মজিদ ঠিক বুঝে উঠতে পারেনা উহু্ শব্দটা সে কি দুঃস্বপ্নের ঘোরে নিজে করেছে? স্বপ্নের অংশ ছিলো? নাকি তার পাশে শুয়ে থাকা বউটি করলো। কিন্তু হঠাৎ এই ঘুম ভেঙে যাওয়ায় সে মনে মনে খুব বিরক্ত হয়। পৌষের হাড়কাপানো ঠাণ্ডায় আধো ছেঁড়া কাঁথার ভেতর থেকে মাথা বের করে শব্দের উৎস খোঁজারও প্রয়োজন বোধ করলোনা সে। পেপার মোড়ানোর পরও বেড়ার ফাঁক চিরে ঠিকই বাতাস ঢুকছে মজিদের বস্তির ঘরটিতে। এ যেন এক হিমঘর! ‘কোন মানে হয়না মাথা বের করে ওম নষ্ট করবার- ভাবে সে। বরং হাত দুটোকে দুই ঊরুর মাঝখানে ঠেসে উষ্ণতা পাবার চেষ্টা করে। শরীরটাকে বাঁকিয়ে বাংলা বর্ণমালার ‘দ’ এর মতো করে শোয় মজিদ। কিন্তু উষ্ণতা বাড়ানোর এই অদম্য প্রচেষ্টায় নিষ্ঠুরের মতো পানি ঢেলে দেয় তার পোয়াতি বউটি।
সাড়ে তিন মাসের পোয়াতি রাহেলা খাতুন ধাক্কা দিয়ে স্বামীকে জাগানোর চেষ্টা করে। ‘শুনছেন? পেটে বেদ্না লাগে, তাবিজে চাপ খাইছি মনে লয়। শুনছেন?’
মজিদ তীব্র বিরক্তি নিয়ে গজ গজ করতে করতে কাঁথা মুড়ি দিয়েই উঠে বসে প্রবল অনিচ্ছায়। ‘ঘুমাইবার কালে হুঁশ থাহেনা তোর? কুন হানে বিষ করে?’ মজিদ ধমক দেয় বউকে।
রাহেলা খাতুন শাড়ি সরিয়ে পেটি কোটের ফিতাটা খুলে বাম হাত দিয়ে দেখায় স্বামীকে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে মজিদ ঠিক ঠাওর করে উঠতে পারেনা। সে বালিশের নিচে হাত দিয়ে দেশলাই বের করে। কুপি জ্বালায়। পেটি কোটের ফিতার সাথে হুজুরের দেয়া তাবিজটা লেপটে গিয়ে পাশ ফেরার সময় খোঁচা খেয়েছে রাহেলা। খানিকটা লাল হয়ে গিয়েছে যায়গাটা। মজিদের মেজাজ আরো চড়ে যায়। ‘এর লাগি আমারে ডাহন লাগে? এইডাও সহ্য করবার পারসনা তুই?’
‘চেতেন ক্যান? পুরা পেডেইত বেদ্না করতাছে। আপনেরওত হুঁশ নাই, হাত পাও কুনদিক থাহে খবর থাহেনা ঘুমাইবার সম্। ভয় করতাছে হেরলাগি আপনেরে ডাকছি। অপরাধ হইছে? ক্ষেমা দেন’।
‘কত রঙ্গের কথা কস্ তুই! এহন কলি তাবিজে চিপ খাইছস্, এহন কস আমি দুঃখ দিছি। তোর হইছেডা কী?’ মজিদ বুঝে উঠতে পারেনা সমস্যাটা তাবিজের কারণে হলো নাকি সে আসলেই অসাবধানতায় হাত পা ছুড়তে গিয়ে আঘাত দিয়েছে বউয়ের পোয়াতি পেটে। মজিদ অবশ্য জানে যতোই সে সাবধান থাকুক ছোট্ট একটু খানি জায়গায় ধাক্কা লাগাটা অসম্ভব নয়। ‘আইচ্ছা ঠিক আছে, অহন ঘুমা কিচ্ছু হবিনা। তাবিজডা হাতে বাইনলে সমইস্যা কি হেইডাওত বুঝিনা!’
