কবি বলেছিলেন -
তোমার পতাকা যারে দাও
তারে বহিবার দাও শক্তি।
খুবই খাটি কথা। বুড়া কবি আজাইরা কথা কম বলে গেছেন। পতাকা মানেই যারা মনে করে লাঠির আগায় একটুকরা কাপড় বান্ধা, তাঁদের হাতে পতাকা আর বান্দরের হাতে লোহা ... একই কথা। মান মর্যাদা না জেনে পকেট থেকে ফস করে টাকা বের করে যারা পলিস্টার কাপড়ের লাল সবুজ পতাকা কিনে ফেলে, কিভাবে তা উড়াতে হয়, কিভাবে পতাকা কে তার প্রাপ্য মর্যাদাটুকু দিতে হয় এই ভাবনা করে না, তারা পতাকাবাহী হবার যোগ্য না। যে কোন দেশের পতাকাই সে দেশের সবচেয়ে সম্মানের বস্তু। পতাকা অর্জন করতে গিয়ে আমাদের দেশ এর মত এত দাম আর খুব কম জাতিকে দিতে হয়েছে। আমরা যারা স্বাধীনতা উত্তর প্রজন্ম, আমরা হয়ত কোনদিন বুঝতে পারবো না; পুরো পরিবারের সবার মৃতদেহ উঠানে পড়ে পচতে শুরু করেছে, আর পুকুরে তিন দিন ধরে কচুরীপানায় লুকিয়ে কাপতে থাকা কিশোর ছেলে গোলাগুলির শব্দ থেমে যাবার পর চোখ খুলে বাড়ির সামনে দিয়ে উল্লাস করতে থাকা যুবকের হাতে এই লাল সবুজ পতাকা দেখে তার কেমন লেগেছিল।
আমাদের কাছে পতাকার অনেক রকম মানে থাকতে পারে, কিছুটা গর্বের, কিছুটা কাব্যিক, কিছুটা উল্লাসের, কিছুটা হয়ত দেশপ্রেমের। কিন্তু কারো কারো কাছে পতাকাটাই গোটা অস্তিত্ব। তাঁদের মত করে ভাবতে না পারলেও, স্বাধীন দেশের সভ্য নাগরিক হিসাবে আমাদের অন্তত নিজেদের পতাকাটাকে কেমন করে ব্যবহার করা উচিত তা জানা দরকার। আমরা অনেকেই জানিনা আবেগ প্রকাশ করার জন্য যে আমরা টান মেরে পতাকা মাথায় বেধে ফেলি, খেলা দেখার সময় সুপারম্যান এর মত পতাকা পীঠে বেধে ফেলি, খেলায় জিতলে পতাকা গাড়ির বনেটে কায়দা করে সেট করে ফেলি, এগুলো অনুচিত আচরন। নিয়ম মত নির্মিত জাতীয় পতাকা এইরকম ভাবে ব্যবহার করা যায় না। তবে লাল সবুজ রঙ্গে অন্য কোন ডিজাইন নিয়ে আমরা একই উল্লাসটাই করতে পারি, তাতে কিছু কমতি হয় না। মাঝখান দিয়ে পতাকার ইজ্জত টা বেঁচে যায় ।
আমরা আমাদের পতাকা সম্মান নিয়ে তুলে ধরতে জানিনা বলেই কিছু বান্দরের হাতে আবার লোহার সঙ্গে আগুনও উঠে। তারা মহা উল্লাসে ক্রিকেটের মাঠে , মহররমের মিছিলে উসিলা পেলেই পাকিস্তানি ঝান্ডা উচা করে ধরে। টেবিলে বসে ভাগ হয়ে দেশের মালিক হবার পর যেই ঝান্ডা তারা পেয়েছিল সেই ঝান্ডার নিচে তারা নিজেরাই এক হতে পারেনি এখনো, আর আমার দেশের মর্কটকূল সেই ঝান্ডা উচা করে ধিতাং ধিতাং করছে।
