তানপুরা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বুধ, ০৯/০৪/২০১৪ - ১:৫৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১।
মনসুর সাহেবের সাথে আমার পরিচয় পর্বটা ছিল বেশ অদ্ভুত।সে প্রায় বছর পনের আগের কথা।মাস্টার্স শেষ করে বেসরকারি একটা কোম্পানিতে ঢুকেছি।মোটা অংকের বেতন পাচ্ছি।মেস ছেড়ে কলাবাগানে ছিমছাম একটা দুইরুমের ফ্ল্যাট নিয়ে উঠে পড়লাম।শুধু সংসারটাই যা শুরু করা বাকি।
সেদিন খুব ঝড় বৃষ্টি ছিল।অফিস থেকে বাসায় ফিরতেই কারেন্ট বাবাজি বিদায় নিল।ব্যাচেলর মানুষ।ঘরে একটা মোমবাতি রাখার কথাও মনে হয়নি।উপায়ন্তর না দেখে পাশের ফ্ল্যাটের দরজায় নক করলাম।আসা অবধি কাজের ব্যস্ততায় প্রতিবেশীর সাথে পরিচিত হবার ফুরসতটুকুও মেলেনি।শুধু অফিসে যাবার সময় এক ভদ্রমহিলাকে ছোট একটা মেয়েকে নিয়ে স্কুলে যেতে দেখতাম।এটুকু পর্যন্তই।দরজা খুলতে বেশ খানিকটা সময় লাগলো।মোমবাতি হাতে নিয়ে ভদ্রমহিলা দরজা খুললেন।
দরজাটা খোলার সাথে সাথেই অচেনা একটা বাদ্যযন্ত্রের শব্দ ভেসে এল।মিষ্টি টুংটাং একটা শব্দ একটানা বেজে চলেছে।ভদ্রমহিলাকে খানিকটা অপ্রস্তুত মনে হল।আমি কোনরকমে বললাম, “ইয়ে মানে, ঘরে মোমবাতি নেই।একটা মোমবাতি দিলে খুব উপকার হয়”।
“ভেতরে এসে বসুন।আমি দিচ্ছি”।
খানিকটা কৌতুহল নিয়েই ঢুকলাম। মিষ্টি বাজনার শব্দটা এখন আরো স্পষ্ট।খুব অবাক লাগছিল।শব্দটা কোন পরিচিত বাদ্যযন্ত্রের না এইটুকু বেশ বোঝা যাচ্ছিল। শুনতে শুনতে কেমন একটা ঘোর চলে আসছিল। গান বাজনার সমঝদার আমি কখনই ছিলাম। মাঝে মাঝে মন খারাপ হলে রবীন্দ্র সংগীত শোনা পর্যন্তই আমার দৌড়।কিন্তু বেশ বুঝতে পারছিলাম, বাজনাদার যেই হোক, গান বাজনার উপর ভাল দখল না থাকলে অম্ন সুন্দর বাজানো যায় না।মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম।

“আপনার মোমবাতি”।
টেবিলে মোমবাতির সাথে একটা পিরিচে কিছু বিস্কুট আর চানাচুর রাখলেন।ভদ্রমহিলার আপ্যায়ন দেখে খুব অবাক হলাম।আমি কিছু বলার আগেই উনি বলে উঠলেন।

“আমার সাহেব গান বাজনা খুব ভাল জানেন।বৃষ্টি আসলেই তানপুরা নিয়ে বসে যান।মাঝে মাঝে আপনার অসুবিধা হতে পারে। কিছু মনে করবেন না”।

“না না।মনে করার কি আছে।বেশ বাজান তো।এই যুগেও তানপুরা কেউ বাজায়,তাও এত ভালো-ভাবতেই পারছিনা।উনি কি রেডিও টিভিতেও বাজান নাকি?”

“না।শখের শিল্পী বলতে পারেন।তবে দু একটা প্রোগ্রাম করেছেন”।
ভদ্রমহিলার নাম বীণা।বয়স ২৭/২৮ হতে পারে।একটা স্কুলে শিক্ষকতা করছেন।বেশ স্মার্ট।খুব পরিচিত মানুষদের মতন কথা বলেন।কথা বলার মাঝখানে বেশ একটা উচ্ছলতা প্রকাশ পায়।টুকটাক গল্প করতে করতে কারেন্ট চলে এল।এই সময় পর্দার ফাঁক দিয়ে ফুটফুটে একটা বাচ্চা মেয়েকে উঁকি দিতে দেখলাম। চোখে চোখ পড়ার সাথে সাথেই লুকিয়ে পড়ছে।
“অন্তরা এদিকে এসো”।
মেয়েটি গুটিগুটি পায়ে পর্দা সরিয়ে এল।
“বাবা উনাকে ডাকছেন”।
আমি হঠাৎ খেয়াল করলাম বাজনার শব্দটা থেমে গেছে।ভদ্রমহিলা শশব্যস্ত হয়ে উঠে গেলেন।একটু ইতস্তত করে বাচ্চা মেয়েটির পিছন পিছন গেলাম।

