শেষ বিকেলে বসে ছিলাম ক্যাম্পাসের মুক্তমঞ্চের সিঁড়িতে । লাল রঙের সূর্যটা মুক্তমঞ্চের পিছনের আকাশমণি গাছের পাতার আড়ালে অদৃশ্য হচ্ছিল ক্রমশ ।
হু হু করে বাতাস হচ্ছে সেই দুপুর থেকে । অদূরের ঝোপঝাড়ের আড়াল থেকে আসা গাঁজার গন্ধ, ঝালমুড়ি বিক্রেতার ঝালমুড়ির গন্ধ আর মহুয়া ফুলের গন্ধ
মিলে কেমন যেন মাতাল মাতাল আমেজ ।
কিচ্ছু বদলায়নি এই ক’বছরে ।
মনে পড়ে সারাদিন প্রচণ্ড কষ্টের ল্যাব সেরে এই মুক্তমঞ্চে এসেই আমরা কজন চিৎ হয়ে শুয়ে পড়তাম আকাশের দিকে মুখ করে । সেই সুন্দর করে ছাঁটা
ঘাসের ঘ্রাণ আর লাল মাটির গন্ধ সারাদিনের সব ক্লান্তি শুষে নিত । একবার এক বন্ধুকে বলেছিলাম “ঘাসের গন্ধ শুকে দেখ, কি অদ্ভুত সুন্দর !” । ওর
নাকের ভেতর ঢুকে গেছিল লজ্জাবতী ফুলের রেণু । তারপর হাঁচি টাচি দিয়ে এক বিশ্রী অবস্থা ! আমার সাথে তিন দিন কথা বলেনি ও ।
আজকেও কয়েকটা ছেলে মেয়ে শুয়ে আছে ঘাসের উপর ।
আমারও খুব ইচ্ছে করল ওই রকম ভাবে শুয়ে থাকতে । কিন্তু এখন আর আমি মুক্ত মানুষ নই । ক্রীতদাসের জীবন যাপন করছি আজ বছরখানেক হল ।
আর উঠতি ভুঁড়ি আকাশ পানে উঁচিয়ে একা একা ঘাসের উপর শুয়ে থাকলে লোকে হাসবে ।
মুক্তমঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে তাই ফাঁকা সেন্ট্রাল ফিল্ডের উপর এসে দাঁড়ালাম । আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি একটা বেশ রঙচঙে ঘুড়ি আকাশে উড়ছে ।
হঠাৎ কেমন যেন একটা পুরনো অনুভূতি টের পেলাম মাথার ভেতর । মনে হল ঠিক এমন একটা সময়ে আমি আগেও ছিলাম এইখানে । ঘাড় উঁচিয়ে
ঘুড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম একদৃষ্টে । ঘুড়ির রঙ আমার দৃষ্টি কেমন যেন ঘোলা করে দিল ।
আরো অনেক গুলো ঘুড়ি আমার চারপাশে উড়তে শুরু করল ।
মনের ভেতর উড়তে থাকা সেই ঘুড়ি গুলোকে আমি চিনতে পারলাম আলাদা আলাদা ভাবে ।
সাপ ঘুড়ি ! এই ঘুড়িটার পেছনে বেশ লম্বা একটা সাপের মত লেজ থাকত । সবচে উঁচুতে উঠত এই ঘুড়ি গুলো । রঙিন পোস্টার পেপার অথবা খবরের
কাগজ দিয়ে বানাতাম এই ঘুড়িগুলো ।
চিল ঘুড়ি ! এই ঘুড্ডিটার কোন লেজ থাকত না । কিন্তু এই ঘুড়িটার সবচে মজার দিক ছিল এর ক্রমাগত এদিক ওদিক বাঁক খাওয়া । সুতা কেটে যেত এই ঘুড়িগুলোর সবচেয়ে বেশি । মনে পড়ে সুতো ছেড়া ঘুড়ির পেছন পেছন কতবার ছুটে গেছি আমরা দুরন্ত সব বালকেরা । বেশিরভাগ সময় কোথায় যেন হারিয়ে যেত ঘুড়ি গুলো ।
ডাক ঘুড়ি ! এই ঘুড়িটায় আমরা লাগিয়ে দিতাম একটা বাঁশের চিকন কাঠি । বাতাসের কম্পনে পোঁওওওওওওওওওও করে একটা একটানা শব্দ হত । প্রায়ই আমরা ঝগড়া লাগিয়ে দিতাম “আমার ঘুড়ি বেশি জোরে ডাকে” এই দাবি করে ।
বাক্সো ঘুড়ি ! আমার একটাও ছিলনা বাক্সো ঘুড়ি । আমার কতদিনের সাধ ছিল ছিল একটা বাক্সো ঘুড়ির ! কত ধরনা দিয়েছি বড় ভাইদের কাছে একটা বাক্সো ঘুড়ি বানিয়ে দিতে, কেউ দ্যায়নি । শেষমেশ আমার বারোতম জন্মদিনে আমি পেয়েছিলাম আমার জীবনের সবচে প্রিয় জন্মদিনের উপহার, লাল রঙের একটা বাক্সো ঘুড়ি ।
