ক্যাসান্ড্রা- গ্রীক মিথলজির এক বিয়োগান্তক চরিত্র। তিনি ছিলেন ট্রয়ের রাজা প্রায়াম এবং রানী হেকুবার কন্যা। ছিলেন অসম্ভব সুন্দরী আর বলতে পারতেন ভবিষ্যতের কথাও। কিন্তু দুর্ভাগ্যটা ছিলো- তার ভবিষ্যতবাণী কেউ বিশ্বাস করতেন না! কিভাবে তিনি ভবিষ্যৎ বলার ক্ষমতা পেয়েছিলেন আর কেনোইবা তার কথা কেউ বিশ্বাস করতেন না- সেটার পিছনের কারণ ছিলেন দেবতা এপোলো।
প্রাচীন গ্রীসে বিভিন্ন শহরে বিভিন্ন দেবতাদের নামে মন্দির থাকতো। দেবতারা সেইসব মন্দিরে মাঝে মাঝে ভ্রমণ করতেন। ট্রয় নগরীতেও এইরকম একটি মন্দির ছিলো- এপোলোর নামে। একদিন সেখানে ঘুমিয়ে ছিলেন ক্যাসান্ড্রা আর এপোলো সেই মন্দির দেখতে গেলেন। সেখানেই তিনি ঘুমন্ত অবস্থায় দেখলেন অনিন্দ্যসুন্দরী ক্যাসান্ড্রাকে। স্বর্গের দেবতা এপোলো আবারো প্রেমে পড়লেন মর্ত্যের মানবীর- এবার ক্যাসান্ড্রা। কিন্তু এই ভালোবাসা ছিলো শরীরের। এপোলো উদ্বেল হয়ে উঠলেন ক্যাসান্ড্রার সাথে মিলনের জন্য। তিনি ক্যাসান্ড্রাকে বললেন, “হে সুন্দরী! আমি তোমাকে শিখিয়ে দিবো কীভাবে ভবিষ্যতবাণী করতে পারবে, যদি তুমি আমাকে ভালোবাসো”। ক্যাসান্ড্রা দেবতাকে প্রেমিক হিসেবে দেখতে রাজী ছিলেন না, এমনকি একরাতের জন্য হলেও না। কিন্তু তার ভালোবাসার বিনিময়ে যা দিবেন এপোলো, সেই অসম্ভব ক্ষমতার লোভও ক্যাসান্ড্রা পরিত্যাগ করতে পারছিলেন না। কিছুক্ষণ ভেবে ক্যাসান্ড্রা বললেন, “আমি আপনার প্রস্তাবে রাজী এপোলো, তবে ভবিষ্যতবাণী করার ক্ষমতাটা আমাকে আগে শিখিয়ে দিতে হবে!” ভালোবাসায় মত্ত এপোলো কোনো কিছু চিন্তা না করেই ক্যাসান্ড্রাকে তার ডানার ভিতরে নিয়ে শিখিয়ে দিলেন সেই অপার ক্ষমতা।
ক্যাসান্ড্রা (শিল্পী- ইভেলিন ডি মরগান, ১৮৫৫- ১৯১৯)
ভবিষ্যৎ জানার ক্ষমতাটা পেয়েই ক্যাসান্ড্রা সুর বদলালেন। তিনি নিজের শরীরকে এপোলোর কাছে তুলে দিতে চাইলেন না, অস্বীকার করলেন প্রতিজ্ঞা পালন করতে। এবার দেবতার বোধোদয় হলো। এপোলো খুব ক্ষুদ্ধ হলেন। কিন্তু তিনি ক্যাসান্ড্রাকে যে ক্ষমতা দিয়েছেন, সেটা ফিরিয়ে নিতে চাইলেন না। বরঞ্চ ঠিক করলেন, এমন এক অবস্থার সৃষ্টি করবেন যাতে ক্যাসান্ড্রার ভবিষ্যতবাণী কেউ বিশ্বাস না করেন! তিনি ক্যাসান্ড্রাকে নিদেনপক্ষে একটি চুমু দেবার জন্য অনুরোধ করলেন। এবার ক্যাসান্ড্রা সদয় হলেন। এপোলো ক্যাসান্ড্রাকে গভীর চুমু দিলেন, একইসাথে তার অভিশাপও ছড়িয়ে দিলেন ক্যাসান্ড্রার মধ্যে!