রুমে ঢুকেই ধাক্কার মত খেলাম।মাদুর পেতে তানপুরা হাতে যিনি বসে আছেন,তার সাথে কেবল ইতিহাসের বইয়ের গ্রীক দেবতাদের তুলনা দেওয়া চলে। তানপুরা হাতে ভদ্রলোক মিষ্টি করে হাসছেন।
“আসেন ভাই সাহেব।বসেন।আমি জানতাম আপনি আসবেন।বীণাকে বলছিলামও সন্ধ্যেবেলা।আজ যেই রাগটা তুললাম,তা গৃহে অতিথির আগমন ঘটায়”।
ভদ্রলোক কিসের কথা বলছেন কিছু না বুঝেই আমি অপ্রস্তুতের হাসি হাসলাম।দু এক কথায় পরিচয় পর্বটা শেষ হবার পর ভদ্রলোক হঠাৎ বলে উঠলেন,
“বীণা লাইটটা অফ করো তো।আজ বেশ মুড এসেছে।হাসান ভাইকে আলো জ্বালানোর রাগটা শোনাই”।
ভদ্রমহিলা বেশ বিরক্ত হয়েই লাইট অফ করলেন।ঘরের ভিতর এখন জমাট বাধা অন্ধকার।তানপুরা বেজে উঠলো।সেই সাথে মন্সুর সাহেবের গমগমে কন্ঠ।তানপুরা ও গলার স্বর দুটোই উচ্চগ্রামে উঠতে লাগলো।একটা অদ্ভুত মায়ায় আমি আচ্ছন্ন হয়ে যেতে লাগলাম।এভাবে কতক্ষন কেটে গেল বোঝার আগেই হঠাৎ চোখের সামনে দেখলাম মোমবাতিটা দপ করে জ্বলে উঠলো।বিস্ময় ও ঘোর নিয়ে আমি তাকিয়ে দেখলাম মনসুর সাহেব বিজয়ীর হাসি হাসছেন আমার দিকে তাকিয়ে।

মনসুর সাহেবের সাথে আমার প্রথম দেখাটা এইভাবেই হয়েছিল।তারপর দেখতে না দেখতে ছোট এই পরিবারটির সাথে আমি বেশ সহজ হয়ে গেলাম।মনসুর সাহেব আর বীণা ভাবীর প্রেমের বিয়ে।এতিমখানায় বড় হওয়া মনসুর সাহেব কে ভাবীর পরিবারের কেউ মেনে নিতে পারেনি।পরিবার থেকে বিছিন্ন রীতিমত নিঃসঙ্গ এই পরিবারটির আত্মীয় কি প্রতিবেশী-সবই হয়ে গেলাম আমি।বীণা ভাবীর আন্তরিকতা,কিংবা অন্তরার মিষ্টি করে আমাকে চাচা ডাকা-এসব কিছুই আমাকে এদের খুব কাছের মানুষ করে দিল।তবে ভাবী কিংবা অন্তরা না, যে মানুষটা আমাকে সবচে বেশী প্রভাবিত করল, তিনি হচ্ছে মনসুর সাহেব।গানবাজনার উপর ভদ্রলোকের অদ্ভুত এবং আশ্চর্য্যরকম প্রতিভা আমাকে মুগ্ধ করেছিল।গান গেয়ে লাইট ভেঙ্গে ফেলা,বৃষ্টি নামানো,আগুন ধরানো-একসময় যেগুলোকে কিংবদন্তি ভাবতাম-মনসুর সাহেবের সাথে পরিচিত হবার পর তা নিজের চোখে দেখেছিলাম।এমন প্রতিভাবান শিল্পী এই যুগেও হয় তা দেখেও হতবাক হয়েছিলাম। পুর্ণিমা হলেই ছাদে গিয়ে গানের আসর বসানো,চাকরির তোয়াক্কা না করেই হুটহাট করে বেরিয়ে পড়া-এসবই আমি বেশ উপভোগ করতাম।যদিও বীণা ভাবী মনসুর সাহবের এই ব্যপারগুলা একেবারেই পছন্দ করতেন না।গান বাজনার ব্যপারে উনার পাগলামির আর একটা নমুনা ছিল,নিজেকে উনি মুঘল সম্রাট আকবরের নবরত্নের একজন সদস্য সুরসম্রাট তানসেন এর উত্তরাধিকারী বলে দাবি করতেন। কিছুটা পাগলাটে আর উদাসীন স্বাভাবের এই মানুষটাকে আমার বেশ ভালো লেগে গিয়েছিল। উনার চিন্তা ধারার জগৎটা ছিল আমাদের মত ছাপোষা মানুষদের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা।পার্থিব লোভ,হিংসা,ক্রোধ-এইসব মনসুর সাহেবকে কখনো স্পর্শ করতো না।এইজন্য উনার সানিধ্যে আসলে একটা আশ্চর্য্য প্রশান্তি লাভ করতাম।

২।
একবার ঢাকার বাইরে এক ট্রেনিং এ গিয়ে মাস খানেক থাকা লাগলো। ট্রেনিং থাকা অবস্থায় মনসুর সাহেবের চিঠি পেলাম।খুব নাকি জরুরি দরকার।ট্রেনিং শেষ করে ঢাকা ফিরতেই মনসুর সাহেবের বাসায় গিয়ে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম।বাসায় কেবল মনসুর সাহেব একা।ভাবী,অন্তরার দেখা নেই।তাদের কথা জিজ্ঞেস করার পরও কোন উত্তর দিচ্ছিলেন না।বিষাদময় কন্ঠে আবোল তাবোল অনেকে কথা বলতে লাগলেন।
“হাসান,সুর আর সংগীত কিন্তু একধরনের প্রার্থনা।স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা জানানোর একটা শক্তিশালী উপায়,বুঝলে?আমরা নির্বোধ মানুষরা যে সুর সংগীত এগুলোকে একেবারেই গুরুত্ব দেই না এটা কিন্তু একেবারেই ঠিক না”।
“ভাবী,অন্তরা ওরা কোথা মনসুর ভাই?”
“বিকালে পিজিতে একবার যেও।তোমার ভাবী আর অন্তরা আছে পিজিতে”।
আমি হতভম্ব হয়ে প্রশ্ন করলাম, “কি হয়েছে? হঠাৎ হস্পিটালে কেন?”
“অন্তরার একটা টিউমার ধরা পড়েছে”।নির্বিকারভাবে কথাটা বলেই মনসুর সাহেব ভিতরে চলে গেলেন।আর তারপরই ভিতর থেকে তানপুরার চিরপরিচিত মিষ্টি শব্দটা ভেসে আসতে লাগলো। আমি হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। মেয়ের টিউমার ধরা পড়েছে আর উনি ঘরে বসে আয়েশ করে তানপুরা বাজাচ্ছেন?লোকটা কি উন্মাদ হয়ে গেলো?

