বিশ্ব রাজনীতিতে রাশিয়া নামের এক নতুন মেরুর আবির্ভাব ঘটলো| "এক ঘর মে দো পীর" হওয়াতে নতুন পীরের মুরিদসহ অনেকই "বিশ্ব রাজনীতিতে ভারসাম্য এলো" এই অজুহাতে আনন্দিত হওয়ার সুযোগ খুঁজছে| কিন্তু সিরিয়া হয়ে ক্রিমিয়া দখল এবং তত্পরবর্তী রাজনীতি বলে দেয় এটা কোন ভারসাম্য-ভারসাম্য খেলা নয় বরং এক নতুন ভূ-রাজনৈতিক ভাগ-বাটোয়ারার পর্ব শুরু হয়েছে|
বর্তমান এই রাশিয়া রাষ্ট্রের চরিত্র কেমন? সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়ার রাজনীতি চলে যায় কমুনিস্ট পার্টির ননী-মাখন খাওয়া সদস্য, দুর্নীতিবাজ সামরিক-বেসামরিক আমলা, মাফিয়া-কর্পোরেট মাফিয়াদের হাতে| সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন পরবর্তী সময়টিতে রাশিয়া একটি গভীর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মন্দায় পড়ে যায়| আর সেই মন্দার সুফল ভোগ করে রাশিয়ার হাল ধরে থাকা এই সুবিধাভোগী শ্রেণী| দুর্নীতি, লুটপাট সমাজের সব স্তরেই প্রবেশ করে| পৃথিবীর দুর্নীতিবাজ দেশগুলোর তালিকায় রাশিয়ার অবস্থান এখনো ওপরের দিকে| দুর্নীতির সাথে যুক্ত হয় রুশ উগ্র জাতীয়তাবাদ| প্রাক সোভিয়েত এবং সোভিয়েত সময়ে রুশ অহংবোধ তার অধীনস্ত এবং পার্শবর্তী অন্যান্য জাতিসত্বাকে ঠিক ততটুকুই প্রশ্রয় দিয়েছে যতটুকুতে তারা রুশ কতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানাতে না পারে| রুশ, ইউক্রেন এবং বেলারুশ মিলে মধ্যযুগে "pravoslav" নামে যে জাতিসত্বার সৃষ্টি হয় মজার ব্যাপার হচ্ছে তার উত্পত্তি ইউক্রেনের বর্তমার রাজধানী কিয়েভে (পরবর্তীতে সেটা তিনটি উপশাখায় বিভক্ত হয়|)| কিন্তু তার কতৃত্ব চলে যায় রুশদের হাতে এবং সেই কতৃত্ব এখনো দৃশ্যমান| সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন পরবর্তী সময়ে অন্যান্য জাতির মধ্যে সুবিধাভোগী রুশ বিরোধী সাংঘর্ষিক রাজনীতির সূচনা হয় এবং এর ফলে রুশ জাতীয়তাবাদের উগ্রতা রাশিয়ার বাইরেও (যেখানে যেখানে রুশ বসতি ছিলো) ছড়িয়ে পড়ে|
তুলনা করা ঠিক হবে কিনা জানি না...তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও ১৯৩০ এর মহা মন্দা পরবর্তী জার্মানির উত্থান এবং ২১ শতকের মহা মন্দা পরবর্তী রাশিয়ার উত্থানের মধ্যে একটা সাদৃশ্য খুঁজে পাই| সেই সময়ের জার্মানির অর্থনৈতিক ও সামরিক অগ্রগতির সাথে উগ্র জাতীয়তাবাদী-সাম্রাজ্যবাদী চেতনার যে মিলন তার অনেক কিছুই আজ রাশিয়ার বর্তমান অবস্থার সাথে মিলে যায়| উগ্র জাতীয়তাবাদ যখন প্রবলভাবে জনসমর্থিত হয় এবং তার সাথে অর্থনৈতিক ও সামরিক অগ্রগতির মিলন হয় তার ভয়াবহ পরিণতি পৃথিবী দেখেছে ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত| জার্মানির সাম্রাজ্যবাদের সূচনা হয় অস্ট্রিয়া দখল দিয়ে আর রাশিয়ার শুরু হোল ক্রিমিয়া দিয়ে|
বিশ্ব ধনতন্ত্র আজ ইউক্রেনের জনগণকে দু'ভাগে (রুশপন্থী ও ইউরোপপন্থী) ভাগ করে একটি জাতিগত বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে| এই দুর্ভাগ্য শুধু ইউক্রেন নয় সমগ্র বিশ্ববাসীর যে, সোভিয়েত পরবর্তী বাজার অর্থনীতির বিপর্যয়কে প্রতিহত করার যে ভারসাম্যপূর্ণ আর্থ-সামাজিক রাজনীতির উপস্থিতি দরকার ছিল তা না হয়ে রাজনীতি গিয়ে পড়লো ধর্মীয় জঙ্গীবাদের হাতে এবং এখন রাশিয়ার হাতে|
-হাসান রায়হান
মন্তব্য
একটু ব্যাখ্যা করলে ভাল হত না? কোন প্রেক্ষাপটে গড়ে উঠেছিল?
