(অনেক জায়গায় অনেক সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিত মানুষের সাথে কথা বলতে গিয়ে অনুধাবন করেছি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কতটুকু সঠিক শিক্ষায় আমাদের শিক্ষিত করছে আর কতটুকু বেঁচে থাকার প্রয়োজনে পাস করা শিক্ষিত করেছে। অার শিক্ষিতই বা কাকে বলে, এটি নিয়েও আমাদের অনেকের মাঝে ভ্রান্ত ধারণা বিদ্যমান রয়েছে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পাশ দিলেই আমরা তাকে শিক্ষিত বলি। আসলে কি তাই? আমরা নানান কথায় বলি সমাজ-রাষ্ট্রের সকল জনগণ শিক্ষিত হলেই আমরা অসম্প্রদায়িক একটা সমাজ পাবো, সঠিক গনতন্ত্র পাবো, সৎ শাসক আর শাসন পাবো। কিন্তু যে শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে আমরা বেড়ে ওঠছি, তার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠে কাঙ্ক্ষিত সমাজ-রাষ্ট্র পাওয়া কি সম্ভব? বদ্ধ সামাজিক ব্যবস্থা আর ভুলে ভরা শিক্ষা নীতিতে যদি সব মানুষ স্কুল-কলেজ পাশ ও দেয় তাহলেও বাংলাদেশ বদলে যাবে না। আমাদের শিক্ষা, সমাজ আর জীবনের নানান সীমাবদ্ধতা নিয়ে ড. আহমদ শরীফ বহুকাল আগে একটি প্রবন্ধ লেখেছিলেন ‘শিক্ষার হের ফের’ শিরোনামে। প্রবন্ধটি কে আজকের এই অবস্থায়ও অনেক বেশী প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ মনে করি আমি। সেই প্রবন্ধের উল্লেখযোগ্য অংশকে সাজিয়ে পোষ্ট আকারে দিলাম। সঠিক শিক্ষা ব্যবস্থায় পৌছাতে না পারার ব্যর্থতা এবং সেই ব্যর্থতায় জন্ম নেওয়া বিশ্বাসের কুফল নিয়ে লেখাটি।)
লেখাপড়া করলেই বা জানলেই লোক শিক্ষিত হয় না। কাজেই লেখাপড়া জানা আর শিক্ষিত হওয়া এক কথা নয়। অর্জিত বিদ্যার জ্ঞানের প্রয়োজনীয় অংশ বোধ-বুদ্ধির আয়ত্তে এনে জীবনচর্চার অন্তর্গত করে নিতে না জানলে বা না নিলে মানুষ শিক্ষিত হয় না। এজন্যে আগ্রহ ও আকাঙ্ক্ষা থাকা আবশ্যক। শিক্ষা মানুষের রুচি করে পরিস্রুত, বুদ্ধি করে তীক্ষ্ণ, মন করে পরিচ্ছন্ন, মনন করে মার্জিত ও বিন্যস্ত। লেখাপড়া তাই মন-বুদ্ধি-আত্নার পরিমার্জনা ও বিকাশের উৎকৃষ্ট পন্থা হিসাবে বিবেচিত। কিন্তু আমাদের দেশে শিক্ষা আশানুরূপ ফলপ্রসূ হয়নি। তার কারণ যে বিদ্যা অর্জনের জন্যে আমরা মানসিক ও পরিবেশিক প্রস্তুতি নেই, সেই বিদ্যা, লব্ধ জ্ঞান আর লালিত বিশ্বাস নীলনদের প্রবাহের মতো তিনটে পৃথক ধারায় আমাদের মন ও মননের ক্ষেত্রে জীবনরস সিঞ্চিত করে।