পিজিতে গিয়ে বীণা ভাবীর মুখে সব শুনলাম।অন্তরার টিউমার ধরা পড়ার পরও নাকি মনসুর সাহেব হাস্পাতালে ভর্তি করাতে চাচ্ছিলেন না।গান গেয়ে নাকি উনি চিকিৎসা করবেন।অনেক ঝগড়া,যুদ্ধের পর গত পরশু অন্তরাকে ভর্তি করা হয়েছে। টিউমারটা প্রাথমিক পর্যায়েই আছে।তবে পেশেন্টের বয়স অল্প বলে চিকিৎসকরা অপারেশন করার আগে কয়েকদিন পর্যবেক্ষনে রাখছেন। বীণা ভাবীর হতাশ মুখটা দেখে আমার খুব খারাপ লাগছিল।কথা কথা বলতে বলতে বার বার কেঁদে ফেলছিলেন।

“ভাবী কাঁদবেন না।সব ঠিক হয়ে যাবে।আপনি একটু শক্ত হন”।
“আপনি বাসায় গিয়েছিলেন?দেখা হয়েছিল ওর সাথে?কি বলেছে?মানুষটা কি পুরোপুরিই পাগল হয়ে গেল?মেয়েটাকে পর্যন্ত একবার দেখতে আসেনি।আমার বোধ হয় আর ওর সাথে সংসার করা হল না।”
অনেকগুলো কথা একসাথে বলতে বলতে আবারো কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। গান বাজনা নিয়ে মনসুর সাহেবের পাগলামি বীণা ভাবী পছন্দ না করলেও মানুষটাকে যে ভাবী কত ভালোবাসেন, তা দু একটা কথা শুনলেই বোঝা যেত।
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দু একটা সান্তনার কথা বলে অন্তরা কে দেখতে এলাম।
মেয়েটার মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে।তবে কথা বলে মনে হল একদম ভেঙ্গে পড়েনি।অন্তরাকে দেখে চলে আসার মুহুর্তে হঠাৎ মেয়েটা আমাকে ডাক দিল।
“চাচা,একটু শুনে যাও”।
কাছে যেতেই মেয়েটা হাত দিয়ে ধরে আমার কানের কাছে মুখটা নিয়ে ফিসফিস করে বলল, “চাচা, তুমি মাকে বুঝিয়ে বল না, যাতে আমাকে বাসায় নিয়ে যায়।এই ডাক্তাররা আমার কিছুই ভালো করতে পারবে না।।আমাকে বাবার কাছে নিয়ে যাও না। বাবা সত্যিই গান গেয়ে আমার অসুখ ভাল করে দিতে পারবে।বাবার গান শুনলে আমার খুব ভালো লাগে।মাথার ভিতরে যন্ত্রণাটা একদম হয় না।তুমি মাকে রাজি করাও না চাচা”।

আমি বিস্ময়ভরা চোখে মেয়েটার দিকে চাইলাম।বাবার কথা বলতে বলতে একটু আগের হাসিখুশি মেয়েটার চোখ উপচে জল পড়ছে।আমি মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করে বের হয়ে এলাম।মাথাটা একদম এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল।ব্যপারটা এখন আর স্রেফ পাগ্লামিতে সীমাবদ্ধ নেই।সিরিয়াস হয়ে গেছে।ছোট মেয়েটার মাথাতেও পোকা ঢুকিয়ে দিয়েছেন মনসুর সাহেব।তানসেনের উত্তরাধিকার না, ছাই। গানের ব্যপারে ভদ্রলোকের পাগলামি গুলো এতদিন আমি বেশ হাসিঠাট্টা হিসেবেই নিচ্ছিলাম।এই পাগলামি যে এত দূর গড়াবে তা কে জানত। জীবন মরণ নিয়ে টানাটানি! বাসায় ফিরে মনসুর সাহেবকে ঝাড়ি টাড়ি দিয়ে গানের গুষ্ঠি উদ্ধার করার প্ল্যান করলাম।

বাদ সাধলো কপাল। বাসায় ফিরতেই বাবার চিঠি পেলাম।মা ভীষণ অসুস্থ। চিঠি পাওয়া মাত্রই যাতে বাড়ি চলে যাই। মার অসুস্থতার খবর পেয়ে আমার মাথা খারাপ হবার মত অবস্থা হল। মনসুর সাহেবদের ফ্ল্যাটে অনেকবার নক করেও কারও সাড়া না পেয়ে আপাতত গানের গুষ্ঠি উদ্ধার না করেই রাতের ট্রেনেই বাড়ি চলে গেলাম।তখনো আমি জানতাম না, মনসুর সাহেবের সাথে সেই ছিল আমার শেষ দেখা।