রাশিয়ার অর্থনৈতিক অগ্রগতি সেই সময়ের জার্মানের অগ্রগতির সাথে মিলে যায়? বা, এমনকি সামরিক অগ্রগতিও? কিছু পরিসংখ্যান তুলে ধরতে পারতেন কিন্তু!
বিশ্ব ধনতন্ত্র বলতে ঠিক কি বোঝাতে চাইছেন? ঠিক কে বা কারা এই ব্লকের অন্তর্ভুক্ত যারা এই বিভাজন নীতি গ্রহণ করেছেন বলে আপনার মনে হচ্ছে?
যাই হোক, ক্ষুদে লেখাটির জন্য ধন্যবাদ, অন্তত ভাবিয়েছে।
.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল
ধন্যবাদ দীনহীন| রুশ, বেলারুশ এবং ইউক্রেন "pravoslav" নামে একই জাতিসত্বার তিনটি উপশাখা| কিছু ভাষাগত পার্থক্য ছাড়া তাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় উত্তরাধিকার এক| ৯ম শতকে ইউক্রেনের বর্তমান রাজধানী কিয়েভকে ঘিরে তাদের একক সাম্রাজ্য গড়ে উঠে এবং ১৩শ শতক পর্যন্ত সেই সাম্রাজ্য টিকে থাকে|
এখানে অর্থনৈতিক অগ্রগতি বলতে ১৯৩০ সালের বিশ্ব মহা মন্দা (recession) থেকে জার্মানি'র উত্তরণকে বোঝানো হয়েছে| দেখতে পাচ্ছি হিটলারের নেতৃত্বে জার্মানি ওই সময়ে মন্দা কাটিয়ে ওঠার জন্য বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়| যার ফলে ১৯৩৩-১৩৩৯ সময়ে বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি কমে| আর একটি বিষয়...জার্মানির সেই সময়ের সামরিক যে সক্ষমতা গড়ে উঠে সেটা অর্থনীতিতে সফল না হলে হতো না| একইভাবে রাশিয়ান অর্থনীতিও তাদের ১৯৯১ পরবর্তী মন্দা কাটিয়ে উঠে| দেখতে পাচ্ছি ২০০৯ এ তাদের GDP ছিলো ৮.১%| তাদেরও বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি সহণীয় পর্যায়ে পৌঁছে| সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো তাদের যে পাহাড়সম ঋণ ছিলো তা পরিশোধ করে| আর তাদের সামরিক সক্ষমতা নিয়ে তো নতুন করে বলার কিছু নেই| জার্মানি-অস্ট্রিয়া এবং রাশিয়া- ক্রিমিয়া তুলনাটি টেনেছি এই কারণে যে ক্রিমিয়ার ওপর রাশিয়ার মতই অস্ট্রিয়ার ওপর জার্মানির দাবী ছিলো ১ম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে| জার্মানি মনে করতো অস্ট্রিয়া তাদেরই অংশ| তার ওপর হিটলারের জন্মস্থান ছিল অস্ট্রিয়াতেই| তাই ২য় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে জার্মানি অস্ট্রিয়া দখলে নিয়ে নেয়|
বিশ্ব ধনতন্ত্র বলতে মুক্ত বাজার অর্থনীতিকে বোঝচ্ছি| আপনি বোধহয় জেনে থাকবেন, কিছুদিন আগের একটি ব্যাপক সরকার বিরোধী আন্দোলনে ইউক্রেনের জনগণ একরকম দু'ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে| যুগ যুগ ধরে রুশ আধিপত্য থাকায় তাদের একটি অংশ রুশপন্থী আর একটি অংশ ইউরোপীয় ইউনিয়নে যুক্ত হতে চাচ্ছে| রাশিয়া আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন দু'জনেরই ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে ইউক্রেনকে ঘিরে| তাছাড়া ইউক্রেনে একটি বড় রুশ জনবসতি থাকায় ইউক্রেনের নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণে তারা বাধা হয়ে আছে|
-হাসান রায়হান
আমি কয়েকটা খবরে দেখতে পেলাম ইউক্রেইনে নিওলিবারেলদের ছদ্মবেশে নিওনাৎসীরা সামরিক ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণে আছে। আপনি কি এ ব্যাপারে আলোকপাত করতে পারেন?