ক্যাসান্ড্রার ভবিষ্যতবাণীর ক্ষমতা পাওয়ার পিছনে আরো একটি মিথ প্রচলিত আছে, যদিও সেটা খুব জনপ্রিয় নয়। ক্যাসান্ড্রার এক যমজ ভাই ছিলেন- হেলেনাস (ট্রয়ের পতনের জন্য এই হেলেনাসের বিশাল ভূমিকা আছে, সেটা ট্রয়ের যুদ্ধের কাহিনীতে বিস্তারিত থাকবে)। ছোটবেলায় একবার ক্যাসান্ড্রা এবং হেলেনাসের জন্মদিন পালন করার জন্য সবাই এপোলোর মন্দিরে জড়ো হয়ে উৎসবে মেতে উঠেছিলেন। একপর্যায়ে দুই ভাই-বোন ক্লান্ত হয়ে মন্দিরের একপ্রান্তে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। উৎসব শেষে সবাই মন্দির ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন- কারো আর তাদের কথা মনে পড়লো না- এমনকি রাজা প্রায়াম ও রানী হেকুবারও। পরদিন সকালে যখন রানী তাদেরকে খুঁজতে মন্দিরে এলেন, তিনি দেখতে পেলেন – একটি সাপ ক্যাসান্ড্রা এবং হেলেনাসের কান চুষে দিচ্ছে। এই দৃশ্য দেখে হেকুবা ভয়ে চিৎকার করে উঠেন। সাপটি দ্রুত চলে যাওয়ার সময় সেখানে এক লরেল পাতা রেখে যায়- যা দেবতা এপোলোর পবিত্র গাছের পাতা। সেই থেকে ক্যাসান্ড্রা এবং হেলেনাস দুইজনই ভবিষ্যতবাণী করতে পারতেন। এই কাহিনীতে হেলেনাসের ভবিষ্যৎ বলতে পারার ক্ষমতার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়, কিন্তু ক্যাসান্ড্রার বলা কথা কেউ বিশ্বাস করতেন না কেনো, সেটার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না! কেউ কেউ অবশ্য বলে থাকেন, ক্যাসান্ড্রাই নিজের শরীরের লোভ দেখিয়ে এপোলোর কাছ থেকে এই ক্ষমতা পেয়েছিলেন, এপোলো প্রথমে ক্যাসান্ড্রার প্রেমে পড়েননি।
ক্যাসান্ড্রার গল্প যখন শুরু করেছি, তার পুরো গল্পটাই শেষ করি। ক্যাসান্ড্রার ভবিষ্যতবাণীগুলোর মধ্যে প্রথমেই ছিলো ট্রয়ের যুদ্ধের অন্যতম কারণ প্যারিসের জন্মের সময়। যখন প্যারিসের জন্ম হয়, ক্যাসান্ড্রা বলছিলেন, “হত্যা করো! হত্যা করো প্রায়ামের শহর ধ্বংসের কারণ এই শিশুটিকে!” রাজা প্রায়াম ভাবলেন ক্যাসান্ড্রা ঈর্ষান্বিত হয়ে এইসব কথা বলছেন। প্রজাদের মধ্যেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া হলো। সবাই তাকে পাগল ভাবতে লাগলেন। প্রায়ামও বাধ্য হয়ে ক্যাসান্ড্রাকে তার ঘরে আটকে রেখেছিলেন। কিন্তু রানী হেকুবা প্যারিসকে জন্ম দেওয়ার আগের রাতে স্বপ্ন দেখেছিলেন- তিনি এক আগুনের গোলা প্রসব করছেন, যা পুরো ট্রয় শহরকে পুড়িয়ে দিচ্ছে। হেলেনাস যখন এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিলেন, অনেকটা ক্যাসান্ড্রার মতোই, তখন প্রায়াম এবং হেকুবা প্যারিসকে হত্যা করার জন্য একজন পরিচারকের হাতে তুলে দিলেন। অথচ তারা ক্যাসান্ড্রার একই ধরনের ভবিষ্যতবাণী বিশ্বাস করেননি!