বাড়ি গিয়ে দেখলাম মা দিব্যি সুস্থ সবল।পান চিবুতে চিবুতে ছেলের বিয়ের তদারকি করছেন।অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, সেই রাতেই আমার বিয়ে হয়ে গেল।পাত্রী আমার খুবই পরিচিত।আমার ছোটবেলার বন্ধু।রীতিমত বাংলা সিনেমা স্টাইলে আমার বিয়ে হয়ে গেল।আর তার দুদিন পরই মুরুব্বীদের আগ্রহ ও পরামর্শে হানিমুন গমন। এতসব উত্তজনার মধ্যেও আমার বার বার অন্তরার কথা মনে হচ্ছিল।মেয়েটার অপারেশনটা ঠিক মত হল কিনা- খুব চিন্তা হচ্ছিল। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল বেশ।একটা পরিবার এত কঠিন একটা পরিস্থিতির ভিতর দিয়ে যাচ্ছে আর আমি কিনা হানিমুন করছি! প্রায় সপ্তাহ দুয়েক পর যখন ঢাকায় ফিরলাম, তখনও জানতাম না আমার জীবনে মনসুর সাহেব, বীণা ভাবী কিংবা অন্তরা অধ্যায় সেখানেই সমাপ্তি। হন্যে হয়ে পুরো ঢাকা শহর রীতিমত চষে বেড়ালাম। কোথায় কোন হদিস পেলাম না। মানুষ তিনটা যেন একেবারে কর্পুরের মত উবে গেছে। আত্বীয় না হলেও এমন একটা অসহায় পরিবারকে একা ফেলে বাড়ি যাওয়ার ডিসিশানের কারণে এরপর বাকি ১৫ টা বছর আমি আত্মগ্লানিতে ভুগেছিলাম। পুর্ণিমা কিংবা বৃষ্টি হলেই আমার কানে মনসুর সাহেবের তানপুরার শব্দ ভেসে আসত।

৩।
প্রতিদিনকার মত অফিস শেষে বাসে চড়ে বাসায় আসছিলাম।সীট না থাকায় দাঁড়িয়ে যেতে হচ্ছিল।হঠাৎ লেডিস সীটের দিকে চোখ যেতেই অবাক হয়ে দেখলাম একটা ১৭/১৮ বছরের তরুণী আমার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে।তার চেয়েও আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে ছোট করে ছাটা চুল, মুখে কিশোর আদলের ধারালো চেহারার মেয়েটাকে একপলক দেখেই আমার খুব পরিচিত মনে হচ্ছিল।হাসার ভঙ্গীটাও বড় চেনা।মনে হয় আগে কোথাও দেখেছি।কোথায় দেখেছি ঠিক মনে করতে না পেরে মুখটা ঘুরিয়ে নিলাম।আজকালকার ছেলেমেয়েদের বিশ্বাস নেই।নিজের ছেলেকে দেখেই খুব বুঝতে পারি।ত্যাদরামির চুড়ান্ত যাকে বলে!কার সাথে কিভাবে কথা বলতে হয়,সেই আদবকেতাটাও হারিয়ে বসে আছে।বন্ধু বান্ধবদের ডাকে মামা বলে।কোন মানে হয়?

শংকরের কাছে এসে বাস থেকে নামলাম।রিকশার খোজে হাটা শুরু করতেই দেখলাম, লেডিস সীটে বসা মেয়েটা আমার পিছন পিছন আসছে।আচ্ছা বিপদে পড়া গেল তো।মলম পার্টি ফার্টি না তো?পা চালিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম।হঠাৎ খুব পরিচিত কন্ঠের ডাক শুনতে পেলাম, “চাচা-আ, হাসান চাচা-আ”।
বজ্রহাতের মত হয়ে পিছন ফিরে দেখলাম বাসের সেই মেয়েটি ডাকছে। পনেরো বছর আগে যেই মেয়েটাকে শেষ দেখেছিলাম।সেই ছোটবেলার মত মিষ্টি করে ডাকছে।এক মুহুর্তের মধ্যে পনেরো বছর আগেকার সেই স্মৃতি ছায়াছবির মত ভেসে উঠলো।

৪।
প্রথমে বাস,তারপর স্কুটার, তারপর কিছুদুর হেঁটে ছোট একতলা একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম।
“চাচা, এই আমাদের বাসা। বাবা,মা যে আপনাকে দেখে কি খুশি হবে!”
যে অসহায় পরিবারটিকে আমি তাদের চরম দুঃসময়ে কোন সাহায্যই করতে পারিনি, তারাই আজ এতদিন পর আমাকে দেখে কেন খুশি হবে তা মাথায় আসছিল না।
অপরাধীর মত গেট খুলে পা রাখলাম।বাড়ির বাইরে ছোট একটা বাগানের মত জায়গা।সেখানে দাঁড়িয়ে পরম মমতায় দীর্ঘদেহী একজন লোক গাছে পানি ঢালছে।
“এলি মা?” বলে তাকাতেই চোখ পড়লো।বিস্ময়ভরা দৃষ্টি নিয়ে মনসুর সাহেব বললেন, “হাসান ভাই না?”
বিকেলের নরম আলোয় আমি দেখলাম মনসুর সাহেবের চোখে জলের ঝিলিক।

অনেকদিন আগের মত বসে আড্ডা দিলাম।সেই আন্তরিকতা, সেই হৃদ্যতা-সব যেন আগের মতই আছে।অন্তরার অপারেশনের পর মনসুর সাহেবের দুরসম্পর্কের এক চাচার এই বাড়িতে এসে উঠা,তারপর স্টেশনারীর ব্যবসা শুরু করে সংসারের হাল ধরা-১৫ বছরের সব জমানো কথা একদিনেই বলা হয়ে গেল।ভাবী,মনসুর ভাই,অন্তরা-সবাই আগের মতই আছে।শুধু একটাই পরিবর্তন দেখলাম।মনসুর সাহেব আসা অবধি একবারও গান বাজনার প্রসঙ্গ তুললেন না।কৌতুহলী চোখে বসার ঘর পর্যবেক্ষণ করেও সেই তানপুরা বা বাদ্যযন্ত্রের কোন হদিশ পেলাম না।কি জানি কি এক সংকোচে এই প্রসংগ তুলতেও অস্বস্তি হচ্ছিল।