‘আমার দুষ দ্যান ক্যান? হুজুররেত কইছিলাম হাতে বান্ধনের কথা, হে কয় পুলা ধইরবা পেডে তাবিজ হাতে বাইন্ধলে হইব?’
‘হইছে হইছে! অহন ঘুমা, বেদ্না একডু সহন লাগে এই সম। বিষ না কমলে ফজরে মায়েরে কইস্, মুরুব্বিরা জানে কুন সম কি কইরতে হইব’।
বউ রাগারাগি করবে জেনেও ঘুম ছুটে যাওয়ায় মজিদ বিড়ি ধরায়। রাতে বস্তিতে ফেরার পর থেকে মজিদ অন্তত দশটা বিড়ি খেয়েছে। শীত রুখতে পেপার লাগানোর ফলে ধোঁয়া খুব সহজে বেরুতে পারেনা মজিদের বস্তির ঘর থেকে। ফলে একটা বীভৎস ধোঁয়াটে গন্ধময় পরিবেশ সৃষ্টি হয় মজিদের ঘরটিতে। বিড়ির নিকোটিন মিশ্রিত ধোঁয়া নির্দ্বিধায় প্রবেশ করছে রাহেলা খাতুনের পোয়াতি শরীরে। অতিরিক্ত ধোঁয়াটে পরিবেশ রাহেলা-মজিদের অনাগত সন্তানের কী পরিমাণ ক্ষতি করছে তা এদের কারোই ধারণা নেই। বড় ধরণের বিপদের কারণও হতে পারে এই ধোঁয়াটে পরিবেশ। এমনকি মিসকারেজও হতে পারে পরিবেশগত কারণে।
ভোরের আলো ফোটার আগেই মজিদ রিক্সা নিয়ে কমলাপুর রেল স্টেশনের সামনে এসে প্যাসেঞ্জারের আশায় অপেক্ষা করতে থাকে। এখনো কোন ট্রেন এসে স্টেশনে দাঁড়ায়নি। মজিদ অপেক্ষা করে। শৈত্য প্রবাহের তীব্রতায় তার কানে জড়ানো মাফলার, গায়ে জড়ানো পুরনো পাতলা চাদর ঠিকমতো কাজ করেনা । মজিদ ভাবে একটু গরম চা পেলে উষ্ণতা পাওয়া যেতো। কিন্তু কুয়াশাচ্ছন্ন কমলাপুরের ফুটপাত এখনো ঠিক জেগে উঠেনি ঘুমের আড়মোড়া ভেঙে। কিছু ছিন্নমূল কুলি গুটিসুটি মেরে বসে আছে, আছে কিছু ছিন্নমূল গৃহহীন মানুষ। সেও রিক্সার হুড় তুলে গুটিসুটি দিয়ে বসে বিড়ি ধরায় মিছে উষ্ণতার আশায়। খালি পেটে ধোঁয়ার উপস্থিতি ফুসফুস ঠিক গ্রহণ করতে চায়না। প্রচণ্ড বেগে ভেতরটা কাঁপিয়ে কাশি উগড়ে আসে মজিদের। বিড়ির তীব্র কটু গন্ধে বাসি মুখটা আরো দুর্গন্ধময় হয়ে উঠে। মজিদ সেটা বুঝতে পারে। নিজের কাছেই খালি পেটের এই বিড়িটা বিস্বাদ ঠেকে তার, কিন্তু অভ্যাস বসত টানতে থাকে।
অনেকক্ষণ ট্রেন আসার কোন লক্ষণ না দেখে কুয়াশা ঢাকা ভোরের আলোতে সময়টা ধরার চেষ্টা করে মজিদ। ঠিক বোঝা না গেলেও মজিদ আন্দাজ করে সাতটার কাছাকাছি হবে সময়। সে আর অপেক্ষা করেনা। কুয়াশা ফুঁড়ে রিক্সা নিয়ে এগুতে থাকে সায়দাবাদের দিকে। কোন বাস যাত্রী যদি পাওয়া যায় সেই আশায়। অফিস যাত্রীর ভিড় শুরু হবার আগে দু’একটা খেপ ধরতে না পারলে দিন শেষে মহাজনের টাকা দিয়ে পোষানো দায় হয়ে যাবে। মজিদ দ্রুত এগুতে থাকে।