ক্যাসান্ড্রা ট্রোজানবাসীদেরকে সতর্ক করছেন
শিশু প্যারিসকে হত্যা করার আদেশ দেওয়া হলেও, তাকে হত্যা করা হলো না। পাশের রাজ্যে রাখাল বালক হিসেবে তিনি বড় হতে লাগলেন। একদিন এক উৎসব উপলক্ষে এলেন ট্রয় নগরীতে। সেখানে তার অন্য ভাইদের সাথে (প্রায়ামের অন্যান্য সন্তান) এক লড়াইয়ে তিনি যখন জিউসের মন্দিরে আশ্রয় নিলেন, ক্যাসান্ড্রাই প্রথম চিনতে পারলেন প্যারিসকে। এবার প্রায়াম এবং হেকুবা প্যারিসকে মেনে নিলেন নিজেদের সন্তান হিসেবে। এই সময় ক্যাসান্ড্রা ট্রয় ধ্বংসের কথা পুনরুল্লেখ করেছিলেন কি না সেটা অবশ্য জানা যায়নি। তবে ক্যাসান্ড্রার এই একটিমাত্র কথাই সবাই মেনে নিয়েছিলো, প্রকারান্তরে যেটা ট্রয়ের ধ্বংসকেই ত্বরান্বিত করেছিলো!
রাজা প্রায়ামের এক বোন ছিলেন- হেসিওনে। একবার দুই গ্রীক বীর টেলামোন এবং এচিড হেসিওনেকে অপহরণ করে গ্রীসে নিয়ে গেলেন। হেসিওনেকে উদ্ধারের জন্য প্রায়াম এন্টেনর এবং এনকেসিস (আফ্রোদিতির প্রেমিক)-কে পাঠালেন গ্রীসে। কিন্তু তারা হেসিওনেকে উদ্ধারতো করতে পারলেনই না, বরঞ্চ কোনোরকমে পালিয়ে প্রাণে বাঁচলেন। ঠিক সেই সময়ে ক্যাসান্ড্রা আবারো ট্রয়ের পতনের ভবিষ্যতবাণী করলেন। এবারো ক্যাসান্ড্রার কথা কেউ বিশ্বাস করলেন না, রাজা প্রায়াম খুব বিরক্ত হলেন।
প্যারিস যখন স্পার্টার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করছিলেন, তখনো আবার ক্যাসান্ড্রা বললেন ট্রয়ের ধ্বংসের সূচনা হতে যাচ্ছে। তিনি বললেন, “প্যারিস, তুমি কোথায় যাচ্ছ? তোমার সাথে তুমি আগুনের গোলা নিয়ে ফিরে আসবে, যার জন্য এই ট্রয় নগরী পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে। তুমি সেটা বুঝতেও পারছো না!” এবার তার সাথে তার যমজ ভাই হেলেনাসও একই ভবিষ্যতবাণী করলেন। দুর্ভাগ্য ট্রয়ের! রাজা প্রায়াম ক্যাসান্ড্রার সাথে সাথে এবার হেলেনাসের কথাও বিশ্বাস করলেন না! প্যারিস যখন হেলেনকে নিয়ে ট্রয়ে ফিরে এলেন, একমাত্র ক্যাসান্ড্রাই হেলেনের চুল ধরে টান দিয়েছিলেন, সরিয়ে ফেলেছিলেন সোনালী অবগুণ্ঠন। অথচ ট্রয়বাসী হেলেনকে ট্রয়ের এক গৌরবোজ্জ্বল সম্পদ হিসেবেই গ্রহণ করলেন! দিলেন রাজোচিত সম্মান!