সেদিনের মত আড্ডা শেষ করে বিদায় নিলাম।বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তায় পা বাড়াতেই অন্তরার ডাক শুনতে পেলাম।
“চাচা, আসেন আপনাকে পুল পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি”।
আমি হাসি মুখে বললাম, “চল”।
“চাচা জানেন, বাবা আর গান করেন না।বাবার ধারণা, গানের দিকে বেশি মনোযোগ দিতে গিয়েই আমার অত বড় একটা অসুখ হয়েছিল।তারপর থেকে বাবা আর গান করেন না।সেই তানপুরাটা বাবা নিজের হাতে ভেঙ্গেছে,জানেন?আমার এত কষ্ট হয়েছিল সেদিন!”
অন্ধকার রাস্তায় যেতে যেতে আমি বুঝলাম অন্তরার গলা কেঁপে উঠছে।গান নিয়ে এত আবেগ কেবল মনসুর সাহেবের গলায়ই পাওয়া যেত।
আমি কিছু না বলে অন্তরার মাথায় হাত রাখলাম।
হঠাৎ কিশোরীর উচ্ছ্বাস নিয়ে অন্তরা জিজ্ঞেস করল, “চাচা দেখুন তো, আপনার ঘড়িতে কটা বাজে?”
“আট টা পঁচিশ”।
অন্তরা কি জানি একটা নিয়ে মুখে ধরলো।আবছা আলোয় বুঝলাম জিনিসটা একটা বাদ্যযন্ত্র,হারমোনিকা।রাতের স্তব্ধতা ভেদ করে হারমোনিকার ছন্দময় শব্দ বাজতে লাগলো।এটা মনসুর সাহেবের সেই তানপুরার শব্দের মত মায়াবী নয়,বরং অনেক বেশী সুরেলা,ছন্দময়।বেশ মজা লাগছিল শুনতে।অন্তরা কতক্ষন বাজালো খেয়ালই ছিল না।বাজানো শেষ করার পর আমি আশেপাশের কোন লাইট জ্বলে উঠতে দেখলাম না,কিংবা বৃষ্টিও শুরু হল না, যেমন দেখেছিলাম মন্সুর সাহেবের বেলায়।সবকিছুই আগের মতন।
“চমৎকার বাজাও তো তুমি।শিখলে কোথা থেকে?”
“শিখব কোথায়?বাবা মা জানলে আস্ত রাখবে?আমার এক বন্ধু গিফট করেছিল।তারপর নিজে নিজে বাজিয়েই শিখেছি।চাচা,এইতো স্কুটার।উঠে পড়ুন”।

“আচ্ছা,আসি তাহলে মা।ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে শংকর তো বেশী দূরে না।যেকোন সময় চলে আসবে।একদিন হারমোনিকা পার্টি হবে”।
অন্তরা স্মিত মুখে হাসলো।

স্কুটার ছেড়ে দেওয়ার মুহুর্তে অন্তরা হঠাৎ বলে উঠলো, “চাচা, আপনার ঘড়িটা একবার চেক করুন তো”।
বলতে বলতেই স্কুটার ছেড়ে দিল।আমি কিছুটা অবাক হয়ে আমার সদ্য কেনা সিটিযেন ঘড়ির দিকে তাকিয়েই স্তব্ধ হয়ে গেলাম।ঘড়ির কাটা সেই আটটা পঁচিশেই আছে।


মন্তব্য

মেঘলা মানুষ এর ছবি

মুগ্ধ

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

প্রথমেই একটা ছোট্ট বকা দিই - লেখকের নাম কোথায়?

ভাই বা বোন যেই হন আপনি, আপনার লেখার হাত অসাধারণ! কতদিন পরে যে একটা গল্প এভাবে মুগ্ধ আবেশে একটানা পড়ে শেষ করলাম আর শেষ করার পরে আফসোস করলাম ইস, আরো কিছুক্ষণ চললো না কেন!! আপনার লেখার ধরণ খুবই ভালো লাগলো, তারচেয়ে বেশী ভালো লাগলো আপনার ঝরঝরে মেদহীন ভাষা। একটা দৃশ্য থেকে আরেক দৃশ্যে পট পরিবর্তনটাও করেছেন বেশ মুন্সীয়ানার সাথে।

আর গল্পের শেষের টুইস্টটা তো লা জবাব!! পড়ার আগ মুহূর্তেও ধরতে পারিনি। ভাবছিলাম এত সুন্দর করে লেখা একটা গল্প এভাবে সাদামাটা ভাবে শেষ হয়ে যাবে? আর ঠিক তখনই--- ! গুরু গুরু গুরু গুরু

দুটো পরামর্শ: প্যারার মাঝখানে একটা করে লাইন গ্যাপ দেবেন। প্যারা আর ডায়লগের মাঝেও। আর লেখার শেষে আপনার নাম লিখে দেবেন - মানে যে নামে সচলে নিবন্ধন করেছেন।

আপনার লেখা নিয়মিত পড়তে চাই। হারিয়ে যাবেন না, প্লীজ।

(যেহেতু অতিথি লেখকরা তারা দেখতে পান না, তাই জানিয়ে রাখি - এখন পর্যন্ত আপনার লেখায় ২টা পাঁচতারা পড়েছে)

____________________________

মেঘলা মানুষ এর ছবি

গল্পটা পড়ে এতটাই আবিষ্ট হয়ে গিয়েছিলাম যে, খেয়ালই করতে পারিনি লেখক/লেখিকার নিকটাই নেই।
আমিও, প্রফেসরের কথার প্রতিধ্বনি করে গেলাম।

শুভেচ্ছা হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

প্রথমেই অনেক অনেক ধন্যবাদ।আমি নিজেই লিখতে গিয়ে বোর হয়ে যাচ্ছিলাম।এত সময় গল্পটা পড়ে এত বড় একটা রিপ্লাই দিয়েছেন-আমি ধন্য। হাসি
লেখক এর আগে "স্বাধীনতা" নামে আরেকটি গল্প দিয়েছিল।আশা করি পড়েছেন।নাম না দেওয়ায় দুঃখিত।
ব্লগের ব্যাপারে আমি মোটামুটি ক-অক্ষর গোমাংস।গল্পটা কিভাবে এখানে পাব্লিশ করতে হয়,এটুকু জানি শুধু।বাকিসব কেমন জানি আউলা লাগে। ইয়ে, মানে...