আমাদের দেশে সন্তানদের লোকে স্কুল কলেজে পাঠায় বিদ্যার্জনের জন্যে, জ্ঞান বা শিক্ষা অর্জনের জন্যে নয়। এ বিদ্যা শুধুমাত্র অর্থোপার্জনের জন্যে প্রয়োজন। এর জন্যে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাও দায়ী। আমরা বিজ্ঞানের বই ও দীনিয়াত একই ছাত্রের জন্যে একই সঙ্গে পাঠ্য করি। ফলে ছাত্রটি বিজ্ঞানের বইতে সৃষ্টিতত্ত্ব কিংবা প্রাণিতত্ত্ব পায় একরকম আর দীনিয়াতে পড়ে পায় অন্যরকম। বদ্ধমনের ছাত্র দীনিয়াতকেই জানে জীবনের সত্য বলে আর বিজ্ঞানকে গ্রহণ করে পরীক্ষা পাসের বিদ্যারূপে। এ অসঙ্গতি তার জীবনে কখনো ঘোচেনা। যে ছেলে সমাজবিজ্ঞানে মানুষ, ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্রের উদ্ভব তত্ত্ব পড়ে ও মুখস্থ করে এবং প্রশ্নহীনচিত্তে যান্ত্রিক নৈপুণ্যে পরীক্ষার খাতায় পুনরাবৃত্তি করে পরীক্ষককে চমকে দিয়ে আশি-নব্বই নম্বর পায়, সে হয়তো ব্যক্তি জীবনে দেও-দানু-ভূত-প্রেত প্রভৃতির ভয়ে অস্থির অথবা তাবিজ কবছ মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহ লাভে তৎপর।
আবার যে ছাত্র মুক্তমনের কিন্তু দুর্বলচিত্ত তার ও জ্ঞানে বিশ্বাসে দ্বন্দ্ব কখনো ঘোচে না। তার অবস্থা আরো শোচনীয়। কেননা, তার জীবনে অসঙ্গতি আরো প্রবল ও প্রকট। সে কখনো সন্দেহ-তাড়িত, কখনো বা বিশ্বাস চালিত. সে ঘরেও সুস্থ থাকে না, ঘাটেও পায় না স্বস্তি। এমনি লোকের যৌবন ও বার্ধক্য দ্বৈতসত্তায় হয় বিকৃত, প্রৌঢ়ত্ব থাকে পীড়িত।
যারা ধর্ম ও বিজ্ঞানের যুক্তি ও বিশ্বাসের সমন্বয় চান, তাঁরা চাঁদ-সূ্র্যর অদ্বয়রূপে উপস্থিতিই কামনা করেন। পরস্পর বিপরীত সত্যে অাস্থা স্থাপন, কেবল যে চরিত্রহীনতার পরিচায়ক তা নয়, কোন সত্যকেই গ্রহণ না করার নামান্তর মাত্র। বিশ্বাস হচ্ছে অন্ধ, বলতে গেলে যুক্তির অনুপস্থিতিই বিশ্বাসের জন্মদাতা। যুক্তি দিয়ে তাই বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠিত করা চলে না। বিশ্বাসের ভিত্তিতে যুক্তির অবতারনা ও তেমনি বিড়ম্বনাকে বরণ করা ছাড়া কিছুই নয়।
আমাদের সরকার, শিক্ষক ও অভিভাবক সবাই বৃত্তিমূলক বিদ্যার অনুরাগী ও পক্ষপাতী। তারা জনগণকে ও ছাত্রকে বৃত্তিমূলক বিদ্যার উপযোগ সমন্ধে সচেতন করিয়ে দেয়ার প্রয়াসী। ’পেশাগত লক্ষ্য স্থির করেই পড়’ - এ হচ্ছে তাঁদের স্লোগান। শুনে শুনে ছাত্রছাত্রীরাও লেখাপড়াকে ’পেশা ’শিক্ষা’ বলেই মনে করে। বিদ্যার্জন যেন ভাবী পেশারই ট্রেনিং। ফলে লেখাপড়া করে বিদ্যার্জন করে শিক্ষিত হও, মানুষ হও- এমন কথা আজকালকার ছেলেমেয়েরা শুনতেই পায় না। মানবিক বৃত্তির পরিশীলন, পরিস্রুতি ও বিকাশের জন্যেই বিদ্যার্জন এবং বিদ্যার্জনেই যে বিদ্যাচর্চার শেষ-এর বৈষয়িক গুরুত্ব থাকলেও তা যে ছাত্রছাত্রীদের অমন করে জানিয়ে দিতে নেই, এ যুগে সে কথা কেউ স্বীকারই করেন না। ফলে লেখা পড়া শিখে লোক যন্ত্রীই হচ্ছে, মানুষ হয়ে ওঠার প্রেরণা পাচ্ছে না। তাই সমাজে এখন লেখাপড়া