ট্রয়ের যুদ্ধে যখন ট্রয়ের সবচেয়ে বড় বীর হেক্টর নিহত হলেন একিলিসের হাতে, প্রায়াম একিলিস শিবিরে গিয়ে তার সন্তানের মরদেহ নিয়ে এলেন, একিলিসের সাথে এগারো দিনের শান্তিচুক্তি করে, যাতে নির্বিঘ্নে হেক্টরের শেষ ক্রিয়া সম্পন্ন করা যায়। প্রায়াম হেক্টরের মৃতদেহ নিয়ে গভীর রাতে ট্রয় নগরীতে প্রবেশ করছিলেন, একমাত্র ক্যাসান্ড্রাই তখন চিৎকার করে বলে উঠলেন, “উঠো ট্রয়বাসী! তোমাদের সেরা বীরের শেষ ক্রিয়ার জন্য যে এগারো দিন সময় পেয়েছ- এটাই তোমাদের জীবনের শেষ শান্তিপূর্ণ সময়! আর বেশিদিন তোমরা ট্রয়ের বাতাস উপভোগ করতে পারবে না!” স্বভাবতই এবারো ট্রয়বাসীরা খুবই বিরক্ত হলেন।
ক্যাসান্ড্রার ভবিষ্যতবাণীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো যুদ্ধের শেষের দিকে গ্রীকদের কাঠের ঘোড়া নিয়ে। সবাই যখন সমুদ্রতীরে পাওয়া কাঠের ঘোড়া নিয়ে কি করবে চিন্তা করছিলেন, ক্যাসান্ড্রাই তখন বলছিলেন, “কাঠের ঘোড়া নিয়ে শহরে প্রবেশ করো না! এই ঘোড়াই শহর ধ্বংস করবে!” আবারো ক্যাসান্ড্রার কথা কেউ বিশ্বাস করলেন না। ট্রয় যখন পুড়ছে, শোকাহত রানী হেকুবাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে আবারো ভবিষ্যতবাণী করলেন ক্যাসান্ড্রা। বললেন, “রাজা আগামেমননও খুন হবেন, আমি সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে তা দেখবো!”
ট্রয়ের যুদ্ধের সময়েই দুইজন বীর ট্রয়ে এলেন শুধুমাত্র ক্যাসান্ড্রাকে বিয়ে করার জন্য। তাদের একজন ছিলেন বেব্রিসিয়ানের রাজা মাইগডনের পুত্র কোরোয়েবাস (ঘটনার প্রায় বছরখানেক পূর্বে হারকিউলিস মাইগডনকে খুন করেছিলেন), অন্যজন ছিলেন অথ্রাইয়োনিয়াস- যিনি ক্যাসান্ড্রাকে বিয়ে করার বিনিময়ে যুদ্ধে গ্রীক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়তে চেয়েছিলেন। রাজা প্রায়ামও রাজী হয়েছিলেন অথ্রাইয়োনিয়াসের সাথে ক্যাসান্ড্রাকে বিয়ে দিতে। কিন্তু সেই বিয়ের সময় আর হয় নি! যুদ্ধে অথ্রাইয়োনিয়াসকে ক্রিটের রাজা ইডোমিনিয়াস হত্যা করেন। ঠিক একইভাবে কোরোয়েবাসও খুন হোন নিওপ্টোলেমাস অথবা ডিওমেডেস কিংবা পেনেলিউসের হাতে (এই তিনজন গ্রীক বীর সম্পর্কে ট্রয়ের যুদ্ধের বর্ণনায় বিস্তারিত বলা হবে)।
যুদ্ধের শেষের দিকে ট্রয় যখন ধ্বংসের পথে, ক্যাসান্ড্রা আশ্রয় নিয়েছিলেন দেবী এথেনার মন্দিরে। সেই সময়ে সেখানে প্রবেশ করলেন গ্রীক বীর অ্যাজাক্স দ্য লেসার বা লকরিসের রাজা অ্যাজাক্স (খ্যাতিমান গ্রীক বীর অ্যাজাক্স দি গ্রেট নয়)। ক্যাসান্ড্রা দেবী এথেনার কাঠের মূর্তি ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। অ্যাজাক্স গিয়ে ক্যাসান্ড্রার চুল ধরে টেনে হিঁচড়ে