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

আচ্ছা - আপনিই তাহলে সাফফাত আরা সাঈদ। তবে আপনি এবার মন্তব্যেও নাম দিতে ভুলে গেছেন। মন্তব্য বা লেখা শেষ করে একটা লাইন গ্যাপ (এন্টার) দিয়ে নামটা লিখে দেবেন, তাহলেই হবে।

____________________________

এক লহমা এর ছবি

তিনটা ৫ তারা হইল।
প্রোফেসর সাহেবের মন্তব্য - সবটাই এইখানে বসায় লন।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

তারকার ব্যাপারটা জানা ছিল না।খুশি হয়ে গেলুম। দেঁতো হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

অসাধারন লিখা।

সদস্যনামঃ Jon Rulz

অতিথি লেখক এর ছবি

এক কথায় অসাধারন!

----তন্ময়-----

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ। হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

কিছু মনে করবেন না, আমার বোকা প্রশ্নের জন্য।
ঘড়ির কাঁটা স্থির দিয়ে আপনি কী বুঝিয়েছেন?? বুঝিয়ে দিলে সুন্দর গল্পটা বুঝতে পারতাম

সাইদ

মেঘলা মানুষ এর ছবি

স্থির কাঁটা দিয়ে মনে হয় লেখক বোঝাতে চেয়েছেন, মেয়েও বাবার মত ক্ষমতা পেয়েছে, সে হারমোনিকার শব্দ (সুর) দিয়ে ঘড়ির মেকানিজম নষ্ট করে দিয়েছে।

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

আমিই দিয়ে দিই উত্তরটা, যদি ঠিক বুঝে থাকি।

১। বাজানো শুরু করার আগে ঘড়িতে দেখা গেছিল “আট টা পঁচিশ”।
২। "বাজানো শেষ করার পর আমি আশেপাশের কোন লাইট জ্বলে উঠতে দেখলাম না,কিংবা বৃষ্টিও শুরু হল না, যেমন দেখেছিলাম মন্সুর সাহেবের বেলায়।সবকিছুই আগের মতন।"
৩। স্কুটার ছেড়ে দেওয়ার মুহুর্তে "ঘড়ির কাটা সেই আটটা পঁচিশেই আছে"

বাবা বাজনা দিয়ে আগুন জ্বালাতো, আর মেয়ে বাজনা দিয়ে সময় থামিয়ে দিতে পারে।

ধন্যবাদ।

____________________________

অতিথি লেখক এর ছবি

জাদুকর পিসি সরকার একবার ঘড়ির কাটা থামিয়ে দিয়েছিলেন-এই গল্পটা কি আপনার জানা আছে?এখানে তেমন একটা ঘটনাই ঘটেছে।আর না বুঝলেও সমস্যা নেই।আপনার যা ইচ্ছা ভেবে নিতে পারেন।আমি পাঠকের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখাটা পরার সঙ্গে সঙ্গে মনে মনে বলছিলাম, এটা জেনো গল্প না হয়। গান গেয়ে বাল্ব ফাটানোর, মেঘ ডেকে বৃষ্টি আনা, এইগুল শুনে আমরা অবাক হয়ে বলি এসব বাজে কথা, কিন্তু আমারা ভেবে দেখি না সংগীত আমাদের কাঁদাতে পারে, হাসাতে পারে। তার মানে এর শক্তি আছে।

মনোব্রত সাহা

আলতাইর এর ছবি

শুধু অন্তরা না......আপনিও ভাই সময় থামায়ে দিলেন গুরু গুরু গুরু গুরু গুরু গুরু

কাঠমিস্ত্রি এর ছবি

অসাধারণ লেখা। অনেক দিন এত ভাল লেখা পড়িনি। কেমন যেন রহস্যময় ভুবনের কথা বলা হয়েছে। এইসব মানুষেরা হয়তো আমাদের মাঝেই আছে, কিনতু তাদের সাথে দেখা হয়না আমাদের।
ভাল থাকুন, এবং আরো লিখুন।

দীনহিন এর ছবি

“হাসান,সুর আর সংগীত কিন্তু একধরনের প্রার্থনা।স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা জানানোর একটা শক্তিশালী উপায়,বুঝলে?আমরা নির্বোধ মানুষরা যে সুর সংগীত এগুলোকে একেবারেই গুরুত্ব দেই না এটা কিন্তু একেবারেই ঠিক না”।

আর রুমি নাচতেন, ঘূর্নিনাচ করে করে উনি স্রষ্টার কাছে পৌঁছতে চাইতেন, আজও সুফি সাধকদের অনেকেই রুমিকে অনুসূরন করেন, এমন অনবদ্য সব ছন্দ সৃষ্টি করেন, দর্শকেরা কিছুক্ষণের জন্য হলেও ডুবে থাকেন গভীর ঘোরে। চলে যান অন্য জগতে!

সংগীত ঐশ্বরিক, সংগীত ম্যাজিকাল, আপনি তাই তুলে আনতে চেয়েছেন খুবই মানবিক একটি গল্পের মোড়কে। অথচ ঘোর সাম্প্রদায়িক মানুষেরা সংগীতকে মনে করে শুধুই শয়তানের ধোঁকা। সংগীতের সাথে স্রষ্টা ও সৃষ্টির যে এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে, তা না জেনেই তারা শয়তান বিণাশে ঝাঁপিয়ে পড়ে, রক্তাক্ত করে নববর্ষের ছায়ানটকে।

হঠাৎ কিশোরীর উচ্ছ্বাস নিয়ে অন্তরা জিজ্ঞেস করল, “চাচা দেখুন তো, আপনার ঘড়িতে কটা বাজে?”
“আট টা পঁচিশ”।

শেষের টুইস্টটি এখান থেকেই আঁচ করা গেছে।

ত্যাদরামির চুড়ান্ত যাকে বলে!কার সাথে কিভাবে কথা বলতে হয়,সেই আদবকেতাটাও হারিয়ে বসে আছে।বন্ধু বান্ধবদের ডাকে মামা বলে।কোন মানে হয়?

