিয়ে দিতে বই সবচেয়ে বড় এবং শহরের পরিবেশ। আমি এখন গ্রামে যখন যাই তখন ছোট ছোটদের কে মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলি, বুঝাতে চেষ্টা করি এবং আমি অত্যন্ত আনন্দের সাথে বলতে চাই কলেজে পড়ে এমন দুজন এখন সেই মিথ্যাচার থেকে বেরিয়ে পাপিস্থানকে প্রচন্ড ঘৃনা করে। তাই ছোটবেলাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, ছোটবেলায় মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ভালোবাসা জাগিয়ে তুলতে পারলে আমাদের কাজটি সহজ হয়ে যায়।আমরা সবাই যদি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সঠিক ভাবে আমাদের পরিচিত গন্ডিতে বিশেষ করে ছোটদের মাভে তুলে ধরতে পারি তবে পাপিস্থান মনা প্রজন্ম রোধ করতে পারবো।
মাসুদ সজীব
ভিন্ন ধরণের প্রয়াসটা কী এর চিকিৎসা ব্যবস্হায়ই বা কেমন হওয়া দরকার? চেষ্টা চিকিৎসা খুব দ্রুতই শুরু করা দরকার যথেষ্ট সময় বয়ে গেছে!
'৭১ এর ঘটনাগুলো গল্পের মত প্রতিনিয়ত বলে যেতে হবে। ক্লান্তি আসবে, বিরক্তিও, কিন্তু বলে যেতে হবে স্কুলের ক্লাসে, খেলার মাঠের অবসরে, ভাতের টেবিলে, বন্ধুদের সাথে আড্ডায়, সপ্তাহিক গল্পের আসরে। ঘটা করে সরবে নীরবে যতরকম ভাবে পারা সম্ভব!
সহমত
মাসুদ সজীব
বুক ভরা ঘৃণা সেইসব শুয়োরদের জন্য যারা নিজের মা কে ভুলে যায়।
ইসরাত
মাসুদ সজীব
এটাই পোষ্টের মোদ্দাকথা। কিন্তু যাদের জন্য বলা এই কথাটা ওরা বুঝবে কিনা বলা মুশকিল।
আপনি সমগ্র পোষ্টে দাড়ি (।) না দিয়ে ফুলস্টপ দিয়েছেন দেখতে পাচ্ছি। টেকি সমস্যা নাকি?
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
তবু ঘরে -বাইরে আমাদেরকে চেষ্টা টা করে যেতে হবে
মাসুদ সজীব
facebook
মাসুদ সজীব
প্রতিবাদে প্রতিবাদে একদিন এগুলা খড়কুটোর মত উড়ে যাবে। আশা সেটাই ।
Shah Waez (শাহ্ ওয়ায়েজ।)
Facebook
..............................................................................................
কোথাও নেই ঝুমঝুম অন্ধকার
তক্ষক ডাকা নিশুতিতে
রূপকথা শুনে শিউরে উঠে না গা
স্বপ্নে আমার শরীরে কেউ ছড়ায় না শিউলি ফুল
আলোর আকাশ নুয়ে এসে ছোঁয় না কপাল
আমাদের এই আশার জয় একদিন হবেই ।
মাসুদ সজীব
"পাপিস্থান সাপোর্ট কেন করে এর পেছনে আসলে অনেকগুলো মোটা দাগের কারন রয়েছে বলে আমি মনে করি। পরিবার, মিথ্যে ইতিহাস, পাপিস্থান মনা শক্তির উত্থান, অন্ধ ধর্ম বিশ্বাস, ভারত বিদ্বেষ প্রভৃতি। ৭১ এ রাজাকার বাদে সবাই যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলো বিষয়টা এমন না।" - পূর্ণ সহমত। কোন একটি লেখায় মন্তব্যে একবার বলেওছি বোধ হয়। এই নানা কারণগুলি মিলে যে ফাঁদ তৈরী করেছে তার থেকে বের হয়ে আসা অসম্ভব তো নয়-ই, অনেকেই বের হয়ে আসবেও, কিন্তু কাজটা কঠিন আর সময়ও নেবে। ভাল লাগে যে আপনারা এই নিয়ে সচেতন এবং সচেষ্ট।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
সবাই সচেতনতা সৃষ্টির কাজ করলে দীর্ঘ সময় পর হলেও সুফলটা আসবে, আসতেই হবে।
মাসুদ সজীব
নতুন মন্তব্য করুন