আসলে দেশপ্রেম কাউকে বলে শেখানো যায় না। যেমন শেখানো যায় না যুদ্ধ করা। অস্ত্র ধরার ট্রেনিং তো সেনাবাহিনী প্রতিদিনই নেয়, তারপরেও আবেগে উদ্ধত মুক্তিবাহিনীর কাছে পৃথিবীর ৮ম চৌকষ সেনাবাহিনী যুদ্ধে হেরে বসেছিল। দেশপ্রেমের শিক্ষা নিজের ভেতর থেকেই নিতে হয়। নিজেকে যদি কেউ প্রশ্ন করে দেশ আগে না খেলা আগে ? তাহলে উত্তরটা পেয়ে যাবার কথা। "রাজনীতির সঙ্গে খেলা মেশাবেন না" এই জাতীয় একটা পুরান ত্যানা পেচানো কৈফিয়ত শোনা যায়। যারা এই ত্যানা মুখে নিয়ে ঘোরেন, তাদের সঙ্গে তর্ক করে লাভ হয় না। তাদের ব্রেন একটু ট্যাপ খাওয়া। তারা কিসের সঙ্গে কি মেশাতে হয় এটাই জানেন না। অস্তিত্বের সঙ্গে যে দেশ, গৌরব আর সার্বভৌমত্ব না মেশালে মানুষ হওয়া যায় না এটাই জানেন না। এইসব হাফ হিউম্যানদেরকে; কেউ মরে গিয়ে দেশ স্বাধীন করে দেবে, কেউ সম্ভ্রম হারিয়ে সম্মান এনে দিবে, কেউ পুরো জীবনের অর্জন তুলে দিয়ে গৌরব এনে দিবে, অন্য নাগরিকদের ট্যাক্সের টাকায় এদের পালতে হবে, গ্যাস, কারেন্ট, পানি, স্যুয়ারেজ, টেলিফোন, হসপিটাল দিতে হবে। মোটকথা এরা বাংলার আগা পাশ তলার সব সুবিধা নিয়ে আরাম করে পাকি জোয়ানদের খেলা দেখবেন আর মারহাবা মারহাবা করবেন। যেন এরা জন্মেছেন ক্রিকেট খেলা দেখে পৃথিবীকে ধন্য করে দিতে। কিছু হাফব্লাড কনফিউসড লোক যদি সঠিক সময়ে কন্ডম ব্যবহার করতেন তাহলে এই তামাশা দেখতে হত না আমাদের। তাই জন্মনিয়ন্ত্রণ করা এত জরুরী।
নিজের দেশের মাটিতে ভিন্ন যে কোন দেশের পতাকা উচা করে ফেলা যে আসলে নিজের দেশের পতাকাকেই অপমান করে বসা, যারা এই সত্যটুকু উপলব্ধি করেন তারা শুধু সমালোচনা করেই ক্ষ্যান্ত দিয়ে দিলে এই ঘটনা কমবে না। সঠিক শিক্ষা আর সামাজিক প্রেরণা জাগানোর কাজটা শুরু করে দেয়া উচিত মনে হয়। তা না হলে দিকভ্রান্ত প্রজন্ম আরো বড় বড় ভুলের পথে পা বাড়াতে থাকবে নিজের অজান্তেই।
আমরা বাঙ্গালী, এই পরিচয় ভুলে যারা যে কোন পরিস্থিতিতে পাকিস্তানী পতাকা উচা করে ধরে রাখে, তাদেরকে বুঝাতে হবে দৃশ্যটা তাদের লুঙ্গি উচা করে ধরে রাখার মতই উৎকট, নোংরা। কে বুঝাবে ? আমাদেরকেই বুঝাতে হবে। ইচ্ছা করলেই শুরু করে দেয়া যায়। ইচ্ছাটাই জরুরী।
পতাকা বহন করার জন্য একটা শক্তি দরকার, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সেই শক্তি প্রবাহিত হতে হয়। তা না হলে শুধু একটা দন্ড একটা জাতীয় পতাকা তুলে ধরে রাখতে পারে না। সেটা সম্ভব না।
মুকুল চৌধুরী
http://mukulchowdhury.blogspot.com/
মন্তব্য
লাইনটা এমন না!