মন্দিরের বাইরে নিয়ে এলেন, ক্যাসান্ড্রা যেহেতু এথেনার মূর্তি ধরে ছিলেন, সেটিও জায়গা-চ্যুত হয়ে পড়লো। আর এভাবেই শুরু হলো ট্রয়ের যুদ্ধে বিজয়ী গ্রীক বীরদের প্রতি এথেনার ক্রোধ, যার ফলশ্রুতিতে সবাই গ্রীসের ফিরতি পথে বিভিন্ন বিপদের সম্মুখীন হলেন। কেউ কেউ বলে থাকেন, মন্দিরের ভিতরে অ্যাজাক্স ক্যাসান্ড্রার শ্লীলতাহানি করেছিলেন। এই সময়েই ক্যাসান্ড্রাকে বাঁচাতে গিয়েই মারা গিয়েছিলেন কোরোয়েবাস। সে যাই হোক, যুদ্ধ শেষে ট্রয়ের নারীদের ভাগ বাটোয়ারায় গ্রীক রাজা আগামেমননের ভাগে পড়েন বন্দী ক্যাসান্ড্রা।
এথেনার মন্দির থেকে অ্যাজাক্স ক্যাসান্ড্রাকে টেনে হিঁচড়ে বের করছেন
তারা জাহাজে করে মাইসিনিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরুর প্রাক্কালে দেবী এথেনার মন্দিরে আশ্রয় নেওয়া ক্যাসান্ড্রার সাথে অ্যাজাক্স যে আচরণ করেছেন, গ্রীক বীর ওডিসিয়াস তার তীব্র নিন্দা করলেন, একইসাথে আগামেমননকে জানালেন অ্যাজাক্সের বিচার না করলে দেবী এথেনার অভিশাপে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অ্যাজাক্স ট্রয়ের এথেনার মন্দিরে গিয়ে শপথ নিয়ে বললেন, তিনি ক্যাসান্ড্রার শ্লীলতাহানি করেননি! গ্রীকরা অ্যাজাক্সের বিরুদ্ধে আর কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিলেন না। দেবী এথেনা এতে প্রচন্ড ক্ষুদ্ধ হয়ে পসাইডনের সাহায্য চাইলেন। পসাইডন সমুদ্রে এক বিশাল ঝড়ের সৃষ্টি করলেন- ফলে মেনেলাউস মিশর হয়ে স্পার্টায় পৌঁছালেন, ওডিসিয়াসের দশ বছর লেগে গেলো নিজ এলাকায় যেতে, পাথরের আঘাতে ঝড়েই মারা গেলেন অ্যাজাক্স এবং আগামেমননের জন্য ঘনিয়ে আসছিলো বিশাল বিপদ- সেটা আপন আলয়ে। অনেকেই বলে থাকেন, এই যাত্রাপথেই আগামেমননের ঔরসে ক্যাসান্ড্রা টেলেডামুস এবং পেলোপ্স নামে দুই যমজ সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন।
আগামেমননের স্ত্রীর নাম ছিলো ক্লাইটেমনেস্ট্রা। যুদ্ধের শুরুতেই ট্রয়ে যাওয়ার প্রাক্কালে বাতাস পাওয়ার জন্য আগামেমনন নিজের মেয়ে ইফিজেনিয়াকে উৎসর্গ করেছিলেন। ক্লাইটেমনেস্ট্রা সেটা কখনো মেনে নিতে পারেন নি। আগামেমনন যখন ট্রয়ে যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন, তখন ক্লাইটেমনেস্ট্রা ভালোবাসায় লিপ্ত হলেন ইজিস্থাসের সাথে (ওডিসিয়াস অংশে বিস্তারিত বর্ণনা করা হবে) আর প্রতিজ্ঞা করলেন স্বামী আগামেমননকে হত্যা করার। আগামেমনন এবং ক্যাসান্ড্রা যখন মাইসিনিয়ার রাজপ্রাসাদে এলেন, আগামেমনন প্রাসাদের ভিতরে প্রবেশ করলেন, কিন্তু ক্যাসান্ড্রা ফটকেই দাঁড়িয়ে রইলেন। তিনি প্রাসাদের রক্তের গন্ধ পেয়েছিলেন! আগেই বুঝতে পেরেছিলেন কিছু একটা ঘটবে!