শোনা যাচ্ছে ইউক্রেনের এখন কোয়ালিশন সরকারে "স্ভাবোদা" (বাংলায় এর অর্থ "স্বাধীনতা") নামে উগ্রডানপন্থী দল রয়েছে| তবে পশ্চিমা বড় কোন মিডিয়াতে এর স্বপক্ষে খবর পেলাম না| এতে আশ্চর্য হওযার কিছু নেই| উগ্র জাতীয়তার এক পাশে যেমন থাকে নিজের জাতির জন্য ভালোবাসা আর অন্য পাশে থাকে অন্য জাতির জন্য ঘৃণা| রুশ জাতীয়তাবাদের উগ্রতার বিরুদ্ধে ইউক্রেনে এই ডানপন্থী শক্তির উত্থান হতেই পারে| এর জন্য চাই ইউক্রেনকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়া|
-হাসান রায়হান
এই "ইউক্রেন" বা "ইউক্রেনিয়ান" কে বা কাহারা? যা দেখতে পাচ্ছি, ইউক্রেন একটা না - বেশ কয়েকটা। অন্তত দু'টো তো বটেই! তো, কাকে বা কোন ইউক্রেনকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়া দরকার? সবগুলিকেই, নাকি যে কোন একটাকে? এবং এই একটার স্বাধীন সিদ্ধান্ত বা অ-সিদ্ধান্ত অর্থাৎ ভোট বা ভেটো বাকিগুলির অবশ্যমান্য বলে চালিয়ে দিয়ে? কিম্বা এমন একটা স্টেলমেট (অচলাবস্থা) পরিস্থিতি সৃষ্টি করে সবাইকেই "স্বাধীন" ভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা দেয়া, যেখানে আসলে একটা গ্রুপের বা 'ইউক্রেনের' সিদ্ধান্ত বা ইচ্ছাই চূড়ান্ত বৈধ আউটকাম হিসেবে গৃহীত হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না অন্যগুলির ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে বাতিল করে?
****************************************
গত শতকের জার্মানির অর্থনৈতিক-সামরিক উত্থানের সাথে বর্তমানের রাশিয়ার অর্থনৈতিক-সামরিক উত্থান কেন এবং কি ভাবে তুলনীয় হতে পারে? রাশিয়ার যে সামরিক অগ্রগতি, তা তো সোভিয়েত আমলের অগ্রগতিরই ধারাবাহিকতা মাত্র। আর অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রন যে মুষ্টিমেয় কিছু লোকের হাতে পুঞ্জীভূত হয়েছে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সেটাই তো হওয়ার কথা।
জার্মানির অষ্ট্রিয়া দখল, আর রাশিয়ার ক্রিমিয়া অধিকারও একই পাল্লায় মাপাটা বোধ হয় অতি সরলীকরণ মাত্র। কারন মাত্র অর্ধশত বছর আগে রুশ ভাষাভাষী অধ্যুষিত ক্রিমিয়া ছিল রাশিয়ারই অন্তর্গত, সোভিয়েত আমলে প্রশাসনিক সুবিধার কারনে সেটা ইউক্রেন স্টেটে দেয়া হয়। সর্বোপরি হিটলারের জার্মানি ভয়াবহ জাত্যাভিমানের দম্ভে অপরাপর সকল জাতিকে ধংসের যে উন্মত্ততায় আচ্ছন্ন ছিল, সেই জার্মানির সাথে এখনকার রাশিয়াকে এক করে দেখানোর চেষ্টা নানাবিধ প্রশ্নের উদ্রেক করে।
নতুন মন্তব্য করুন