জানা যুবকেরা ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার, উকিল-অধ্যাপক বা সরকারি -সওদাগরী কর্মচারী হয়। সততায়, প্রীতিবানতায়, পরার্থপরতায়, উদারাতায়, মানবিকতায় ও বিচারশীলতায় মানুষ হয় ক্বচিৎ। এর পরিনাম যে সমাজের পক্ষে শুভ হচ্ছে না, তা বোধহয় বলার অপেক্ষা রাখে না। বিদ্যাকে এভাবে বিষয়বৃত্তির অনুগত করে সীমিত লক্ষ্যে নিবদ্ধ রাখা আর মানবমনীষা ও মানবিক বৃত্তিতে জৈবিকতার সংকীর্ণ সীমায় নিয়ন্ত্রিত করা একই কথা। এতে প্রাণ বাঁচে কিন্তু মন নিশ্চিতই মরে এবং প্রাণ থাকলে প্রাণী হয়, কিন্তু মন না থাকলে মানুষ হয় না।
মাসুদ সজীব
মন্তব্য
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সুন্দর লেখা। তবে বানান নিয়ে আরেকটু যত্নবান হতে হবে।
পড়ার জন্যে ধন্যবাদ, অবশ্যই যত্নবান হবো। বাংলা নতুন বছরের শুভেচ্ছা।
মাসুদ সজীব
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
ধন্যবাদ ও নতুন বাংলা বছরের শুভেচ্ছা দাদা
মাসুদ সজীব
মাসুদ ভাই, খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অনেক গুলো দামী দামী কথা বলেছেন। কিন্তু প্রসঙ্গটা এতটাই ব্যপক যে আরো অনেক কিছু প্রত্যাশা করছিলাম। লেখাটা প্রসঙ্গ অনুযায়ী সংক্ষিপ্ত হয়ে গেছে। আরেকটু গুছিয়ে আরেকটু বড় পরিসর নিয়ে লিখলে মনে হয় ভালো লাগতো। আর মন্তব্যেও হয়তো আরো সুন্দর একটা আলোচনা আসতো।
____________________________
বিস্তারিত যাই নি, কারণ শিক্ষিত বলতে আমরা যা বুঝি আর প্রকৃত শিক্ষক কি সেটা বুঝাতে চেয়েছি। হুম এটা নিয়ে বিস্তারিত লেখা যেত। কিছুটা অবহেলা ছিলো এটা স্বীকার করি। আর আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্যে বিজ্ঞান পড়ে ও অসংখ্য মানুষ কি করে অবিজ্ঞানে ডুবে থাকে, তার কারন কি, সেগুলো সংক্ষেপে বলার চেষ্টা করেছি। কারণ আমি জানি সচলে সবাই এই বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান রাখে, তাই নতুন করে কিছু না বলে শুধু মূল বিষয় টাতে ফোকাস করতে চেয়েছি। তবে ভবিষ্যতে এমন বিষয় নিয়ে লেখতে গেলে অবশ্যই বিস্তারিত আকারে লেখবো। পড়ার ও মন্তব্যের জন্যে ধন্যবাদ প্রোফেসর সাব
মাসুদ সজীব
লেখায় নতুন কিছু পেলাম না। লেখা আরো একটু স্পেসিফিক ও বিস্তারিত হলে ভালো হয়।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
হাসিব ভাই লেখা টা একটু সংক্ষেপে হয়ে গেছে সেটা বুঝতে পারছি। তবে দুটো বিষয় স্পষ্ট করতে চেয়েছি, একটি হলো শিক্ষিত বলতে কি বুঝি আর দ্বিতীয়টি হলো অন্ধ আস্তিকতার পেছনে শিক্ষা ব্যবস্থার অবদান। ভবিষ্যতে অবশ্যই বিস্তারিত লেখার আশা রাখছি। ধন্যবাদ
মাসুদ সজীব
নতুন মন্তব্য করুন