ক্লাইটেমনেস্ট্রা ইজিস্থাসের সহযোগিতায় আগামেমননকে হত্যা করে রাজপ্রাসাদ থেকে বের হয়ে, একই অস্ত্র দিয়ে ক্যাসান্ড্রাকেও হত্যা করেন। পরবর্তীতে তার দুই সন্তানকেও হত্যা করা হয়েছিলো।
এভাবেই সমাপ্ত হয়েছিলো এমন এক রাজকুমারীর জীবনকাল, জীবদ্দশাতে তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভবিষ্যতবাণী করেও নিজের লোকদের কাছে কখনো স্বীকৃতি পাননি, নিজের দেশকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করতে পারেননি, সবশেষে নিজেকে এবং নিজের সন্তানদেরও বাঁচাতে পারলেন না! তাই গ্রীক মিথলজিতে ক্যাসান্ড্রা হয়ে রইলেন এক বিয়োগান্তক চরিত্র হিসেবেই, যার জন্য মূলত দায়ী ছিলেন দেবতা এপোলো!
(এবার একটু ডাক্তারি ফলাই- সেটা আবার সাইকোলজির ডাক্তারি!
ক্যাসান্ড্রা সিন্ড্রোম- আমাদের সমাজে এমন বেশকিছু মানুষ আছেন, যারা নিজেদের দুঃখ কষ্টের কথা অনেকের সাথেই শেয়ার করেন, কিন্তু যাদের সাথে শেয়ার করেন- তারা তার সেইসব দুঃখ কষ্টের কথাকে খুব একটা গুরুত্ব দেন না, বা বিশ্বাস করতে চান না! অভিযোগকারী এক্ষেত্রে নিজেকে খুবই অবহেলিত ভেবে থাকেন। এটাকেই বলা হয়ে থাকে ক্যাসান্ড্রা সিনড্রোম। চিকিৎসা? জানতে হলে আমাকে ফি দিতে হবে!)
এই সিরিজের আগের লেখাগুলোঃ
সৃষ্টিতত্ত্বঃ
পর্ব-১: বিশ্ব-ব্রক্ষ্মান্ডের সৃষ্টি এবং ইউরেনাসের পতন
পর্ব-২: টাইটান যুগের সূচনা এবং অলিম্পিয়ানদের জন্ম
পর্ব-৩: প্রথম টাইটান যুদ্ধ এবং জিউসের উত্থান
পর্ব-৪: মানবজাতির সৃষ্টি, প্রমিথিউস এবং পান্ডোরা উপাখ্যান
পর্ব-৫: প্রমিথিউসের শাস্তি এবং আইও
পর্ব-৬: আবার যুদ্ধ- জায়ান্ট এবং টাইফোয়িয়াস
পর্ব-৭: ডিওক্যালিয়নের প্লাবন
দেবতাদের গল্পঃ
পর্ব-৮: জিউস, মেটিস এবং এথেনার জন্ম
পর্ব-৯: এথেনার গল্পকথা-প্রথম পর্ব
পর্ব-১০: এথেনার গল্পকথা- দ্বিতীয় (শেষ) পর্ব
পর্ব-১১: আফ্রোদিতির গল্পকথাঃ আফ্রোদিতি, হেফাস্টাস এবং অ্যারিসের ত্রিমুখী প্রেমকাহিনি
পর্ব-১২: আফ্রোদিতির গল্পকথাঃ অ্যাডোনিসের সাথে অমর প্রেমকাহিনী
পর্ব-১৩: আফ্রোদিতির গল্পকথাঃ এনকেসিসের সাথে দূরন্ত প্রেম
পর্ব-২০: আফ্রোদিতির গল্পকথাঃ লেমনসের নারী এবং অন্যান্য
পর্ব-২১: লেটোঃ এপোলো এবং আর্টেমিসের মায়ের কাহিনী
পর্ব-২২: আর্টেমিসের গল্পকথাঃ একটাওনের মন্দভাগ্য
পর্ব-২৩: আর্টেমিসের গল্পকথাঃ এলোয়াডি, আলফিউস ও আরেথুসা এবং ক্যালিষ্টোর কাহিনী
পর্ব-২৪: আর্টেমিসের গল্পকথাঃ অরিয়ন
পর্ব-২৫: এপোলোর গল্পকথাঃ ডেলফির মন্দির
পর্ব-২৬: এপোলোর গল্পকথাঃ মোর বীণা বাজে.........