টিটি পাড়া মোড় ফেলে একটু খানি এগুতেই সে দেখতে পায় রাস্তার উল্টো পাশে একটা রক্তাক্ত লোক পা ছুড়ছে আর আর্তনাদ করছে সাহায্যের জন্য। লোকটির অসহায়ত্ব ছুঁয়ে যায় মজিদের মন। কাছে গিয়ে দেখতে পায় লোকটি একহাতে চোখ কচলাচ্ছে, অন্য হাতে ছুরিকাহত পেট চেপে রক্তপাত বন্ধের চেষ্টা করছে। কেউ একজনের উপস্থিতি টের পেয়ে লোকটি করুণ ভাবে মিনতি করতে থাকে। মজিদ ভাবে- ভোর হবার আগে বের হয়ে এখন পর্যন্ত একটা খেপও ধরতে পারে নাই সে। এখন এই লোককে সাহায্য করার মানে অফিস যাত্রীর খেপ গুলোও হারাতে হবে। সে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যায়। কিন্তু মলম লাগানো চোখে দেখতে না পেয়ে লোকটি তীব্র আর্তনাদের সঙ্গে রীতিমতো বাচ্চা ছেলের মতো অনুনয় বিনয় করছে সাহায্যের জন্য। মজিদ খেয়াল করে লোকটির পেটে চেপে ধরা হাত উপচে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে কালো পিচ ঢালা পথে। মজিদ আগ পিছ আর না ভেবে লোকটিকে রিক্সায় উঠায় সাবধানে। কানের মাফলারটা দিয়ে শক্ত করে বেঁধে নেয় ছুরিকাহত স্থান।
‘ভাই, চউখ কচলাইয়া ফায়দা হবেনা, আপনের চউখ্যে দেহনেরও কাম নাই, হুড় তুইল্ল্যা দিছি বেদ্না সহ্য কইরা হুড় ধইরা খিছচ্যা বইয়া থাহেন, দশ মিনিটের মামলা, টান মাইরা লইয়া যামু এনশাল্লাহ্। বাকী আল্লার ইচ্ছা। মজিদ লোকটিকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে তীব্র গতিতে প্যাডেল মারতে থাকে। গন্তব্য ঢাকা মেডিক্যাল।
মেডিক্যালের ইমার্জেন্সিতে নেয়ার পর ছুরিকাহত লোকটি শুধু বলতে পেরেছে সে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের একাউন্টসের হেড। তারপরই জ্ঞান হারায়। মজিদের মনে ক্ষুদ্র একটা আশা ছিলো লোকটির আত্মীয় স্বজন আসলে সে কিছু বকশিস পাবে, খেপ হারানোর লস্টা খানিকটা পোষাবে। কিন্তু লোকটিকে নিয়ে সে বিপদের আশঙ্কা দেখে। বলা যায়না, পুলিশ এসে তাকেও জড়িয়ে ফেলতে পারে। সে ‘রিক্সাডা দেইখ্যা আসি’ বলে বাইরে এসে সোজা শহীদ মিনার হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঢুকে পড়ে দ্রুত।
****************************************
পাঠকের আগ্রহের উপর নির্ভর করছে গল্পটার শেষ অংশটা
------------------------------------------------------------
-দেব প্রসাদ দেবু
মন্তব্য