আমারও বুঝ আসে না! এক সময় পাড়ার দোকানদার, রিকশাওয়ালাকে সন্মান করে 'মামা' সম্বোধন করার চল ছিল, আর এখন বন্ধু মহলেও 'মামা' খুবই জনপ্রিয় সম্বোধন। কোথা থেকে উদ্ভব হল এর, কে জানে!

.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

সংগীতের সাথে স্রষ্টার কোন সম্পর্ক নেই। সঙ্গীতের সাথে সম্পর্ক সম্পূর্ণই মানুষের, সেইজনেই সঙ্গীত অসাধারণ। কোন জিনিসের অসাধারণ হবার জন্য স্রষ্টার সাথে সম্পর্ক থাকার দরকার নাই।

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

আস্তে কন, জোকার হুইনা ফালাইলে?? চিন্তিত
কাল থিক্যা পিস্টিভিতে গানা গাওন আরম্ভ করলে তো বিপদ ইয়ে, মানে...

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

দীনহিন এর ছবি

সংগীতের সাথে স্রষ্টার কোন সম্পর্ক নেই।

এটি আপনার ব্যক্তিগত ধারণা। খুব স্বাভাবিক একটা বিষয়ের মধ্যে আপনি স্রষ্টা-অ-স্রষ্টার বিতর্ক কেন নিয়ে এলেন, বুঝতে অক্ষম। ব্যাপারটা কেমন হল, জানেন? কারো মাঝে তীব্র ভালবাসা দেখে কেউ বলে উঠল ঐশ্বরিক ভালবাসা, আপনি সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে উঠলেন, তা কি করে হয়? ঈশ্বর আছে নাকি?

সঙ্গীতের সাথে সম্পর্ক সম্পূর্ণই মানুষের, সেইজন্যেই সঙ্গীত অসাধারণ।

রুমির উদাহরণটি দেখুন। স্রষ্টাই সৃষ্টি, স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝে কোন দূরত্ব থাকে না - চেতনার কোন স্তর অতিক্রম করলে, রুমি চলে যেতে চান স্বয়ং ঈশ্বরের কাছে ?
ইতিহাসের পাতায় পাতায় দেখুন, বড় বড় সঙ্গীত সাধকেরা সুর খুঁজতেন প্রকৃতির আনাচে-কানাচে, তাদের কাছে সুর ছিল ঐশ্বরিক, আর এই ভাবনা কখনো মানুষকে ক্ষুদ্র করেনি; মানুষ ও ঈশ্বর কখনোই তাদের কাছে আলাদা কোন অস্তিত্ব ছিল না, তাদের কাছে এই বিশ্ব প্রকৃতি ও চরাচর সবই ছিল এক সুতোয় গাঁথা!

.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

বুজরুকি এভাবেই ছড়ায় ভাই, ঈশ্বর আছে কিনা সেটারই কোন প্রমাণ নাই, আবার তার সাথে সঙ্গীতের কানেকশান। স্রষ্টার সাথে সঙ্গীতের সম্পর্ক আছে, সেটা বরং আপনার ব্যক্তিগত ধারণা হতে পারে।

সাধারণ জিনিসও অসাধারণ হতে পারে। কোন জিনিসকে অসাধারণ হবার জন্য বুজরুকি আরোপ করা লাগে না। সেটা যুগ যুগ ধরে হয়ে আসছে, ঠিক, কিন্তু এখন তো বিজ্ঞানের যুগ, এইসব বুজরুকি থেকে কি আমরা বের হতে পারব না?

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

দীনহিন এর ছবি

সেটা যুগ যুগ ধরে হয়ে আসছে, ঠিক, কিন্তু এখন তো বিজ্ঞানের যুগ, এইসব বুজরুকি থেকে কি আমরা বের হতে পারব না?

একটা সাদামাটা গল্পে আপনি বিজ্ঞানের যুগ, বুজরুকি, স্রষ্টা ইত্যাদি কেন বার বার টেনে আনছেন, কিছুতেই বুঝতে পারছি না।
আপনাকে বারবার বলছি, তবু বুঝতে চাইছেন না, যুগ-শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত সাধকেরা সঙ্গীত সাধনার মাধ্যমেই মানব-সাধনা করতেন, আর মানব-সাধনার মাধ্যমেই ঈশ্বর-সাধনা করতেন। মানব, ঈশ্বর, প্রকৃতি কিছুই তাদের কাছে আলাদা সত্তা ছিল না, সবই ছিল এক।

আপনি যাকে অসাধারণ বলছেন, তাকেই হয়ত ঐশ্বরিক বলতেন তারা, আর এ করে মানুষকে কখনোই নীচে নামাতেন না। তাদের কাছে, মানব-সাধনাই ছিল ঈশ্বর সাধনা, ঈশ্বর সাধনাই ছিল মানব সাধনা। তবে কিনা তাদের ভুলও হতে পারে, যেহেতু তারা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না, হলে ঈশ্বর সংক্রান্ত বুজরুকি ধরে ফেলতে পারার আনন্দে উদ্বাহু নৃত্য করতেন নিঃসন্দেহে!