পর্ব-২৭: এপোলোর গল্পকথাঃ আমাদের রাজার গাধার কানের সোনালী স্পর্শ
পর্ব-২৮: এপোলোর গল্পকথাঃ ডাফনি এবং মারপেসসার ভালোবাসা
ভালোবাসার গল্পঃ
পর্ব-১৪: পিগম্যালিয়ন এবং গ্যালাতিয়া
পর্ব-১৫: পিরামাস এবং থিসবি
পর্ব-১৬: হিরো এবং লিয়েন্ডার
পর্ব-১৭: বোসিস এবং ফিলোমোন
পর্ব-১৮: কিউপিড এবং সাইকী- প্রথম পর্ব
পর্ব-১৯: কিউপিড এবং সাইকী- শেষ পর্ব
লেখকঃ
এস এম নিয়াজ মাওলা
ছবি সূত্রঃ ইন্টারনেট
মন্তব্য
এস এম নিয়াজ মাওলা, এক নিঃশ্বাসে পড়লাম। দারুণ। সাথে বুকমার্কও করলাম। ভাল থাকবেন আর এমন ভাল ভাল লেখে আমাদের জানার সুযোগ করে দেবেন
Shah Waez (শাহ্ ওয়ায়েজ।)
Facebook
..............................................................................................
কোথাও নেই ঝুমঝুম অন্ধকার
তক্ষক ডাকা নিশুতিতে
রূপকথা শুনে শিউরে উঠে না গা
স্বপ্নে আমার শরীরে কেউ ছড়ায় না শিউলি ফুল
আলোর আকাশ নুয়ে এসে ছোঁয় না কপাল
প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি দেরীতে জবাব দেওয়ার জন্য।
আসলে প্রফেশনাল ব্যস্ততাই এর জন্য দায়ী!
আর পড়ার জন্য আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ।
ভালো থাকুন অবিরত।
-এস এম নিয়াজ মাওলা
ক্যাসান্ড্রার সাথে পরিচয় হয়েছিল অনেক আগে 'হারকিউলিস' দেখতে দেখতে।
আপনার এই সিরিজটা অনেক ভালো লাগে। গ্রীক মিথলজি আসলেই চমকপ্রদ।
ভালো থাকুন, শুভেচ্ছা
অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে মেঘলা মানুষ।
ভালো থাকুন খু-উ-ব।
-এস এম নিয়াজ মাওলা
যাক, আপনি এখন একটু ফ্রি আছেন মনে হচ্ছে। ক'দিন মন ভরে গ্রীক উপকথা পড়া যাবে!!!
____________________________
পুরোপুরি ফ্রি হতে পারি নি ভাইয়া! এই দেখুন না, এই কমেন্টের জবাব দিচ্ছি কতদিন পরে!
-এস এম নিয়াজ মাওলা
বেচারা ক্যাসান্ড্রা!
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
আমারো কিন্তু ক্যাসান্ড্রার জন্য খুব কষ্ট লেগেচগে।
ভালো থাকুন ভাইয়া, সবসময়ের জন্য।
-এস এম নিয়াজ মাওলা
২৯ পর্বের পরে বাকি গুলো আর খুঁজে পাচ্ছিনা।কাইন্ডলি বাকি গুলোর লিংক বা সোর্স দেওয়া যাবে কি?
নতুন মন্তব্য করুন