লেখাটা সাবলীল। কিন্তু এমন একটা জায়গায় বিরতি দিলেন! গল্পটা পুরোটা লিখেই পোস্ট করতেন। এই টুকু পড়ে মন তো ভরলই না, বরং উল্টো আপনার উপরে রাগ লাগছে আধা-খেঁচড়া লেখা পোস্ট করার জন্য। (কড়া ভাষায় বলে ফেলে থাকলে দু:খিত, কিন্তু এটাই আমার প্রতিক্রিয়া)
____________________________
হে হে হে প্রোফেসর, দুস্ক পাবার কিছু দেখিনা! সত্যি কথা বললে দুটো কারণে পুরো পোস্টটা দেইনি। প্রথমত একটু বড় হয়ে যায় এক পোস্ট হিসেবে। নবীন লেখকের এতো লম্বা ভ্যাজর ভ্যাজর অনেকের ভালো নাও লাগতে পারে এটি একটি বিবেচনা ছিলো, অন্যটি হচ্ছে যে দু'একজন গল্পটা পড়বে তাঁদের কি একটুও ভাবায় কিনা কিংবা আগ্রহ থাকে কিনা সেটি দেখার নিরীহ লোভ। আপনার রাগটাকে আমি পজেটিভলি নিচ্ছি। নীড়পাতা থেকে অন্তর্হিত হলেই পরের অংশ ছেড়ে দেবো।
-দেব প্রসাদ দেবু
আপনাকে কে বলেছে নবীন লেখকের বড় লেখা পড়বো না!!! যে বলেছে তার মাথায় কষে গাট্টা দিলাম। লেখাটাই মূখ্য়, লেখক নন। আপনি নিজে তো কোন লেখা বাদ দেন না! আমরাও তো তাই। সুতরাং অতি বিনয় বাদ দিয়ে লাইনে আসুন। তাড়াতাড়ি পরের পর্ব দেন, নইলে আপনার খবর আছে কইলাম!
____________________________
প্রোফেসর সাব আর ভুল হবেনা। এইবারকার মতো ক্ষেমা দেন। কোমল হৃদয়ে এতো থ্রেট সহিবারে শকতি নাই!
-দেব প্রসাদ দেবু
শেষ অংশটার অপেক্ষায় রইলাম।
সদস্যনামঃ Jon Rulz
অনেক ধন্যবাদ আগ্রহ দেখাবার জন্য!
-দেব প্রসাদ দেবু
এই পাঠকের আগ্রহ আছে।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
এই পাঠকটা একটু সর্বভুক প্রকৃতির! ছাইপাশ গিলে ফেলে দেখছি!
-দেব প্রসাদ দেবু
ধুর্মিয়া,
কেম্নে শেষ করবেন হেইডা লেখকের উপ্রে ছাইড়া দেন।
এম্নে আচানক ব্রেক মারলে এক্করে ৫৭ ধারা দেখায়া দিমু
পাঠক বইলা কি আমাগো অনুভূতি নাই?
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
ধমক দেন ক্যা ভাই? ভয় খাইছি!
অ আপনেরও অনুভূতি আছে! আমিতো ভাবছি খালি হেগো জন্যই ঐ বস্তুটা বরাদ্দ হইছে উপর থেইক্যা!
ভাই ব্যক্তি সন্ত্রাসী তাও ভালো, রাষ্ট্রীয় ৫৭ ধারা নামক সন্ত্রাসীরে বড্ড ডর করে!
-দেব প্রসাদ দেবু
ডরাইলেই ডর!!
____________________________
শেষ অংশটা এর সাথে থাকলেই ভালো লাগত। খুব একটা লম্বা তো হয়ে যায়নি। পরে সুর ছুটে যায়।
এই লেখাটা পরের পাতায় চলে গেলেই লেখা দিয়ে দিন।
শুভেচ্ছা
অনেক ধব্যবাদ মেঘলা মানুষ। আপনার পরামর্শ মনে থাকবে ভবিষতে।
এবারকার গল্পের শেষ অংশ মডারেটরদের অনুমোদন ক্রমে খুব তাড়াতাড়িই চলে আসবে আশা করছি।
-দেব প্রসাদ দেবু
নতুন মন্তব্য করুন