এই গল্পে সঙ্গীতের একটি অতিপ্রাকৃত ক্ষমতাকে রূপকার্থে তুলে ধরা হয়েছে, সব শেষে সঙ্গীতের জয়গান গাওয়া হয়েছে, সঙ্গীতের সঞ্জীবনী সুধা ছড়িয়ে দিতে চাওয়া হয়েছে। আপনি এখানে বারবার স্রষ্টা, বুজরুকি ইত্যাদি তুলে আনছেন কেন, তা আপনিই জানেন।

আপনার মতে, এখন থেকে তাহলে আর কেউ গল্পে বিশ্বাসীদের চরিত্র তুলে আনতে পারবে না, যেহেতু 'বুজরুকি এভাবেই ছড়ায়'??

কেন ঈশ্বরের অস্তিত্ব থাকতে পারে না, সে ব্যাপারে অনেক পোস্ট আছে, আপনিও কিন্তু কিছু যোগ করতে পারেন। আপনি ইদানীং স্যাম হ্যারিস পড়ছেন, চাইলে সেখান থেকেও কিছু আলোকপাত করতে পারেন। আমরা সাগ্রহে পড়ব নিঃসন্দেহে। কিন্তু সমস্ত গল্প-কবিতা-প্রবন্ধেই যদি ঈশ্বরের অনস্তিত্ব প্রমাণের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তাহলে তো সমস্যা রে, ভাই!

.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

গল্পে খুঁজি নাই রে ভাই, আপনার কমেন্টে খুঁজছি, একটু খেয়াল করে দেখেন। গল্পে আপত্তি থাকলে সেটা তো গল্পেই জানাতাম। অবশ্য আমার বোঝানোর দুর্বলতাও হইতে পারে।

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

দীনহিন এর ছবি

অবশ্য আমার বোঝানোর দুর্বলতাও হইতে পারে।

আপনার বোঝাতে ভুল হয় নাই রে ভাই, বুঝতে ভুল হইছে।
আমার কমেন্টটা গল্পের ভিত্তিতেই করা হয়েছিল, গল্পে সঙ্গীতের এক প্রকার ম্যাজিকাল ক্ষমতা (মানে, নিরাময়যোগ্যতা ইত্যাদি) প্রতীকাকারে উপস্থাপন করা হয়েছিল, ঈশ্বরের ঝাণ্ডা তুলে ধরা বা অবিশ্বাসীদের মধ্যে বিশ্বাস জাগরণের উদ্দেশ্য কিন্তু এখানে ছিল না; আমার মন্তব্যটিও গল্পটিরই প্রতিনিধিত্ব করেছিল, বিশ্বাসীদের পক্ষে বা অবিশ্বাসীদের বিপক্ষে কোন অবস্থানই এখানে ছিল না; নিছক সঙ্গীতের মাহাত্ম্য নির্দেশ করাই ছিল উদ্দেশ্য; ঐশ্বরিক অভিহিত করে আসলে মানুষেরই জয়গান গাওয়া হয়েছিল, মহান সব সঙ্গীত সাধকেরা এভাবেই ভাবতেন, কিন্তু আপনি পারছেন না।
একটি নেহায়েত সাদামাটা মন্তব্যকে টেনে টেনে কত লম্বা করে ফেলেছেন লক্ষ্য করেছেন? আগের কথাতেই আসি, সব কিছুর মধ্যেই ঈশ্বরের অনস্তিত্ব প্রমাণের দায়িত্বটি কাঁধে নিয়েন না ভাই। আপনি বরং আলাদা পোস্ট দেন, কেন ঈশ্বরের অস্তিত্ব থাকতে পারে না, স্যাম হ্যারিস কি সব যুক্তি উপস্থাপন করেছেন - এ বিষয়ে, আমরা সেগুলো পাঠ করব এবং প্রাণভরে আলোচনা করব, ঠিক আছে?

.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

চলুক

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

গৃহবাসী বাউল এর ছবি

এক কথায় অসামান্য। পরিচিত লেখকদের আঙ্গিকের বাইরে যেয়ে, এই রকম গল্প অনেকদিন পর পড়লাম। লেখনির গুণে টুইস্ট গুলো A+ গ্রেডে উতরে গেছে। শেষটাও চমৎকার হয়েছে। নিজের লেখতে না পারা নিয়ে একবুক হিংসা হল।

সচলে স্বাগতম। কি-বোর্ড চলুক ঝড়ের গতিতে।
হাততালি পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম চলুক উত্তম জাঝা!

-----------------------------------------------------------
আঁখি মেলে তোমার আলো, প্রথম আমার চোখ জুড়ালো
ঐ আলোতে নয়ন রেখে মুদবো নয়ন শেষে
-----------------------------------------------------------

অতিথি লেখক এর ছবি

অসাধারণ লেখা। সচলায়তনে অনেক ভালো ভালো লেখা আসত আগে, পড়তাম অনেক। কিন্তু ইদানিং লেখাগুলো হয়ে যাচ্ছিল অনেক বেশি ভারী, বাস্তব, ডকুমেন্টারী ধরনের। এই লেখাটা পড়ে অনেক দিন পর একটা খুব ভালো গল্প পড়ার অনুভূতি পেলাম। অনেক ধন্যবাদ।

চমত্কার গল্প বলার ভঙ্গি। দারুন সাবলীল গতি। সহজ ভাষার ব্যবহার। চমত্কার।

অতিথি লেখক এর ছবি

দুর্দান্ত! চলুক

-দেব প্রসাদ দেবু

অতিথি লেখক এর ছবি

সাংঘাতিক লিখেছেন । সত্যি অনেক ভালো লাগলো ভাই !!

ননস্টপ

শাখী এর ছবি

যে কোন কমপ্লিমেন্ট কম হয়ে যাবে । শেষ লাইন টা পড়ে কয়েক সেকেন্ড স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলাম। .... মুগ্ধ!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।