এক বড়ভাই একবার বিশাল এক মানুষ আকৃতির ঘুড়ি নিয়ে আসলো কোথা থেকে জানি ! আমরা তো সবাই বিস্ময়ে হতবাক । তারপর যখন ওটা আকাশে উড়ল কি দারুণ যে দেখাচ্ছিল ! আমি ওই বড় ভাইয়ের কাছে একটু নাটাই ধরতে চাইলাম । সে বলল ঘুড়িটা নাকি আমার মত তালপাতার সেপাইকে নিমেষে উড়িয়ে নিয়ে যাবে ! কয়েকদিন আগে টেনিদার গল্পে এমন একটা ব্যাপার পড়েছিলাম । তাই সাহস করে আর নাটাই হাতে নেইনি । তারপর একদিন যখন ঘুড়ির দোকানে মানুষ ঘুড়ি দেখে ছোট মামা কিনে দিতে চাইল আমি ভয়ে ওটা নেইনি ।
আরো কত কত সব ঘুড়ি ! বিচিত্র রঙ আর বিচিত্র নামের সব ঘুড়ি । খোলা আকাশের নীচে দাঁড়ানো আমার মাথার উপর এক ঝাঁক পাখির মত সেই সব স্মৃতির ঘুড়িরা উড়তে থাকে ।
একদম শুধু শুধু আমার মনে পড়ে পূর্নেন্দু পত্রীর একটা কবিতার লাইন-
তাহসিন রেজা
মন্তব্য
এটা কোন কথা হলো! ইচ্ছেঘুড়ি নেই কেন রে আপনার আকাশ জুড়ে?
ওটা না থাকলে এমন কত আফসোস এসে ভীড় বাড়াবে মনঘরে।
সত্যি, ইচ্ছেঘুড়ি নেই আমার একটাও
ছোটমামাকে বলব কিনে দিতে ।
তাহসিন রেজা
সাত সকালে লেখাটা পড়ে মনটাই খারাপ হয়ে গেলো
আসলেই স্মৃতিরা বড্ড উচ্ছৃংখল।
বেঁচে থাকার জন্য একটা মাত্র জীবন কখনই যথেষ্ট নয়
স্মৃতি বড় উচ্ছৃঙ্খল , দু হাজার বছরেও সব মনে রাখে...
নওশীন শুভকামনা
তাহসিন রেজা
ভালো লাগলো পড়ে।
আমার মনে হয়, ১০ বছর পর এখনকার প্রজন্মের অনেকে ঘুড়ি জিনিসটাই চিনবে না।
যে জিনিস আকাশে দেখেনি কতদিন, সেই জিনিস Kite অর্থ ঘুড়ি করে করে আর কতদিন মনে রাখবে বাচ্চারা?
শুভেচ্ছা
সত্যি তাই, এখনকার আকাশে খুব বেশী ঘুড়ি উড়তে দেখিনা
ঘুড়ি হারালে অনেকখানি আকাশও হারিয়ে যাবে বোধহয়
তাহসিন রেজা
ভাল লাগলো লেখাটা।
অনেক ধন্যবাদ ।
তাহসিন রেজা
খানিকটা সময় মুক্তমঞ্চে নিয়ে গেলেন। এভাবে নিয়ে যাওয়া সহজ কাজ নয়। বিনা টিকিটে কল্পনার চোখে দেশের অন্যতম সেরা একটি প্রাণের জায়গা ঘুরিয়ে নিয়ে আসলেন। চমৎকার। এক কথায় অনবদ্য আরও লিখেবন আশা করি
Shah Waez (শাহ্ ওয়ায়েজ।)
Facebook
..............................................................................................
কোথাও নেই ঝুমঝুম অন্ধকার
তক্ষক ডাকা নিশুতিতে
রূপকথা শুনে শিউরে উঠে না গা
স্বপ্নে আমার শরীরে কেউ ছড়ায় না শিউলি ফুল
আলোর আকাশ নুয়ে এসে ছোঁয় না কপাল
লিখব হয়ত
ধন্যবাদ শাহ্ ওয়ায়েজ
তাহসিন রেজা
ঘুড়ি নিয়ে ঘোরাঘুরি
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
ধন্যবাদ এবং শুভকামনা ।
তাহসিন রেজা
আহ, কতদিন খোলা নীল আকাশে ঘুড়ি দেখিনা ... ... ...
চলুক ...
__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---
নিজেই একটা বানিয়ে ওড়াতে শুরু করে দিন দিদি
তাহসিন রেজা
স্মৃতিরা বড় উচ্ছৃঙ্খল, সত্যিই যেন দমকা হাওয়া!
---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।
তাহসিন
ঘুড়িরা ওড়ে না, ঘুড়িরাই ওড়ায়!!!
সুন্দর লিখেছেন তাহসিন। আরো লিখুন।
____________________________
একদম ঠিক
অনেক শুভকামনা প্রফেসর
তাহসিন রেজা
নতুন মন্তব্য করুন