নিজের দেশের কোন অর্জনে পতাকা নিয়ে আবেগ দেখানোতে আইন অমান্য করা হয়ে যায় হয়ত।
হয়ত এটা দোষের। তবুও আবেগের ঐ উচ্ছ্বাসে কেন জানি আপত্তি তুলতে পারিনা জোরগলায়।
কারণ ভেসে যাওয়াদের দলে নিজেই কখন ভীড়ে যাই যে! পারজদের উচিৎ শিক্ষা না দিলে এরা সোজা হবে না।
পতাকার কথা, একাত্তুরের কথা লাগাতার বলে যেতে হবে। ক্লান্ত হলে চলবে না।
''পতাকা মানেই যারা মনে করে লাঠির আগায় একটুকরা কাপড় বান্ধা, তাঁদের হাতে পতাকা আর বান্দরের হাতে লোহা ... একই কথা।'' জাতী সত্তা, জাতীয়তাবোধ এগুলা আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। তবে ফিরে আসবে আবারও এই আশা করাই যায়। বহুবার বাংলাদেশের অস্তিত্বকে বিলীন করার অপচেষ্টা চালানো হয়েছে। লাভ হয়নি কোনদিন। একদিন প্রতিবাদের ঝড়ে ঠিকই মাথা উঁচু করে দাড়িয়েছি আমরা। ভাল লেখনী। সুস্পষ্ট এবং মনে গেথে যাবার মত।
Shah Waez (শাহ্ ওয়ায়েজ।)
Facebook
..............................................................................................
কোথাও নেই ঝুমঝুম অন্ধকার
তক্ষক ডাকা নিশুতিতে
রূপকথা শুনে শিউরে উঠে না গা
স্বপ্নে আমার শরীরে কেউ ছড়ায় না শিউলি ফুল
আলোর আকাশ নুয়ে এসে ছোঁয় না কপাল
আয়নামতি, আপনি যেমনটা লিখেছেন -
তোমার পতাকা যারে দাও, তারে বহিবারে দাও শকতি
এটাই শুদ্ধ ।
ধব্যবাদ, ভুল ধরিয়ে দেবার জন্য।
ব্যাপার টা কিন্তু এমন না যে নিজের দেশের গৌরব উদযাপনের সময় আমরা আমাদের পতাকা নিয়ে উল্লাস করতে পারব না। অবশ্যই পতাকা নিয়ে আবেগ থাকবে, পতাকা উতসব, উদযাপনের উপসঙ্গ হবে। তবে সঠিক নিয়মে পতাকা উত্তোলন বা বহনের কথা বলতে চেয়েছিলাম। আমরা আসলে জানিই না কিভাবে নিজের দেশের পতাকাটা ওড়াতে হয়।
যেমন গাড়িতে পতাকা উড়ানোর বেলায় নিয়মটা না জানার কারনে মার্চ আর ডিসেম্বর মাসে রাস্তায় সব গাড়িতে পতাকা দেখে যেমন বুক বড় হয় তেমন আবার কিছু দৃশ্য দেখে মনটা খারাপ ও হয়ে যায়।
- বিশাল বড় পতাকা গাড়ির বনেটে সেঁটে রাখা ( অনুচিত )
- জানালায় পতাকা কাপড় শুকানোর মত করে ঝুলানো ( অনুচিত)
- ফ্লোর মপের লাঠিতে পতাকা বেধে বাড়ির ছাদে উড়ানো (অনুচিত)
এমন উদাহরন আরো বহু আছে ।
পতাকা ব্যবহারের একটা সুষ্ঠ নীতিমালা থাকলে, সবাই জানতে পারবে, তখন নিয়ম মেনে পতাকা উড়ালে ভালোই লাগবে।
- মুকুল চৌধুরী
ভালই লিখেছেন
ভাল লেগেছে ।
শাহ্ আলম শেখ শান্ত
লেখা ভালো লাগলো মুকুল ভাই। আরো লিখুন।
____________________________
নতুন মন্তব্য করুন